ফিরে_আসা ১৯+২০

0
561

#ফিরে_আসা
১৯+২০
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

সীমাকে আজ অপরূপ সুন্দর লাগছে। তার পরনে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, খোঁপায় বেলি ফুলের মালা, চোখ কাজলে রাঙানো, আর কপালে ছোট্ট একটা লাল টিপ। তার সৌন্দর্য কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে সর্বক্ষণ ঠোঁটে লেগে থাকা হাসিটা। এই সাজের সঙ্গে হালকা কিছু গয়না না হলে ঠিক জমছে না। এই যেমন দুহাত ভর্তি লাল চুড়ি, কানে বড় কানের দুল, গলায় রঙিন কোনো হার। সীমার আলমারিতে একরাশ গয়নাগাটি পরে আছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত গয়নাগুলো খুঁজে পাচ্ছে না। বিরক্তিতে তার গা জ্বলে যাচ্ছে।

অরা বিছানার ওপর বসে হাই তুলতে তুলতে বলল, “লাল শাড়ির সঙ্গে লাল চুড়িই পড়তে হবে এমন কোনো কথা আছে? হাতের কাছে যা আছে তাই পড়ে যা।”

সীমা চুড়ি খুঁজতে খুঁজতে ভ্রু কুঁচকে বলল, “তুই ফ্যাশনের কী বুঝিস রে? এত বড় মেয়েমানুষ হয়েছিস, অথচ আজ পর্যন্ত একটু সাজগোজ করতে দেখলাম না।”

মিনিট কয়েকের মাঝেই সীমা খুঁজে পেল তার কাঙ্ক্ষিত সকল গয়না। গয়নাগুলো পরে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। অরা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার বান্ধবীর দিকে। এই মেয়েটাকে প্রকৃতি একটু বেশিই সুন্দর করে পাঠিয়েছে।

সীমা আঁচল ঠিক করতে করতে বলল, “তুই সত্যি যাবি না?”

অরা শুকনো গলায় বলল, “না রে। মন ভালো নেই।”

সীমা আয়নার দিক থেকে চোখদুটো না সরিয়েই বলল, “মন খারাপ করার কী আছে? আমি তো আগেই বলেছিলাম ওই মেয়ের নির্ঘাত কোনো দোষ আছে। না হলে আরশাদের মতো সোনার টুকরো একটা ছেলের থেকে কেউ আলাদা হয়ে যায়?”

কাল রাত থেকে আরশাদ আর নওশীনের ডিভোর্সের প্রকৃত কারণ জানার পর থেকে সীমা রাগে ফুসছে। নেহায়েত ভার্সিটির বর্ষবরণ উৎসবে যেতে হবে বলে মুখে একটা কৃত্রিম হাসি ধরে রেখেছে। মনে মনে তার রাগ সকল সীমানা অতিক্রম করে গেছে।

সীমা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “একে তো আরশাদের ওপর চিট করলো, তার ওপরে আবার অন্য একজনের বাচ্চাকে আরশাদের বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো? ছি!”

“আমার বিশ্বাস হয় না জানিস!”

“তুই না ছবি দেখেছিস?”

অরা বিভ্রান্ত গলায় বলল, “দেখেছি, কিন্তু মানুষটাকে তো চার বছর ধরে দেখছি। একটা ভালো মানুষের ছবি কল্পনা করলে যা পাওয়া যায়, ম্যাম ঠিক তাই। সবসময় হাসি মুখে কথা বলবে, কখনো উঁচু গলায় কথা বলবে না, ভুল করলে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলবে। আর সেই মানুষটাই কিনা…?”

“আচরণ দিয়ে মানুষের অন্তরটা বিচার করা ঠিক না অরা। সেভাবে হিসাব করলে তো আরশাদের মতো খারাপ মানুষ এই পৃথিবীতে নেই।”

“স্যারের আচরণ যে খারাপ তা কিন্তু বলছি না। মাঝে মাঝে একটু রেগে যায়, এই যা।”

সীমা আয়নার সমানে থেকে সরে এল। বিছানায় অরার পাশে বসতে বসতে বলল, “ফ্যান হিসেবে নিয়ে ওপর খুব গর্ব হচ্ছে জানিস?”

“কেন?”

“কারণ আরশাদ ভালো অভিনেতা হওয়ার সাথে সাথে ভালো একটা মানুষ। হুটহাট রেগে গেলেও ওর মনে কোনো মারপ্যাঁচ নেই। কিন্তু এই নওশীনকে আমার এক ফোঁটাও ভরসা নেই। দেখবি, ভবিষ্যতেও ওই মেয়ে আরশাদের জীবনে ঝামেলা করবে।”

অরা অবিশ্বাসের সাথে বলল, “ধুর! কী যে বলিস!”

সীমা আক্ষেপের সাথে তেজী গলায় বলল, “আমার কোনো কথাই দেখি তোর বিশ্বাস হয় না। নওশীনের মনে মনে বিশাল প্যাঁচ! কিছুদিন আগে ইন্টারভিউতে এসে কী করেছে জানিস? কাঁদো কাঁদো গলায় বলেছে, ডিভোর্স হয়েছে তো কী হয়েছে? সন্তানের মা হিসেবে কি আমি সন্মান পেতে পারি না? সবই পাবলিকের সিম্প্যাথি পাওয়ার ধান্দা! আরে বাবা, আরশাদ তোকে সন্তানের মা হিসেবে সন্মান করে বলেই তোর কুকর্ম কেউ জানে না। ডিভোর্সের পর আরশাদকে নিয়ে কত আজেবাজে কথা লেখা হয়েছে। সেই নিয়ে বেচারা আজও কষ্ট পায়। দেশের সবথেকে বড় সুপারস্টার ও। কেন শুধু শুধু মিথ্যা অপবাদ বয়ে বেড়াতে যাবে? চাইলেই পারতো ওর আসল চেহারাটা সবার সামনে তুলে ধরতে। করেনি কারণ নওশীন ওর বাচ্চার মা।”

“তুই এত রেগে যাচ্ছিস কেন?”

“তো কী করবো? রাগে আমার রক্ত টগবগ করছে। একে তো চিট করলি, নিজেই সেধে সেধে ডিভোর্স নিলি, তারপরে আবার যার ওপর চিট করলি তাকেই ব্যবহার করে পাবলিকের সিম্প্যাথি নেওয়ার চেষ্টা করবি? আমি তোকে বলে দিলাম অরা, এই নওশীনকে যদি কোনদিন সামনে পাই, ওর একটা হাড়ও আস্ত রাখবো না আমি।”

মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অরা বলল, “হয়েছে, হয়েছে। এই কথাটা আবার মানুষকে বলে বেড়াবি না কিন্তু।”

“আমার তো ইচ্ছা করছে টিভির ইন্টারভিউতে গিয়ে ওর মুখোশ টেনে ছিঁড়ে ফেলতে।”

সীমার পাগলামিতে অরার হাসি পেয়ে গেল। হাসিটা ঠোঁটে ধরে রেখেই বলল, “আচ্ছা? মানুষ বিশ্বাস করবে তোর কথা?”

“আমি তো কথার কথা বললাম। কিন্তু আরশাদের এতটাও ভালো মানুষ হওয়া উচিত নয়। নওশীন যদি বেশি বাড়াবাড়ি করে, ওর উচিত এই সত্যিটা ফাঁস করে দেওয়া।”

সীমা বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অরার মনে হলো বিরাট বোকামি হয়ে গেছে। সীমার সঙ্গে বর্ষবরণ উৎসবে গেলেই ভালো হতো। আজকের এই দিনে শুধু শুধু বাড়িতে বসে আলসেমি যাপন করার কোনো মানে হয় না। পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। এই দিনটায় সকলের মন আনন্দের দোল খেলে বেড়ায়।

অবশ্য অরা এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে তার মনে আনন্দে উসখুস করে না। যে মানুষ জীবনে অজস্র কষ্ট আর যন্ত্রণা পেরিয়ে আসে, বিশেষ দিন উদযাপনের জন্যে মন কেঁদে ওঠে না।

উদযাপনের লোভে নয়, অরা ঘর থেকে বের হতে চাচ্ছে নিজের থেকে পালানোর উদ্দেশ্যে, মনটাকে ব্যস্ত রাখার উদ্দেশ্যে। কাল রাত থেকে মনের মাঝে বিচিত্র এক অস্থিরতা কাজ করে যাচ্ছে। এই অস্থিরতার কোনো মাত্রা নেই, কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। মনে হচ্ছে বুকের ওপর কেউ শক্ত একটা পাথর চেপে ধরে রেখেছে। পাথরটার কারণে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নেওয়াও যেন কষ্টকর হয়ে উঠেছে। অরা ভেবে পায় না, আরশাদের কষ্টে তার এত কষ্ট হচ্ছে কেন? বারবার কেন ইচ্ছা করছে কোনো এক জাদুর বলে তার সমস্ত কষ্টগুলোকে এক নিমিষে দূর করে দিতে?

আরশাদের মনের গভীরতম স্তরে জমে থাকা কথাগুলো যে অরা জেনে গেছে, এ খবর কি আরশাদ জানে? খুব সম্ভবত না। ড্রাংক অবস্থায় কথাবার্তার ওপরে মানুষের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তার ওপরে আবার আরশাদ মাত্রাতিরিক্ত ড্রিংক করে প্রায় অচেতন হয়ে ছিল। ওই অবস্থায় কাকে, কী বলেছে তার নিজেরই মনে থাকার কথা নয়।

স্বাভাবিক অবস্থায় যে কথাগুলো আরশাদ কাউকে বলতে পারেনি, অস্বাভাবিক অবস্থায় বলে দিয়েছে অরাকে। এই ব্যাপারটা যেন অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। যে কথাগুলো আজ অরা জানে, সেগুলো তো তার জানার কথাই ছিল না।

কাল বাড়ি পৌঁছেই বিছানায় ঢলে পড়ে আরশাদ। ঘুম নির্ঘাত এখনো ভাঙেনি। মতিউরকে জানিয়ে রাখা হয়েছে, আরশাদের ঘুম ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে যেন অরাকে খবর দেওয়া হয়। একটা পার্টির নিমন্ত্রণ এসেছে। নববর্ষ উপলক্ষে পার্টির আয়োজন করেছে জনপ্রিয় অভিনেতা আরিয়ান আলম। আজ রাতের পার্টির নিমন্ত্রণ এসেছে আজ সকালে। এ আর নতুন কিছু নয়। সেলিব্রিটিরা হুটহাট করে পার্টির আয়োজন করে, আবার হুটহাট করেই মানুষকে নিমন্ত্রণ দেয়।

সাধারণত এ ধরনের নিমন্ত্রণ এলে অরা আরশাদকে জিজ্ঞেস না করেই ভদ্রভাবে না বলে দেয়। বিনয়ী গলায় বলে,“স্যার আজ ব্যস্ত আছেন, কিন্তু আপনার পার্টিতে অ্যাটেন্ড করতে পারলে তিনি অনেক খুশি হতেন।”

কথাটা এক বিন্দুও সত্য নয়। পার্টি-টার্টি আরশাদের একেবারেই পছন্দ নয়। তার থেকেও বেশি অপছন্দের একরাশ মানুষের মুখোমুখি হওয়া। তবে আজকের পার্টির কথা আলাদা। আরিয়ান আরশাদের অনেক ভালো বন্ধু। প্রায় একই সময়ে দুজনের আগমন ঘটে ইন্ডাস্ট্রিতে। আরশাদ মনে করে এই ইন্ডাস্ট্রিতে তার একমাত্র ভালো বন্ধু আরিয়ান। তাই তার নিমন্ত্রণ আরশাদ না জিজ্ঞেস করে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না।

মগভর্তি কফি বানিয়ে জানালার কাছে এসে বসলো অরা। কাল সারারাত কী ভয়ঙ্কর ঝড়টাই না হলো! অথচ সেই ঝড়ের কোনো রেশ নেই আজকের প্রকৃতির মাঝে। মাথার ওপর সূর্যটা ঠিকই ছড়িয়ে যাচ্ছে তার তীব্রতা।
এরই মাঝে ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে মতিউরের নাম। এর মানে একটাই, আরশাদ উঠে গেছে। অরা আর মতিউরের ফোন রিসিভ করলো না। আজ কেন জানি অযথা কথা ব্যয় করতে ইচ্ছা করছে না।

অরা সরাসরি ডায়াল করলো আরশাদের নম্বরে। কয়েকটা রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ করলো সে। অরা কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই অপরপ্রান্ত থেকে আরশাদ গম্ভীর গলায় বলল, “বাসায় চলে এসো অরা, কুইক!”

কোনো মানে হয়? এই ছেলেটার কান্ডজ্ঞান বলে কিছু নেই। না হলে কেউ সরকারি ছুটির দিনে একটা ম্যানেজারকে কাজ করতে ডাকে? যদিও এই ইন্ডাস্ট্রির কাজের ধরনের সঙ্গে কর্পোরেট অফিসের কোনো মিল নেই। অনেক সময় এমনও হয় শুক্রবার দিন শুটিং পড়ে গেছে। অরা উদযাপন করে না তো কী হয়েছে? ছুটি কাটানোর অধিকার তো সবারই আছে।

হাজার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তৈরি হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো অরা। আরশাদের নির্দেশের ওপর দ্বিমত পোষণ করার সাহস বা ইচ্ছা কোনোটাই তার নেই। তার পেটের ভেতর হাজারো প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। আরশাদের বাড়িতে এর আগেও অসংখ্যবার তার যাওয়া হয়েছে। তবে কোনোবারই এই অনুভূতিটা হয়নি। কালকের ঘটনার পর থেকে আরশাদের মুখোমুখি হতে কেমন ভয় ভয় লাগছে। যদিও ভয়ের কোনো কারণ নেই। আরশাদের তো সে ঘটনার লেশমাত্র মনেই নেই।

আরশাদকে দেখে হতভম্ব বনে গেল অরা। তার চোখেমুখে বিচিত্র এক প্রশান্তির ভাব। চোখদুটোতে বিরাজ করছে একরাশ স্নিগ্ধতা। পরনের সাদা শার্টে সেই স্নিগ্ধতা যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। কে বলবে এই একই মানুষ গত রাতে ড্রিংক করে একাকার কান্ড ঘটিয়েছে!

‘শেষ বিকেল’ সিনেমার শুটিং শেষ হয়েছে ঠিকই কিন্তু শুটিংয়ের পরেও সিনেমার পেছনে অনেকটা সময় দিতে হয় অভিনেতাদের। বেশির ভাগ সময় যায় ডাবিংয়ের পেছনে। সিনেমায় আমরা অভিনেতাদের যে কণ্ঠস্বর শুনি তার কোনোটাই দৃশ্য ধারণ করার সময়কার নয়। সেগুলো আলাদা করে স্টুডিওতে ধারণ করা হয়। শুটিংয়ের সময় আশপাশ থেকে নানা অবাঞ্ছিত শব্দ ভেসে আসতে পারে। যার ফলে সংলাপ পরিষ্কার শোনা যায় না। সংলাপ বুঝতে যাতে দর্শকের কোনো অসুবিধা না হয়, তাই শুটিংয়ের পর সকল দৃশ্যের সংলাপগুলো আলাদাভাবে স্টুডিওতে ধারণ করা হয়। এরপর এডিটের সময় দৃশ্যের ওপর আলাদা ধারণকৃত সেই সংলাপগুলো বসিয়ে দেওয়া হয়।

‘শেষ বিকেল’ সিনেমার পেছনে আর কত দিন ব্যয় করতে হবে তার একটা হিসাব করতেই অরাকে ডেকে পাঠানো। অরা তার ল্যাপটপ খুলে বসেছে। আরশাদের আগামী দিনগুলোর শিডিউল এখানেই গুছিয়ে লেখা আছে।

আরশাদ গম্ভীর গলায় বলল, “ডাবিং শেষ হতে কতদিন লাগবে?”

“আমি ডিরেক্টরের সঙ্গে কথা বলেছি স্যার। তিনি বললেন, আপনি সময় দিতে পারলে চার থেকে পাঁচ দিনের ভেতর শেষ হয়ে যাবে।”

“তাহলে নেক্সট উইকের রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার ডেট দিয়ে দাও।”

অরা ভদ্রভাবে বলল, “মঙ্গলবার দেওয়া যাবে না স্যার। ওইদিন অ্যাডের প্রিমিয়ার ইভেন্টে আপনাকে যেতে হবে।”

আরশাদ বিরক্ত গলায় বলল, “ওহ!”

আরশাদের বিরক্তির যথাযথ কারণ আছে। বিজ্ঞাপনের ইভেন্টে সাংবাদিকরা গিজগিজ করে। আরশাদকেও বাধ্য হয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে দিতে হবে তাদের প্রশ্নের উত্তর। সেটা কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হলো, সীমা অতিক্রম করে যাওয়া সাংবাদিকদের প্রিয় কাজ। আরশাদকে পেয়েই তারা অবাঞ্ছিত প্রশ্নের ঝুলি খুলে বসবে। সবটাই তার ব্যক্তিগত জীবনকে ঘিরে।

অরা বলল, “তাহলে স্যার মঙ্গলবার আর শুক্রবার বাদে, রবিবার থেকে শনিবার ওদের ডেট দিয়ে দিই?”

আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “হ্যাঁ, আর শোনো! ইভেন্টের আগে সাংবাদিকদের ব্রিফ করে দেবে কোনো পার্সোনাল প্রশ্ন যেন না করে। পাঁচ মিনিটের জন্য তাদের মুখোমুখি হবো, যে কটা প্রশ্নের উত্তর দিবো সবগুলো হবে অ্যাড নিয়ে।”

অরা ভয়ে ভয়ে বলল, “সিনেমা নিয়েও কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না স্যার?”

আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “পারবে, কিন্তু বেশি না। অ্যাডের ইভেন্টে আবার সিনেমার প্রশ্ন কীসের?”

অরা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “জি স্যার।”

“এই সিনেমার প্রমোশনের জন্য কয়দিন চেয়েছে?”

“চেয়েছিল পনেরো দিন, কিন্তু আমি বলে দিয়েছি পাঁচ দিনের বেশি দেওয়া সম্ভব নয়।”

“পাঁচ দিন? পাঁচ দিন ধরে কীসের প্রমোশন করবো? তিন দিনের বেশি দেওয়া যাবে না। আর কোথায় কোথায় ইন্টারভিউ দিতে যাবো, সেটাও আমি ঠিক করবো।”

কোনপ্রকার প্রচার-প্রচারণা না করলেও আরশাদ হকের সিনেমা সুপারহিট হবেই। এই সত্য সবার জানা। তবুও ভক্তদের কাছাকাছি থাকার উদ্দেশ্যে আরশাদ সিনেমার প্রচারে যায়। চার বছর আগে আরশাদ প্রচারণার জন্যে পনেরো-ষোলো দিন করে রাখতো। তবে প্রতিটা নতুন সিনেমার সঙ্গে সঙ্গে সেই সংখ্যা যেন কমেই যাচ্ছে। এর আগের সিনেমার প্রচারের জন্যে আরশাদ সময় দিয়েছিল পাঁচদিন। এবার তিনে নেমে এলো। পরের সিনেমায় কতটুকু সময় রাখবে সে? এক বেলা?

অরা বলল, “স্যার আরেকটা কথা?”

“কী?”

“আরিয়ান আলমের ফোন এসেছিল। তিনি আজ তার বাড়িতে একটা পার্টি রেখেছেন। আপনাকে ইনভাইট করছেন।”

অরা মনে মনে ধমক খাওয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। ভেবেছে এই কথাটা শুনে আরশাদ নির্ঘাত প্রচন্ড এক ধমক দিয়ে বলবে, “এতদিনেও কাজ শিখতে পারলে না? কতবার বলেছি এসব পার্টি-ফার্টিতে আমি যাই না।”

কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে আরশাদ অনেকটা সময় ভেবে বলল, “আমরা যাচ্ছি।”

অরার গা বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল ‘আমরা’ শব্দটা শুনে। তার মানে কী? অরাকেও তার সাথে পার্টিতে যেতে হবে? কী যন্ত্রণায় পড়া গেল!সেলিব্রিটিদের পার্টিতে সেলিব্রিটিরা যাবে, শুধু শুধু অরাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার কী প্রয়োজন? যদিও প্রয়োজনটা খুব ভালো করেই জানে অরা। আরশাদের স্বভাব হুটহাট রেগে গিয়ে তুলকালাম কান্ড ঘটানো। কোনো কারণে পার্টিতে একরাশ মানুষের সামনে তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে তাকে সামলানোর মতো মানুষ একজনই আছে, অরা।

আরশাদের বাড়ি থেকে আপাতত বেরিয়ে এল অরা। আবারও আসবে সন্ধ্যার আগে আগে। সে সময়েই আরশাদের গাড়িতে করে পার্টির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হবে তাদের। অরা বুঝতে পারছে না এই মুহুর্তে কী করা উচিত? বাড়ি ফিরে যাবে? পার্টির জন্যে সাজগোজ করবে? একেবারেই না।

সীমা ঠিকই বলে, অরার মতো রসকষহীন মেয়ে এই পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই।
সাজগোজের ঝামেলা চিরকাল সে এড়িয়েই গেছে। সাজতে গেলেই বিভ্রান্তি! এই যেমন আরিয়ান আলম আজ নববর্ষের দিনে পার্টি রেখেছ। এই পার্টিতে তার পোশাক কী হওয়া উচিত? তার কী লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরা উচিত না-কি সেলিব্রিটিদের পার্টির উপযোগী জমকালো কোনো পোশাক পরা উচিত? বিভ্রান্তি এড়াতে অরা সাজাই ছেড়ে দিয়েছে। এই মুহূর্তে তার পরনে হালকা মেরুন রঙের শার্ট, সাদা কোট আর নীল জিন্স। এই পোশাকেই সে পার্টিতে যাবে। যা থাকে কপালে!

চাকরির শুরুর দিকে অরার ধারণা ছিল, সেলিব্রিটি মানেই বিশাল দোতলা বাড়ি, বাড়ির সামনে প্রকান্ড সুইমিং পুল। ঠিক যেমনটা আরশাদের রয়েছে। তবে আদতে এমনটা হয় না। সেলিব্রিটিরাও সাধারণ মানুষের মতো ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকতে পারে। যেমন আরিয়ান। যদিও তার ফ্ল্যাটটা নেহায়েত সাধারণ মানুষের মতো নয়।

পাঁচ বেডরুমের এই বিশাল ফ্ল্যাটে রয়েছে ফুটবল মাঠের সাইজের বসার ঘর। পঞ্চাশ-ষাটজন আনয়াসে এ ঘরটাতে হাত-পা ছড়িয়ে পার্টি করতে পারবে। এই ফ্ল্যাট আরিয়ান নতুন কিনেছে। সে জন্যেই হয়তো বাড়ির সমস্ত ফার্নিচার চকচক করছে। পুরোটা বসার ঘরজুড়ে পরিচিত মুখগুলোকে দেখতে পেলো অরা। সকলেই যে যার মতো কথাবার্তা বলছে, ছবি তুলছে। সকলের ঠোঁটেই লেগে আছে এক চিলতে হাসি আর পরনে ঝলমলে পোশাক।

তবে এক নিমিষেই সকল চোখগুলো গিয়ে আবদ্ধ হলো বাড়ির মূল দরজায়। সকলের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু আরশাদ। সে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে অন্যরকম এক মোহনীয় হওয়া বয়ে গেল। কালো পাঞ্জাবিতে আজ তাকে অতিরিক্ত হ্যান্ডসাম লাগছে।

আরশাদ প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে যেন ছুটে এল আরিয়ান। উৎসাহে-উত্তেজনায় জড়িয়ে ধরল তার বন্ধুকে।

আরিয়ান হতবাক গলায় বলল, “আমি ভাবতেই পারিনি তুই আসবি।”

আরশাদ ক্ষীণ হাসি ঠোঁটে নিয়ে বলল, “তুই আগের মতোই রয়ে গেলি। Pure idiot!”

“আমি আবার কী করলাম?”

“পহেলা বৈশাখে কেউ পার্টি থ্রো করে?”

“আসলে নতুন বাসায় সবাইকে ডাকা হয়নি। ভাবলাম ভালো একটা উপলক্ষে আছে, তাই আর কি। চল ওদিকে যাই!”

এই বাড়ির আরেক আকর্ষণ এর বারান্দা। প্রকান্ড এই বারান্দায় দারুণ বসার ব্যবস্থা করেছে আরিয়ান। চোখের সামনে চারিদিকে সবুজ গাছ-গাছালি আর মাথার ওপরে খোলা আকাশ। পার্টি উপলক্ষে এই বারান্দায় আজ চমৎকার আলোকসজ্জা করা হয়েছে।

আরিয়ান আরশাদকে নিয়ে বসল বারান্দায় থাকা কালো সোফাটায়। যদিও হোস্ট হিসেবে তার কর্তব্য সকল অতিথির সঙ্গে ঘুরে ঘুরে কথা বলা। এতদিন পর কাছের বন্ধুকে পেয়ে ভদ্রতা রক্ষা করার ব্যাপারটা তার মাথা থেকে উড়ে গেল।

আরিয়ান বলল, “তারপর? কেমন চলছে?”

আরশাদ ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি টেনে বলল, “আমার সবসময়ই ভালো চলে।”

“চলবেই তো। দেশের সবথেকে বড় সুপারস্টার বলে কথা।”

আরশাদ মুখ বিকৃত করে বলল, “আরে ধুর! আমি ওসব কিছুই না।”

“সেটা তো তোর মনের ভুল।”

“আমার কথা বাদ দে। তোর কী অবস্থা বল!”

“আমাদের অবস্থা তো বারো মাস একই থাকে। একেকটা সিনেমায় সাইন করি। দুদিন পর নিজেকেই প্রশ্ন করি, কী মনে এই জঘন্য স্ক্রিপ্টে সাইন করেছিলাম। তবুও বাধ্য হয়ে শুটিংয়ে চলে যাই। শুটিং শেষে গর্ব করে সবাইকে বলি, এই সিনেমাটা একেবারেই আলাদা, একেবারেই নতুন। যদিও কাহিনী সেই পাঁচশ বছর আগেকার।”

আরিয়ানের কথায় হাসি পেয়ে গেল আরশাদের। কথাগুলো নেহায়েত মিথ্যা নয়। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে এমনটা আরশাদের সঙ্গেও হতো। সিনেমা রিলিজের আগের দিন মনে হতো, এমন বাজে সিনেমা আমি কী করে করলাম? এখন আর মনে হয় না। গত কয়েক বছর ধরে আরশাদ নিখুঁতভাবে স্ক্রিপ্ট বাছাই করে।

“আরশাদ?”

“হুঁ?”

“তুই ঠিক আছিস তো?”

আরশাদ সত্যের মতো করে মিথ্যা বলল, “হ্যাঁ, ঠিক থাকবো না কেন?”

“কারণ তুই বদলে গেছিস। একটা সময় ছিল প্রতিমাসে আমাদের দেখা হতো। অন্যান্য বন্ধুদের সাথে তোর গাজীপুরের বাংলোতে আড্ডার আসর বসতো। সেই তুই আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিলি। এক বছর পর আজ আমাদের দেখা হচ্ছে।”

অনেক সময় চুপ করে থেকে আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “Social Anxiety.”

আরিয়ান হতবাক গলায় বলল, “কী বলিস? কবে থেকে?”

“অনেকদিন হলো।”

“ডক্টর কী বলে?”

“থেরাপি নিতে বলে।”

“তুই নিসনি?”

“আরিয়ান, আমার দম ফেলার সময় পর্যন্ত নেই। সেখানে আমি কিনা ঘণ্টার পর ঘণ্টা থেরাপি সেশনে গিয়ে বসে থাকবো?”

সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তি সহজে মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে না। অপরিচিত মানুষের সঙ্গে কথা বলার কথা চিন্তা করলেও তাদের বুক কাঁপে। আরশাদের পেশাটাই হলো নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে মেশার। শুটিং সেটে চেনা-অচেনা কত মানুষ থাকে। সবার সঙ্গে মানিয়ে যে চলতে পারে, সেই সফল হয়। আরশাদ এক সময়ে সে কাজ অনায়েশে করেছিল বলে আজ সে সফল। কিন্তু এখন তার মধ্যে নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে মেশার ধৈর্য হারিয়ে গেছে।

বসার ঘরের এক কোণে চুপচাপ বসে আছে অরা। এই আরশাদের পাল্লায় পড়ে আজ তাকে এখানে আসতে হলো। একগাদা অচেনা মানুষের ভিড়ে নিজেকেই হারিয়ে ফেলছে বেচারি। অবশ্য অচেনা বললে ভুল হবে। সকলেই চেনা মুখ, ইন্ডাস্ট্রির জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রী। এরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। কারো সঙ্গে পরিচয় নেই বলে অরা একা পড়ে গেছে।

অরা হঠাৎ খেয়াল করলো একটা মেয়ে হাসিমুখে তার দিকে এগিয়ে আসছে। মেয়েটাকে অরা চেনে, অভিনেত্রী আশফা খানম। দিন কয়েক আগে অরা অবাক হয়ে খেয়াল করে তার ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছে আশফা। কেন পাঠিয়েছে কে জানে? অরা এমন তো বিখ্যাত ব্যক্তি নয় যাকে সেলিব্রিটিরা ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়ে বেড়াবে।

আশফা অরার পাশে বসে উৎফুল্ল গলায় বলল, “তুমি অরা, তাই না? আরশাদ হকের অ্যাসিস্টেন্ট?”

বিরক্তিতে গা জ্বলে গেল অরার। অ্যাসিস্টেন্ট আর ম্যানেজারের মধ্যে জমিন-আসমান পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও অনেকে তাকে আরশাদের অ্যাসিস্টেন্ট বলেই মনে করে।

অরা ভদ্রভাবে বলল, “ম্যানেজার।”

“ওহ হ্যাঁ! আমি আশফা।”

“আমি আপনাকে চিনি।”

“আমাকে আপনি বলতে হবে না। আমরা তো প্রায় সমবয়সী। তুমি আমাকে তুমি করেই বলো।”

অরা হাসিমুখে বলল, “ঠিক আছে।”

অরা মনে মনে এই মেয়েটার উদ্দেশ্য খুঁজে বেড়াতে ব্যস্ত। আরশাদের ম্যানেজার হওয়ার সুবাদে এই কয় বছরে বহু অভিনেত্রীদের সঙ্গে কথা হয়েছে তার। কখনো এমন পার্টিতে, কখনো শুটিং সেটে। প্রত্যেকে সেধে সেধে বাড়তি আহ্লাদ দিয়ে কথা বলতে এসেছে অরার সঙ্গে। কারো উদ্দেশ্য আরশাদের সিনেমায় নায়িকা হওয়ার সুযোগ খোঁজা, আর কারো উদ্দেশ্যে ভিন্ন কিছু। এই মেয়েটার উদ্দেশ্য কী কে জানে?

“আমি তোমার ছবি দেখি ফেসবুকে। বাস্তবে তুমি ছবির থেকেও অনেক বেশি সুন্দর।”

অরা কৃত্রিম হাসি নিয়ে বলল, “থ্যাংক ইউ। তুমি বাস্তবে, সিনেমার পর্দায় – দু জায়গাতেই সুন্দর।”

ইতোমধ্যেই এই কথোপকথনের প্রতি বিরক্তি ধরে গেছে অরার। এই মুহূর্তে এখান থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারলে ভালো হতো।

“থ্যাংকস। আচ্ছা, তুমি কত বছর ধরে আরশাদের সাথে কাজ করছো?”

“চার বছর।”

“Wow, you have a lot of experience.”

“Not much actually, আমি প্রতিনিয়ত শেখার চেষ্টা করি।”

“আমিও প্রায় চার-পাঁচ হলো অভিনয় করছি। একটা সময় নাটক করেছি, এবছর সিনেমা করলাম।”

“আমি তোমার সিনেমা দেখেছি।”

“তাই? কেমন লেগেছে তোমার?”

“অনেক ভালো লেগেছে।”

মনে মনে বারবার একটাই প্রশ্ন করে যাচ্ছে অরা। এই কথোপকথন শেষ হবে কখন?

আশফা হাসিমুখে বলল, “থ্যাংক ইউ। কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”

“অবশ্যই।”

“What is it like to be around Arshad all the time?”

“It’s amazing, স্যার অনেক ভালো একজন মানুষ।”

“আমার তোমাকে খুব হিংসা হয় জানো? আরশাদ আমার সারাজীবনের ক্রাশ। আমার অনেক দিনের স্বপ্ন ওর সাথে একটা দিন কাটানোর। আর তুমি আমার সেই স্বপ্নটা প্রতিনিয়ত পূরণ করছো।”

সেরেছে! মনে মনে এই ভয়টাই পাচ্ছিল অরা। এই মেয়ের উদ্দেশ্য তাহলে ‘ভিন্ন কিছু’। এই বিরক্তি আর সহ্য করা যাচ্ছে না। অরা এমন মেয়ে খুব কম দেখেছে যে জীবনে একবার হলেও আরশাদের ওপর ক্রাশ খায়নি। বেচারি যেখানেই যায়, সেখানেই একটা করে আরশাদের প্রেমে পাগল মেয়ে উপস্থিত থাকে। ভার্সিটি, পার্টি এমনকি নিজের বাড়িতে পর্যন্ত রেহাই নেই। কোনো মানে হয়?

আশফা হঠাৎ নিচু গলায় বলল, “একটা সিক্রেট কথা জিজ্ঞেস করবো? কাউকে বলবে না তো?”

“কী সিক্রেট?”

“আরশাদ কী সিঙ্গেল?”

রাগে-বিরক্তিতে তান্ডব চালাতে ইচ্ছা করছে অরার। এমন প্রশ্নের মানে কী? আরশাদ সিঙ্গেল হলে কী করবে এই মেয়ে? তার সঙ্গে প্রেমপর্ব শুরু করে দেবে? এতটাই সহজ? অরা ভাবল, এই মেয়ের সঙ্গে মজা না নিয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। যদিও মজা নেওয়াটা অরার অভ্যাসে নেই। মাঝে মাঝে অভ্যাস লঙ্ঘন করতে ইচ্ছা করে। আজ যেমন করছে।

অরা দৃঢ় গলায় বলল, “না, স্যার সিঙ্গেল না।”

নিমিষেই আশফার চোখেমুখে অন্ধকার নেমে এলো। আহারে! বেচারিকে আশাহত হতে দেখে এবার অরারই খারাপ লাগছে। আবার মনে মনে হাসিও পাচ্ছে।

আশফা নিজেকে সামলানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে বলল, “ও আচ্ছা… So who’s the lucky girl?”

অরা ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি টেনে বলল, “Sorry, it’s very confidential.”

পার্টিতে ঘন্টা দুয়েক সময় কাটিয়ে ফিরে আসছে অরা এবং আরশাদ। ড্রাইভ করছে আরশাদ, আর তার পাশের সিটে বসে থাকা অরার ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। এই ছেলের ড্রাইভিংয়ের ওপর বিন্দুমাত্র ভরসা নেই। দেখা গেল কোন সময়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগিয়ে অ্যাকসিডেন্ট বাঁধিয়ে দিয়েছে! পার্টিতে যাওয়ার সময় ড্রাইভ করেছিল অরা। নিজে ড্রাইভ করতে গেলেও অরার ভয় হয়, তবে এতটা না।

ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে আবারও ফিরে এসেছে সেই অস্থিরতা। গতকাল রাতের ঘটনা এতক্ষণ ভুলেই গিয়েছিল সে। আরশাদের সঙ্গে একান্তে গাড়িতে বসে কথাগুলো যেন আবারও মনে পড়ে গেল। আরশাদের সেই মলিন কণ্ঠস্বর, অশ্রুভরা চোখ, কুৎসিত সত্য – সবটা যেন এক নিমিষে চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মুহূর্তেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো অরার।

নাহ্! এই অস্থিরতা নিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। যে করেই হোক অস্থিরতার এই জাল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে তাকে। অরা জানে কী করলে তার অস্থিরতা কমবে। লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করলো। ভয়ঙ্কর সেই কাজটাই সে করতে যাচ্ছে। এ কাজের পর আরশাদের প্রতিক্রিয়া কী হতে যাচ্ছে কে জানে? রেগেমেগে কোনো প্রচন্ড কোনো প্রলয় যদি সে নিয়ে আসে?

অরা ভয়ে ভয়ে মুখ খুলল, “স্যার একটা কথা ছিল।”

সামনের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই আরশাদ বলল, “বলো।”

অরা ইতস্তত করে বলল, “আপনাকে একটা বিষয় জানানোর ছিল। মনে হলো আপনাকে জানানো দরকার।”

আরশাদ এবার বিরক্ত গলায় বলল, “হ্যাঁ বলো! এত সাসপেন্স ক্রিয়েট করার কী আছে?”

শুকনো ঢোক গিলে অরা বলল, “স্যার কাল রাতে আপনি ড্রাংক ছিলেন। আমি যখন আপনাকে ফিরিয়ে আনতে যাই তখন আপনি আমাকে অনেকগুলো কথা বলেছেন। আপনার হয়তো মনে নেই, কথাগুলো আপনার জীবন নিয়ে, আপনার অতীত নিয়ে। আমি শুনতে চাইনি, কিন্তু…”

বিন্দুমাত্র অবাক না হয়ে আরশাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “মনে থাকবে না কেন? মনে আছে। কেন কী সমস্যা সেটা নিয়ে?”

অরা হতবিহ্বল গলায় বলল, “স্যার আপনার মনে আছে?”

ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেখা নিয়ে আরশাদ বলল, “অরা, অজস্র পরিমাণ ড্রিংক করলেও আমি নিজের অপর কন্ট্রোল হারাই না।”

তার মানে সবটাই মনে আছে আরশাদের? নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারায়নি সে? তাহলে কেন বলল নিজের সবথেকে গভীরতম গোপন কথাটা অরাকে। অরার বিস্ময়ের সীমা রইল না।

আরশাদ শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “বহুদিন ধরে মনের ভেতর কথাগুলো জমিয়ে রেখেছিলাম। কাল কেন জানি মনে হলো, সেগুলো আর ধরে রাখতে পারছি না। ওই কথাগুলো কাউকে না বললে দমবন্ধ হয়ে মরেই যাবো। ওই মুহূর্তে মাথায় একটাই ভরসার নাম আসছিল, তোমার নাম।”

অরার বিস্ময় এবার সকল সীমা ছাড়িয়ে গেল। আরশাদ এতটাই ভরসা করে তাকে? এও সম্ভব?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here