তুমি_অপরূপা (২৮)

0
279

#তুমি_অপরূপা (২৮)
বাসের ঝাঁকুনি, চারদিকের কোলাহল,মানুষের কথাবার্তা কোনো কিছুই রূপাকে স্পর্শ করতে পারছে না।সে নিজের ধ্যানে মগ্ন হয়ে আছে।বুকের ভেতর অজানা ব্যথারা আঘাত হানছে বারবার।
নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে রূপার।
কেনো এতো কষ্ট পাচ্ছে বুঝতে পারছে না।

ফোন বাজছে,বের করে দেখে রত্না কল দিচ্ছে।রূপা কল কেটে দিয়ে টেক্সট দিলো,”আমি বাসে,ঢাকায় আসতেছি।”

কোনো দোষ না করে দিনশেষে সে নিজেই অপরাধী হয়ে গেলো। যেই উৎসাহ, উত্তেজনা নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলো,ফিরে এসেছে ঠিক দ্বিগুণ কষ্ট নিয়ে।
রূপার দমবন্ধ হয়ে আসছে।এতো ব্যথা,এতো যন্ত্রণা, এতো আঘাত কিভাবে সইবে সে?

বাস কতক্ষণ ধরে চলছে,এখন কয়টা বাজে কিছু জানে না রূপা।ঢাকায় পৌঁছাতে আর কতক্ষণ লাগবে তাও জানে না।

বাসের কন্ডাকটর এসে বললো, “আপা,শাহবাগ তো আইসা গেছি,নামবেন না আপনে?”

রূপার হুঁশ এলো ততক্ষণে। সীট থেকে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি ও পাচ্ছে না সে।অনেক কষ্টে সামনের সীট ধরে উঠলো। উঠতেই মাথা কেমন চক্কর দিতে লাগলো। রূপার তখন মনে পড়লো গতকাল সকালের পর থেকে এখন পর্যন্ত না খেয়ে আছে সে।এজন্য শরীর দুর্বল হয়ে গেছে আরো বেশি।
অনেক কষ্ট হলো রূপার বাস থেকে নামতে।বাস থেকে নামতেই রূপার মাথা ঘুরতে লাগলো। পা ফেলার শক্তি নেই শরীরে।
সবকিছু যেনো গুলিয়ে গেছে। কোথায় বাসা,কোথায় রিকশা,কিভাবে যাবে সব মাথা থেকে বের হয়ে গেছে। মাথায় শুধু ঘুরছে মা আমায় ভালোবাসে না কেনো,কেনো আমাকে চিনতে পারে না!

শূন্য দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাতে তাকাতে দেখতে পেলো ফর্সা,গোলগাল ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে। ছেলেটা কে?
কেমন চেনা চেনা লাগছে!
রূপার মাথা কাজ করছে না। সারা পৃথিবী দুলছে যেনো!

সমুদ্র এগিয়ে এলো।রূপাকে তার স্বাভাবিক লাগছে না কিছুতেই।গতকাল যেই সুস্থ স্বাভাবিক মেয়েটাকে দেখে এসেছে আজকে তার এ কি হাল!
চোখ মুখ বসে গেছে।এক রাতেই যেনো অনেক শুকিয়ে গেছে। মাথার সব চুল এলোমেলো হয়ে আছে।কপালে এসে অবহেলিতের মতো লেপ্টে আছে তারা।

সমুদ্রের কোমল মন আরো দ্রবীভূত হলো।হঠাৎ করে মনে হলো, এই মেয়েটাকে ছাড়া তার কিছুতেই চলবে না।
না মানে না,কিছুতেই না।অসম্ভব!
এই মেয়েটাকে গুছিয়ে রাখতে হলে তাকে এই মেয়েটার হতে হবে।এই মেয়েটা বড্ড এলোমেলো। সমুদ্রের চোখের কোণে জল এলো। রূপক! ঠিক এরকম এলোমেলো তো রূপক ও থাকতো।

সাহস করে রূপার হাত ধরে বললো, “কি হয়েছে তোমার? এরকম উদভ্রান্তের মতো লাগছে কেনো?”

রূপা কি বলবে?রূপা কি বলবে তার মা তাকে ভালোবাসে না,একটুও ভালোবাসে না তার মা তাকে।
না এই কথা বলা যাবে না।
অনেক কষ্টে নিজেকে স্থির করে রূপা বললো, “আমার কিছু হয় নি, হাত ছাড়েন।”

সমুদ্র হাত ছেড়ে দিতেই রূপা সোজা হাটতে লাগলো। রিকশা খুঁজে নিয়ে রিকশায় উঠতে যেতেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো রূপার।রিকসাওয়ালা মামা শক্ত করে হাত ধরে ফেললো রূপার।

সমুদ্র দ্রুত এগিয়ে গিয়ে রিকশায় উঠে রূপার হাত ধরে রূপাকে রিকশায় তুললো। তারপর রূপার সাথে বসে যেতে লাগলো। রূপা বুঝতে পারছে কাজটা ঠিক হচ্ছে না। সমুদ্রের সাথে যাওয়া উচিৎ হচ্ছে না কিন্তু শরীর এতোটাই ভেঙ্গে পড়ছে যে রূপার পক্ষে কথা বলাও সম্ভব না।

রিকশা চলে গেলো রূপকের সামনে দিয়ে। এক বুক জ্বালা নিয়ে রূপক তাকিয়ে রইলো। আস্তে আস্তে রিকশা রূপকের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলো।
বাইকের সাথে হেলান দিয়ে, দুই হাত বুকে ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে রূপক সবটাই দেখলো। একবার ইচ্ছে করছিলো এগিয়ে যেতে রূপার কাছে।সমুদ্রের আগে সে-ই দেখেছে রূপাকে বাস থেকে এলোমেলোভাবে নামতে।
রূপক যেতো রূপার কাছে,তার আগেই দেখলো রূপা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। এরপর আর রূপার কাছে যাওয়ার মানে হয় না।
আচ্ছা রূপা কি কখনো জানবে রূপক যে সেই সাতসকালে এসে এখানে দাঁড়িয়েছে রূপার অপেক্ষায়। না রূপক জানতো না রূপা আজকেই আসবে।তবুও এসে দাঁড়িয়ে ছিলো। আজ না আসুক কাল আসবে,কাল না এলে পরশু,নয়তো দুই দিন বা তিন দিন পর অথবা এক সপ্তাহ পর ।রূপক প্রতিদিন এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে ভেবে ঠিক করেছিলো। রূপক দাঁড়িয়েই ছিলো তখনই রত্না কল দিয়ে বললো, “দাদা,রূপা আসতেছে ঢাকায়।”

মনে মনে হেসে রূপক, “রূপা,আজ থেকে যদি ১ মাস পরেও তুমি আসতে আমাকে এই জায়গায় ঠিক এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেতে।”

সমুদ্র বসে বসে দোয়া করতে লাগলো রিকশার যাতে চেইন পড়ে যায় অথবা সামনে রাস্তাটা আজ বন্ধ হয়ে যায়।
রাস্তায় আজ কেউ কাঁটাতার লাগিয়ে দিক।এই পথ কখনো শেষ না হোক,অনন্তকাল ধরে এই রিকশা চলুক।
কিন্তু তা আর হয় না।
রূপকদের বাসার সামনে এসে রিকশা দাঁড়ালো। রূপা রিকশা থেকে নেমে রিকশা ভাড়া দিতে গেলো। সমুদ্র রূপার হাত ধরে বললো, “আমি ভাড়া দিয়েছি।তুমি যাও।”

অন্য সময় হলে হয়তো সমুদ্রের ভাগ্য এতো প্রসন্ন হতো না। রূপার সাথে রিকশায় আসার ও স্বপ্ন পূর্ণ হতো না। কিন্তু আজ রূপা ঠিক নেই সমুদ্র বুঝতে পারলো।

কি এক ভালো লাগা,আবেশ সমুদ্রের মন প্রাণ জুড়ে আছে।রূপার সাথে এক রিকশায় করে এসেছে সে!
রূপার একটু কাছাকাছি সে আসতে পেরেছে!

ফোন বের করে অচেনা নাম্বারটিতে টেক্সট দিলো সমুদ্র।
“আপনি কে আমি জানি না,ধন্যবাদ আমার এতো বড় উপকার করার জন্য । আপনি না টেক্সট দিলে আমি সেদিন ও জানতে পারতাম না রূপা বাড়ি যাচ্ছে আর আজও জানতে পারতাম না রূপা আসছে।”

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়েছে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাহি রূপাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সমুদ্রের সাথে এক রিকশায় করে এসেছে দেখে মাহির কিছুটা ভালো ও লাগছে।এটাই তো চায় সে।রূপকের থেকে দূরে সরে যাক এই মেয়েটা।
রত্নার থেকে জানতে পেরেছে আজ রূপা আসবে,সেই থেকে মাহি অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখানে।

রূপা রুমে এসে কোনো দিকে না তাকিয়ে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণের মধ্যে থরথর করে কাঁপতে লাগলো রূপা।

নিপা রপার কপালে হাত দিয়ে দেখে রূপার প্রচন্ড জ্বর। রত্না পান্নার কাছে গিয়ে কথাটা বলতেই দুজনে ছুটে এলো। রূপার কোনো হুঁশ নেই।দুই বোন দুই পাশ থেকে ধরে রূপাকে নিজেদের বাসায় নিয়ে গেলো। রূপক ততক্ষণে মোড়ের ফার্মাসি থেকে ডাক্তার ডাকতে ছুটে গেছে।
ডাক্তার এসে জ্বর মাপলো,প্রেশার চেক করে বললো, “ওনার মাথায় জলপট্টি দিন,হাতের তালু,পায়ের তালু মুছে দিন বারবার করে। আর ওনার শরীর দুর্বল, কিছু খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিন।”

রত্না বললো, “দাদা,ভাগ্যিস মা আজকে বাসায় নেই।নয়তো রূপাকে এখানে আনা যেতো না আর ওর সেবা ও কেউ করতো না।”

কঠোর স্বরে রূপক বললো, “মা থাকলেও আমি রূপাকে নিয়ে আসতাম তোদের রুমে ও অসুস্থ হলে।কারো পরোয়া করি না আমি।”

বালতিতে করে পানি এনে রূপক রূপার মাথায় ঢালতে লাগলো। ভেজা কাপড় রত্নার হাতে দিয়ে বললো, “তুই ওর হাত পা মুছে দে।”

পান্না বললো, “তুই দে দাদা।”

রূপক হাসলো। হেসে বললো, “সেই ভাগ্য আমার হবে কি কোনো দিন? রূপা যদি জানে আমি ওর অনুমতি ছাড়া ওকে ছুঁয়েছি ওর অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে, তবে আমাকে ও খুব খারাপ মনে করবে।এমনিতেই তো আমার রেকর্ড খুব একটা ভালো না এলাকায়। সবাই আমাকে গুন্ডা ভাবে।”

রূপক হাসতে লাগলো এই কথা বলে। রত্না ছলছল দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমরা কেউ ওকে বলবো না দাদা।তাহলে তো ও জানবে না।”

রূপক হেসে বললো, “তাহলে তো সেটা তোদের খাঁটি বন্ধুত্ব হলো না।বন্ধুত্ব সবকিছুর উর্ধ্বে। আমি তোর ভাই বলে নিজের বন্ধুর সাথে বেইমানি করবি?আমি নিজের কাছে নিজে আজীবন ছোট হয়ে থাকবো যদি ওর অনুমতি ছাড়া ওকে ছুঁই।তেমনই তোরা ও থাকবি।”

রত্না কেঁদে বললো, “দাদা,রূপা যদি তোর না হয়?এতো ভালোবাসা তোর,কিভাবে থাকবি?”

রূপক বললো, “না পেলে কি ভালোবাসা থাকে না? ভাগ্যে কি আছে সেটা কে জানে!
হতেও তো পারে রূপা আমারই হবে!”

চলবে……..

রাজিয়া রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here