বুকে_যে_শ্রাবণ_তার #পর্ব_৯

0
200

#বুকে_যে_শ্রাবণ_তার
#পর্ব_৯
#নিশাত_জাহান_নিশি

“ভাঙবে তবু মচকাবেনা! এরা দুজন দুজনকে পছন্দ করে তবুও মুখ খুলে কেউ কাউকে কিছু বলবেনা। কীসের এত বাঁধা তাদের?”

জানালার গ্রীল ধরে আনমনে দাড়িয়ে সামান্তা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আচমকা ক্ষীণ হাসল! উদাসী হয়ে খোঁপায় বেঁধে রাখা চুলগুলো ছেড়ে দিলো। অমনি যেন বাহিরে বইতে থাকা প্রবল হাওয়া এসে তার পরিপাটি চুলগুলোকে নিমিষেই এলোমেলো করে দিয়ে গেল। মুক্তি পাওয়ার আনন্দে তারা নির্বিঘ্নে উড়তে লাগল। মজবুতভাবে খোঁপা বেঁধে রাখার দরুন তার মাথাটাও কেমন যেন ব্যথা করছিল। তাইতো চুল ছাড়তে বাধ্য হলো। এখন বেশ স্বস্তিও খুঁজে পেল। ঘন অন্ধকারে ঢাকা নিকষ কালো রজনী। নিগড় আকাশের পানে নিরশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গ্রীলে মুখ ঠেকালো সামান্তা। মনে মনে দুঃখ যাপন করে বিষণ্ন সুরে বলল,

“জানিনা কেন হুট করে আজ মনে বিষাদ নামল! বুকে এক অদ্ভুত যন্ত্রণার উৎপত্তি হলো। কিছু না পাওয়া, কিছু না বলা অনুভূতিরা এসে আমার গলা চেপে ধরল৷ মাঝে মাঝে নিজেকেই নিজের শত্রু মনে হয়! সত্যিকার অর্থে জীবনে আমি কী চাই তা ভেবে পাইনা। নিজের অনুুভূতিকে ও একসময় বুঝতে পারাটা দায় হয়ে পরে। খুবই দমবন্ধকর এই অনুভূতি। কিছু চাইতে গিয়েও থেমে যাই। বার বার ভাবি আমি যা চাই, তা যদি আমাকে না চায়? এই সংশয় থেকে আমি কবে পরিত্রাণ পাব? কবে নিজের অনুভূতিকে প্রাধান্য দিতে পারব? আমিতো চেয়েছিলাম নিজের অনুভূতিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে আমার চাওয়া পাওয়া থেকে অনেক দূরে সরে যেতে৷ কিন্তু শেষ অবধি তো পারিনি! কোনো না কোনোভাবে আটকে গেলাম। যদিও সবটাই উপর ওয়ালার ইচ্ছা ছিল।”

কিঞ্চিৎ মুহূর্ত থেমে সামান্তা পুনরায় চমকিত ও ভাবুক স্বরে বলল,

“তবে কী উপর ওয়ালা চাইছেন আমি যা চাই তা আমার জীবনে আসুক? কোনো উদ্দেশ্য বা কারণ ছাড়া তো উপর ওয়ালা কারো জীবনে সুখও দেননা, দুঃখও দেননা! যা করেন বান্দার ভালোর জন্যই করেন। তবে কী আমি এই সবটা উপর ওয়ালার ইশারা ধরে নিব? কিন্তু জেনিয়া? সেদিন কী মিশাল ভাইয়া জেনিয়ার জন্যই আমাকে রিজেক্ট করেছিল?”

এতেই যেন ধক করে বুকটা কেঁপে উঠল সামান্তার! মাথায় তীব্র যন্ত্রণা চরে বসল। এই মুহূর্তে তার শরীরের শান্তির প্রয়োজন। আলুথালু পায়ে হেঁটে সামান্তা বিছানায় ধপ করে বসল। কপাল ঘঁষতে ঘঁষতে লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে পরল। জিম খিঁচে চোখ বুজে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করল। এতে যদি ব্যথাটা একটু হলেও সারে।

____________________________

টানা তিন ঘণ্টা ঘুমানোর পর শাহনাজ বেগমের ডাকাডাকিতে সামান্তার ঘুম ভাঙল। চোখ মেলে সে ধরফরিয়ে শোয়া থেকে ওঠে বসল। পাশেই বসে রইলেন শাহনাজ বেগম। হকচকিয়ে ওঠা সামান্তার দিকে তিনি ভ্রু উঁচিয়ে তাকালেন। কপাল কুঁচকে চিন্তিত গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,

“কী রে? এই অবেলায় ঘুমোচ্ছিলি যে?”
“মাথাটা একটু ধরেছিল চাচী।”
“এখন ঠিক আছিস? ঔষধ এনে দিব?”
“না লাগবেনা চাচী। এখন ঠিক আছি।”
“সত্যি তো?”
“হ্যা সত্যি।”
“তাহলে চল খাবার খাবি।”
“কয়টা বাজে এখন?”
“এগারোটা।”
“কী বলো? এতক্ষণ অবধি ঘুমিয়েছি আমি?”
“তা নয়ত কী? জেনিয়া এসেও তোকে কয়েকবার খুঁজে গেছে।”
“মিশাল ভাইয়াও কী চলে এসেছে?”
“এখন এসেছে না-কি? সেই কখন এসেছে। খাবার টেবিলে সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে। চলে আয় তাড়াতাড়ি।”

বেশ তাড়াহুড়ো দেখিয়ে প্রস্থান নিলেন শাহনাজ বেগম। বিছানা ছেড়ে ওঠে দাড়ালো সামান্তা। চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে গেল খাবার ঘরে। পেছনে দাড়িয়ে সবার ভাবভঙ্গি ও অবস্থান পর্যবেক্ষণ করছিল সামান্তা। জেনিয়া ও রুমকির পাশাপাশি মিশালও বেশ হাসি ঠাট্টা করছে তাদের সাথে! তবে কী নিয়ে হাসি ঠাট্টা করছে বুঝা যাচ্ছেনা। তারা কেউই এখনও খাবার শুরু করেনি। মিশালের দু-পাশের চেয়ার দুটো ফাঁকা। রুমকির পাশের চেয়ারটিতে বসেছে জেনিয়া। এর পাশের চেয়ারটিতে শাহনাজ বেগম।

সবার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে সামান্তা খাবার টেবিলে গেল। সামান্তাকে এক নজর দেখামাত্রই জেনিয়া মৃদু হাসল! বেশ প্রফুল্ল সুরে বলল,

“এই সামান্তা আপু যে? কেমন আছো? এই অবেলায় কেউ এত ঘুমায় বলো? কতবার যে তোমার রুম থেকে ফিরে এসেছি।”

পিছু ফিরে তাকালো মিশাল। সামান্তার দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল! এই কী হাল অবস্থা হয়েছে সামান্তার? যে কাউকে আকৃষ্ট করার মত চোখদুটো এমন ফুলে আছে কেন? মুখটাও কেমন ফোলাফোলা দেখাচ্ছে, ফ্যাকাশে লাগছে। ক্ষীণ হেসে সামান্তা প্রত্যত্তুরে জেনিয়াকে বলল,

“মাথাটা একটু ধরেছিল জেনিয়া।তাই ঘুমাচ্ছিলাম। বাই দ্য ওয়ে, তুমি কেমন আছো?”
“আমিতো বিন্দাস আছি আপু! জানো? আজ বাসস্ট্যান্ডে কী হয়েছিল? তুমি শুনলে তো অবাক হয়ে যাবে!”

তৎক্ষণাৎ খিলখিল করে হাসতে থাকা জেনিয়াকে থামিয়ে দিলো মিশাল! গলা ঝেরে বেশ রগচটা সুরে বলল,

“খাবার টেবিলে বসে এত কথা বলতে নেই জেনিয়া। পরেও এই বিষয় নিয়ে কথা বলা যাবে।”

মিশালের কথায় চুপ হয়ে গেল জেনিয়া। শাহনাজ বেগম ও রুমকি মিলে সবার প্লেটে খাবার বেরে দিতে লাগলো। পুনরায় সামান্তার দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকালো মিশাল। তবে সামান্তা মিশালের দিকে ফিরেও তাকালোনা! মাথা নুইয়ে ঠায় দাড়িয়ে রইল৷ সামান্তাকে উদ্দেশ্য করে মিশাল এবার মিহি স্বরে বলল,

“তুই কেন দাড়িয়ে আছিস? বসে যা।”

প্লেটে ভাত মাখতে গিয়ে জেনিয়া হঠাৎ ঘ্যান ঘ্যান করে উঠল! নাক ফুলিয়ে শাহনাজ বেগমকে বলল,

“খালামনি লবণ কোথায়? তুমি জানোনা আমি লবণ ছাড়া ভাত খেতে পারিনা?”
“উফ৷ আনছি তো দাড়া। ভুলে গিয়েছিলাম।”

রান্নাঘরের দিকে রওনা হতেই শাহনাজ বেগমকে থামিয়ে দিলো সামান্তা। শাহনাজ বেগমের হাত ধরে ব্যতিব্যস্ত গলায় বলল,

“তুমি দাড়াও চাচী। আমি নিয়ে আসছি।”

হনহনিয়ে হেঁটে সামান্তা রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। এই পরিস্থিতি থেকে সে বের হয়ে যেতে পারলেই যেন বাঁচে। রান্নাঘরে গিয়ে রুদ্ধশ্বাস ফেলল সামান্তা। এখানে এসেও শান্তি মিললনা তার। হাত ধোঁয়ার বাহানায় মিশাল ঠিক রান্নাঘরে এলো! সামান্তার ঠিক পাশে এক পায়ে ভর দিয়ে ঘাঁড় বাকিয়ে দাড়ালো। শার্টের কলারটি কিঞ্চিৎ পেছনের দিকে এলিয়ে ক্রুর হেসে বলল,

“এজন্যই বলি সারাক্ষণ মুখে খৈ ফুটতে থাকা ঝগড়ুটে বালিকাটি হঠাৎ কেন এত নীরব পাথর হয়ে গেল!”

চোয়াল খিঁচে নিলো সামান্তা। ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। তবুও ফিরে তাকালোনা মিশালের দিকে! মিশালের উপস্থিতিও এই মুহূর্তে তার বিষের জ্বালার মত মনে হচ্ছিল। দু’দণ্ড নিরিবিলি যে কোথাও দাড়াবে তারও জোঁ নেই! মাথা নুইয়ে সামান্তা খরতর গলায় মিশালকে বলল,

“কী বলতে চাইছ বুঝিয়ে বলো?”
“ইশ, বেচারি! উপর থেকে খুব শক্ত হলেও ভেতর থেকে ঠিক ততটাই নরম। ভেতর থেকে যেহেতু নিজেকে শক্ত করতে পারবিনা তাহলে উপরে উপরে এত কঠোর হওয়ার অভিনয় করিস বল?”
“মাথা একদম গরম করবেনা মিশাল ভাইয়া। যা বলার বুঝিয়ে বলো?”
“স্বপ্নীলকে খুব মনে পরছে তাইনা? তার বিরহে বুঝি কেঁদে কেটে বুক ভাসিয়েছিস? চোখ-মুখ ফুলিয়ে রেখেছিস? মানুষের এমন ভালোবাসা দেখতেও ভালো লাগে! কই পাস রে এত ফরমালিনমুক্ত ভালোবাসা? সারাদিন তো খাস শুধু ফরমালিনযুক্ত খাবার।”
“কিছু না জেনে বুঝে উল্টো পাল্টা কথা বলবেনা মিশাল ভাইয়া। তুমি জানো এসব আমার পছন্দ নয়, এরপরেও কেন এত ঘাটাচ্ছ আমায়?”
“তোকে জানি এবং বুঝি বলেই তো সত্যিটা বললাম!”

শার্টের কলারটি ঝেড়ে সামান্তাকে ক্ষেপানোর উদ্দেশ্যে মিশাল বেশ রসালো স্বরে বলল,

“বাই দ্য ওয়ে, এত কান্নাকাটি করার কিছু নেই। আমরা খুব শীঘ্রই তোকে একটা বেটে, নাক বোঁচা, টাক মাথা ও ভুড়িওয়ালা বুড়ো লোক দেখে বিয়ে দিয়ে দিব! তবে যদি তোর দুঃখ কমে।”

হাতের কাছে একটা খুন্তি পাওয়া মাত্রই সামান্তা খুন্তিটি হাতে নিয়ে পিছু ঘুরল! রাগে টইটম্বুর সে। তেড়ে এলো মিশালের দিকে। খুন্তিটি দিয়ে মিশালকে হিট করার প্রস্তুতি নিয়ে সামান্তা রাগে গিজগিজ করে বলল,

“এখান থেকে যাও বলছি মিশাল ভাই। না হয় এক্ষুণি কিন্তু আমি তোমাকে আহত করে ফেলব।”

কদাচিৎ হেসে মিশাল হুট করে সামান্তার হাত থেকে খুন্তিটি কেড়ে নিলো! এক কদম হেঁটে এসে সামান্তার মুখোমুখি দাড়ালো। রক্তিম ও একরোখা দৃষ্টি সামান্তার। অনিমেষ দৃষ্টিতে সামান্তার তীক্ষ্ণ দু-চোখে তাকালো মিশাল। সামান্তার মুখের কাছে মুখ এনে মন্থর গলায় বলল,

“আমার সাথে পারবি তুই ফাইট করে? আমার একটা চড়ের আঘাতই তো তুই সামলাতে পারবিনা। কাঁদতে কাঁদতে নিজের বাড়ি ফিরবি।”
“মিশাল ভাই প্লিজ সরে যাও সামনে থেকে। সিরিয়াসলি তোমাকে আমার সহ্য হচ্ছেনা। গাঁয়ে হাত ওঠে যাবে কিন্তু!”
“ওকে, সরে যাচ্ছি। তবে একটা শর্তে!”
“তোমার কোনো শর্ত ফর্ত শুনতে আমি রাজি নই! তোমাকে সরানোর টেকনিক আমার জানা আছে।”

গাঁয়ের সমস্ত শক্তি কাজে লাগিয়ে সামান্তা চেষ্টা করল মিশালকে তার থেকে দূরে সরানোর! তবে প্রতিবারই সে ব্যর্থ হলো। জায়গা থেকে এক চুলও নড়াতে পারছিলনা মিশালকে! পূর্বের তুলনায় আরও অধিক রেগে গেল সামান্তা। মিশালের শক্তির সাথে পেরে উঠছিলনা। ঘাম ছুটে গেল তার। নিঃশব্দে হাসতে ব্যস্ত মিশাল। বুকের উপর হাত দুটো গুটিয়ে শক্ত হয়ে জায়গায় দাড়িয়ে রইল। উস্কানিমূলক গলায় সামান্তাকে বলল,

“হেই স্টপ সামান্তা। তুই পারবিনা। আমাকে টলাতে হলে তোর কমচে কম আরও দশ কেজি ওজন বাড়াতে হবে! সাথে শক্তিও। তোর হাতের ছোঁয়ায় আমার সুরসুরি হচ্ছে। বুকের ভেতরে থাকা হৃদপিণ্ডে কোনো একটা অঘটন ঘটে যাচ্ছে! টের পাচ্ছিস না তুই?”

#চলবে…?

[আসসালামু আলাইকুম। পাঠকদের কাছে আমার একটি অভিযোগ। অনেক পাঠিক পাঠিকারাই আছেন গল্প পড়েন অথচ চার পাঁচ কমেন্ট খরচ করে একটা লাইক, কমেন্ট করেননা। অথচ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করে মাথায় অনেক মানসিক চাপ আমাদের একটি পর্ব সাজাতে হয়। আপনাদের অনুপ্রেরণার কারণে বিশেষ করে আমি উৎসাহ হারিয়ে ফেলি। লিখার মনমানসিকতা তৈরি হয়ে ওঠেনা। এটা করবেননা প্লিজ। গল্প পড়ার পর কষ্ট করে লাইক, কমেন্ট করবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here