বুকে_যে_শ্রাবণ_তার #পর্ব_১৭

0
160

#বুকে_যে_শ্রাবণ_তার
#পর্ব_১৭
#নিশাত_জাহান_নিশি

সামান্তার আচরণে ভীষণ আশ্চর্য হলো মিশাল। কারণ, সামান্তা এই প্রথম মিশালের হাত ছুঁলো! ছোঁ মেরে টেনে নিয়ে গেল মিশালের বাঁ হাতটি। একটি ব্র্যান্ডেড ওয়াচ পরিয়ে দিলো মিশালের হাতে! ঘটনার আকস্মিকতায় ‘থ’ হয়ে গেল মিশাল। সামান্তা কী সত্যিই তাকে ছুঁলো?

স্তব্ধ, নির্বিকার, নির্লিপ্ত মিশাল। হতবিহ্বল দৃষ্টি তার সীমাবদ্ধ আলতো হেসে তার পানে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকা আবেদনময়ী সামান্তার দিকে। মিশাল এর আগে কখনও সামান্তাকে এহেন পলকহীন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেনি। কখনও সামান্তার চোখের দিকে তাকিয়ে তার প্রতিচ্ছবি দেখেনি! সত্যি বলতে কলিজা জুড়িয়ে যাওয়ার মতো এই চাহনি। ভেতর থেকে রোগ নিরাময় করার মতো চাহনি। চুপিসারে সর্বনাশ করার মতো চাহনি। মূলত এই কারণেই বিষয়টা তেমন হজম হচ্ছেনা মিশালের। অতিরঞ্জিত কোনোকিছুই যে শুভ নয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো সামান্তা এখনও তার হাত ছুঁয়ে দাড়িয়ে আছে। হাত ছাড়াবার কোনো তাড়া নেই তার। যেনো হাতটা ধরেছে শুধুমাত্র ধরে রাখার জন্যই, ছেড়ে দেওয়ার জন্য নয়! খুবই শক্ত কিন্তু মসৃণ এই হাতের বেড়ি। পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের ন্যায় কিছু একটা ঘটে যাচ্ছে মিশালের সাথে! একে অঘটন বলবে না-কি ঘটনা বলবে তাই ভেবেই কুল কিনারা পাচ্ছিলনা মিশাল। তবে বুকের বাঁ পাশটায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে তার! দেহের শিরায়-উপশিরায় উষ্ণ স্রোতের ন্যায় কিছু একটা বয়ে চলছে। বুকে বইতে থাকা শ্রাবণ পেরিয়ে বসন্ত যেনো অচিরেই ধরা দিয়েছে। শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। মিশাল টের পাচ্ছে তার শরীরে এই বিস্তর সুখ সইছেনা! দম বন্ধ করা এই সুখকে দূর থেকে উপলব্ধি করাই শ্রেয়। এতে অন্তত বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকে। না পাওয়ার মাঝেও গভীর এক ভালোবাসা নিহিত থাকে।

ঝট করে মিশাল তার হাতটি সরিয়ে নিতেই দ্বিতীয় দফা মিশালকে অবাক করে দিয়ে সামান্তা পূর্বের তুলনায় আরও কঠিনভাবে টেনে নিলো মিশালের হাতটি! রাগী ভাব নিয়ে বেশ রুঢ় গলায় শুধালো,

“এতো ছটফট করছ কেন? খুব তাড়া না? হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার?”

“তোর কোনো রাইট নেই আমার অনুমতি ছাড়া আমার হাত ধরার! দিন দিন উদাসীন হয়ে যাচ্ছিস। সীমা পরিসীমা সব লংঘন করছিস।”

“জেনিয়ার মতো প্রেম-ভালোবাসা করার জন্য আমি তোমার হাত ধরিনি! ধরেছি ঘড়িটা পরিয়ে দেওয়ার জন্য। এতেই যেনো সহ্য হচ্ছেনা! গাঁয়ে ফোঁসকা ফুটছে। হাতটা নোংরা হয়ে যাচ্ছে। খুব সেনসেটিভ স্কিন তোমার তাইনা?”

“উঁহু। সেনসেটিভ আমার স্কিন নয়। সেনসেটিভ আমার মন! বাই দ্য ওয়ে, আমাকে ছুঁলে তোর হাত নোংরা হবে। তাই মূলত ছুঁতে দিচ্ছিনা! আর একটা কথা, জেনিয়াকে এর মধ্যে টেনে আনবিনা।”

“কেন আনবনা? তুমি বুঝোনা জেনিয়া তোমাকে পছন্দ করে?”

“বুঝি! তবে বুঝাতে চাইনা। এসব ছোটো খাটো বিষয় নিয়ে ভাববার সময় নেই আমার। এসব বিষয় আমার ফা’ল’তু লাগে। আমি মনে করি, তোর মতো নিকাম্মা মানুষরাই এসব বিষয় নিয়ে সময় নষ্ট করে এতো গভীরে ভাবে।”

সামান্তার হাত থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো মিশাল। একরোঁখা ভাব নিয়ে হাত থেকে ঘড়িটি খুলতে যাবে অমনি সামান্তা বাঁধ সাধল। হম্বিতম্বি হয়ে হাতটা আবারও শক্ত করে চেপে ধরল। ঝাঁজালো গলায় শুধালো,

“কী সমস্যা তোমার? সবসময় তোমার ইচ্ছেমতো সব হবে না-কি? কী ভেবেছ তোমার উপরে আর কেউ নেই?”
“না নেই! হাতটা ছাড়। সিনক্রিয়েট করিসনা প্লিজ।”
“করব! কী করবে তুমি? কী ভেবেছ তোমাকে ভয় পাই আমি? সবসময় এভাবে হম্বিতম্বি করে আমাকে দমিয়ে রাখা যাবে?”
“জোরাজোরি করতে হলে সাহিল ভাইয়ার সাথে কর৷ আমার সাথেই কেন?”

তৎক্ষণাৎ মিশালের হাতটি ছেড়ে দিলো সামান্তা! বুকের উপর হাত গুটিয়ে তেজী দৃষ্টিতে তাকালো মিশালের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন ছুড়ল,

“আমাদের মাঝখানে তুমি সাহিল ভাইকে টেনে আনলে কেন? সাহিল ভাই কী আমার প্রেমিক হয় যে তার সাথে আমি জোরাজোরি করব?”
“আমিই বা কবে তোর প্রেমিক হলাম? আমার সাথে কেন এতো জোরাজোরি করছিস?”

হকচকিয়ে উঠল সামান্তা। কথা জড়িয়ে এলো তার। কীভাবে প্রসঙ্গ পাল্টাবে তা ভাবতে লাগল। কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকার পর বহু কষ্টে প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,

“তার মানে তুমি ঘড়িটা খুলে ফেলবে?”
“হঠাৎ এসব ঘড়ি টড়ি দেওয়ার কারণ কী?”
“কারণ, তোমার হাত ফাঁকা দেখতে ভালো লাগেনা! কয়েকদিন যাবত নোটিশ করছি তোমার হাতে ঘড়ি নেই। তাছাড়া মাঝে মাঝে গিফট করাই যায়। এটা কী এমন বড়ো ইস্যু?”
“তুই কিন্তু জানিস আমি কারো গিফট নিইনা।”
“ওয়েট ওয়েট। কারো সাথে আমার তুলনা দিলে চলবে?”
“কেন? তুই কী এমন ঝাঁসি কী রাণী যে তোর সাথে কারো তুলনা যাবেনা?”
“কেন? আমিতো তোমার মনের রাণী! টের পাওনা তুমি? আমি কিন্তু চুপিসারে তোমার মনের রাজত্ব দখল করে আছি! মনের মাঝে থেকে তোমাকে শাসন করছি। দেখবে একদিন রাজাকেও দখল করে নিবো! সুযোগ পেলে আমি আমার শক্তিশালী রূপ দেখাব। জাস্ট ওয়েট এন্ড সি।”

মুখ টিপে হেসে রুম থেকে বের হয়ে গেল সামান্তা! হেঁচকি ওঠে গেল মিশালের! ঢকঢক করে গ্লাসভর্তি পানি গিলে খেলো সে। বিড়বিড় করে বলল,

“স্টুপিট গার্ল! রাজত্বসহ রাজাকে তো তুই সেই কবেই দখল করে রেখেছিস! যবে থেকে আমি নিজেকে বুঝতে শিখেছি ঠিক তবে থেকেই। টের তো তুই পাসনা। আমি ঠিকই পাই।”

______________________________

ড্রয়ার থেকে কিছু টাকা নিয়ে মিশাল হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। সেখানের কাজ বাজ সেরে হসপিটাল থেকে বের হয়ে গেল। ছেলেটির মা মিশালকে প্রাণভরে দোয়া করে দিলো। মিশালের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে গেল। মিশালকে তার ছেলের জায়গায় বসালো। তাদের মধ্যে সুন্দর একটি সম্পর্ক তৈরী হলো। খোশমেজাজে হসপিটাল থেকে বের হতেই মিশাল অপ্রত্যাশিত ভাবে সাহিলের মুখোমুখি হয়ে গেল। হম্বিতম্বি হয়ে মাত্র গাড়ি থেকে নেমেছিল সাহিল। ইতোমধ্যেই মিশালের সাথে তার দেখা। থতমত খেয়ে গেল সাহিল। মুখ লুকিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। কদাচিৎ হাসল মিশাল। প্রশ্ন ছুড়ল,

“কী ব্যাপার? তুমি এখানে? মুখ লুকাচ্ছ কেন?”
“শাট আপ। মুখ লুকোলাম কোথায়? বাই দ্য ওয়ে, তুই এখানে কী করছিস?”
“তুমি এখানে যে কারণে এসেছ, আমিও ঠিক সেই কারণেই এখানে এসেছি।”
“আজব! আমি আবার কী কারণে এখানে এসেছি?”
“কারণ কী আবার? তুমিতো রাজনকে ধরতে এখানে এসেছ! সকালে তোমার দেওয়া কাজটা সে ঠিকঠাক ভাবে করল কি-না তা জানতে!”
“মামামানে?”
“আরে আরে তোতলাচ্ছ কেন? ঠিকভাবে কথা বলো। রাজারা কথায় কথায় এতো ভয় পায় না-কি? ওয়েট আমিই রাজনের হয়ে তার কাজের আপডেট দিচ্ছি। একচুয়েলি তোমার উদ্দেশ্য ফুলফিল হয়নি! উদ্দেশ্য তখনি ফুলফিল হতো যদি না তোমার উদ্দেশ্য অসৎ হতো! ছোটো মুখে তোমাকে একটা উপদেশ দিই শোনো। এসব ছোটোখাটো কাজ করে নিজেকে অযথা নিচে না নামিয়ে তুমি বরং এমন কিছু করো যেনো লাঠিও না ভাঙে আর সাপও মরে। সামান্তার জন্যই তো আমার পেছনে লাগা তোমার তাইনা? সামান্তাকে পেতে হলে আমার পেছনে কেন তোমাকে লাগতে হবে বলো? আমি কে তোমাদের মাঝখানে আসার? বরং তুমি এমন কিছু করো যেনো সামান্তার মন তুমি জয় করতে পারো! আমার অভিজ্ঞতা বলছে এতেই তোমার কাজ হয়ে যাবে।”

মিশালের উপদেশ শুনেও সাহিলের এতোটা রাগ হলোনা যতোটা রাগ হলো মিশালের হাতে ঘড়িটি দেখে! রাগে গিজগিজ করে ওঠে সাহিল ঘড়িটির দিকে তাকালো। মিশালকে উদ্দেশ্য করে উঁচু গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“তার মানে সামান্তা তোর জন্যই ঘড়িটি কিনেছিল? ভেতরে ভেতরে এতোকিছু?”

বেশ ভাব নিলো মিশাল! শার্টের কলারটি ঝাকিয়ে শার্টের হাতা দুটি গুটালো। ঘড়িটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। বলল,

“বুঝলাম না। আমিতো কখনও সামান্তার মন জোগানোর চেষ্টাও করিনি! তবুও সামান্তা কেন আমার পেছনেই ঘুরে মরে? এর কোনো লজিক জানা আছে তোমার? আমার তো জানা নেই!”

সাহিলকে খোঁচা মেরে কথাটি বলল মিশাল! ঠোঁটে তার ক্রুর হাসির রেখা। সাহিল জেচে এসেই তার কাছে অপমানিত হচ্ছে। এর পেছনে কালেভদ্রেও মিশালের কোনো হাত নেই। মেজাজ চটে গেল সাহিলের। হাত তুলতে চাইল মিশালের গাঁয়ে! দাম্ভিকতায় আচড় পরল। তবে চড় মারতে গিয়েও থেমে গেল। হনহনিয়ে গাড়িতে ওঠে গেল। অবাক হলো মিশাল। সাহিল ততক্ষণে উর্ধ্বগতিতে গাড়ি ছেড়ে দিলো। নির্বোধ দৃষ্টিতে সাহিলের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল মিশাল। বেশ চিন্তিত হয়ে ওঠল সে। বিড়বিড় করে বলল,

“কী করতে চাইছে সাহিল ভাই?”

_______________________________

সামান্তার সামনেই অনবরত সিগারেট ফুঁকছে সাহিল! এতে সামান্তার বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে। তার স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হচ্ছে। নাক টিপে ধরে বিরক্তিকর চাহনিতে সে সাহিলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। রাত বাজে তখন দশটা প্রায়। মিশালদের বাড়ির আঙিনায় মুখোমুখি দাড়িয়ে দুজন। এই রাতে বাড়ি থেকে সামান্তাকে ডেকে এনেছে সাহিল। তার সাথে জরুরি কথা বলবে তাই। তবে এখানে জরুরি কথা কম হচ্ছে কিন্তু ক্ষতিকারক কাজ বেশি হচ্ছে। এক পর্যায়ে সামান্তা অসহ্য হয়ে গেল। তটস্থ গলায় শুধালো,

“এই তোমার জরুরি কথা? তুমি এখানে আমার ক্ষতি করার জন্য ডেকে এনেছ?”

তৎক্ষনাৎ সিগারেটটি পা দ্বারা পিষে ফেলল সাহিল। নাকমুখ থেকে ধোঁয়া বের করে সোজা হয়ে সামান্তার মুখোমুখি দাড়ালো। নিজেকে যথেষ্ট শান্ত করার চেষ্টা করল। সামনের চুলগুলো টেনে ঠিক করল। কয়েক দফা অস্থির শ্বাস ফেলে ধীরস্থির গলায় বলল,

“আমি এখন যা যা প্রশ্ন করব তার ঠিকঠাক উত্তর দিবি।”
“মানসম্মত প্রশ্ন হলে নিশ্চয়ই ঠিকঠাক উত্তর দিব।”
“মিশালের সাথে তোর কীসের সম্পর্ক?”
“কেন তুমি জানোনা? স্মৃতিশক্তি কী লোপ পেয়েছে তোমার? মাথায় আঘাত করে দেখব?”
“আমাকে রাগাসনা সামান্তা। আমি এক্সঅ্যাক্ট আনসারটা জানতে চাইছি!”
“বলতে হবে কেন? বুঝোনা তুমি? কাজিনের চেয়েও মিশাল ভাই আমার কাছে অনেক বেশী স্পেশাল! শুনতে চাইছ যেহেতু তাই শুনিয়েই দিলাম। নেক্সট টাইম আমাদের সম্পর্ক নিয়ে তুমি কোনো কথা বলতে আসবেনা। আমি কিন্তু প্রশ্রয় দিবনা।”

সম্পূর্ণ কথা শেষ করে দম নেওয়ারও সময় পেলোনা সামান্তা। ঠাস করে শক্ত হাতের চড় পরল তার গালে!

#চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here