#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ১৮
#আদওয়া_ইবশার
লাবিব রাফিনের কথা কিছুই বুঝতে পারেনা পাপড়ি। চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকে দুজনের দিকে। পাপড়ির অভিব্যক্তি দেখে রাফিন পূণরায় বলে,
“নিশ্চই বুঝতে পারছোনা কি বলছি! সবটাই বুঝিয়ে বলব। তার আগে চলো কোথাও একটু বসি। অনেক লম্বা কাহিনী ঘটে গেছে। পুরোটা বিশ্লেষণ করতে সময় লাগবে একটু।”
কিছুক্ষণ ভাবে পাপড়ি। হাতে থাকা পিঠার বক্সের দিকে তাকায়। বেশিক্ষণ থাকলে পিঠা গুলো হয়তো নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এদিকে লাবিবদের মুখের উপর না’ও বলে দিতে পারেনা। বিষয়টা খারাপ দেখায়। তাছাড়া ঘটনা নিশ্চয়ই নাহিদ কেন্দ্রিক। না হয় তাকে জানানোর জন্য হয়তো ওদের প্রয়োজন হতনা। কৌতূহল সৃষ্টি হয় পাপড়ির। মাথা নাড়িয়ে সায় জানায় রাফিনের কথায়। আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে দুই মিনিটের পায়ে হাঁটা পথ অতিক্রম করে একটা কফি শপে গিয়ে বসে। তিনজনের জন্য তিনটা কফির অর্ডার দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলতে শুরু করে রাফিন,
“গত বৃহস্পতিবার ছুটি পেয়ে অনেক দিন পর নাহিদের বাসায় এক হয়েছিলাম চার বন্ধু। অর্ধেক রাত পযর্ন্ত আড্ডা দিয়ে ফজরের আগ মুহুর্তে ঘুমিয়েছিলাম। সকালে না কি নাজিমের ফোনের শব্দে আমাদের আগেই ঘুম ভেঙ্গে যায় নাহিদের। ফোনটা এসেছিল নাদিয়ার নাম্বার থেকে। বোনের নাম্বার থেকে নাজিমের ফোনে কল আসায় একটু ভাবনায় পরে যায় নাহিদ। কৌতূহল বসত ফোন ঘেটে নাদিয়ার সাথে নাজিমের অনেক গুলো ম্যাসেঞ্জারে কনভার্সেসন দেখতে পায়। ম্যাসেজ গুলো দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে দুজনের মাঝে গভীর প্রেমের সম্পর্ক। হুট করে এমন কিছু একদম অপ্রত্যাশিত ছিল নাহিদের জন্য। বিষয়টা মানতে না পেরে ঘুমন্ত অবস্থা থেকেই নাজিমকে টেনে তুলে জেরা করতে শুরু করে। কথার এক পর্যায়ে নাজিমের গায়ে’ও হাত তুলে নাহিদ। ওদের হুড়োহুড়ির শব্দেই ঘুম ভাঙ্গে আমাদের। কাঁচা ঘুম থেকে ওঠে ওদের এই অবস্থা দেখে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারিনি আমরা। পরে ঘটনার বিস্তারিত জানার পর আমরাও কম অবাক হয়নি। নাজিমের সাথে যে নাদিয়ার কোনো সম্পর্ক আছে বিষয়টা আমরা কেউ জানতাম না। এরপর যা ঘটে গেল কি আর বলব। তোমার খ্যাঁপা ষাড় একদম দিকশূণ্য হয়ে যেভাবে পেরেছে সেভাবেই আঘাত করেছে নাজিমকে। এক পর্যায়ে নাজিম’ও চুপ করে না থেকে পাল্টা আঘাত শুরু করে। নাহিদের এক কথা,নাজিমের মতো মেয়েবাজ একটা ছেলে তার বন্ধু হতে পারে ঠিক আছে। হাজারটা মেয়ের সাথে তার রিলেশন থাকতে পারে। এতেও নাহিদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কিন্তু তার বোনের দিকে কোন সাহসে নজর দিল সে! বন্ধু হয়ে বন্ধুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা কেন করল। প্রথমে নাজিম শান্তভাবে নাহিদকে বুঝানোর চেষ্টা করলেও এক পর্যায়ে সে নিজেও পাল্টা নাদিয়ার দিকে আঙুল তুলে। নাহিদকে ব্লেম দিয়ে বলে, “আমি না হয় খারাপ। মেয়েবাজ বখাটে একটা ছেলে। কিন্তু তোর বোন কোন ধোয়া তুলসী পাতা? এতোই যখন ভালো তোর বোন তাহলে আমি বললেই কেন সম্পর্কে জড়াবে আমার সাথে? এখানে যদি কেউ দোষী হয়ে থাকে তাহলে আমি একা না, তোর বোনও সমান দোষী। আমাকে শাসানোর আগে তোর বোনকে সামাল দে।” ব্যাস! তোমার ওনাকে আর কে আটকায়? সাথে সাথে রওনা হয়ে যায় রাজশাহীর উদ্দেশ্যে। এতোক্ষনে হয়তো বাচ্চা মেয়েটার উপর কেয়ামত সৃষ্টি করে ফেলেছে।”
ঘটনা বিস্তারিত শুনে বিস্ময়ে বাকহারা পাপড়ি। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে রাফিনের মুখের দিকে। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে প্রশ্ন করে রাফিনকে,
“আমি নিজেও জানতাম আপনারা অনেক ভালো বন্ধু। নাজিম ভাইয়ের চরিত্র কেমন সেটা আমি জানিনা। তবে আপনাদের কথা অনুযায়ী সত্যিই যদি নাজিম ভাই প্লেবয় টাইপ হয়ে থাকে তবে ওনি কিভাবে নিজের প্রাণপ্রিয় বন্ধুর বোনের দিকে নজর দেয়? এদিক থেকে ভাবলে কিন্তু আমার মনে হয় ভাই হিসেবে আপনাদের বন্ধুর এমন রিয়েক্ট করা যুক্তিসঙ্গত। কোনো ভাই নিশ্চয়ই চাইবেনা তার বোন কোনো মেয়েবাজ ছেলের পাল্লায় পরুক। হোক সেই ছেলে নিজের যতই ভালো বন্ধু। বোনের ভালোর কাছে এমন বন্ধুত্ব কিছুই না।
“প্লেবয় টাইপ ছেলেরা কি কখনো কোনো মেয়েকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসতে পারেনা?”
পাপড়ির কথা শেষ হতেই প্রশ্ন ছুড়ে দেয় লাবিব। ধোয়া উঠা কফির মগেদ দিকে দৃষ্টি দিয়ে একটু রয়েসয়ে জবাব দেয় পাপড়ি,
“অবশ্যই পারে।”
“তাহলে নাহিদের মতো তোমারও কেন মনে হচ্ছে নাজিম নাদিয়ার সাথে ভালোবাসার নাটক করে ঠকাচ্ছে তাকে? হতেও তো পারে সে সত্যিই নাদিয়াকে ভালোবাসে!”
এবার একটু বিরক্ত হয় পাপড়ি। তাকে এভাবে আসামীর মতো জেরা করার কোনো মানে হয়? তাদের বন্ধু কাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসে আর কাকে বাসেনা এটা পাপড়ি কিভাবে জানবে? অদ্ভুত সব প্রশ্ন! বিষয়টা বিরক্তিকর ঠেকলেও যথেষ্ট নমনীয় কন্ঠে জবাব দেয় পাপড়ি,
“এটা তো আমার জানার কথা না ভাইয়া। নাজিম ভাই নাহিদ দুজনেই আপনাদের ভালো বন্ধু। কে কাকে ভালোবাসে সে তো আমার থেকে আপনাদেরই ভালো জানার কথা।”
পরিস্থিতি অন্য দিকে ঘুরে যাচ্ছে বুঝতে পেরে দুজনকেই থামিয়ে দেয় রাফিন। পাপড়িকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“এই মাথা মোটার কথায় কিছু মনে করোনা বোন। ওর কথা বাদ দাও। তবে এটা সত্যি নাজিম নাদিয়াকে সত্যিই ভালোবাসে। এমন একটা পরিস্থিতির কথা ভেবেই বিষয়টা এতোদিন আমাদের কাওকে জানাতে ভয় পাচ্ছিল নাজিম। এতোদিন ওর যতগুলো মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল সবটাই আমাদের জানা। জাস্ট ফোনেই কথা হতো সবার সাথে। একটা মানুষের চোখ দেখেই বোঝা যায় তার ভিতরে আসলে কি চলছে। তোমার জন্য আমরা নাহিদের চোখে সবসময় যেমন ভালোবাসা দেখেছি তেমনটাই গতকাল থেকে নাজিমের চোখে দেখেছি। কালকের ঘটনার পর থেকে নাজিমের পরিস্থিতিও খুব একটা ভালো না। ছেলেটা একদম ভিতর থেকে গুড়িয়ে গেছে। একদিকে ভালোবাসা হারানোর ভয় অপরদিকে বন্ধু হারানোর ভয়। আমরা ছেলেরা কিন্তু খুব সহজে কাঁদিনা পাপড়ি। নাজিমের সাথে নাহিদ লাবিবের বন্ধুত্বটা ভার্সিটি লাইফ থেকে শুরু হলেও ওকে আমি চিনি সেই কলেজ লাইফ থেকে। সবসময় হাসিখুশি থাকা ছেলেটাকে আমি কাল থেকে কাঁদতে দেখেছি। বারবার আমাদের কাছে একটা কথায় বলছে, দরকার পরলে বন্ধুর জন্য সে জীবনের প্রথম ভালোবাসা বিসর্জন দিবে। কিন্তু তবুও যেন নাহিদ তাকে দূরে ছুড়ে না দেয়। ছয় মাসের ভালোবাসার জন্য পাঁচ বছরের বন্ধুত্ব নষ্ট হোক এটা সে চায়না।”
“ভালোবাসা ছয় মাসের হোক বা ছয় দিনের। বন্ধুত্বের জন্য সেটা এতো সহজে বিসর্জন দিতেও রাজি ওনি? এতোই স্বস্তা ভালোবাসা? বেষয়টা আমার কাছে কেমন যেন ঠেকছে ভাইয়া। প্লিজ কিছু মনে করবেন না। আমার মাথায় যা এসেছে তাই বলে দিয়েছি। আসলে আমার কাছে ভালোবাসার সজ্ঞাটা অন্যরকম। পরিস্থিতি যতই খারাপ হোক। তাই বলে মাঝ পথে ভালোবাসার মানুষটার হাত ছেড়ে দেবার কথা ভাবতে পারিনা নিশ্চয়ই!”
পাপড়ির কথা গুলো শুনে অল্প হাসে রাফিন। ঠান্ডা হয়ে আসা কফির কাপে অল্প ঠোঁট ছোঁয়ায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“তোমার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু প্রকৃত বন্ধুত্বের বন্ধন কতটা দৃঢ় হতে পারে জানো তো? আচ্ছা বাদ দাও সে কথা। তোমাকে একটা প্রশ্ন করি। ধরো তোমার আর নাহিদের পরিবার তোমাদের দুজনের সম্পর্কটা মেনে নিলনা। নিরুপায় হয়ে নাহিদ তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবার কথা ভাবলো। তখন তুমি কি করবে? নাহিদের দুদিনের ভালোবাসার কাছে কি জন্ম থেকে পাওয়া বাবা-মা’র ভালোবাসাকে তুচ্ছ করে দিবে? না কি সবটা ভাগ্যের উপর ছেড়ে পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের পরিবারকে বুঝানোর চেষ্টা করবে?”
প্রসঙ্গটা এভাবে নিজের দিকে ঘুরে যাওয়ায় একটু অস্বস্থিতে পরে যায় পাপড়ি।নড়েচড়ে বসে ধীরস্থির ভাবে উত্তর দেয়,
“নাহিদের ভালোবাসা আমার কাছে যেমন মূল্যবান। তার থেকেও দ্বিগুণ মূল্যবান বাবা-মায়ের ভালোবাসা। বাবা-মা সেই ছোট থেকে আমাকে আদর-যত্নে বড় করে আজ এই পযর্ন্ত এনেছে বলেই আমি নাহিদকে পেয়েছি। ওনারা যদি আমাকে এই পৃথিবীর আলো না দেখাতো বুকে আগলে যত্ন করে বড় না করতো। তাহলে আপনাদের বন্ধুকে পেতাম না। সেই দিক থেকে ভেবে অবশ্যই আমি বাবা-মায়ের মনে কষ্ট দিয়ে শুধু আপনার বন্ধুর ভালোবাসার মূল্য দিতে তার হাত ধরবনা।”
মুচকি হাসে রাফিন। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলে,
“বাবা-মা আমাদের জন্ম দিয়ে আদর-যত্নে লালন করে মৃ’ত্যু’র আগ পযর্ন্ত আমাদের মাথার উপর ছায়া হয়ে থাকে। আর একজন প্রকৃত বন্ধু ঢাল হয়ে পাশে থেকে সমস্ত প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে সামনের দিকে অগ্রসর হবার স্পৃহা জোগায়। বাবা-মায়ের নিরাপদ আশ্রয় থেকে বেড়িয়ে যখন আমরা এই অস্থিতিশীল সমাজের ঝাতাকলে পৃষ্ঠ হয়ে বেঁচে থাকার অনুপ্ররেণা হারিয়ে ফেলি। তখন বন্ধু নামক মানুষ গুলোই ভরসার হাত রাখে কাধে। নতুন করে বেঁচে থাকার উদ্যম জোগায়। একটা মেয়ের ভালোবাসার কাছে যদি বাবা-মায়ের ভালোবাসা ঠুনকো না হতে পারে। তাহলে বাবা-মায়ের পর সবথেকে আপন বন্ধুর ভালোবাসা কিভাবে ঠুনকো হয়? কেন পারবেনা একটা ছেলে বন্ধুর জন্য ভালোবাসা বিসর্জন দিতে? খাঁটি বন্ধু যে কারো ভাগ্যে জুটেনা পাপড়ি। এটা পেতে হলেও ভাগ্য লাগে। যে মানুষ গুলো ভাগ্য করে সেই বন্ধুত্ব পেয়েও ধরে রাখতে পারেনা তার থেকে হতভাগা আমার মতে এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। এইযে আমাদের চারজনকে দেখছো না! আমরা চারজনকে চার দেহের এক আত্মা বললেও ভুল হবেনা। আমরা এই চারজন মানুষ ছাড়া বাইরের কেউ জানেনা আমরা একে অপরের কাছে ঠিক কতটা মূল্যবান। তবে আর একটা কথা বলি!নাজিম মুখে যতই বলোক বন্ধুর জন্য প্রেমিকার ভালোবাসা বিসর্জন দিতে রাজি সে। কিন্তু আমার মনে হয় এটা পারবেনা সে। সর্বোচ্চ মুখে স্বীকার করবে ভালোবাসেনা। তবে অন্তরে ঠিকই সে থাকবে। আমরা ছেলেরা পরিবারের কথা ভেবে আপন মানুষের কথা ভেবে অনেক কিছুই হাসিমুখে ত্যাগ করতে পারি। পরিবর্তে যে আমাদের বুকের ভিতর কতটা রক্তক্ষরণ হয় এটা কেউ দেখেনা। মৃ’ত্যু’র আগ পযর্ন্ত এক অ’দৃ’শ্য আগুনে পু’ড়ে অঙ্গার হই আমরা। তবুও কারো কাছে মুখ ফোটে বলিনা নিজের দুখের কথা। নাজিম’ও হয়তো সে পথের সারথীই হবে।”
কথাগুলোর মাঝখানে একটু বিরতি নেয় রাফিন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে পাপড়ির দিকে তাকিয়ে অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করে। নিরব পাপড়ি মাথা নত করে আছে। রাফিনের মতো করে এতোটা গভীরভাবে হয়তো সময় কথা গুলো ভেবে কিছু বলেনি। যার কারণে এতোটা সহজ ভাবে বলে দিতে পেরেছিল তার কথা গুলো। পরিবর্তে রাফিনের যুক্তিগুলো শুনে বোবা হয়ে গেছে সে। অল্পক্ষণ চুপ থেকে পূণরায় রাফিন বলে,
“সে যায় হোক। অনেক কথা বলে ফেলেছি। আমার কথা গুলো যদি তুমি বুঝে থাকো তাহলে তোমার কাছে একটা রিকোয়েস্ট থাকবে বোন। আমার একটু হলেও বিশ্বাস আছে নাহিদ আর কারো কথা না শুনলেও তোমার কথা একটু হলেও বোঝার চেষ্টা করবে। আমরা কেউ কাল থেকে ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারছিনা। সে ভাবছে নাদিয়ার সাথে নাজিমের সম্পর্কটা আমরা আগে থেকেই জানতাম। যে কারণে ভুল বুঝে সে আমাদের সাথেও যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তুমিই আমাদের শেষ ভরসা। তুমি একটু নাহিদকে নিজের মতো করে বোঝানোর চেষ্টা করো প্লিজ। ওকে বলো এই সামান্য একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেন আমাদের এতো বছরের বন্ধুত্বটাকে নষ্ট করে না দেয়।”
চলবে……