ফিরে_আসা ১৫

0
472

#ফিরে_আসা
১৫
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

কিছুক্ষণ হলো সূর্য ডুবেছে। এখনো অন্ধকারে ছেয়ে যায়নি চারপাশ। অরা একেক কদম এগিয়ে যাচ্ছে, আর একটু একটু করে বেড়ে যাচ্ছে তার হৃদস্পন্দন। বাড়ন্ত হৃদস্পন্দনের শব্দে নিজের কানে এসে পৌঁছাচ্ছে। অরার ডান হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে কথা। বাচ্চাদের এই এক সুবিধা। পৃথিবীতে ভয়ঙ্কর প্রলয় এসে গেলেও তার দুশ্চিন্তা করতে হয় না। অরা কেন দুশ্চিন্তা করছে কে জানে? একটু পর আরশাদ মুখোমুখি হবে নওশীনের। মেজাজ বিগড়ে যাবে আরশাদের। এতে তার এত দুশ্চিন্তার কী আছে কে জানে?
নিজেকে বারবার শান্ত করতে চেয়েও ব্যর্থ হচ্ছে অরা।

নওশীন বাড়ির কলিংবেল চাপলো। অরা মনে মনে প্রার্থনা করছে আরশাদ যেন বাড়ি থেকে না ফেরে। যদিও এখন তার বাড়ি ফিরে আসার কথা। শুটিং শেষ হয়েছে বিকেল পাঁচটায়। তার ওপরে আবার কথার আগমন উপলক্ষে আরশাদেরও থাকবে জলদি ফেরার তাগিদ।

দরজাটা খুলে গেল। ওই তো! দেখা যাচ্ছে আরশাদের মুখটা। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে তার চোখমুখ রক্তশূন্য হয়ে উঠলো। এই মুহূর্তে নির্ঘাত নওশীনকে দেখার আশা করেনি সে।
কঠিন দৃষ্টিতে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে রইল আরশাদ। ভেতরে ভেতরে আগ্নেয়গিরির লাভা সৃষ্টি হচ্ছে। এখন কেবল অগ্নুৎপাতের অপেক্ষা।

আরশাদ কঠিন গলায় বলল, “তুমি এখানে কেন এসেছ?”

নওশীন সঙ্গে সঙ্গে বলল, “কেন আসতে বারণ আছে?”

“হ্যাঁ আছে, আমার বারণ আছে।”

নওশীন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তোমার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে, সেই কথাগুলো সামনাসামনি…”

নওশীনকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আরশাদ বলল, “তোমার সাথে আমার কোনো কথা নেই।”

কী সাংঘাতিক ব্যাপার! দুটো মানুষ এক মুহূর্তের জন্যে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে না? আরশাদ যে কতটা রেগে গেছে অরা ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। এই রাগটাকে সে সবথেকে বেশি ভয় করে।

বাবা-মায়ের ঝগড়া যেকোনো সন্তানের জন্যে যন্ত্রণাদায়ক। শুধু শুধু কথাকে সেই যন্ত্রণা দেওয়ার কোনো মানে হয় না। এদের কথোপকথন ঝগড়ার দিকে এগোনোর আগেই মেয়েটাকে নিয়ে সরে যেতে হবে।

অরা কথার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “সোনা, চলো আমরা ভেতরে যাই।”

কথা বাধ্য মেয়ের মতো ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালো। অরা তাকে কোলে নিয়ে ওই দুজনকে কাটিয়ে ঘরের ভেতরে চলে গেল।

নওশীন লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, “তুমি কথার কাস্টাডির আপিল করছো কেন?”

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “তার কৈফিয়ত তোমাকে দিতে হবে?”

“হ্যাঁ দিতে হবে। কারণ ও আমার মেয়ে। আমার মেয়ের জীবন নিয়ে এত ইম্পর্ট্যান্ট একটা সিন্ধান্ত তুমি নিয়ে নেবে আর আমি চুপ করে থাকবো?”

“সিদ্ধান্ত আমি একাই নিয়েছি? তুমি কী করেছ? আমার মেয়েকে নিয়ে বিদেশে যাওয়ার আগে একবারও আমার ওপিনিয়ন চেয়েছ?”

“আমি এখনো কোথাও যাইনি শা…”

কথাটা শেষ করতে পারলো না নওশীন। ভালোবেসে আরশাদকে ‘শাদ’ নামটা দিয়েছিল সে। অথচ আজ নিজের দেওয়া নামেই তার ডাকতে মানা।

আরশাদ বলল, “সিদ্ধান্ত তো নিয়েছ। নাওনি?”

“আমার মেয়েকে আমি একটা বেটার লাইফ দিতে চাই। ভালো স্কুলে পড়াতে চাই।”

আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “বেটার লাইফের জন্যে কানাডায় যেতে হবে কেন? এ দেশে কেউ কোনোদিন বেটার লাইফ পায়নি? এদেশে কোনো ভালো স্কুল নেই।”

নওশীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ওই বিষয়ে আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছি না।”

আরশাদ সঙ্গে সঙ্গে বলল, “কেন বলবে না? কথা বলতেই তো এসেছ।”

“দেখ, কাস্টাডির আপিল করার চিন্তভাবনা করে তুমি শুধু শুধু সময় নষ্ট করছো। আঠারো বছরের আগ পর্যন্ত একটা মেয়ের কাস্টাডি তার মাই পায়।”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আরশাদ বাঁকা হাসি হেসে বলল, “আর বাবা যদি উপযুক্ত কারণ দেখায়। যে কারণের ভিত্তিতে আগামী সাত জন্মেও মায়ের কাস্টাডি পাওয়া উচিত নয়। তখন? দেখাবো কারণ?”

নওশীন ঢোক গিলে বলল, “তুমি আমাকে এভাবে ভয় দেখাতে পারো না।”

“ভয় তো অলরেডি পেয়ে বসে আছো। সত্যি করে বলো তো কেন পালাচ্ছো কানাডায়? আবার ড্রাগস ধরেছ না-কি?”

নওশীন উঁচু গলায় বলল, “Stop it!”

“I will, যদি না তুমি সত্যিটা বলো।”

“আমি কোথাও পালাচ্ছি না। মায়ের কাছে যাচ্ছি।”

আরশাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “মায়ের কাছে না? তোমার কী ধারণা? আমি ভুলে গেছি কানাডায় কে থাকে?”

নওশীন চুপ করে রইল। এই প্রশ্নের উত্তরটা তার কাছে ঠিকই আছে। তবে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করার মতো ক্ষমতা নেই।

আরশাদ বিরক্ত গলায় বলল, “তুমি কেন যাচ্ছ, কার কাছে যাচ্ছ – I don’t care. আমার মেয়ে তোমার সাথে যাবে না।”

“তোমার কাছে থাকবে তাহলে? তুমি পারবে ওর টেক কেয়ার করতে? ওকে হোমওয়ার্ক করাতে, ওর সাথে খেলতে, ওকে খাইয়ে দিতে, ঘুম পাড়িয়ে দিতে? সেই সময় হবে তোমার?”

“হবে। এই পৃথিবীতে কোনো কিছুই আমার মেয়ে থেকে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট না।”

একদৃষ্টিতে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে কথা। আর কথার দিকে অরা। বাচ্চাদের মন যেমন সরল তেমনি জটিল। আশপাশের সবকিছু নিয়ে তারা মনে মনে কত হাজার গবেষণা যে চালায় তার কোনো হিসাব নেই। কথা একটু বড় হওয়ার পর আজই প্রথম বাবা-মাকে একসঙ্গে দেখলো। এর আগে নির্ঘাত কয়েকবার ফোনে কথা বলতে দেখেছে, কিন্তু সামনা-সামনি আজই প্রথম। এত বড় একটা ঘটনা কি তার ছোট্ট হৃদয়ে কোনপ্রকার ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়েছে? অরা বোঝার চেষ্টা করছে, কিন্তু বুঝতে পারছে না।

কথা কী যেন মনে করে টিভির দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অরার দিকে তাকালো। কৌতুহলী গলায় জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা অরা? বাবা আর মা সবসময় এত রেগেরেগে কথা বলে কেন?”

অরার গা বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। এ প্রশ্নের উত্তর কী হতে পারে? উত্তরটা তো অরা নিজেও জানে না। এ পৃথিবীর সবথেকে কঠিন কাজ জটিল বিষয়কে সহজভাবে বাচ্চাদের সামনে উপস্থাপন করা।

কথা আবারও ভাবুক ভঙ্গিতে বলল, “মা যখন আমার সাথে কথা বলে, তখন সব নাইস নাইস। আবার বাবা যখন আমার সাথে কথা বলে, তখনও সব নাইস নাইস। শুধু মা যখন বাবার সাথে কথা বলে আর বাবা যখন মার সাথে কথা বলে তখনই সব রাগী রাগী।”

অরা কিছুক্ষণ চিন্তা করে হাসিমুখে বলল, “কারণ বাবা আর মা ফ্রেন্ডস না। বাবা তোমার ফ্রেন্ড, তাই তোমার সাথে নাইস। মাও তোমার ফ্রেন্ড। কিন্তু বাবা মায়ের ফ্রেন্ড না আবার মাও বাবার ফ্রেন্ড না।”

উত্তরটা সম্ভবত পছন্দ হলো না কথার। তাই ভ্রু কুঁচক বলল, “ফ্রেন্ড না হলে কি রাগ করে কথা বলতে হয়?”

“না, তা না।”

অরা ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেল। কথার বাবা-মায়ের মধ্যকার সম্পর্ক আর পাঁচটা সাধারণ বাবা-মায়ের মতো নয়। এই বিষয় নিয়ে তার মাঝে কৌতূহল জাগাটাই স্বাভাবিক। বরং এতদিন কেন জাগেনি সেটাই চিন্তার বিষয়। এই বিষয়টা তাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতে হবে। বোঝাতে একটু ভুল করলেই কথার জীবনের একাংশ অস্পষ্ট রয়ে যাবে।

অরা কিছুটা ভেবে বলল, “আচ্ছা, তোমার স্কুলে এমন কেউ আছে যাকে তুমি পছন্দ করো না?”

“স্কুলে নেই, কিন্তু আর্ট ক্লাসে আছে। অবনী। ও সবসময় রংপেন্সিল দিয়ে আমার ছবি নষ্ট করে দেয়।”

“তবুও কি তুমি ওর সাথে নাইসলি কথা বলো?”

“আমি সবার সাথে নাইসলি কথা বলি। কিন্তু ওর সাথে কথা বলতে গেলেই আমার ছবি নষ্ট করে দেওয়ার কথা মনে পড়ে যায়।”

“বাবা-মায়ের ব্যাপারটাও ঐরকম।”

কথা অবাক গলায় বলল, “বাবাও কি মায়ের ছবি নষ্ট করেছিল?”

অরা সহজ গলায় বলল, “কে কার ছবি নষ্ট করেছে বলতে পারবো না। তবে কেউ একজন করেছে। আমাদের সবার মনে অনেকগুলো ছবি থাকে। একেক মানুষের জন্যে একেক রকম ছবি। এই ছবিগুলোর নাম ভালোবাসা।”

“তোমার মনেও আমার জন্য ছবি আছে?”

অরা হাসিমুখে বলল, “আছে তো! এত্ত বড় একটা ছবি আছে আমার কথার জন্যে। কিন্তু সেই ছবিটা যদি তুমিই নষ্ট করে ফেল, তখন কী হবে?”

“তুমি আমার ওপর রাগ করবে।”

“এই তো বুঝে গেছ! বাবা-মায়ের মধ্যে কেউ একজন আরেকজনের ছবিটা এভাবেই নষ্ট করেছিল।”

কথা চুপ করে রইল। তার ছোট্ট মস্তিষ্ক কোনো এক গভীর চিন্তায় ডুব দিয়েছে। সম্ভবত চিন্তাটা ভালোবাসার ছবিকে কেন্দ্র করেই।

অরা হঠাৎ বলে উঠলো, “আচ্ছা সোনা? বাবা আর মায়ের মধ্যে কাকে তুমি সবথেকে বেশি ভালোবাসো?”

কথা সঙ্গে সঙ্গে বলল, “দুজনকেই।”

যেন উত্তরটা আগে থেকেই মস্তিষ্কে গুছিয়ে রেখেছিল। কেউ জিজ্ঞেস করলে যাতে চট করে উত্তরটা দিতে পারে।

“ধরো মা কিছুদিনের জন্যে অনেক দূরে কোথাও চলে গেল। কিছুদিন পর আবার বাসায় ফিরে আসবে। তুমি কি মায়ের সঙ্গে দূরে যেতে চাও, না-কি বাবার সঙ্গে এখানে থাকতে চায়।”

“আমি তো মায়ের সঙ্গেই থাকি অরা। কেন? মা কোথাও গেলে আমাকে নিয়ে যাবে না?”

“না, মানে… এমনি বললাম। তুমি দেখো তো, স্পঞ্জবব কী করছে!”

কথার মনোযোগ আবারও ফিরে গেল টিভির স্ক্রিনে। এই মেয়েরা আর দশটা বাচ্চাদের মতো নয়। জটিল জিনিস বোঝালে সে বোঝে, কিংবা বোঝার চেষ্টা করে। ভগ্ন পরিবারের সন্তানেরা এমনই হয়। তারা বয়সের অনেক আগেই পরিপক্ক হয়ে যায়। যেমনটা অরা হয়েছে। তবে তার পরিবারটাকে ঠিক ভগ্ন পরিবার বলা যায় না।

গাড়ির হর্নের শব্দ ভেসে এলো কানে। নওশীন সম্ভবত চলে যাচ্ছে। আজ বহুদিন পর তাকে এবং আরশাদকে একসঙ্গে দেখলো অরা। নিজেকে তার ভাগ্যবতী মনে করা উচিত। ভক্তরা যেখানে বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে তাদের একসঙ্গে দেখার জন্যে, সেখানে তাদের কাঙ্ক্ষিত দৃশ্যটার দেখা পাচ্ছে অরা। অবশ্য এখানে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করার কিছু নেই। আরশাদ এবং নওশীনকে এখন একসঙ্গে দেখলে বেশিরভাগ দর্শকই হবে মনঃক্ষুন্ন। তাদের চিরচেনা জুটির মাঝে ভালোবাসার লেশমাত্র অবশিষ্ট নেই। যা আছে, তার নাম তিক্ততা।

চোখের সামনে সবকিছু কেমন যেন বদলে গেল। দিনটার কথা আজও স্পষ্টভাবে মনে আছে। অরার ঠান্ডা লেগে গলা ভেঙে গেছে। তবুও আরশাদের জরুরি তলবে সেদিন সন্ধ্যায় ছুটে আসে এ বাড়িতে।

অরার এ অবস্থা দেখে নওশীন ব্যস্ত হয়ে বলেছিল, “তোমাক নিয়ে আর পারি না শাদ! কী দরকার ছিল মেয়েটাকে ডেকে আনার। আহারে! গলা ভেঙে একাকার অবস্থা।”

গলা ভেঙে গেলে না-কি দুধ-হলুদ খেয়ে আরাম পাওয়া যায়। নওশীন পরম যত্নে দুধের সঙ্গে হলুদ মিশিয়ে খেতে দিল অরাকে।

আরশাদ ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলেছিল, “তোমার এসব ঘরোয়া টোটকায় কোনো কাজ হয় না-কি? এত বছরে আমার ওপর ট্রাই করে কোনো ফল পেয়েছ?”

শুধু হয়ে গেল দুজনের ভালোবাসাময় খুনসুটি। যে ভালোবাসার সাক্ষী হওয়ার জন্যে দিনের পর দিন তপস্যা করে যেতে হয়। কাজ শেষে অরা সেদিন ফিরে গেল বাসায়। ওই একটা রাত। এক রাতের মধ্যে এমন কী হলো কে জানে? একটা রাত লন্ডভন্ড করে দিলো দুটো মানুষের জীবনকে।

পরদিন সকালেই আরশাদ অরাকে ফোন করে বিরস কণ্ঠে বলল, “অরা ডিভোর্স লয়ার ঠিক করো, নওশীনের সঙ্গে আমার ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে।”

সেদিনের মত অবাক অরা এ জীবনে হয়নি। অরা কখনো কাউকে ভালোবাসেনি। তবে তার দৃঢ় বিশ্বাস ভালোবাসার কোনো মাঝামাঝি স্তর নেই। একটা মানুষ আজ ভালোবেসে আগামীকাল অল্প ভালোবাসা যায় না। ভালোবাসা ব্যাপারটা মনে থাকলে পুরোপুরিভাবে থাকে। আর একবার উবে গেলে চিরজীবনের মতো যায়।

অনেকটা সময় আজ অরা কাটালো কথার সঙ্গে। দুজনে একসঙ্গে কার্টুন দেখলো, নতুন খেলনা দিয়ে কিছুক্ষণ খেলল, একসঙ্গে রাতের খাবার খেলো। আরশাদের বাবুর্চি আজ তৈরি করেছে কথার পছন্দের লবস্টার রোল। এই লোকটা একেক দিন একেক দেশের খাবার তৈরি করে। প্রতিবারই তার রান্না হয় অসাধারণ।

নওশীন চলে যাওয়ার পর থেকে আরশাদের কোনো খোঁজ নেই। অরা একবার উঁকি দিয়ে দেখেছে, সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় বসে আছে। গভীর চিন্তায় মগ্ন তার সমগ্র অন্তরাত্মা। অরা আর বিরক্ত করতে যায়নি তাকে। কী দরকার শুধু শুধু বিগড়ে যাওয়া মেজাজকে আরেকটু বিগড়ে দেওয়া।

ঘড়ির কাঁটা দশটার ঘরে অবস্থান করছে। ইতোমধ্যেই সীমার ফোন আসা শুরু হয়ে গেছে। এই মেয়েটা অরাকে নিয়ে একটু বেশিই চিন্তা করে। সন্ধ্যা মেলানোর সঙ্গে সঙ্গেই তার চিন্তা – অরা কখন ঘরে ফিরবে। অরা কথার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ফোনটাকে সাইলেন্ট করে রাখলো। এই মুহূর্তে কথা বলা যাবে না, কথা ঘুমিয়ে পড়েছে।

এমন সময় দেখা পাওয়া গেল আরশাদের।
তাকে দরজার কাছে দেখেই অরা উঠে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বলল, “কথা ঘুমিয়ে পড়েছে স্যার।”

অরা ঘরের বাইরে গিয়ে আরশাদের মুখোমুখি দাঁড়ালো। কথার একটা বাজে অভ্যাস আছে। ঘুমের ঘোরে একটু শব্দ কানে গেলেই জেগে ওঠে মেয়েটা।

আরশাদ বলল, “Thank you Aura.”

“It’s my duty sir.”

আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “No it’s not. তোমার দায়িত্ব আমার কাজ সামলানো, আমার মেয়েকে না।”

কথাটার জবাব না দিয়ে অরা বলল, “স্যার আমি তাহলে আসি?”

“না দাঁড়াও! তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।”

আরশাদের জরুরি কথা শোনার উদ্দেশ্যে দুজনে গিয়ে বসলো বসার ঘরে। আরশাদের চোখেমুখে আজ একরাশ চিন্তা খেলে বেড়াচ্ছে। এতটা চিন্তিত তাকে সচরাচর দেখায় না।

চিন্তার রেশ কণ্ঠস্বরে নিয়েই আরশাদ বলল, “আমার কী করা উচিত বলো তো?”

“কোন বিষয়ে স্যার?”

“কথার যাওয়ার বিষয়ে। আমার কি উচিত ওকে এতদিনের জন্যে যেতে দেওয়া? না-কি কথাকে নিজের কাস্টাডিতে নিয়ে রাখা উচিত?”

“সেটা তো আপনিই ভালো বলতে পারবেন স্যার।”

আরশাদ অরার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন তার মতো বোকা মেয়ে এই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। বিরক্ত গলাতেই বলল, “কী আশ্চর্য! তোমার কোনো মতামত থাকতে পারে না? তুমি কথাকে ভালো করে চেনো। ওর সঙ্গে অনেকটা সময় কাটিয়েছ। তুমি হয়তো ধারণা করতে পারবে, ও কী চায়।”

অরা শুকনো ঢোক গিলে বলল, “কথাকে আমি জিজ্ঞেস করেছি স্যার। ওর কাছে মায়ের সঙ্গে থাকাটাই স্বাভাবিক। ও তো ভয় করছে, মায়ের সঙ্গে যেতে পারবে কিনা।”

কিছুটা সময় চুপ করে থেকে আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সমস্যাটা এখানেই। কথা ওর মাকে ছাড়া থাকতে পারে না, আর আমি কথাকে ছাড়া।”

“একটা কথা বলবো স্যার?”

“বলো।”

“বাবা-মায়ের মধ্যকার সম্পর্ক ঠিক না থাকাটা একটা বাচ্চার জন্যে খুব ডিপ্রেসিং হতে পারে। আমি নিজে বিষয়টা ফেস করেছি তো, তাই বুঝতে পারি। আপনারা দুজনেই কথাকে সময় দেন বলে ওর ওপরে অতটা খারাপ প্রভাব পড়েনি।”

“তুমি কী বলতে চাচ্ছো অরা? আমার কথাকে ওর মায়ের সঙ্গে যেতে দেওয়া উচিত?”

“না স্যার। আমি বলতে চাচ্ছি, এমন কিছু করবেন না যাতে ওর ওপরে কোনো খারাপ প্রভাব পড়ে। কথা এখন যে জীবনটা যাপন করছে, তাতেই সে অভ্যস্ত। মায়ের সঙ্গে থাকা, মাঝে মাঝে বাবার কাছে এসে থাকা। আপনি চাইলেই কাস্টাডি আপিল করতে পারেন। আপনি কাস্টাডি পেলে কথার জীবনে অনেক বড় একটা পরিবর্তন আসবে। সেই পরিবর্তন সে ভালোভাবে অ্যাকসেপ্ট নাও করতে পারে।”

অরার বলা প্রতিটা শব্দ মনোযোগে পর্যবেক্ষণ করে আরশাদ শুকনো গলায় বলল, “হুঁ।”

আরশাদ খুব ভালো করেই জানে, অরা মিথ্যা কিছু বলছে না। স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হওয়ার থেকে বেশি যন্ত্রণাদায়ক একটা বাচ্চার কাছে অন্য কিছু হতে পারে না। বাবা সবাইকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর, আরশাদের জীবনও তার স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে ফেলেছিল। ভেঙে সেও পড়েছিল।

চিন্তার জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে আরশাদ বলল, “তুমি এখন যেতে পারো অরা, এমনিতেই অনেক রাত হয়ে গেছে।”

অরা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “জি স্যার।”

“জহিরকে বলে রেখেছি, তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে।”

অরা কৃতজ্ঞ ভঙ্গিতে বলল, “থ্যাংক ইউ স্যার।”

এই রাতে একা একা ফেরা নিয়ে কিছুটা হলেও দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল অরা। রাতের ঢাকা এখনো একটা মেয়ের জন্যে নিরাপদ হয়ে উঠতে পারেনি। দুশ্চিন্তার কালো মেঘগুলো আরশাদের কারণেই কেটে গেল। আসলেই ছেলেটার পাগলামির কোনো অন্ত নেই। গতকালই অরাকে বলছিল, রেজিগনেশন লেটার দিয়ে চাকরি ছেড়ে দিতে। আর আজ সেই একই মানুষ অরার নিরাপদে বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।

(চলবে)

[রাতে ছোটখাটো একটা বোনাস পর্ব পেয়ে যাবেন। ❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here