তুমি_অপরূপা (১২)

0
279

#তুমি_অপরূপা (১২)
রূপার সাথে মায়ের আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। রূপাকে দেখলেই সালমা খেঁকিয়ে উঠে। এরমধ্যে দুইবার সালমা রূপার বই খাতা পুড়িয়ে ফেলেছে,রূপাকে ঘরে বন্দী করে রেখেছে যাতে রূপা স্কুলে যেতে না পারে।
সিরাজ হায়দার মেয়ের পক্ষে ছিলেন বলে রূপা এখনো পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে আর কতো দিন!

দিন দিন সালমার অবস্থার অবনতি দেখে সিরাজ হায়দার সিদ্ধান্ত নিলেন মেয়েকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিবেন। এই মেয়েকে তিনি কিছুতেই বন্দী পাখির মতো খাঁচায় পুরে রাখবেন না।তার রূপা তার জীবনের শেষ বাজি,এই বাজিতে যদি হেরে যান তবে বুঝে নিবেন বাবা হিসেবে তিনি ব্যর্থ, আর তাহলে এই জীবনের কোনো দাম থাকবে না তার কাছে।

অনামিকা যাবার পর থেকে সালমার সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। খাওয়া দাওয়া, ঘুম, গোসল কোনো কিছুই ঠিক নেই।রান্না ও করে না এখন আর।আপন মনে কথা বলেন আর রূপাকে সারাদিন গালাগালি করা ছাড়া তার করার মতো কিছু নেই।

সকালে উঠে রূপাকেই রান্না চাপাতে হয়।মায়ের শাপ শাপান্ত শুনতে শুনতে রূপা ঘরের কাজ সামলে নিয়ে স্কুলের জন্য তৈরি হয় যদি মুহূর্তে ঠিক সেই মুহুর্তে সালমা ঝাঁপিয়ে পড়ে রূপার উপর।
ক্রমে রূপার এসএসসি পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে আসতে লাগলো আর রূপার ভয় বাড়তে লাগলো। পরীক্ষার দিন সকালে সালমা দা** নিয়ে বারান্দায় এসে বসলো। দুই চোখ তার টকটকে লাল হয়ে আছে। রূপা সকালেই তৈরি হয়ে নিলো সিরাজ হায়দার গম্ভীর কণ্ঠে সালমাকে বললেন,”আইজ আমার মাইয়া পরীক্ষা দিবার যাইবো,আইজকের দিনে আমি কোনো ঝামেলা দেখতে চাই না সালমা।আইজ যদি তুমি বেতাল করো তবে খুব খারাপ হইবো। ”

সালমা কি বুঝলো কে জানে!
তবে সিরাজ হায়দারের কথা শুনে সালমা দা** ফেলে দিয়ে ঘরে চলে গেলো। মা’কে এতো সহজে শান্ত করা যাবে রূপা বুঝে নি।
দুই চোখ ভরা অশ্রু নিয়ে রূপা পরীক্ষার হলে গেলো মিতা আর বাবার সাথে। রিকশায় বসে সিরাজ হায়দার মেয়েকে বললেন, “অপরূপা মা,আমি সিদ্ধান্ত নিছি তোর পরীক্ষা শেষ হওনের পর তোরে আমি ঢাকা পাঠাইয়া দিমু।তুই আমার শেষ ভরসা।হয় তুই আমার মুখ উজ্জ্বল করবি,আমার বাঁইচা থাকনের শক্তি হবি আর নয়তো তোর বড় দুই বোইনের পথে হাঁইটা আমারে মৃত্যু পথযাত্রী বানাবি।”

রূপা চমকে উঠে বললো, ” এসব কথা কেনো বলেন আব্বা?
আমারে ভরসা করেন আব্বা,আমি আপনার ভরসা কিছুতেই বৃথা যাইতে দিমু না।আমারে আপনি অবিশ্বাস কইরেন না আব্বা।”

সিরাজ হায়দারের অশ্রু সজল চোখের দিকে তাকিয়ে রূপা সিদ্ধান্ত নিলো পথে যতোই বাঁধা আসুক কিছুতেই সে থামবে না।দুই বোনের করা ভুলের পথে কিছুতেই হাটবে না।

রূপাকে হলে পৌঁছে দিয়ে সিরাজ হায়দার নিজের দোকানে চলে গেলেন।দুপুরে মেয়ের পরীক্ষা যখন শেষ হবে তার আগ মুহূর্তে আবার চলে গেলেন মেয়েকে নিয়ে আসতে।
উচ্ছ্বসিত মনে রূপা বের হলো। পরীক্ষা ভীষণ ভালো হয়েছে তার। বাবার সাথে বাড়ি ফিরে সিরাজ হায়দার আর রূপা দুজনেই চমকে গেলো।
সালমা ঘরের বেড়া দেওয়া সব টিন কে**টে ফেলেছে দা*** দিয়ে কু**পিয়ে।

উদভ্রান্তের মতো বারান্দায় বসে আছে সালমা। রূপা ভীষণ ভয় পেলো। সিরাজ হায়দারের রাগ হতে গিয়ে ও হলো না। মনে পড়ে গেলো এই মানুষটাকে একান্ত নিজের করে নেওয়ার জন্য কতো কষ্ট, কতো আঘাত হজম করেছেন। হৃদয়ের পুরোটা জুড়ে যার বসবাস তার উপর কেনো রাগ করবেন!
রাজকন্যাকে এনে মাটির ঘরে রেখেছেন, ধনীর দুলালিকে দুই তিন মাসে একটা শাড়ি কিনে দেওয়ার ক্ষমতা তার ছিলো না অথচ সে সব সহ্য করে হাসিমুখে মেনে নিয়েছে। আজ মানসিক আঘাতে সে যখন বিপর্যস্ত তখন তার ভুলবাল কাজের জন্য তার উপর কিভাবে রাগ করবেন তিনি!

সালমাকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেলেন সিরাজ হায়দার। পাশের ঘরের বারান্দায় বসে থাকা সুরাইয়া বেগম আর সুরভির হাসি মুখ মলিন হয়ে গেলো। ভেবেছিলো বাড়িতে এসে এরকম অবস্থা দেখলে সিরাজ হায়দার রেগে সালমাকে ইচ্ছেমতো পে*টাবেন।কিন্তু কই!
কিছুই তো হলো না।

————–

অন্তরার সাথে রানার সাথে খুব একটা ভাব হয় নি এখনো। তবে অন্তরা ভীষণ চেষ্টা করে রানার সাথে ভাব জমাতে।দিন দিন ছেলেটার উপর অন্তরার মায়া জন্মে গেছে।
জুয়েল অফিসে গেলে অন্তরা টুকটাক এটা সেটা বানিয়ে রানাকে খাওয়ায়।রানা অন্তরাকে ডাকে অন্তর বলে। এত্বি অন্তরা ভীষণ খুশি।
তবে মাঝেমাঝে অন্তরা রানাকে কোলে নিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, “মা বল না একবার আমায়।আমি ও তো মা তোর।মা বল,মা বল।”

রানা খিলখিল করে হাসে অন্তরার কথা শুনে। রানা এবং অন্তরা দুজনের মধ্যে সম্পর্ক ভীষণ স্বাভাবিক তবে স্বাভাবিক নয় জুয়েলের সাথে অন্তরার সম্পর্ক। কিছুতেই অন্তরা এখনো মেনে নিতে পারছে না জুয়েল তার সাথে মিথ্যে বলেছে।

————–

ঝড়ের আগে প্রকৃতি যেমন শান্ত হয়ে যায় তেমনি শান্ত হয়ে গেলো হাসানুজ্জামান এবং রোজিনা। স্বামী স্ত্রী দুজন মিলে ভেবে দেখলো রাগ দেখিয়ে ছেলের সাথে কাজ হবে না উল্টো ছেলের কাছে দুজন খারাপ হবে।তার চেয়ে বরং মধুর ব্যবহার করে ছেলেকে আগে সৌদি পাঠাতে হবে।একবার ছেলেকে বাড়ির বাহির করতে পারলে বাকিটা আর সমস্যা নেই।অনামিকাকে বাড়ি থেকে বের করা তখন দুই মিনিটের ব্যাপার।

হঠাৎ করেই শ্বশুর শাশুড়ির ব্যবহার এরকম বদলে যাওয়ায় অনামিকা প্রথমে অবাক হলো। শাহেদ কিংবা অনামিকা কেউই বুঝতে পারলো না এর পিছনে লুকিয়ে থাকা উদ্দেশ্য।

শাহেদ আড়তে যাবার সময় মা’কে বললো, “অনামিকারে আমি লইয়া যাইতাছি মা।ওর কলেজে একটু কাজ আছে।কয়দিন পর ওর পরীক্ষা শুরু হইবো। ”

রোজিনা হাসিমুখে ছেলে আর বউকে বিদায় দিয়ে হাসানুজ্জামানের কাছে এলেন।হাসানুজ্জামান তখন সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে।
রোজিনা বিরক্ত হয়ে বললো, “আপনে বিরি খাইতাছেন,ওই দিকে আপনের পোলায় তো মহারানী ভিক্টোরিয়ারে লইয়া গেছে কলেজে।বউয়েরে পড়ালেখা করাইবো আপনার পোলায়।”

হাসানুজ্জামান সিগারেট শেষ করে বললেন,”আর কয়টা দিন।একটু সইয্য কইরা থাক।জানো না,সবুরের ফল মিঠা হয়!”

কলেজে কাজ শেষ করে অনামিকা কে শাহেদ নিজের আড়তে নিয়ে গেলো। তারপর দুপুরে মালিকের থেকে ছুটি নিয়ে দুজনে রিকশায় করে একটু ঘুরতে বের হলো। রিকশায় বসে শাহেদ অনামিকাকে শক্ত করে ধরে রাখলো। পরম নির্ভরতায় অনামিকা শাহেদের কাঁধে মাথা রাখলো।

দুপুরে খেয়ে শাহেদ অনামিকার জন্য জামা কিনলো,মায়ের জন্য শাড়ি,বাবার জন্য লুঙ্গি কিনে নিলো।

ভেতরে প্রচন্ড ক্ষোভ থাকার পরেও রোজিনা হাসিমুখে ছেলের থেকে এগুলো নিলেন।
বাবা মা’কে এরকম স্বাভাবিক ব্যবহার করতে দেখে শাহেদ নিশ্চিন্ত হলো।

সপ্তাহ খানেক পর খাবার খেতে বসে হাসানুজ্জামান আবারও কথা তুললেন। তবে এবার আর আগের মতো রাগারাগি করার মতো বোকামি করলেন না।
খেতে খেতে শান্তভাবে বললেন,”এই আড়তের চাকরি দিয়া কি আমগো পোষাইব শাহেদ?
আমি এখন আগের মতো নাই,দিন দিন বয়স হইতাছে।কাম কাজ ও করবার পারি না আগের মতো। তোর যদি একটা লাইন হইতো তাইলে আমি সব ছাইড়া দিয়ে একটু বিশ্রাম নিতাম।
আল্লাহ নাতি নাতনি দিলে তাগোরে লইয়া খেলাধুলা করতাম।”

লজ্জায় অনামিকার গাল লাল হয়ে গেলো এই কথা শুনে।

শাহেদ খেতে খেতে বললো, “আমি চেষ্টা করতাছি আব্বা,ভালো একটা চাকরি আমি ও খুঁজতাছি।কিন্তু কইলেই তো চাকরি পাওন যায় না।সময় লাগবো। ”

রোজিনা হতাশার ভঙ্গিতে বললেন, “আমাগো জীবনডা এরকম দুঃখেই কাটবো।আশে পাশের সবাই পোলাগোরে বিদ্যাশ দিয়া বছরের মাথায় পাকাঘর তুলছে।আমি মনে হয় মরনের আগে নিজেগো পাকা ঘরে একটা রাইত ঘুমাইতে পারমু না।সেই ভাইগ্য আমার হইবো না।
জীবন কাটাইলাম ভাঙ্গা ঘরে, বেড়ার ফাঁক দিয়ে চান্দের আলো দেখতে দেখতে জীবন যাইবো। ”

শাহেদ কিছু বললো না। অনামিকার খুব খারাপ লাগলো শাশুড়ীর আক্ষেপ শুনে। সিদ্ধান্ত নিলো যেভাবেই হোক,শাহেদকে বিদেশে যাওয়ার জন্য রাজি করাবে সে।

চলবে…..

রাজিয়া রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here