ফিরে_আসা ৪৬ লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

0
775

#ফিরে_আসা
৪৬
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

সিগারেটের ধোঁয়া ঘিরে রেখেছে আরশাদকে। ধোঁয়ার প্রখরতা ভেদ করে তার মুখটা দেখাও দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ঠিক সামনেই বসে রয়েছেন ধানমন্ডি থানার ওসি হানিফ সাহেব। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা। ওই ম্যাসেজটা পাওয়ার পর এক মুহুর্তও অপেক্ষা করেনি আরশাদ। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছে পুলিশের ডিআইজিকে। ডিআইজি সাহেব আবার আরশাদের বিরাট ভক্ত। তার স্ত্রী নিখোঁজ এই সংবাদ শোনার পর তিনি হুলুস্থূল কান্ড বাঁধিয়েছেন।

আরশাদের হকের স্ত্রী নিখোঁজ, এই খবর সারা দেশে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকার প্রতিটা রাস্তায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। পুলিশ গাড়ি চেক না করে কাউকে ঢাকা ছাড়তে দিচ্ছে না। প্রতিটা থানায় পৌঁছে গেছে অরার ছবি। পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে তাকে যত দ্রুত সম্ভব খুঁজে বের করার। অরাকে যে কিডন্যাপ করা হয়েছে – এ বিষয়ে পুলিশের কোনো সন্দেহ নেই।

আরশাদ নিজেই পুলিশ স্টেশনে যেত, তার আগেই হানিফ সাহেব দলবল নিয়ে চলে এসেছেন বাড়িতে। ইতোমধ্যে সীমাও এ বাড়িতে চলে এসেছে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে। অরার মতো বুদ্ধিমতী একটা মেয়েকে কেউ কিডন্যাপ করে কী করে এটাই সীমার মাথায় খেলছে না। তার থেকেও বেশি রাগ লাগছে আরশাদের ওপরে। কোনো বিচার বিবেচনা না করে আগেই পুলিশ খবর দিয়েছে। পুলিশকে খবর দেওয়ায় কিডন্যাপার যদি অরার কোনো ক্ষতি করে ফেলে?

যে প্রাইভেট নম্বর থেকে ম্যাসেজটা এসেছিল, পুলিশ সেটা ট্রাক করার চেষ্টা করছে। অরার মোবাইল নম্বরটাও ট্রাক করা হচ্ছে। অরার মোবাইলটা কোনোক্রমে হাতে এলে সেখান থেকে কোনো ক্লু পাওয়া গেলেও যেতে পারে।

ওসি সাহেব কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে বললেন, “আপনার কি কোনো শত্রু আছে?”

কথাটা আরশাদের কর্ণকুহরে পৌঁছালেও জবাব দেওয়ার আগেই তার মস্তিষ্ক চিন্তায় ডুবে গেল। আসলেই তো! আরশাদের প্রচুর শত্রু আছে। সফল মানুষের শত্রুর অভাব হয় না। যারা তাদের সফলতা দেখে হিংসায় জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যায়, তারাই শত্রু। এমন কেউ চাইলেই তো অরার ক্ষতি করতে পারে। নিজের ওপর নিজেই রাগে জ্বলে উঠছে আরশাদ। তার উচিত ছিল অরার জন্যে বডিগার্ড রেখে দেওয়া। যে বডিগার্ড সর্বক্ষণ অরাকে চোখে চোখে রাখবে। আরশাদের বোঝা উচিত ছিল অরা এখন আর তার ম্যানেজার নয়, তার স্ত্রী। তার জীবনের সঙ্গে অরার জীবনটাও জড়িয়ে রয়েছে।

হানিফ সাহেব সংযত কণ্ঠে বললেন, “আরশাদ ভাই?”

আরশাদ সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলল, “হুঁ?”

“আপনার কি কোনো শত্রু আছে যে ভাবিকে কিডন্যাপ করতে পারে? আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়?”

আরশাদ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “আমার শত্রুর অভাব নেই। স্পেসিফিকালি কারও নাম মনে পড়ছে না।”

হানিফ সাহেব কিছু একটা বলতে যাবেন তার আগেই একজন পুলিশ অফিসার এসে শুকনো মুখে বলল, “স্যার! নম্বরটা ট্র্যাক করা যাচ্ছে না।”

হানিফ সাহেব চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, “সেটাই তো স্বাভাবিক। কিডন্যাপার একটা সিম থেকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে সেই সিম নিশ্চয়ই আস্ত রাখবে না। তবে আমার ধারণা সে আবারও যোগাযোগ করবে। মুক্তিপণ দাবি করতে হলে তো…”

আরশাদ দৃঢ় কন্ঠে বলল, “আমার মনে হচ্ছে না মুক্তিপণের উদ্দেশ্যে ওকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। এর পেছনে বড় কোনো উদ্দেশ্য আছে।”

সীমা এতক্ষণ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। আরশাদের এ কথাটা শুনে ফিরে এসে তার পাশের সোফায় বসতে বসতে বলল, “আমারও তাই মনে হচ্ছে ভাইয়া। মুক্তিপণ দাবি করতে হলে তো প্রথম ম্যাসেজেই করতো। ওর উদ্দেশ্য মুক্তিপণ না, অরা।”

সীমার এই কথাটা শুনে তড়িৎ গতিতে রাগের স্রোত বয়ে গেল আরশাদের মস্তিষ্কে। লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। রাগে তার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। জ্বলন্ত সিগারেট দুমড়ে মুচড়ে হাতের মুঠোয় পুরে ফেলল আরশাদ। সে নিজের চোখদুটো দেখতে পাচ্ছে না, তবে নিশ্চিত তারা রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। যে অরাকে কিডন্যাপ করেছে, সে জানে না কোথায় হাত দিয়েছে। ওই কিডন্যাপারকে একবার হাতে নাগালে পেলে তার অবস্থা ঠিক এই সিগারেটার মতো করবে আরশাদ। বসার ঘরে উপস্থিত সকলে দেখলো শান্ত-শিষ্ট, জেন্টেলম্যান আরশাদ হক রেগে গেলে কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।

আরশাদ উঠে গেলো দোতলায়। তার ঘরের উত্তর দেয়ালজুড়ে বিশাল এক ছয় দরজার আলমারি। আলমারির রঙ ধবধবে সাদা। যদিও এ বাড়িতে আরশাদ জামা-কাপড় রাখার জন্যে আস্ত একটা ঘর রয়েছে, তবুও এখানে তার কিছু পছন্দের জামা-কাপড় রাখা হয়। দৃপ্ত পায়ে হেঁটে আমারির দিকে এগিয়ে গেল আরশাদ। পকেট থেকে চাবিটা বের করে তৃতীয় দরজা খুলে নিলো। এই দরজার পেছনে মাঝামাঝি অবস্থানে একটা ড্রয়ার রয়েছে। ড্রয়ারটা খুলল আরশাদ। তার টাইগুলো সুন্দর করে সাজানো এখানে। আর একরাশ টাইয়ের নিচেই জিনিসটা লুকানো।

বের করে আনলো সেই জিনিস আরশাদ। ক্যারিয়ারের প্রথম কয়েকটা সিনেমা হিট হওয়ার পরেই আরশাদ যখন সুপারস্টার খেতাব পেয়ে যায়, তখন আত্মরক্ষার জন্যে একে কেনা হয়েছিল। আজও ঠিক প্রথম দিনের মতো ঝলমল করছে।

আবারও আরশাদের হাত ফিরে গেল পকেটে। নিজের মোবাইল বের করে এনে ধীরে-সুস্থে ডায়াল করলো নম্বরটায়। আরশাদ জানে না অরা কোথায়। তবে কেন জানি তার অবচেতন মন বারবার বলছে অরার কিডন্যাপের পেছনে এই মানুষটার কোনো না কোনো ভূমিকা আছে। নওশীন। নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্যে সে সব পারে। নওশীন কতটা ভয়ঙ্কর সেটা আর কেউ না জানলেও আরশাদ জানে। তবে সে হয়তো ভুলে গেছে, প্রয়োজনে আরশাদ তার থেকেও অধিক ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে।

কয়েকটা রিং বাজতেই কল রিসিভ করলো নওশীন। কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “অরা কোথায়?”

একটু যেন ভড়কে গেল নওশীন। ঠিক এই প্রশ্নটা আশা করছিল না আরশাদের কাছ থেকে।

নওশীন বিভ্রান্ত গলায় বলল, “এসব তুমি কী বলছো শাদ? আমি কী করে জানবো ওই মেয়েটা কোথায়?”

আরশাদ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “তাহলে আমার সিক্সথ সেন্স কেন বলছে এর পেছনে কোনো না কোনো ভাবে তুমি জড়িত?”

নওশীন আত্মপক্ষ সমর্থনের সুরে বলল, “তোমার সিক্সথ সেন্স তো ধরেই নিয়েছে আমি পৃথিবীর সবথেকে খারাপ মানুষ। আমাকে ছাড়া আর কার কথা মাথায় আসবে তোমার? আমার অত সময় নেই তোমার সো কল্ড ওয়াইফকে কিডন্যাপ করার।”

আরশাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “সো কল্ড না? নওশীন ভুলে যেও না, আমার লাইসেন্স করা রাশিয়ান পিস্তলটা এখনো যত্ন করে রেখে দিয়েছি। কখনো ব্যবহার করিনি তো কী হয়েছে? সময় এলে অবশ্যই করবো।”

“ভয় দেখাচ্ছো আমাকে?”

“না। সাবধান করছি। তুমি জড়িত থাকলে এখনি বলে দাও। যদি কোনমতে জানতে পারি তুমিই অরাকে কিডন্যাপ করেছো, তাহলে আমিই হবো পৃথিবীর সবথেকে খারাপ মানুষ।”

দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা আর উদ্বেগের মাঝে কেটে গেল একটি রাত। গোটা একটা রাত অরা বাড়ির বাইরে। অচেনা কারও কাছে বন্দী হয়ে আছে। সে কি ঠিক আছে? তার কি কষ্ট হচ্ছে? আরশাদ কিছুই জানে না। সারারাত ধরে অশান্ত মনটা ছটফট করেছে কেবল।

পুলিশ ইতোমধ্যেই তার কাজেকর্মে বহুদূর এগিয়ে গেছে। অরার ফোনের শেষ লোকেশন ধানমন্ডি ২৭ এর ব্যস্ত রাস্তায়। আশেপাশের লোকজনের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ঠিক এখান থেকে গতকাল বিকেলে অরাকে কিডন্যাপ করা হয়। মুখোশ পরিহিত একটা লোক টেনেহিঁচড়ে তাকে মাইক্রোবাসে তোলে। বিশাল একটা ক্লু। এই একটা মাত্র ক্লু ধরে এগোলেই অরাকে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। পুলিশ রাস্তার সিসিটিভি ফুটেজ যোগাড় করছে।

রাস্তার মোড়ে এক পান-সিগারেটের দোকানদার দেখেছে কিডন্যাপার যখন অরাকে টেনেহিঁচড়ে মাইক্রোবাসে তোলার চেষ্টা করছিল তখন তার হাত থেকে মোবাইল ফোনটা রাস্তায় পড়ে যায়। আর এক শ্রেণীর বাঙালির চৌর্যবৃত্তির অভ্যাস তো দীর্ঘদিনের। একটা মেয়েকে ব্যস্ত রাস্তায় তুলে নিয়ে যাওয়া হলো, কেউ এগিয়ে এলো না। অথচ তার ফোন রাস্তায় পড়ে থাকায় ঠিকই কেউ একজন চুরি করে নিয়ে গেছে।

চোরকে খুঁজে বের করতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না পুলিশকে। তাকে পাওয়া গেল গুলিস্তান এলাকার চোরাই মার্কেটে। অরার ফোনটাও সেখান থেকে উদ্ধার করা হলো। হাত থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়ে যাওয়ায় ফোনের ডিসপ্লে ভেঙে গেছে। পুলিশ আপাতত সেটা সারাতে ব্যস্ত। ফোনটা একবার সারাতে পারলেই এখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসবে।

গত রাতে আরশাদের কল পাওয়ার পর থেকে ঝিম মেরে বসে রয়েছে নওশীন। আরশাদ কি তাকে রাশিয়ান পিস্তল দিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দিলো? তাও আবার একটা থার্ড ক্লাস মেয়ের জন্য? নিজের চুল নিজেরই ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে নওশীনের। সব দোষ তার। ভালোমানুষী করে ওই মেয়েটাকে এতিমখানা থেকে তুলে না আনলে আজ এত এত ঝামেলার সৃষ্টি হতো না। খুব শখ তার আরশাদ হকের বউ হবার। নওশীন যদি সেদিন ওই এতিমখানায় না যেত তাহলে আজও সেখানেই পড়ে থাকতে হতো তাকে, পেটেভাতের শিক্ষিকা হয়ে।

নওশীনের ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে অপরিচত নম্বর। মোটেও বিচলিত হলো না নওশীন। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে রিসিভ করলো ফোনটা।

অপরপ্রান্তের ব্যক্তি কিছু বলে ওঠার আগেই নওশীন থমথমে গলায় বলল, “সাবের? সব ঠিকঠাক?”

“জি।”

“খেয়াল রাখবে মেয়েটা যেন কোনমতে পালিয়ে যেতে না পারে।”

সাবের আশ্বাস দিয়ে বলল, “আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। ওকে যে ঘরটাতে রেখেছি সেখানে কোনো জানালা নেই। একটা মাত্র দরজা। তার ওপরে আবার চেয়ারের সঙ্গে হাত পা বেঁধে রেখেছি। পালানোর কোনো উপায় নেই।”

“ভেরি গুড। শোনো, প্ল্যানে একটা চেঞ্জ এসেছে।”

“কী চেঞ্জ?”

নওশীন নির্দেশের ভঙ্গিতে বলল, “তোমাদের লোকেশন শিফট করতে হবে। যেখানে আছো সেটা নিরাপদ হলেও আমি ভরসা পাচ্ছি না। ওখান থেকে সাত কিলোমিটার দূরে আরেকটা পরিত্যক্ত বাড়ি আছে। মেয়েটাকে নিয়ে সেখানে চলে যাও।”

“এখন ওকে নিয়ে যাবো কী করে?”

নওশীন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “যেভাবে ঢাকা থেকে নিয়ে গিয়েছ। অজ্ঞান করে। শোনো সাবের, পুলিশ কিন্তু হন্তদন্ত হয়ে মেয়েটাকে খুঁজছে।”

সাবের বিচলিত গলায় বলল, “আপনি তো বলেছিলেন পুলিশ কিছুতেই আমাদের খুঁজে পাবে না।”

“সেটা তো এখনও বলছি। বাড়তি সতর্কতার জন্য লোকেশন শিফট করতে বলছি।”

“জি আচ্ছা। আমাদের ওখানে কতদিন থাকতে হবে?”

“খুব বেশি হলে আর একটা দিন। এরমধ্যেই তোমাদের পাসপোর্ট রেডি হয়ে যাবে।”

সাবের ছেলেটা বেশ কাজের। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত নওশীন তাকে যতগুলো নির্দেশ দিয়েছে, তার সবই ঠিক ঠিক পালন করেছে সে। তিতিলির প্রাইভেট ইনভেস্টিগেশন ফার্মের বদৌলতে সাবেরকে তার খুঁজে পাওয়া। ভার্সিটির ক্যাম্পাসের সবাই না-কি সাবেরের নাম দিয়েছে লুজার রোমিও। একটা সময়ে অরার সঙ্গে বেশ ভাব ছিল, তবে এখন ছেলেটা তার চোখের বিষ। কেউ জানে না ঠিক কী কারণে অরা তাকে আর সহ্য করতে পারে না। কারণটা অবশ্য নওশীনও জানতে চায় না। সে এমন একজনকে খুঁজে পেয়েছে, যার দুর্বলতা অরা। এটাই অনেক।

মাস দুয়েক আগের ঘটনা। নওশীন ডেকে পাঠায় সাবেরকে। সেলিব্রিটির কাছ থেকে ডাক পেয়ে কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও শেষমেশ দেখা করতে আসে সাবের।

নওশীন কোনপ্রকার ভনিতা না করে বলল, “তুমি অরাকে ভালোবাসো?”

সাবের থতমত খেয়ে বলল, “জি।”

নওশীন বাঁকা হাসি হেসে বলল, “সে এখন অন্য আরেকজনের স্ত্রী। তবুও ভালোবাসো তাকে?”

“জি।”

নওশীন ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার নিখুঁত অভিনেত্রীর মুখোশটা পড়ে বলল, “তোমার অরাকে যে বিয়ে করেছে তাকে আবার আমি ভালোবাসি। নিজের থেকেও বেশি।”

সাবের ইতস্তত করে বলল, “আমাকে এখানে কেন ডেকেছেন?”

নওশীন নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “একটা ডিল করতে।”

“ডিল?”

“হুঁ। এই ডিলে অরা তোমার আর শাদ আমার। তোমাকে শুধু আমার কথা মতো কাজ করতে হবে।”

“মানে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“বুঝতেও হবে না। শুধু আমার কথামতো কাজ করলেই হবে। তবেই তো তুমি অরাকে পাবে।”

প্রায় অনেকটা সময় চুপ করে থেকে সাবের বলল, “কী করতে হবে আমাকে?”

নওশীন গুছিয়ে বলতে লাগলো, “প্রথমত অনেকগুলো সিম কিনতে হবে তোমাকে। তবে ভুলেও নিজের নামে সিমগুলো রেজিষ্টার করবে না। ভুয়া নামে করবে। সেই সিমগুলো ব্যবহার করে একমাস ধরে অরাকে কল করবে। বেশি না, দিনে-দুদিনে একবার করে। প্রথম প্রথম অরা ফোন রিসিভ করার পর চুপ করে থাকবে, কথা বলবে না। অনেকগুলো সিম কিনতে বলছি কারণ অরা নিশ্চয়ই বিরক্ত হয়ে তোমার প্রতিটি নম্বর ব্লক করে দেবে। এরপর আমি যেদিন বলবো সেদিন ওকে ফোন করে প্রথমবারের মতো কথা বলবে।”

“কী বলবো?”

“ব্ল্যাকমেইল করবে।”

“কীভাবে?”

“সেটা নিয়ে তোমাকে আপাতত ভাবতে হবে না। যথাসময়ে শিখিয়ে দেওয়া হবে। ব্ল্যাকমেইল করে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ডাকবে ওকে।”

সবার আঁতকে উঠে বলল, “আমি বললেই কী চলে আসবে না-কি? তাছাড়া আমার ভয়েস অরা চেনে।”

“ভয়েস কোনো ব্যাপার নয়। আজকাল অনেক অ্যাপ বের হয়েছে সেগুলো ব্যবহার করে নকল কণ্ঠে ফোনে কথা বলা যায়। ওগুলোর একটা ব্যবহার করে নিও। আর তুমি বললেই অরা আসবে না, এমনভাবে ব্ল্যাকমেইল করবে যে অরা আসতে বাধ্য হবে। সেখান থেকে ওকে কিডন্যাপ করবে।”

সাবের বিস্ময়ে খাবি খেয়ে বলল, “কিডন্যাপ?”

নওশীন অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে বলল, “চমকে ওঠার কী হলো?”

“কিডন্যাপ করবো? কী করে?”

“সেটা তো আমি শিখিয়ে দিতে পারবো না।বেশি বেশি করে থ্রিলার সিনেমা দেখে শিখে নিও।”

“আমি তো আপনার কোনো কথাই বুঝতে পারছি না। একবার বলছেন ব্ল্যাকমেইল, এখন আবার কিডন্যাপ। শুধু শুধু কিডন্যাপ করতে যাবো কেন?”

“কিডন্যাপ না করলে কী করে পাবে ওকে?”

“কিন্তু আমি একা কিডন্যাপ করবো কী করে?”

“তোমাকে একটা মাইক্রোবাস দিয়ে দেওয়া হবে। একজন লোক ওটা চালাবে। তোমার কাজ হবে ওকে টেনে-হিচড়ে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে গাড়িতে উঠানো।”

“মাঝপথে যদি পুলিশ ধরে?”

নওশীন বিরক্তির চূড়ায় পৌঁছে বলল, “পুলিশ ধরলে বলবে এটা আমার বউ। ঘুমিয়ে পড়েছে। বলতে পারবে না?”

নওশীনের এমন ঝাঁঝালো কণ্ঠে চুপসে গেল সাবের।

নওশীন আবারও বলল, “গাজীপুরের গহীন জঙ্গলে একটা বাড়ি তোমাদের জন্য রেডি থাকবে। অরাকে নিয়ে সেখানে থাকবে কিছুদিন।”

“কিছুদিন?”

“খুব বেশি না। বড়জোর দুয়েক দিন। এরমধ্যে আমি তোমাদের নকল পাসপোর্ট আর ভিসা রেডি করে ফেলবো। সেগুলো নিয়ে তোমরা বর্ডার পাড় করে যাবে।”

সাবের চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইল নওশীনের দিকে। প্রতিটা কথাই যেন তার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।

নওশীন আশ্বস্ত করে বলল, “চিন্তা কোরো না। আগামী দুই বছর হেসেখেলে কাটিয়ে দেওয়ার মতো টাকা আমি তোমাকে দিয়ে দেবো। তুমি শুধু ওই মেয়েটাকে আরশাদ হকের জীবন থেকে সরিয়ে নিয়ে যাবে। পারবে না?”

টাকার কথা শুনেই সাবেরের মুখভঙ্গি বদলে গেল। ভয়-জড়তা কেটে দিয়ে বিচিত্র এক উজ্জ্বলতার দেখা মিলল তার চোখে।

সাবের দৃঢ় কন্ঠে বলল, “অবশ্যই পারবো। কিন্তু একটা কথা।”

“আবার কী?”

“আমি যখন অরাকে নিয়ে বর্ডার পাড় করে যাবো তখনও তো ও আরশাদ হকের স্ত্রী থাকবে। তার আগে কি কোনমতে ডিভোর্সটা করিয়ে নেওয়া যায় না?”

নওশীন বিরক্ত গলায় বলল, “তুমি একটা আধুনিক ছেলে হয়ে বিয়ে নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছো কেন? ওকে নিয়ে বর্ডার পাড় করে অন দেশে সারাজীবন একসাথে থাকতে পারছো এটাই তো অনেক।”

সিসিটিভি ফুটেজের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরশাদ। ভরা রাস্তায় অরাকে মাইক্রোবাসে তুলে নিচ্ছে মুখোশ পরিহিত কেউ। অরা প্রাণপণ নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। আরশাদ পুলিশ স্টেশনে পা রাখার পর থেকে কারও মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হয়নি। তার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে যেন এক্ষুনি পুরো পৃথিবীটাকে পুড়িয়ে ফেলবে নিজের রাগ দিয়ে। প্রচন্ড রাগে হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলল আরশাদ।

আরশাদ পুলিশ স্টেশনে এসেছে শুনে সীমাও ছুটে এসেছে সঙ্গে সঙ্গে। অরার জন্যে দুশ্চিন্তা তার নেহায়েত কম হচ্ছে না।

আরশাদ গম্ভীর গলায় ওসি সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আর অরার ফোন থেকে কিছু পেলেন?”

হানিফ সাহেব বললেন, “হ্যাঁ পেয়েছি। প্রায় এক মাস যাবত বিভিন্ন আননোন নম্বর থেকে ফোন আসছিল।”

মনে মনে কিছুটা অবাক হলো আরশাদ। এক মাস যাবত অরার ফোনে আননোন নম্বর থেকে ফোন আসছে? কই! আরশাদ তো কিছুই জানে না। এমন তো নয় যে গত এক মাসে তাদের মধ্যে বস-ম্যানেজারের সম্পর্ক ছিল। এই মাসটায় দুজনের একে অপরের সঙ্গে কাটিয়েছে দীর্ঘ সময়। তাহলে এত বড় একটা কথা কেন গোপন করলো অরা?

হানিফ সাহেব আবারও বললেন, “আমরা ধারণা করছি এই কিডন্যাপই তাকে ভয় দেখাচ্ছিল। কারণ যতবারই ভাবি ফোন রিসিভ করেছিলেন, ততবারই সে কোনো কথা বলেনি। শেষ কলটা আসে গতকাল বিকেলে। মূলত গতকালই কিডন্যাপার তাকে ফোন করে ব্ল্যাকমেইল করে। কল রেকর্ডও আমরা বের করেছি। চলুন আপনাদের শোনাই।”

ফোনের পুরো কথোপকথন মন দিয়ে শুনলো আরশাদ। অরার ভড়কে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। যেসকল তথ্য দিয়ে তাকে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে, ওই তথ্য খুব কম মানুষের কাছে আছে। আরশাদ আর অরার বিয়ের সত্যতা জানে এমন কেউই কি তাহলে অরাকে কিডন্যাপ করলো? আরশাদ কি তাহলে এতক্ষণ শুধু শুধু নওশীনকে সন্দেহ করছিল?

তাদের বিয়ের সত্যতা জানে কেবল তিনজন মানুষ। তুফান, মেহেদী এবং হিমেল। তুফান আরশাদের বডিগার্ড, সর্বক্ষণ তার সঙ্গে থাকে। এমনকি এখনও থানার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সে এই কাজ করবে কী করে? মেহেদী অরাকে বড় বোনের চোখে দেখে। সেও এই কাজ করবে না। বাকি রইল কেবল হিমেল। কিন্তু হিমেলই তো আগ বাড়িয়ে বিয়েটার ব্যবস্থা করলো। সে কেন অরাকে কিডন্যাপ করতে যাবে। মাথায় কিছুই খেলছে না। সবার আগে জানতে হবে এই রোবোটিক কণ্ঠস্বরের পেছনে কে রয়েছে।

আরশাদ ব্যস্ত গলায় বলল, “এই ভয়েসটা থেকে আসল ভয়েস বের করা যাবে না?”

ওসি সাহেব জোর গলায় বললেন, “অবশ্যই যাবে। কাজ চলছে।”

কয়েক ঘন্টা পর পুলিশ ওই এনক্রিপ্টেড ভয়েস থেকে আসল ভয়েসটা বের করলো সক্ষম হলো। আরশাদ নিশ্চিত হলো এটা হিমেলের কণ্ঠস্বর না। তবে সীমা আঁতকে উঠে বলল, “ভাইয়া! এটা তো সাবেরের কণ্ঠ!”

আরশাদ অবাক স্বরে বলল, “সাবের?”

নিজের তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তির কারণে কিছুই ভুলে যায়নি আরশাদ। তার স্পষ্ট মনে আছে অরা সাবের নামের একটা ছেলের কথা তাকে বলেছিল। যে ছেলেটা তার সঙ্গে বিশ্বাসাতকতা করেছে। তাহলে শেষ পর্যন্ত এই সাবেরই? কিছুই বুঝতে পারছে না আরশাদ। কাকে রেখে কাকে সন্দেহ করবে তার মাথায় ঢুকছে না। অরার ক্ষতি করার জন্যে যে এত এত মানুষ উদগ্রীব হয়ে ছিল, কে জানত?

(চলবে)

[অনেক অনেক সরি অপেক্ষা করানোর জন্যে। দুদিন ধরে মাথাব্যথা, আমারও আরশাদের মতো মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। কালকে রাতে মাথাব্যথা নিয়েই পর্বটা লিখলাম। কেমন হয়েছে জানাবেন কিন্তু। আর অনেকের অভিযোগ হঠাৎ করে কেন একটা ঝামেলা আনলাম। ঝামেলা ছাড়াই তো গল্পটা ভালো লাগছিল। আমার কথা হলো, ঝামেলা ছাড়া আবার গল্প হয় না-কি? একটা গল্প তো মূলত ঝামেলার ওপরেই দাঁড়িয়ে থাকে। হ্যাপি রিডিং! ❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here