ফিরে_আসা ১৭+১৮ লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

0
666

#ফিরে_আসা
১৭+১৮
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে অরা। ‘শেষ বিকেল’ সিনেমার শুটিং দুদিন আগে শেষ হয়েছে। আপাতত কাজের তেমন একটা চাপ নেই। শুটিং ছাড়া আরশাদ খুব একটা ঘর থেকে বের হয় না। পরিচালক বা প্রযোজকদের সঙ্গে মিটিংও সারে নিজ বাড়িতে। অরার কাজ শুধু মিটিংগুলো ফিক্সড করে সময়টা দুপক্ষকে জানানো। এ কাজ ঘরে বসেও করা যায়।

অরা বিরক্ত দৃষ্টিতে টিভি স্ক্রিনের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া খবরগুলো পড়ছে। এমন নয় যে বিশ্বের কোথায় কী হচ্ছে তা নিয়ে সে খুব চিন্তিত। করার কিছু নেই বলে খবরগুলো পড়া। সীমা বাড়িতে নেই। থাকলে ওর সঙ্গে গল্পগুজব করে সময়টা পাড় করে দেওয়া যেত। পড়াশোনাও করার নেই। সেমিস্টার শেষ হয়ে গেছে, নতুন সেমিস্টার শুরু হতে এখনো ঢের বাকি।

হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। বিরক্তিতে অরার সমস্ত শরীর জ্বলে উঠছে। এখন আবার কে ফোন করলো কে জানে? কিছু কিছু দিন থাকে, যখন কোনো কাজ করতেই মন সায় দেয় না। ইচ্ছা করে কেবল একরাশ আলসেমি নিয়ে বিছানায় পড়ে থাকতে। অরার জন্যে আজ তেমনি একটা দিন।

মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নামটা দেখে অরার বিরক্তি আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল। ফোন করেছে তুফান। তুফান আরশাদের বডিগার্ড। আরশাদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কারও সাথে আজ কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। কাজ করতে করতে বেচারি ক্লান্ত। একটা দিনও সে কাজ ছাড়া কাটাতে পারবে না?

হাজার বিরক্তি সত্বেও ফোনটা রিসিভ করলো অরা। অপরপ্রান্ত থেকে তুফান ব্যস্ত গলায় বলল, “অরা আপা? স্যার কোথায় জানেন?”

অরা বিরক্ত গলায় বলল, “সেটা তো তোমার জানার কথা তুফান। তুমি স্যারের বডিগার্ড, আমি না।”

“স্যারের আজকে কোথায় থাকার কথা?”

“আমি কী করে বলবো কোথায় থাকার কথা? আজ কোনো মিটিং রাখিনি। স্যারের তো বাড়িতেই থাকার কথা। কেন? কী হয়েছে?”

তুফান উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “দেখেন তো অবস্থা! স্যার সেই দুপুরবেলা গাড়ি নিয়ে বের হয়েছেন। আমাদের কাউকে সাথে নেননি। একাই ড্রাইভ করে চলে গেলেন। চিন্তা হয় না বলেন?”

মনের অজান্তেই অরার চোখ গেল টিভির দিকে। টিভি স্ক্রিনের নিচের দিকে ভেসে উঠেছে আজকের তারিখ। কী সর্বনাশ? আজ তেরো তারিখ? আজকের কথা অরা একেবারেই ভুলে গিয়েছিল। আতঙ্কে তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।

অরা বহুকষ্টে নিজেকে সামলে বলল, “তুফান, আমি জানি স্যার কোথায় আছে। আমি উনাকে নিয়ে আসছি। তোমাদের তাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।”

ফোন কেটে দিয়ে এক লাফে উঠে বসলো অরা। তার গা বেয়ে প্রবল হওয়া বয়ে গেল। একটু একটু করে হৃদস্পন্দন বেড়েই চলেছে। তেরোই এপ্রিল, প্রতিবছর ঠিক এই দিনটায় এমনই অনুভূতি হয় তার। ঠিক এই দিনটায় আরশাদের পাগলামি যেন সকল সীমা ছাড়িয়ে যায়।

আজকের এই দিনটাতেই নওশীনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল আরশাদের। নিঃসন্দেহে এক সময় এই দিনটা ছিল তার জীবনের সবথেকে বিশেষ দিন। তবে এখন আর নেই। তাই হয়তো এই দিনটাকে সহ্য করতে পারে না আরশাদ। নিজের মধ্যে থেকেও হারিয়ে যাওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বিরক্তিকর ব্যাপার! এতই যখন টান তখন ডিভোর্স নেওয়ার কী দরকার ছিল কে জানে? সভ্য সমাজ মনে করে বিচ্ছেদ মানুষের জীবনে শান্তি বয়ে আনে। যে মানুষটার সাথে থাকা সম্ভব নয়, সেই মানুষটার থেকে আলাদা হয়ে গেলেই জীবনে ফিরে আসবে সকল শান্তি। এ ধারণা একেবারেই ভুল। অরা দেখেছে এক ডিভোর্সের কারণে কীভাবে তিলে তিলে নিজেকে শেষ করে ফেলছে আরশাদ। কোনো মানে হয়?

চিন্তিত ভঙ্গিতে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো অরা। বাইরে প্রকৃতি তার তাণ্ডব চালাচ্ছে। শুরু হয়েছে প্রবল কালবৈশাখীর ঝড়। জানালা থেকে কিছু দূরে কয়েকটা তালগাছ দেখা যায়। প্রচন্ড ঝড়ের বেগে গাছগুলো একটু পর পর হেলে উঠছে। ঝড়কে ভয় করলে চলবে না। অরাকে এই মুহূর্তে বাইরে বের হতেই হবে। তা না হলে সত্যি সত্যিই অনর্থ ঘটে যাবে।

তৈরি হতে হতে উবার কল করলো অরা। এই প্রবল ঝড়ের মধ্যে নিশ্চয়ই রিকশা নিয়ে বের হওয়া যাবে না। অবশ্য আরশাদের ড্রাইভার জহিরকে ফোন করে বললেই সে একটা গাড়ি নিয়ে চলে আসতো। জহির সারাদিন ও বাড়িতেই পড়ে থাকে। কী দরকার?

অরা নিতান্তই ভীতু প্রকৃতির মেয়ে নয়। একটা সময় ছিল, এখন আর নেই। ভয় তাকে সহজে কাবু করতে পারে না। তবে আরশাদের ছোট-বড় এই পাগলামিগুলো নিয়ে তার ভয়ের শেষ নেই। পাগলামির বশে যদি ছেলেটা কোনো দিন এক নিজের বড়সর ক্ষতি করে ফেলে?

বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হোটেলের সামনে এসে থামলো অরার উবার। অরা জানে আরশাদ কোথায় আছে। ৩১৬ নম্বর রুমে। প্রতি বছর এই দিনে ঠিক ওই রুমটায় গিয়ে ওঠে আরশাদ। নিজের জন্যে অজস্র পরিমাণ ড্রিংকস অর্ডার করে অচেতন না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত ড্রিংক করে। এই ভয়ঙ্কর ব্যাপারটায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে অরা। মদ্যপানের বদভ্যাস আরশাদের নেই। তবে এই একটা দিনে নিজেকে কিছুতেই আটকাতে পারে না সে।

যন্ত্রণার নানা ধরন রয়েছে। কিছু কিছু যন্ত্রণা আছে যা সহজেই গা সয়ে যায়। আবার কিছু যন্ত্রণা এতটাই তীব্র হয় যে, তার মুখোমুখি হওয়ার মতো শক্তি মানুষ হারিয়ে ফেলে। আরশাদের যন্ত্রণাগুলো ঠিক তেমনই।

কাঙ্ক্ষিত রুমটায় সামনে এসে অনবরত কলিংবেল বাজিয়ে যাচ্ছে অরা। দরজার ওপাশ থেকে কোনোপ্রকার সাড়াশব্দ আসছে না। যদিও তাতে কিছু যায় আসে না, দরজা না খুলে যাওয়া পর্যন্ত এই কলিংবেল বাজিয়েই যাবে অরা।

অরা ভেবেছিল কয়েক ঘন্টা নিরলস পরিশ্রমের পর আরশাদকে ঘর থেকে বের করা যাবে। তবে তাকে অবাক করে দিয়ে কয়েক মিনিটের মাথায় দরজা খুলে দিলো আরশাদ।

বুকটা ধ্বক করে কেঁপে উঠলো অরার। শত মানুষের মনের মাঝে বাস করা আরশাদকে প্রতিনিয়ত খুব কাছ থেকে দেখে অরা। ব্যক্তিগত জীবনে আরশাদ গম্ভীর, অল্পভাষী আর রাগী। এছাড়াও তার মাঝে যে বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় তা হচ্ছে অনুভূতিশূন্যতা। নিজের অনুভূতিগুলো সকলের সামনে আরশাদ প্রকাশ করে না বললেই চলে। তবে আজ যেন এক ভিন্ন মানুষকে আবিষ্কার করলো অরা। আরশাদকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কেউ একজন চাবুক দিয়ে অনবরত আঘাত করেছে তাকে। আঘাত পেতে পেতে অবসন্ন হয়ে উঠেছে তার ভেতরটা। চোখদুটোতে জমে আছে একরাশ কথা। সে কথাগুলো এই মুহূর্তে বলতে না পারলে যেন সে মরেই যাবে।

আরশাদ টলতে টলতে বলল, “ওহ! তুমি এসেছ? তোমার অপেক্ষাই করছিলাম।”

আবারও মনে মনে ধাক্কা খেল অরা। প্রতিবছর আরশাদ এমন পাগলামি করে, প্রতিবারই অরা এসে তাকে নিয়ে যায় এখান থেকে। কিন্তু কোনোবারই তো আরশাদ অপেক্ষা করে থাকে না তার জন্যে। তবে আজ অপেক্ষা করছে কেন?

আরশাদ আরও কিছু বলতে যাবে তার আগেই অরা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। হলওয়েতে অনেকে আসা-যাওয়া করছে। সুপারস্টার আরশাদ হককে এ অবস্থায় দেখাটা নিশ্চয়ই কারো কাম্য নয়।

বলতে যাওয়া কথাটা অপূর্ণ রেখে আরশাদ আবারও গিয়ে বসলো সোফায়। সোফার সামনে মার্বেল পাথরের প্রকান্ড এক টেবিল। টেবিলের ওপরেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে ড্রিঙ্কসের বোতল আর গ্লাস। আরশাদ গ্লাসে ছোট্ট চুমুক দিলো।

অরা সোফায় তার পাশে বসে বলল, “স্যার, চলুন প্লিজ।”

আরশাদ ঘোরলাগা কণ্ঠে বলল, “কোথায় যাবো?”

“আপনার বাড়িতে। প্লিজ স্যার, অনেক হয়েছে, এবার ফিরে চলুন।”

আরশাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “আমি কোথাও যাবো না অরা। তুমি চলে যাও। আজ সারারাত আমি এখানে থাকবো। যতক্ষণ পর্যন্ত অজ্ঞান না হই, ততক্ষণ ড্রিংক করবো। তুমি যাও।”

“আপনাকে যেতে হবে স্যার। এত ড্রিংক করলে আপনার শরীর খারাপ হবে।”

“হোক গিয়ে, তাতে তোমার কী?”

ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে অরা ক্লান্ত গলায় বলল, “কেন এমন করছেন স্যার? কেন শুধু শুধু নিজেকে কষ্ট দিচ্ছেন?”

“শুধু শুধু?”

ছোট্ট এই শব্দদুটো যেন ঘুরপাক খাচ্ছে আরশাদের মস্তিকে। ফেলে আসা দিনগুলো ঝড়ের গতিতে বয়ে গেল তার চোখে সামনে দিয়ে।

“তুমি আমাকে চেনোই না অরা। আমি কোনো কিছু শুধু শুধু করি না।”

“ফিরে চলুন প্লি…”

অরার কথা শেষ হওয়ার আগেই আরশাদ অন্যমনস্ক গলায় বলল, “কথা ফোন করেছিলো তোমাকে?”

“জি স্যার।”

আরশাদ ব্যস্ত গলায় বলল, “কী বলেছে? কবে ওর ফ্লাইট?”

অরা শুকনো ঢোক গিলে বলল, “আগামী মাসের তিন তারিখ।”

কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে বসে রইল আরশাদ। বাস্তবতার জগতের সাথে যেন তার কোনো পরিচয় নেই, তার একমাত্র বসবাস ঘোরের জগতে। গ্লাসটা আবারও হাতে নিয়ে এক চুমুকে সবটা ড্রিংক শেষ করে ফেলল আরশাদ। বোতলটা হাতে নিলো পুনরায় গ্লাস ভর্তি করার উদ্দেশ্যে।

অরা উদ্বিগ্ন গলায় বলল,“স্যার প্লিজ, নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করুন।”

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আরশাদ বলল, “কেউ একজন তোমার কাছ একটা একটা করে তোমার সব প্রিয় জিনিস কেড়ে নিলে কী করতে তুমি? পারতে নিজেকে সামলাতে?”

অরা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আরশাদের দিকে। তার চিরচেনা স্যারকে আজ বড্ড অচেনা লাগছে। আরশাদের দৃপ্ত কণ্ঠস্বরে আজ মিশে আছে বিচিত্র এক ব্যথা।

গভীর মনোযোগ দিয়ে গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে থেকে আরশাদ বলল, “সবার ধারণা আমি ক্যারেক্টারলেস। অন্য এক নায়িকার সাথে আমার অ্যাফেয়ার ছিল। আমার কারণেই ডিভোর্সটা হয়েছে। পত্র-পত্রিকা, টিভি-ম্যাগাজিন সব জায়গায় এই একই কথা। সব দোষ আরশাদের। নিজেদের মনগড়া কথা নিয়ে নিজেরাই নিউজ করে ফেলেছে। একবারও জানতে চায়নি সত্যিটা। তুমি জানো সত্যিটা কী?”

অরা বলল, “আমি এসব কথা শুনতে চাই না স্যার…”

আরশাদ ধমকের সুরে বলল, “কেন শুনবে না? তোমাকে শুনতেই হবে। It’s an order! তিন বছর ধরে কেউ আমার কথা শুনতে চায়নি। কেউ আমাকে বুঝতে চায়নি। তোমাকে শুনতেই হবে।”

“আপনার রেস্ট দরকার স্যার।”

আরশাদ ব্যর্থ স্বরে বলল, “আমার কিছুই যায় আসে না। কে কী বলল, কে কী ভাবলো – I don’t care. মানুষ যদি চায় মনগড়া গল্পে বিশ্বাস করতে, আমি তো আর পারবো না তাদের ফেরাতে। আমার সব চিন্তা কথাকে নিয়ে। মেয়েটা এখন না হয় কিছু বোঝে না। কিন্তু একটা সময়ে তো বড় হবে, পৃথিবীটাকে বুঝতে শিখবে। এসব নিউজ কি তখন ওর চোখ এড়িয়ে যাবে? কখনোই না। কথা দেখবে, আর নিজের বাবাকে চরিত্রহীন ভাববে। ঘৃণা করবে আমাকে।”

অরা বিড়বিড় করে বলল, “না স্যার।”

“অবশ্যই হ্যাঁ। বাবা-মায়ের মধ্যে কেউ একজন চরিত্রহীন হলে সন্তানের জীবনটাই ধ্বংস হয়ে যায়। যেমনটা আমার হয়েছে। কথা আমাকে চরিত্রহীন ভাববে, আর মনে মনে কষ্ট পেয়ে শেষ হয়ে যাবে। বাবা হয়ে মেয়েকে এই কষ্টের মুখে ঠেলে দিতে যাচ্ছি আমি। দেশের সবথেকে বড় সুপারস্টার আরশাদ হক, নিজের জীবনে সবথেকে বড় লুজার।”

আরশাদের মুখ থেকে এসব কথা শুনতে চাইছে না অরা। আরশাদকে এতটা কষ্ট দেখে কেঁপে উঠছে তার সমস্ত শরীর। কোনো এক জাদুর বলে নিমিষেই এই মানুষটার সকল কষ্ট দূর হয়ে গেলে ভালো হতো।

একটা মানুষ নিতান্তই অনুভূতিহীন হতে পারে না। অনুভূতি ছাড়া আবার মানুষ হয় না-কি? অরা জানতো, আরশাদ নির্ঘাত মনে মনে অতি গোপন কোনো অনুভূতি পুষে বেড়াচ্ছে। তবে সেই অনুভূতি যে এতটা প্রগাঢ় কে জানত? আরশাদের ভয়টা অগ্রাহ্য করার মতো নয়। নিজের মেয়েকে সে জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসে। আসলেই যদি ওই মিথ্যা-বানোয়াট খবরগুলো বিষিয়ে দেয় কথার শুভ্র মনটাকে। বাবার দিক থেকে যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় মেয়েটা? আরশাদ কি পারবে তা সহ্য করতে?

মেঝের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আরশাদ বলল, “আমার সারা জীবনে আমি ওই একটা মানুষকে ভালোবেসেছি। আমার কী মনে হয় জানো অরা? ভালোবাসার ক্ষেত্রে জোরাজুরি করতে হয় না। ভাগ্যে লেখা থাকলে ভালোবাসার মানুষটা এমনিতেই নিজের হয়ে যায়। আর লেখা না থাকলে কোনোদিনই তাকে নিজের করে পাওয়া যায় না। আমার জীবনটা বড়ই অদ্ভুত। একটা মানুষকে ভালোবাসলাম, তাকে পেয়েও গেলাম। পেয়েও হারিয়ে ফেললাম। তার মানে কী? আমার ভালোবাসা মিথ্যা ছিল?”

“আপনার রেস্ট দরকার স্যার। এসব কথা না হয় অন্য আরেকদিন শোনা যাবে। এখন চলুন
প্লিজ।”

আরশাদ আঁতকে উঠে বলল, “না, তুমি শোনো।”

অরা চুপ করে রইলো। আরশাদকে এভাবে দেখতে তার মোটেই ভালো লাগছে না। ইচ্ছা করছে ছুটে পালিয়ে যেতে। তবুও অরা বসে রইল। কম্পিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার স্যারের দিকে। আরশাদের এই মুহূর্তে এমন কাউকে দরকার যে তার মনে জমে থাকা কথাগুলো শুনবে। মনের সবথেকে গভীর স্তরে যত্ন করে পুষে রাখা গোপন কথাগুলো শোনানোর জন্যে আরশাদ হয়তো একমাত্র তাকেই ভরসা করতে পারছে।

আরশাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “আমার একটাই দোষ, আমি একটু বেশিই কাজ করি। ফ্যামিলিকে বিন্দুমাত্র সময় না দিয়ে সবটুকু সময় আমার কাজকে দিই। এই দোষের সর্বোচ্চ শাস্তি কী হতে পারে অরা? তুমি হলে কী শাস্তি দিতে?”

অরা থেমে থেমে বলল, “এটা তো কোনো দোষ না স্যার।”

“এটা দোষ, অনেক বড় দোষ। তুমি বুঝবে না। এই দোষের কারণেই তো সবটা হারালাম। জীবনটা ভালোই চলছিল জানো? একের পর এক হিট দিয়ে যাচ্ছি। প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন সিনেমায় সাইন করছি। কথা একটু একটু করে বড় হচ্ছে। ওর মা আমার পাশে আছে। জীবনে এতটা খুশি আমি কখনোই ছিলাম না। নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষ বলে মনে হতো। হঠাৎ একদিন জানতে পারলাম, আমি আবার বাবা হবো। আমাদের ঘর আলোকিত করতে আরও একজন আসছে।”

বিস্ময়ের সীমা রইল না অরার। নওশীন কি দ্বিতীয়বারের মতো অন্তঃসত্ত্বা ছিল? চাকরির শুরু থেকে কেবল কথাকেই দেখে আসছে অরা। তার জানা মতে সেই তাদের একমাত্র সন্তান। তাহলে দ্বিতীয় বাচ্চাটা কোথায়?

আরশাদ লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলানোর বৃথা চেষ্টা করা বলল, “খুশি হয়েছিলাম আমি। এর আগে এতটা খুশি হয়েছিলাম কথার জন্মের দিন। সবাই বলতো, বউ-বাচ্চাকে ল্যামলাইটের আড়ালে রাখতে, এলিজিবল ব্যাচেলর ইমেজটা ধরে রাখতে। কিন্তু আমি সবসময় চেয়েছি আমার হ্যাপি ফ্যামিলিটাকে পুরো পৃথিবীর সামনে আনতে। গর্ব করতাম আমি আমার পরিবার নিয়ে। কিন্তু পরিবারটাই আর রইলো না।”

আরশাদের হাতটা আবারও ফিরে গেল গ্লাসে। সে চুমুক দিতে যাবে তার আগেই অরা মিনতির সুরে বলল, “স্যার না। আর না প্লিজ!”

আরশাদ বাধ্য ছেলের মতো নামিয়ে রাখলো গ্লাসটা। তবে গ্লাসের দিক থেকে তার চোখদুটো সরছে না। সেদিকে তাকিয়ে থেকেই বলল, “পাশে ছিলাম ওর। সবসময়, সর্বক্ষণ। একবার শুটিং সেটে ডিরেক্টরের সঙ্গে ঝগড়া করে রীতিমত ভাঙচুর করে বেরিয়ে আসে। পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হয়। পুরো ইন্ডাস্ট্রি ওর বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল, আমি বাদে। আমি পাশে ছিলাম, সাহস জুগিয়েছিলাম। ওই ঘটনার পর ওর ক্যারিয়ার প্রায় ডুবতে বসেছিল। শক্ত হাতে সামলেছি সবটা।
আরেকবার নওশীন ড্রাগ অ্যাডিক্ট হয়ে পড়ল। ড্রাগ নিয়ে পড়ে থাকতো, আর সাংবাদিকদের ফোন করে উল্টোপাল্টা কথা বলতো। বলতো, আমি ড্রাগস নিয়েছে, এ নিয়ে নিউজ করুন। ব্যাপারটা নিয়ে নিউজ করলে এই ইন্ডাস্ট্রিতে একদিনও টিকতে পারতো না সে। সেবারও সামলেছি। প্রতিটা পদে পদে বাঁচিয়েছি ওকে। আর কী পেয়েছি?”

অরা হতবিহ্বল হয়ে লক্ষ্য করলো আরশাদের চোখ ছলছল করছে। যেকোনো সময় টপটপ করে গড়িয়ে পড়বে অবিরাম অশ্রুধারা। অরার হৃদস্পন্দন মুহূর্তেই বেড়ে গেল কয়েকগুণ। সেই সঙ্গে বেড়ে গেল অস্থিরতা। সুপারস্টার আরশাদ হক, যার জন্যে পাগল কোটি কোটি ভক্ত, তার চোখে জল মানায় না।

এজন্যেই লোকে বলে সাফল্যের সঙ্গে আনন্দের কোনো যোগসূত্র নেই। একটা মানুষ সফলতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে গেলেও কষ্টে জর্জরিত থাকতে পারে তার মন।

চোখের জল মোছার কোনপ্রকার উদ্যোগ না নিয়ে আরশাদ আবারও বলতে লাগলো, “ওই রাতে একটা ফোন এলো। আননোন নম্বর থেকে। তুমি জানো আমি আননোন নম্বর রিসিভ করি না। সেদিন কী মনে করে করলাম কে জানে? না করলেই বোধ হয় ভালো হতো।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরশাদ বলল, “ফোন করেছে একটা লোক। ভারী কন্ঠস্বর তার। নামটা কী যেন…”

অনেকটা সময় নিয়ে নাম মনে করার চেষ্টা করলো আরশাদ। মনে পড়তেই বলল, “কবির! নিজেকে নওশীনের খালাতো ভাই বলে পরিচয় দিলো। ওর বেশির ভাগ আত্মীয়-স্বজনদের আমি চিনি না, তাই অবাক হয়নি। লোকটা কথার মধ্যে একরাশ ভদ্রতা। ভদ্রভাবেই কথা বলল পুরোটা সময়। শেষে বলল, আপনার স্ত্রীর পেটে যে বাচ্চাটা আছে সে আমার। তাকে নিজের বলে পরিচয় দেবেন না প্লিজ। নওশীন যেন আমার সন্তানের কোনো ক্ষতি না করে।”

নির্বাক বনে গেল অরা। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে তার কষ্ট হচ্ছে। নওশীন? নওশীন এই কাজ করেছে? কী করে সম্ভব? তার মতো ভালো মেয়ে আর দ্বিতীয়টি নেই। আর সেই নওশীনই কিনা…?

আরশাদ দৃঢ় গলায় বলল, “বিশ্বাস করিনি আমি। একেবারেই বিশ্বাস করিনি। যে মানুষটাকে আমি নিজের থেকে বেশি ভালোবাসি তার ওপরে এতটুকু বিশ্বাস আমার আছে। প্রথমে ভেবেছিলাম লোকটা মজা করছে। পরে দেখলাম, কবির তার কথায় অনড়। প্রমাণ চাইলাম, পেয়েও গেলাম। দাঁড়াও, এখনো সব রেখে দিয়েছে। কিছুই ডিলিট করিনি।”

আরশাদ ব্যস্ত হয়ে পড়লো পকেট থেকে তার ফোনটা বের করতে।

অরা আঁতকে উঠে বলল, “স্যার থাক না এসব। আমি দেখতে চাই না।”

“কেন দেখবে না? এই ছবিগুলো দেখে আমি প্রতিনিয়ত ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাই। তবুও দেখি, বারবার দেখি। তুমি একবার দেখতে পারবে না কেন?”

ফোন ঘেঁটে অনেকটা সময় নিয়ে কী যেন খুঁজলো আরশাদ। কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা পেয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরিয়ে দিলো অরার হাতে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা ছবিটার দিকে তাকাতেই এক সেকেন্ডের মাথায় চোখ সরিয়ে নিলো অরা। এই ছবি দেখা তার পক্ষে সম্ভব নয়। নওশীনকে সে সবসময় আদর্শ বলে মনে করেছে। চেয়েছে তার মতো হতে। নিজের আদর্শকে তার আদর্শ হারিয়ে পরপুরুষের গায়ে ঢলে পড়ার দৃশ্য দেখা অরার জন্যে কষ্টকর।

কিছু জিনিস কখনো জানতে নেই। আরশাদ এবং নওশীনের এই ডিভোর্স নিয়ে তার কৌতূহলের কমতি ছিল না। তবে আজ প্রকৃত কারণটা জানার পর থেকে মনে হচ্ছে, না জানলেই বোধ হয় ভালো হতো। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে অরার। যদিও বিচ্ছেদের জন্যে মনে মনে কখনো দোষারোপ করেনি আরশাদকে। কিন্তু নওশীনকেও তো করেনি।

অরা নওশীনকে আদর্শ মনে করে বলে এই সত্যি মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে অরার। না জানি আরশাদের কতটা কষ্ট হয়েছিল। সে তো প্রাণের থেকেও বেশি ভালোবেসেছিল মানুষটাকে।

আরশাদ থেমে থেমে বলল, “পৃথিবীতে সবকিছুরই রিপ্লেসমেন্ট থাকে, তাই না অরা? আমি সময় দিতে পারি না, সারাদিন ব্যস্ত থাকি – সেজন্যে আমার রিপ্লেসমেন্টও খুঁজে নিলো আমার ভালোবাসার মানুষটা।”

অরার চোখ বয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। কোনোকিছুই সহ্য হচ্ছে না। তিক্ত সত্যতা সহ্য হচ্ছে না, আরশাদকে কষ্টে দেখাটা সহ্য হচ্ছে না।

“একটা দিনও আমি নওশীনকে ছাড়া কল্পনা করতে পারতাম না। Even at that moment, আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা আমি ভাবিনি। ভাবছিলাম কী করে ক্ষমা করে দেওয়া যায় ওকে। ক্ষমা করতে কষ্ট হতো, তবুও করে দিতাম। ভালোবেসেছিলাম তো। এই ভালোবাসা জিনিসটাকে আমি সবথেকে ঘৃণা করি। চট করে আসে, আর চলে গেলে একেবারেই চলে যায়।
ডিভোর্সের কথা প্রথমে ওই তুলল। আমার সঙ্গে থাকলে না-কি ভুল করেই যাবে। তার থেকে ভালো একসঙ্গে না থাকা।”

আরশাদের বলা প্রতিটি শব্দে অরা কেবল অবাকই হয়ে যাচ্ছে। এত বড় একটা ভুল করলো, অথচ কোনো অনুতাপ নেই নওশীনের মাঝে। বিশ্বাস হচ্ছে তার চিরচেনা ম্যাম এমনটা করেছে। বারবার মনে হচ্ছে যেন ভিন্ন এক নওশীনের গল্প শুনছে সে।

আরশাদের চোখমুখ শক্ত হয়ে উঠলো। কষ্টে জর্জরিত মুখটা ক্রমেই ছেয়ে যাচ্ছে কাঠিন্যে। কঠিন গলায় আরশাদ বলল, “ঠিক ওই মুহূর্তে, আমার সব ভালোবাসা উধাও হয়ে গেল। নওশীনের প্রতি সর্বক্ষণ সূক্ষ্ম একট টান অনুভব করতাম। সেই টানটাও চলে গেল। চোখ খুলে গেল আমার। নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগলাম, কেন ক্ষমা করতে যাচ্ছিলাম তাকে। সবকিছুর ক্ষমা হলেও বিশ্বাসঘাতকতার কোনো ক্ষমা হয় তুমি বলো?”

অরা না-সূচক মাথা নাড়ল।

“ওই বাচ্চাটার সাথে নওশীন কী করেছে আমি জানি না। জানতেও চাইনি। ওই সময়টায় আটকে ছিল আমার জীবন। এত বড় একটা শক পেয়েছি। এই শক থেকে রিকোভার করা কোনোদিনই সম্ভব হবে না আমার পক্ষে। আমি বেশি কিছু চাইনি অরা। আমি চেয়েছিলাম কেউ এসে আমার পাশে দাঁড়াক, আমাকে বুঝুক সাপোর্ট করুক। কিন্তু পেলাম কী? শুধুই কটাক্ষ।”

অরার খুব ইচ্ছা হলো বলতে, “আমি আপনার পাশে আছি স্যার।” কিন্তু বলতে পারলো না। ভেতর থেকে কিছু একটা এসে আটকে দিলো তাকে।

“আমার মা জানতো না ডিভোর্সের আসল কারণ কী। পত্র-পত্রিকার লেখা দেখে তার ধারণা হয়ে যায় আমার কারণেই ডিভোর্স হচ্ছে। ফোন করে ইচ্ছা মতো কথা শোনালো। মায়েদের কাজই তো শাসন করা। আমার মা আমাকে জীবনে বহুবার শাসন করেছে, তবে সেবারের মতো কষ্ট আমি কোনোদিন পাইনি। মা আমাকে বলল, নওশীনের মতো ভালো একটা মেয়ের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার জন্যে সে কোনোদিন ক্ষমা করবে না আমাকে। আমার মতো মানুষকে ছেলে হিসেবে পরিচয় দিতে তার লজ্জা লাগছে। তোমার কী মনে হয় অরা? আমি কি এতটাই খারাপ?”

সাবধানে চোখের জল মুছে অরা আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “না স্যার, কখনোই না। এখানে আপনার তো কোনো দোষ নেই। আপনি কেন শুধু শুধু কষ্ট দিচ্ছেন নিজেকে?”

“কষ্ট পেতে পেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি তো। কষ্ট না পেলে বরং কেমন খাপছাড়া লাগে জীবনটা।”

এই ভালোবাসা জিনিসটা এমন কেন? কখনো মনে এনে দেয় পৃথিবীর সবথেকে সুখময় অনুভূতি। আবার এই ভালোবাসাই পারে হৃদয়টাকে কয়েক হাজার টুকরোয় ভেঙে ফেলতে। অরা মনে মনে ঠিক করল, এ জীবনে কাউকে ভালোবাসবে না।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here