#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ৬
#আদওয়া_ইবশার
নাহিদের পরীক্ষার আর মাত্র একদিন সময় আছে। এরপরই দীর্ঘ চার বছরের ফার্মাকোলোজি কোর্সের অবসান ঘটবে। ছোট বেলা থেকেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবার স্বপ্ন রেখে নাহিদ স্বপ্ন দেখতো ফার্মাসিস্ট হবার। এই শব্দটার প্রতি ভিষণ দূর্বল ছিল ছেলেটা। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে দিন-রাত এক করে পড়াশোনা করেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রিয় বিষয়ে পড়ার সুযোগ পাবার আশায়। ভাগ্য ফেরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হলেও পছন্দের বিষয়টা পায়নি সে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে সুযোগ হয়েছিল তার। কিন্তু যে বিষয়ে মন টানেনা সেই বিষয় নিয়ে চর্চা করার যতই সুযোগ আসুক একজন স্বপ্নবাজ ছেলের পক্ষে সেই সুযোগ গ্রহণ করা সম্ভব হয় না কখনো। নাহিদের ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছিল। মাইগ্রেশন চালু রেখেও যখন কাঙ্ক্ষিত বিষয়টা ভাগ্যে আসেনি তখন অনেকটাই ভেঙ্গে পরেছিল নাহিদ।একটা সন্তান যখন কিছু একটা নিয়ে জীবনে সফল হবার স্বপ্ন দেখা শুরু করে। তখন সেই স্বপ্নটা শুধু সন্তানের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনা। ছড়িয়ে পরে বাবা-মায়ের মাঝেও। নাহিদের ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছিল। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বপ্ন পূরণের সুযোগ না পেয়ে নাহিদ ভেঙ্গে পরলেও আশাহত হয়নি তার বাবা-মা। সুদূর রাজশাহী থেকে ঢাকায় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ফার্মেসি অনুষদে ব্যাচেলর ডিগ্রী অর্জনের জন্য পাঠিয়ে দেন ছেলেকে। পারিবারিক অবস্থানের কথা মাথায় রেখে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অত্যধিক খরচের কথা ভেবে প্রথমে রাজি হয়নি নাহিদ। বাবা সাইদুর রহমান বনবিভাগের সাধারণ একজন কর্মকর্তা। মা শাহিনূর একটা প্রাইমারি স্কুলের সহকারী শিক্ষক। মা-বাবার স্বল্প আয়ে নাহিদ’রা তিন ভাই-বোন সহ পাঁচ সদস্যের পরিবারটা সচ্ছলতার সাথে দিন পার করতে পারলেও বুঝতে পেরেছিল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চালানো টা বাবা-মায়ের পক্ষে একটু কঠিন হয়ে যাবে। কিন্তু বাবার যুক্তির কাছে পরাজিত হয়ে পাড়ি জমাতে হয়েছিল তাকে অচেনা শহরে স্বপ্নকে পুঁজি করে। সাইদুর রহমান ছেলের আপত্তির বিষয়টা জানতে পেরে ছেলেকে নিজের পাশে বসিয়ে একদিন বলেছিল,
‘আমি একটা ফল গাছ কিনে এনে বাড়ির আঙ্গিনায় রূপন করলাম। গাছটার যত্নে একটুও ক্রটি রাখলাম না। নিয়ম করে গাছের গুঁড়িতে সকাল -বিকাল পানি দিলাম। কিছুদিন পর পর ছেটে আগাছা মুক্ত করে সুন্দরভাবে বাড়তে দিলাম গাছটাকে। সেই গাছটা বড় হয়ে একসময় কি আমাকে ফল দিবে না?’
উত্তরে নাহিদ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়েছিল। ছেলের সম্মতিসূচক আচরণ পেয়ে সাইদুর রহমান পূণরায় বলেছিল,
‘মনে কর তুই আমার একটা ফল গাছ। তোকে এখন আমি যত্ন করে বড় করছি। জৈব সার, পানি হিসেবে টাকা দিচ্ছি সৎ পথে খরচ করে জ্ঞান অর্জন করার জন্য। কঠোর পরিশ্রমের পর মেধা অন্বেষণ শেষে যত্ন দিয়ে বড় করে তোলা গাছের ফল হিসেবে তুই আমাকে সফলতা দিবি। আমি যেন গর্ব করে বুক ফুলিয়ে মানুষের কাছে বলতে পারি আমার ছেলে একজন সফল ফার্মাসিস্ট। আমি আর তোর মা কখনো সেভিংস এর কথা ভাবি না। না ভাবি তোর ছোট দুইটা ভাই-বোনের কথা। শুধু ভাবি তোর কথা। কারণ আমাদের বিশ্বাস তুই জীবনে সফল হয়ে একদিন আমাদের অবসর দিয়ে ছোট ভাই-বোন দুটোর দায়িত্ব নিবি। মানুষ বলে না ”আশায় বাঁচে চষা”। আমি আর তোর মা হলাম সেই চাষা। আর তুই আমাদের এই জরাজীর্ণ পৃথিবীর বুকে এক টুকরো উর্বর জমির ফসল।পারবিনা আমাদের এই আশাটা পূরণ করতে?’
বাবার কথা গুলো শুনে সেদিন নাহিদ বিমূঢ় হয়ে যায়। অবাক দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে থাকে বাবার মুখের দিকে। সেদিন থেকেই একটু একটু করে উপলব্ধি করতে পারে পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে বাবা-মা, ভাই-বোনের প্রতি তার দায়িত্বটুকু। ছোট্ট একটা গল্পের ছলে খুব ভালো করেই বুঝিয়ে দেয় সাইদুর রহমান ছেলেকে তার দায়িত্ব। সাথে এটাও বুঝিয়ে দেয় তারা বাবা-মা হিসেবে কতটা আশাবাদী বড় সন্তানের প্রতি। এরপর নাহিদ আর একটা বাক্যও উচ্চারণ করেনি। বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তকে সম্মান দিয়েই চিরচেনা শহর ছেড়ে পাড়ি জমায় ঢাকার উদ্দেশ্যে। বাবার বলা কথা গুলো প্রতিটা মুহূর্তে স্বরণে রেখে লেগে পরে স্বপ্ন জয়ের যুদ্ধে। এখানে এসেই পরিচয় হয় লাবিব, রাফিন, নাজিমের সাথে। সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বভাবের চারজন যুবক সময়ের সাথে সাথে হয়ে ওঠে একে অপরের প্রিয় বন্ধু। প্রথম কয়েক মাস হোস্টেলে থাকলেও বেশিদিন হোস্টেলের নানান প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে পারে নি তারা কেউ। পরবর্তীতে চারজন একসাথেই খিলক্ষেত আবাসিক এলাকায় দুই রুমের ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। এরপর থেকেই আরও গাঢ় হয় তাদের চারজনের বন্ধুত্বের বন্ধন।
রাত প্রায় আনুমানিক এগারোটা হবে। নাহিদ, লাবিব, রাফিন তিনজনই এখনো বইয়ের মাঝে মুখ ডুবিয়ে আছে।মাথায় চিন্তা একটাই তাদের যে করেই হোক একদিনের ভিতর সম্পূর্ণ সিলেবাস রিভাইস দিতে হবে। রেজাল্ট ভালো না হলে চারটা বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম, অর্থ, সময়, স্বপ্ন সব কিছুই জলে যাবে।এসবের মাঝে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিন্তা মাথায় নিয়ে রুম জুড়ে পায়চারি করছে নাজিম। বন্ধুদের মাথায় কিভাবে ভালো রেজাল্ট করতে পারবে এমন চিন্তা থাকলেও তার মাথায় একটাই চিন্তা, কিভাবে তার দেড় মাস বয়স হওয়া প্রেমটাকে টিকিয়ে রাখবে। গতকাল নাহিদকে খ্যাপানোর ফলস্বরূপ তার কথা অনুযায়ী প্রাণ প্রিয় বন্ধুদের ইজ্জতে হাত না দিলেও একদিনের জন্য তিনজনের ফোনটাই নিজের জিম্মাই নিয়ে নেই। পরিবারের কোনো সদস্য থেকে ফোন আসলে নিজের হাতে রেখেই ফোন লাউডে রেখে কথা বলতে দেয়। যখনই তিন বন্ধুর তথাকথিত গার্লফ্রেন্ডের কল এসেছে। ঠিক ততবারই কেটে দিয়েছে নাহিদ। ফলস্বরূপ আজ নাজিমের গার্লফ্রেন্ড কল না ধরার অপরাধে ব্রেকআপের মতো চূড়ান্ত একটা সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে তাকে। আর এই ব্রেকআপ শব্দটা শোনার পর থেকেই নাজিমের অবস্থা করুণ। এমনিতেই বেচারার কপালে গার্লফ্রেন্ড জুটেনা। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে যাও একটা ঝুটিয়েছে সেটাও পাখি খাঁচা ছেড়ে উড়াল দেবার পথে। সন্ধ্যা থেকে এখন পযর্ন্ত নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছে গার্লফ্রেন্ডের সাথে প্যাচআপ করার। কিন্তু তাকে সেই সুযোগটাই দিচ্ছেনা। যত গুলো যোগাযোগ মাধ্যম আছে সব গুলো থেকেই একে একে ব্লক মেরে যাচ্ছে ছেলেটাকে। তিন বন্ধুই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে নাজিমের অসহায় অবস্থা লক্ষ্য করে মিটিমিটি হাসছে। অবশেষে রাফিন না পেরে বলে ওঠে,
‘কি রে শা’লা! তোর টয়লেট আটকে গেছে না কি? মুখটাকে এমন কোষ্ঠকাঠিন্য রোগীর মতো করে রাখছিস ক্যান?’
রাগে ফুসতে ফুসতে বন্ধুর দিকে তাকাল নাজিম। দেখতে পেল তিনজনই ঠোঁট টিপে হাসছে। মুহূর্তেই চটে গেল নাজিম। তিরিক্ষি মেজাজে বলে ওঠল,
‘শা’লা তোদের মতো মিরজাফর আমি জীবনে দেখি নাই। আমার দুঃখ দেইখা তোরা হাসতেছিস। মনে রং লাগছে না?’
‘আগুন লাগাইলো নাহিদ্দেয়া আগুন লাগাইলো।’
নাজিমের কথা শেষ হবার পর পরই লাবিবের গলা ছেড়ে এমন গান শুনে তিন বন্ধু একত্রে অট্টহাসিতে মেতে ওঠে। চার বন্ধুর এমন হাসি-আনন্দের মাঝেই নাহিদের ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনের স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করে ওঠে ‘মা’ লিখা শব্দটা। সাথে সাথেই ওঠে দাঁড়ায় নাহিদ। বন্ধুদের থেকে সরে গিয়ে ফোন রিসিভ করে কানে ঠেকায়। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে মমতাময়ী মায়ের কন্ঠ নিঃসৃত আওয়াজ,
‘কেমন আছিস বাবা?’
মুচকি হাসে নাহিদ। দিনের ভিতর না হলেও দশবার কল আসে মায়ের নাম্বার থেকে। প্রতিবারই ফোন রিসিভ করার সাথে সাথেই এই একটা কথা সবার আগে ইথারে ভেসে আসে।,
‘মা, সন্ধ্যায় না বললাম ভালো আছি। এখন আবারও জিজ্ঞেস করছো কেমন আছি!দিনের ভিতর এই এক কথা কতবার জানতে হয় তোমার বলো তো?’
‘যতবার আমি আমার ছেলের কাছে ফোন করব ততবার জানতে চাইবো এই কথা। তোর উত্তর দিতে এতো পরিশ্রম লাগে কেন শুনি? যে মায়ের সন্তান দূরে থাকে সে জানে প্রতি মুহূর্তে সন্তানের জন্য কেমন চিন্তা হয়। প্রতিটা সেকেন্ডে সেকেন্ডে মনটা সন্তানের চিন্তায় কেমন ছটফট করে। তুই বুঝবি কি এসবের?’
‘এতো রেগে যাচ্ছো কেন? আমি তো এমনি মজা করে বললাম। আচ্ছা বাদ দাও এসব। খেয়েছো? বাবা কোথায়?’
ছেলের কন্ঠে একটু আহ্লাদের আভাষ পেয়ে বুঝদার মায়ের মনটা যেন মুহূর্তেই বাচ্চাসুলভ হয়ে উঠল। অভিমানে ঠাঁসা কন্ঠে বলল,
‘আমি খেলেই কি আর না খেলেই কি? ছেলে তো এখন বড় হয়ে গেছে। তাকে যেখানে নিজের ভালো মন্দের কথা জিজ্ঞেস করলেই বিরক্ত হয় সেখানে আমার খাওয়া না খাওয়ার খোঁজ জানার কোনো প্রয়োজন আছে তার?’
ঠোঁট কামড়ে কতক্ষণ চুপ থেকে নাহিদ বলল,
‘মাঝে মাঝে না বাবার প্রতি খুব মায়া হয় আমার জানো? তোমার মতো এমন একটুতেই অভিমানে গা ভাসানো একজন মানুষকে আমার শান্তশিষ্ট বাবা’টা এতো বছর যাবৎ কিভাবে সহ্য করছে! ভাবতেই তাজ্জব বনে যায় আমি।’
ছেলের এমন কথায় এবার যথেষ্ট রাগ হয় শাহিনূরের। শত মাইল দূরে থেকেও নাহিদ ঠিকই বুঝে নেই তার মা’টা রেগে মুখ ভার করে বসে আছে চুপচাপ। দিনের অর্ধেক সময় বাচ্চাদের সাথে থেকে থেকে মা’ও কেমন দিন দিন বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে! কথাটা ভেবেই হেসে ফেলে নাহিদ। মা’কে আর না রাগিয়ে আদুরে স্বরে বলে,
‘ও মা! কয়েকদিন ধরে তোমার হাতের রান্না খুব মিস করছি। বুয়ার হাতের রান্না খেতে খেতে এখন মুখের রুচিই চলে গেছে।কতদিন ধরে তোমার কোলে মাথা রাখি না তার হিসাব রেখেছো? রাখবে কেন? আমি দূরে তো কি হয়েছে? আরও দুই ছেলে-মেয়ে তো আছেই তোমার কাছে।’
মান-অভিমান সব ধুয়ে মুছে হঠাৎ করেই শাহিনূরের চোখ দুটো ছলছল করে ওঠল ছেলের কথায়। তার ছেলেটা কি জানে, নাড়ী ছেড়া ধনটাকে এতো দূরে রেখে শাহিনূর নিজেও যে শান্তিতে থাকতে পারে না! না পারে ভালো কিছু রান্না করলে মুখে দিতে। খেতে বসলেই মাথায় আসে সবার আগে ছেলেটা খেল কি না এই চিন্তা। ঘুমাতে গেলেও এটাই চিন্তায় আসে ছেলেটা এখনো রাত জেগে আছে না কি ঘুমিয়েছে।’
‘অনেক দিন হলো তো আসিস না। এই বৃহস্পতিবার চলে আয়! শুক্রবার সারা দিন থেকে না হয় শনিবার আবার চলে যাবি!’
‘ভুলে গেছো কাল দিন পরই যে আমার এক্সাম? এই মুহূর্তে ঢাকা থেকে রাজশাহী যাওয়া আমার পক্ষে পসিবল? দোয়া করো ভালোই ভালোই এক্সাম গুলো শেষ হোক। এরপরই তোমার ছেলে ঠিক তোমার কোলে ফিরে যাবে।’
চলবে……