ফিরে_আসা ১৬ (বোনাস পর্ব

0
454

#ফিরে_আসা
১৬ (বোনাস পর্ব)
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

অতীতে…

নীরবতার একটা আলাদা ভাষা থাকে। কখনো সে নীরবতা বয়ে আনতে পারে সুখময় কোনো অনুভূতি। আবার এই নীরবতা পারে সৃষ্টি করতে এক অস্বস্তিকর আবহাওয়া। এই মুহূর্তের নীরবতাটা কী ধরনের ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আরশাদ বুঝতেও চাচ্ছে না। কোনোকিছু চিন্তা করার পর্যায়ে নেই তার মস্তিষ্ক। শূন্য দৃষ্টিতে মেঝের দিকে আটকে আছে তার চোখদুটো। এই বারান্দাটাকে আজ পৃথিবীর ভয়ংকরতম স্থান বলে মনে হচ্ছে। অথচ এই জায়গাটার সঙ্গে তার কতশত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। রাতের পর রাত এই বারান্দায় বসে নওশীনের সঙ্গে জোছনাবিলাস করেছে সে। তখন কি একবারের জন্যেও ভেবেছিল একদিন ঠিক এই জায়গায় বসে তার গা ছমছম করে উঠবে।

আচমকা নওশীন এসে বসলো পাশে। এই বারান্দায় প্রকান্ড এক দোলনা আছে। আরশাদ সবসময় দোলনার ডান পাশটায় বসে। বাম পাশটা বরাদ্দ নওশীনের জন্যে। সে হিসাবে আজও কোনো ভুল হলো না। এই স্বাভাবিকতাই বিদঘুটে লাগছে আরশাদের কাছে। ইচ্ছা করছে নওশীনের পাশ থেকে উঠে চলে যেতে। তবে ভেতর থেকে কিছু একটা আটকে দিচ্ছে তাকে বারবার। হাত-পা ক্রমেই অবশ হয়ে আসছে। এখন পর্যন্ত আরশাদ চোখ তুলে তাকায়নি নওশীনের দিকে। তার দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে মেঝের দিকে।

অসহনীয় এই নীরবতা ভঙ্গ করে নওশীন কিঞ্চিৎ অভিমান নিয়ে বলল, “কথা বলবে না আমার সাথে?”

আরশাদ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “আমাকে একটু একা থাকতে দাও প্লিজ।”

“কথা না বললে কোনোকিছুর সমাধান হবে না শাদ।”

“আমি কোনো সমাধান চাই না।”

নওশীন কাঁদছে। তার চোখদুটো বেয়ে টপটপ করে বয়ে যাচ্ছে অশ্রুধারা। তবে কান্নায় দুর্বল হয়ে যায়নি। তার ভাবভঙ্গিতে এখনো রয়েছে একই দৃঢ়তা।

নওশীন দৃঢ় ভঙ্গিতে বলল, “জানি আমি একটা ভুল করে ফেলেছি। বাধ্য হয়ে ভুল করেছি। তুমি আমাকে বাধ্য করেছো।”

আরশাদ এবার চোখ তুলে তাকালো তার দিকে। হতভম্ব হয়ে বলল, “আমি বাধ্য করেছি?”

নওশীন চুপ করে রইল। কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা, তার নিজের কাছেই তা অস্পষ্ট।

আরশাদ বলল, “আমি তোমাকে ভালোবেসেছি নওশীন। আর এই তোমার ভালবাসার মর্যাদা?”

“ভালো আমি বাসিনি? বেসেছি, এখনও বাসি, আজীবন বাসবো। তুমি মর্যাদা দিয়েছ আমার ভালোবাসার? আমার থেকেও তুমি তোমার কাজকে বেশি ভালোবাসো।”

“তাই বলে এত বড় একটা শাস্তি দিতে হবে?”

“আমি কোনো শাস্তি দিইনি তোমাকে। ভুল করেছি, ছোট্ট একটা ভুল।”

“তোমার এটাকে ছোট ভুল বলে মনে হয়?”

এবারও চুপ করে রইল নওশীন।

আরশাদ ক্লান্ত-বিরক্ত গলায় বলল, “তোমার কথা শুনতে ভালো লাগছে না।”

নওশীন একরাশ অভিমান নিয়ে বলল, “এখনো ইগনোর করে যাচ্ছো শাদ? তোমার এই ইগনোরেন্সের কারণেই আমি বাধ্য হয়েছি ভুলটা করতে।”

আরশাদ ক্রুদ্ধ গলায় বলল, “কোন মুখে এত বড় বড় কথা বলছো তুমি? এক ফোঁটাও রিগ্রেট নেই তোমার মধ্যে তাই না? নিজের করা ভুলের জন্যে দোষ আমাকেই দিয়ে যাচ্ছো?”

এর আগে কখনো আরশাদ তার সঙ্গে এতটা উঁচু গলায় কথা বলেনি। আর বলবেই বা কেন? যে মানুষটাকে সে এ জীবনে সবথেকে বেশি ভালোবেসেছে, তার সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলার প্রশ্নই ওঠে না। তার মানে কী? আরশাদ কি আর নওশীনকে ভালোবাসে না? একটা রাত, এই এক রাতের মধ্যে কারও ভালোবাসা উবে যেতে পারে?

নওশীন ব্যথিত গলায় বলল, “ঘৃণা করো না তুমি আমাকে?”

“আমি জানি না।”

আরশাদের এমন উত্তরে যেন তার অন্তরের ব্যথা আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল। দীর্ঘ সময় চুপ করে রইল নওশীন। নিজেকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে হয় না। আরশাদকে ভালোবেসে নিজেকে সর্বোচ্চ কষ্ট দিয়েছে নওশীন।

দীর্ঘ নীরবতার পর নওশীন কম্পিত স্বরে বলল, “তাহলে আমার সঙ্গে এক ছাদের নিচে থাকতে হবে কেন? ডিভোর্স নিয়ে নিই আমরা!”

আরশাদ হতবাক গলায় বলল, “ডিভোর্সের কথা তুমি বলছো?”

নওশীন আরেকটু জোর দিয়ে বলল, “হ্যাঁ বলছি। আমার পক্ষে সম্ভব না তোমার এই ইগনোরেন্স সহ্য করা।”

“আমি কোনোদিনও তোমাকে ইগনোর করিনি। কাজকে একটু বেশি প্রাধান্য দেওয়া মানেই তোমাকে ইগনোর করা নয়। তাই বলে তুমি…”

“তোমার সঙ্গে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাবো। আর তাছাড়া তোমার পক্ষেও সম্ভব না আমাকে মাফ করা। ছেড়ে দাও আমাকে।”

বর্তমানে…

কিছু মুহূর্ত, কিছু দৃশ্য, কিছু স্মৃতি একটা মানুষকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। মানব মস্তিষ্ক না-কি কোনোকিছু ভুলে যায় না। জন্মমুহূর্ত থেকে আজ অব্দি সকল স্মৃতিই মস্তিকে জমা আছে। মস্তিষ্ক যে সকল স্মৃতিগুলো জরুরি মনে করে না, সে সকল স্মৃতি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে না। আর যে স্মৃতিগুলো তার কাছে জরুরি যেগুলো চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।

ওই রাতটাকে আরশাদের মস্তিষ্ক কেন এত জরুরি মনে করে কে জানে? কারণে-অকারণে, যখন-তখন ওই রাতের প্রতিটা মুহূর্তের স্মৃতি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে চোখের সামনে। নওশীনের সঙ্গে ওই কথোপকথনের প্রত্যেকটা শব্দ আজও কানে ভেসে বেড়ায় তার। দোলনাওয়ালা ওই বারান্দায় গেলে আজও গা ছমছম করে ওঠে।

আজ কী যেন মনে করে আবারও পুরনো ডায়রিটা খুলে বসলো আরশাদ। ডায়রি মানুষকে ফেলে আসা দিনগুলোর সাথে জুড়ে দেয়। আরশাদের আজ ফেলে আসা দিনগুলোর কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে কিনা কে জানে? অবশ্য ইচ্ছা না করারই কথা। তার ফেলে আসা দিনগুলো নিতান্ত সুখকর নয়।

আরশাদের লেখায় অর্ধেকের কিছুটা কম ডায়রি ভরেছে, বাকি খালি পড়েছে আছে। প্রতিটি পাতায় একই কথা লেখা। একটি মাত্র বাক্য, বারবার, অনবরত।

“I wanna end me.”

একটা সময় নিজেকে শেষ করে দেওয়ার বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল তার। প্রতিটি মানুষ জীবন কোনো না কোনোবার নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চিন্তা মাথায় আনে কিনা কে জানে? তবে এই এক জীবনে সেই চিন্তা এসেছে আরশাদের মাথায়।

প্রথমবার এসেছিল যেদিন বাবা তাদের একা ফেলে চলে গেল। দ্বিতীয়বার, ওই রাতে। ভাগ্যক্রমে তৃতীয়বারটা না এলেও ওই দুইবারই তার জীবনে প্রলয়ংকরী ঝড় সৃষ্টি করার জন্যে যথেষ্ট ছিল।

নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চিন্তা এখন আর আরশাদ মাথায় আনে না। একটু একটু করে শুধরে নিয়েছে নিজেকে। নিজের জন্যে লড়াই করতে শিখেছে। তবুও কোথায় যেন এক প্রগাঢ় শূন্যতা। মনে হয় যেন নিজের জন্যে লড়াই করতে গিয়ে এক পর্যায়ে হেরে যাবে আরশাদ।

(চলবে)

[আমি একদিন ক্লিয়ার করে বললাম তাও অনেকের কনফিউশন যায়নি। অনেকে এখনো জিজ্ঞেস করেন নায়িকা কে। একজন দেখি আবার জিজ্ঞেস করেছেন নায়ক কে। আজকে একেবারে সরল বাংলায় বলে দিচ্ছি – নায়ক আরশাদ, নায়িকা অরা।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here