হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া #পর্বঃ১৯ #আদওয়া_ইবশার

0
127

#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ১৯
#আদওয়া_ইবশার

গোধূলিয়া বিকেল। দীপ্তিময় সূর্যটা সোনালী আলো ছড়িয়ে একটু একটু করে ঢলে পরছে পশ্চিম আকাশের বুকে। জানালার পাটাতনে বসে আপন ভাবনায় বিভোর পাপড়ি। চোখের সামনে নাম না জানা একঝাঁক পাখির দল কলরব তুলে উড়ে যাচ্ছে নিজ নীড়ে। দৃষ্টিসীমায় থাকা গাছের পাতা গুলো উড়ছে তিরতির বাতাসের দাপটে। মাঝে মাঝে পাপড়ির বড্ড ইচ্ছে হয়, কোনো এক গোধূলি বিকেলে এই কোলাহলপূর্ণ পৃথিবীকে বিদায় দিয়ে পাখির ডানায় ভর করে উড়ে যেতে অচিনপুরের রাজ্যে। যে রাজ্যের সর্বত্র জুড়ে থাকবে শুধু শান্তি আর শান্তি। থাকবেনা কোনো দুঃখ-হতাশা, অপ্রাপ্তির বঞ্চনা আর না পাওয়ার বেদনা। কিন্তু আফসোস! ইচ্ছে গুলো আজীবন অধরায় থেকে যায়। মনের মাধুরী মিশিয়ে কল্পরাজ্য তৈরী করার সাধ থাকলেও যে সে রাজ্যে পারি দেবার সাধ্য নেই। হতাশায় ডুবে গিয়ে স্বপ্নালো চোখ দুটো বুজে নেয় সহসা। পূণরায় নেত্রপল্লব আলগা করে তাকায় মায়াবী প্রকৃতির পানে। দৃষ্টি স্থির করে অনঢ় সূর্যের প্রতিবিম্বের দিকে। মনে হয় সূর্যটাও বুঝি তাচ্ছিল্য ভরে হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। কটাক্ষ করে বলছে,

“হতাশায় জর্জরিত এই নশ্বর পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে তুমি অচীনপুরের রাজকন্য হবার স্বপ্ন দেখো মেয়ে! রূপকথার রাজ্য তোমার জন্য না। যতবার চোখের তারাই স্বপ্ন বুনবে ঠিক ততবার নিরাশার প্রাচীরে বন্দি হবে। এই এক জীবনে মনুষ্য জাতির সব ইচ্ছে পূর্ণতা পায়না। কিছু অপূর্ণ ইচ্ছে, বেদনা, হাহাকার নিয়েই কাটিয়ে দিতে হয় গোটা একটা জীবন। অপূর্ণতার ঝুলিটাকে পূর্ণ করেই একটা সময় বিদায় জানাতে হয় এই মায়ার পৃথিবীকে।”

কথা গুলোর মর্মার্থ হয়তো বুঝতে পারে পাপড়ি। অলীক ভাবনার রাজ্য ছেড়ে ফিরে আসে নিজ ভূবনে।বুক চিরে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসের সাথে ইচ্ছুগুলোকে মুক্তি দেয় বন্দি দশা থেকে। সকাল থেকেই মনটা কেমন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে তার। শরীর জুড়ে ভীড় জমিয়েছে ক্লান্ত, অবসান্নতা। শেষ বিকেলের ঐন্দ্রজালিক মুহুর্তটাও কিছুতেই মনটাকে শান্ত করতে পারছেনা। বারবার কিছু অযাচিত ভাবনা, অমূলক ইচ্ছেরা এসে অপূর্ণতার গ্লানিতে ডুবিয়ে দিচ্ছে পুরো সত্তাটাকে। কেমন যেন ছন্নছাড়া একটা ভাব কাজ করছে। ইচ্ছে করছে জাগতিক সমস্ত কিছু ভুলে আপন ভাবনাতেই মগ্ন থাকতে। অলস ভঙ্গিতেই জানালার কাছ থেকে ওঠে দাঁড়ায়। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে চার্জে লাগানো ফোনটা হাতে নেয়। লাবিব রাফিনের থেকে বিদায় নিয়ে আসার পর থেকেই নাহিদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। কল দিতে গিয়েও বারবার পিছিয়ে আসছে। কিভাবে কথা শুরু করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। ভাবছে গতকালের মতো আজকেও যদি নাহিদ তার সাথে রুক্ষ আচরণ করে! ভাবনার দোলাচল বন্ধ করে অবশেষে সাহস জুগিয়ে কল করে বসে। রিং হচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে অধীর অপেক্ষায় কখন অপর প্রান্ত থেকে প্রিয় মানুষটার গলার স্বর ভেসে আসবে। একবার, দুইবার রিং হতে হতে একটা সময় কলট কেটে যায়। হতাশ হয় পাপড়ি। ফোনটা ছুড়ে মারে বিছানায়। উদ্যত হয় রুম থেকে বের হবার। এরমাঝেই সহসা বেজে ওঠে নিস্তেজ ফোনটা। সাথে লাফিয়ে ওঠে পাপড়ির বুকের ভিতরটা। এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে ঝটপট হাতে তুলে নেয় ফোন। স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করছে নাহিদের নাম্বার। এক পলক দেখেই রিসিভ করে কানে ঠেকায় ফোনটা। জ্বিভের ডগায় শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিচু কন্ঠে বলে,

“হ্যালো!”

“ফোন দিয়েছিলে?”

ভরাট স্বরে জানতে চায় নাহিদ। একটু মনক্ষুন্ন হয় পাপড়ির। চোখে-মুখে লেপ্টে যায় অভিমানের ছাপ। কাল তো ঠিকমতো কথা বলা দূরের কথা, পাপড়ির কোনো প্রশ্নের উত্তর’ও দেয়নি। আজকেও বেহায়ার মতো নিজে থেকেই ফোন করার পরও কেমন ছন্নছাড়া ব্যবহার! একটা সমস্যা হয়েছে বুঝেছে সে। তার জন্য প্রথমদিন ওমন ব্যবহারের পরও কিছু বলেনি। সবটা মেনে নিয়েছে নিরবে। কিন্তু আজকেও কেন সে একই ব্যবহার করবে? ঐ ঘটনায় তো পাপড়ির কোনো দোষ নেয়। তাহলে কেন শুধু শুধু তাকে অবহেলা করবে? বড্ড অভিমান হয় পাপড়ির। কিন্তু অপর মানুষটাকে বুঝতে দেয়না তা। নিরব অভিমানটুকু নিজের কাছেই গোপন রেখে ছোট্ট করে জানতে চায়,

“কেমন আছেন?”

“আছি ভালোই।”

ব্যাস! এটুকুই। উল্টো একটাবার তো তাকেও জিজ্ঞেস করতে পারতো সে কেমন আছে! খুব কি কষ্ট হয়ে যেতো এটুকু জানতে চাইলে? এমন অবজ্ঞা সহ্য হয়না পাপড়ির। হুট করেই সমস্ত বিষাদ গুলো কান্নায় রূপ নেয়। গলার পাশে দলা পাকিয়ে থাকা কান্নার লহর টুকু গিলে নিয়ে বলে,

“আচ্ছা! রাখছি। মা ডাকছে।” আর এক মুহূর্ত অপেক্ষায় থাকেনা। চুপচাপ ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। গাল বেয়ে টুপ করে দু-ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরে। চারপাশের সবকিছুই কেমন বিষাক্ত ঠেকছে তার কাছে। রাফিনকে কথা দিয়েছিল নাহিদকে বুঝাবে সে। কিন্তু কিভাবে বুঝাবে সে? যে মানুষটা ঠিকমতো কথায় বলছেনা তার সাথে তাকে বুঝানোর ক্ষমতা কি আদও পাপড়ির আছে? খুব তো আত্মবিশ্বাসের সাথে রাফিন বলেছিল তার বন্ধু আর কারো কথা না শুনলেও ঠিক পাপড়ির কথা শুনবে। অথচ সে হয়তো জানেই না মেয়েটাকে ঠিক কতটা অবহেলায় জর্জরিত করছে তার বন্ধু গতকাল থেকে।

***
সকাল থেকে বারবার নাদিয়া চেষ্টা করে যাচ্ছে ভাইয়ের সাথে কথা বলার। কিন্তু নাহিদ তাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাচ্ছে। মা-বাবার কাছে ভুল স্বীকার করার পর সাইদুর রহমান স্বাভাবিক আচরণ করলেও শাহিনূর এখনো গম্ভীর। ঠিকঠাক নাদিয়ার কোনো কথার জবাব পযর্ন্ত দিচ্ছেনা। একটা দিনেই পরিবারের মানুষ গুলোর থেকে এমন অবহেলা পেয়ে হাঁপিয়ে ওঠেছে মেয়েটা। ঘুম, নাওয়া-খাওয়া সব ভুলে চেষ্টা করছে সবার কাছে মাফ চেয়ে ভুলটা সুধরে নিতে। ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। উদাস মনে নিজের রুমেই বসেছিল নাদিয়া। ভিড়ানো দরজাটা অল্প ফাঁক করে প্রবেশ করে নাফিস। বোনকে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে কিছুক্ষণ একধ্যানে তাকিয়ে থাকে। কিছু সময় পর গলা পরিষ্কার করে ত্যাড়ছা ভাবে বলে ওঠে,

“ভাইয়া রেডি হচ্ছে। একটুপরেই হয়তো চলে যাবে। কেউ যদি চায় তার জন্য ভাইয়া কষ্ট না পাক। তাহলে এখনো সময় আছে। দরকার পরলে গিয়ে হাতেপায়ে ধরে হলেও ভুল স্বীকার করে মাফ চেয়ে নিতে পারে। কোনো চুন্নির জন্য যদি আমার ভাই মনে কষ্ট নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয় তাহলে কিন্তু আমি তার চুল একটাও মাথায় রাখবনা। কথাটা মনে থাকে যেন।”

আর একটুও দাড়ায় না নাফিস। আড়চোখে এক নজর বোনের দিকে তাকিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে চলে যায় রুম ছেড়ে। নাদিয়া নিজেও লাফিয়ে ওঠে দাড়ায়। হুড়মুড়িয়ে ছুটে যায় বড় ভাইয়ের রুমের দিকে। দরজার সামনে গিয়ে ভিতু মনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সাহস জুগিয়ে ডুকে পরে রুমের ভিতর। নাফিসের কথা অনুযায়ী দেখতে পায় সত্যি সত্যিই নাহিদ তৈরী হচ্ছে। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে ভাইকে ডাকে নাদিয়া,

“ভাইয়া!” এক মিনিটের জন্য স্থির হয় নাহিদ। মুখে গম্ভীর্যতা ফুটিয়ে তাকায় বোনের দিকে। ছলছল করে ওঠে নাদিয়ার চোখ দুটো। কান্নামিশ্রিত কন্ঠে আকুতি নিয়ে বলে,

“আমি তো তোমার ছোট বোন। ছোটরা তো ভুল করতেই পারে তাইনা! আমিও না হয় একটা ভুল করে ফেলেছি। মাফ করে দাওনা প্লিজ! বিশ্বাস করো আমি একটুও বুঝিনি তুমি এতোটা কষ্ট পাবে। যদি বুঝতে পারতাম তাহলে এতো বড় ভুল করতাম না। তুমিই তো বলো মানুষ ভুল থেকেই শিক্ষা নেই। আমিও এই ভুল থেকে যথেষ্ট শিক্ষা নিয়েছি। তোমাদের অবহেলা একদম সহ্য হচ্ছেনা আমার। দম বন্ধ হয়ে আসছে। এবারের মতো মাফ করে একটা সুযোগ দাও আমাকে প্লিজ! আর কখনো এমন কিছুই করবনা। আমি আর তোমাদের অবহেলা নিতে পারছিনা ভাইয়া। একটাবার মাফ করো না প্লিজ!”

কথা গুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পরে নাদিয়া। বুক চিরে এক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে নাহিদের। হাত দিয়ে মুখ ডেকে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে বিছানায়। সময়ের সাথে সাথে নাদিয়ার কান্নার গতি বাড়ে। ভাবে হয়তো ভাইয়ের থেকে মাফ পাবেনা। বুকের ভিতর অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়। ওমনি নাহিদ মাথা তুলে তাকায়। হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকে বোনকে। সাথে সাথেই দৌড়ে ভাইয়ের বুকে ঝাপিয়ে পরে নাদিয়া। স্নেহের হাত দুটো বুলিয়ে দেয় বোনের মাথায়। আস্তে করে বলে,

“কান্না থামা। মাথা ব্যথা করবে।”

শুনেনা নাদিয়া। থামার বদলে কান্নার গতি দ্বিগুণ হয়। নাহিদ’ও আর কিছু বলেনা। কাঁদতে দেয় মন খুলে। একটা সময় নিজে থেকেই কান্না থামে নাদিয়ার। নিস্তেজ হয়ে মিশে থাকে ভাইয়ের বুকে। নিজের বুক থেকে বোনের মাথাটা উঠিয়ে গালে লেপ্টে থাকা অশ্রুটুকু মুছে দেয় যত্ন করে। জলদগম্ভীর কন্ঠে বলে,

“একটা কথা সবসময় মনে রাখিস। যে মানুষ গুলো সবসময় আদর দিতে জানে। প্রয়োজনে সেই মানুষ গুলো কঠোর হতেও জানে। সেই কঠোরতার মাত্রা ঠিক কতটুকু তা হয়তো কল্পনাও করতে পারবিনা তুই। তোর বয়স কম। এই বয়সে সব ভুলেই তোর কাছে মনে হবে সঠিক। কিন্তু যখন সঠিক বয়স হবে তখন ঠিক এই ভুলগুলোর জন্যই আফসোস হবে। আমি চাইনা আমার বোন কখনো অতীতে করা ভুলের কথা ভেবে ভবিষ্যতে কষ্ট পাক। প্রয়োজনে যতটা কঠোর হওয়া প্রয়োজন আমি ঠিক ততটা কঠোর হতেও প্রস্তুত। বোনের সুখের জন্য ভাই সব করতে পারে। প্রথম ভুল বয়সের দোষ ভেবে মাফ করে দিলাম। একই ভুল যদি পূণরায় হয়ে যায় তখন কিন্তু একদম মাফ পাবিনা। আজকে থেকে তোর ফোন চালানো বন্ধ। যেদিন সঠিক সময় হবে। নিজের ভালো বুঝতে পারবি সেদিন হাতে ফোন পাবি। আশা করি সব ভুলে মন দিয়ে পড়াশোনা করবি। কোনোমতেই যেন রেজাল্ট খারাপ না হয়। মনে থাকবে তো আমার কথা?”

উপর নিচে মাথা নাড়িয়ে ভাইয়ের কথায় সায় জানায় নাদিয়া। বোনের কপালে ছোট্ট করে একটা আদরের পরশ বুলিয়ে বেড়িয়ে যায় বিদায় নিয়ে। মা-বাবা,ভাইয়ের থেকেও বিদায় নিয়ে রওনা হয় ঢাকার উদ্দেশ্যে। গাড়িতে কাটানো পুরোটা সময় ভেবে যায় অভিমানী প্রিয়তমার কথা। অকারণেই মেয়েটাকে দুদিন যাবৎ অনেকটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। তবুও কতটা নিখুঁত অভিনয়ের সাথে মেয়েটা নিজের অভিমানটুকু আড়াল করে রেখেছে। বুঝতেই দেয়নি নাহিদকে। তার বোকা রানীটা খুব চালাক হয়ে গেল না কি হঠাৎ!

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here