রূপবানের_শ্যামবতী #৩২তম_পর্ব #এম_এ_নিশী

0
270

#রূপবানের_শ্যামবতী
#৩২তম_পর্ব
#এম_এ_নিশী

ঝড়ের বেগে গাড়ি চালাচ্ছে আয়াজ। একটু পরপর হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসছে তার। রাগের কারণে কপালের শিরাগুলো ফুলেফেঁপে উঠছে। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে রেখেছে সে।
অরুনিকা সবটাই খেয়াল করেছে। কিন্তু এখন এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো পরিস্থিতি নেই তার। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চললো। সময়মতো পৌঁছাতে না পারলে কি হবে, ভাবতেই গা শিউরে উঠছে। গাড়িতে উঠেই আহরারকে ম্যাসেজ করে দিয়েছে সে। তাই মাঝে মাঝে ফোন চেক করছে আহরারের কোনো উত্তর এলো কিনা তা দেখতে।
মনে মনে আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছে অরুনিকা। তার সরল সহজ বোনটা যেন ফেঁসে না যায়। এই বিপদ থেকে উদ্ধার হতে পারে যেন। তার জীবনটা যেন এভাবে নষ্ট না হয়।

সন্ধ্যার আগে আগেই শাহাদাত তার বাবা মাকে নিয়ে হাজির হয়ে গিয়েছে। বসার ঘরে সকলে বসে আছে। জরুরি কথাবার্তা সারছে। এই ফাঁকে শাহাদাত বেরিয়ে এসে খুঁজে বেড়াতে লাগলো আদ্রিকার ঘর। হুট করে সেলিনার মুখোমুখি হতেই বেশ বিব্রত হয়ে পড়লো সে। কিন্তু সেলিনা আহ্লাদী ভাব নিয়ে বলে ওঠেন,

–একি শাহাদাত, বাবা তুমি এদিকে? কিছু খুঁজছো?

শাহাদাত আমতাআমতা করে বলে,

–না মানে.. ওই.. আসলে..

সেলিনা কিছুক্ষণ গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে বোঝার চেষ্টা করলো। পরক্ষণেই সবকিছু বুঝে ফেলার ন্যায় মাথা নাড়িয়ে বলেন,

–ওহহহ! বুঝেছি, বুঝেছি। আদ্রিকাকে খুঁজছো তো? যাও যাও ওই সামনের ঘরটাতে আদ্রিকা আছে। তুমি গিয়ে কথা বলো যাও। কোনো সমস্যা নেই।

এই বলে খিকখিক করে হাসতে হাসতে চলে গেলেন সেলিনা। শাহাদাত বিরক্ত হলেও কিছু বলেনা। সোজা চলে যায় আদ্রিকার ঘরে। দরজা কপাট ধাক্কা দিয়ে খুলে ধুম করে ঢুকে যায় ঘরের ভেতর। যেন তার নিজের ঘর, সম্পূর্ণ অধিকার নিয়ে সে এই ঘরে ঢুকেছে। কি দাপুটে তার আগমন!
ঘরে আদ্রিকা আর রুমকি বসে ছিলো। শাহাদাত ভেতরে ঢুকতেই দুজনে চমকে ওঠে। শাহাদাতের গমগমে কন্ঠস্বর রুমকির উদ্দেশ্যে,

–তুমি একটু বাইরে যাও। আমার আদ্রিকার সাথে কথা আছে।

রুমকি উঠে চলে যেতে চাইলে আদ্রিকা খামছে ধরে তার হাত। ভয় পাচ্ছে সে। সেই সাথে হচ্ছে প্রচন্ড ঘৃণা। রুমকি দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেলো। কিন্তু শাহাদাত তার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যে চাইলেও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। আদ্রিকার হাতটা ছুটিয়ে নিতে নিতে বললো,

–তুই একটু বোস না আদ্রি, আমি এই যাব আর আসব।

রুমকি দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। তবে অন্যকোনো দিকে না গিয়ে ঘরের বাইরেই একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলো। এই লোকের বিশ্বাস নেই।

আদ্রিকা নিজের পরনের কাপড় খামচে ধরে কাঠকাঠ হয়ে বসে আছে। অসহ্য লাগছে তার। এই লোকটাকে মে রে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু আফসোস! সে পারছে না।শাহাদাত এগিয়ে এসে তার মুখোমুখি বসে পড়তেই সে ছিটকে পেছনে সরে যায়। শাহাদাতের রাগ হয়। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে ওঠে,

–সরে যাচ্ছো কোথায়? একটু পরেই তো পার্মানেন্টলি আমার সাথে বাঁধা পড়বে। তারপর? তারপর তো সারাজীবন আমার কাছেই থাকতে হবে সুন্দরী।

বলতে বলতে শাহাদাত অনেকটা এগিয়ে এসেছে। আদ্রিকার পিঠ ঠেকে গিয়েছে। সে আর পিছাতে পারছে না। লোকটা এতোটাই কাছে এসে ভিড়েছে যে আদ্রিকার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ঘৃণায় পেট গোলাচ্ছে তার। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু শরীরে যেন এক ফোঁটাও শক্তি নেই। অকস্মাৎ শাহাদাত তার গাল দুটো চেপে ধরলো। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,

–প্রথমে বিয়েতে অমত করলেও পরে বুঝতে পারলাম প্রতিশোধ নেওয়ার এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর হয়না। তোর বোনের বড্ড তেজ। তোকে দিয়েই নাহয় সেই শোধটা তুলে নেই। আজ রাতের জন্য প্রস্তুতি নে। তোর শরীরের প্রতিটি ভাজে ভাজে আমার বিষাক্ত ছোঁয়া ছুঁইয়ে দিব আজ। তোকে নাচাবো। বাঈজীদের মতো করে নাচাবো। প্রস্তুত হ।

কথা শেষ করে আদ্রিকাকে ছিটকে ফেলে দিলো শাহাদাত। হনহন করে বেরিয়ে গেলো ঘর ছেড়ে। শাহাদাত বেরোতেই রুমকি ছুটে আসে। আদ্রিকা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। রুমকি কোনো প্রশ্ন করেনা। কারণ সে বাইরে থেকে সবটা শুনেছে। আদ্রিকাকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বোলায় কেবল। শান্তনা দেওয়ার ভাষাও যেন পাচ্ছে না সে। ফোঁপানো স্বরেই আদ্রিকা উচ্চারণ করে একটাই বাক্য, “কোথায় তুমি বুবু?”

কাজি সাহেব এসে পড়েছেন। কাগজপত্র সব ঠিকঠাক করে এখন বিয়ে পড়ানো শুরু করবেন। আদ্রিকাকে জোর করে নিয়ে আসা হয়েছে। ধরেবেঁধে বসিয়ে রেখেছে। সে কেবল বারবার আশেপাশে চোখ বুলিয়ে খুঁজে যাচ্ছে তার বুবুকে। কখন আসবে তার বুবু? আর যে সময় নেই। তবে কি তাকে বাঁচাতে পারবেনা তার বুবু? সবটা কি শেষ হয়ে যাবে এবার?

সাঁই করে গাড়ি থামানোর আওয়াজ হয় অরুনিকাদের বাড়ির সামনে। গাড়ি থামাতে না থামাতেই এক মুহুর্ত দেরি না করে নেমে পড়ে আয়াজ। ছুটে চলে যায় বাড়ির ভেতর। অরুনিকা অবাক হয়। সেও দ্রুত নেমে পিছু পিছু ছোটে।
কাজি সাহেব তখন শাহাদাতকে কবুল বলতে বলছেন। যখনই শাহাদাত কবুল বলতে উদ্যত হবে তখনই তার মুখ বরাবর সজোরে এক ঘুষি পড়তেই ছিটকে পড়ে যায় মেঝেতে। আকষ্মিক আক্রমণে স্তব্ধ সবাই। আহাম্মকের ন্যায় দাঁড়িয়ে কেবল দেখতে থাকে। কি হচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই শাহাদাতকে তুলে দাঁড় করিয়ে আরো কয়েক ঘা বসিয়ে দেয় আয়াজ। এমন এক তান্ডবলীলা একসময় আহরারকে করতে দেখা গেছিলো। যখন শাহাদাতের নোংরা থাবা অরুনিকার ওপর পড়ছিলো। সেদিনকার সেই আহরারের রূপ আজ হুবহু আয়াজের মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে। হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়েছে আয়াজের। উদ্ভ্রান্তের ন্যায় শুধু এলোপাতাড়ি মেরে যাচ্ছে শাহাদাতকে। ততক্ষণে আদ্রিকার কাছে এসে তাকে বুকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে অরুনিকা। তখনও আদ্রিকা কেঁদেই যাচ্ছিলো। তবে আয়াজের এমন কান্ড ভালোভাবে নজরে পড়তেই থেমে যায় সব কান্না। বাকিদের মতো সেও বিস্ময় নিয়ে দেখছে আয়াজকে।
শাহাদাতের বাবা আর অরুর চাচা মিলে আয়াজকে আটকানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু পেরে ওঠা যাচ্ছে না আয়াজের সাথে। বরং তার শক্তিশালী ধাক্কায় দুজনেই ছিটকে পড়েছেন দুদিকে। আজ যেন শাহাদাতের প্রাণ নিয়েই ছাড়বে আয়াজ। ওদিকে শাহাদাতের মা হাওমাও করে কাঁদতে শুরু করেছেন। সেলিনা ভয়ে থরথর করে কাঁপছেন। আরজু বেগম, জসিমউদদীন দুজনের কারোরই এখনো বোধগম্য হচ্ছে না ব্যাপারটা। যখন কেউই আয়াজের সাথে পেরে উঠছে না, পারছেনা তাকে থামাতে। তখনই কারো তেজালো কন্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই থেমে যায় আয়াজের হাত। আহরার এসেছে। তার ঝাঁঝালো স্বরের নিষেধাজ্ঞা,

–ছেড়ে দে ওকে আয়াজ।

আয়াজের হাত থেমে যেতেই আরো একবার ভেসে এলো আহরারের কন্ঠস্বর,

–আর একবারো যদি হাত উঠিয়েছিস তবে কিন্তু আমার হাত উঠে যাবে।

আয়াজ ঘুরে তাকায় তার ভাইয়ের দিকে। হাঁপানি রোগীর মতো হাঁপাচ্ছে সে। চোখমুখ অসম্ভব লাল। এখনও নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে এনে শান্ত হতে পারছেনা সে। ওদিকে শাহাদাতের মরামরা অবস্থা। নিজেদের গাড়ির ড্রাইভারকে বলে শাহাদাতকে ধরে গাড়িতে তোলে শাহাদাতের বাবা। ছুটে যায় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। আহরার সকলকে শান্ত হয়ে বসতে বলে। যেহেতু সে বাড়ির জামাই। সকলের সম্মানীয়। তাই কেউ আর দ্বিরুক্তি না করেই তার কথা শুনে বসে পড়লো। আহরার ভিষণ শান্ত হয়ে আছে। যেই পরিস্থিতিটা ঘটেছে তা খুবই ঠান্ডা মাথায় সামলাতে হবে। অরুনিকার ম্যাসেজ আসার কিছু সময়ের মধ্যেই মিটিং শেষ হয়ে গিয়েছিলো আহরারের। ম্যাসেজ পড়ে সে বাকি সব মিটিং ক্যানসেল করে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ে। গাড়ি একপ্রকার উড়িয়েই নিয়ে আসে। অরুনিকার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে সম্ভব হয়নি। এমনকি আয়াজকেও ফোনে পায়নি সে। তাই আর সময় নষ্ট না করে দ্রুত চলে এসেছে এখানে। এখন মনে হচ্ছে সে একদম সময়মতোই আসতে পেরেছে। এই মুহূর্তে তাকে এখানে উপস্থিত সকলকে বেশ কিছু তিক্ত সত্য জানাতে হবে। লম্বা একটা দম নিয়ে আহরার সকলের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,

–আপনারা সবাই হয়তো অবাক হচ্ছেন এটা ভেবে যে আমার ভাই, আয়াজ কেন এতোটা ডেস্পারেট হলো? শাহাদাতকে কেন ওভাবে মারলো? আজ আপনাদেরকে সেসবকিছুর বৃত্তান্ত খোলাসা করে বলবো। তার আগে আমার একটা পরামর্শ, সকলেই মনটাকে শান্ত রাখবেন।

এই বলে আহরার পুরোনো সেই সমস্ত ঘটনাগুলো যা দাইয়ানের বোনের বিয়ের সময় ঘটেছিলো, আদ্রিকার দিকে শাহাদাতের নোংরা দৃষ্টিতে তাকানো, বাজে ব্যবহার, অরুনিকার শাহাদাতকে চড় মারা আর তার জের ধরে অরুনিকার ইজ্জতের ওপর হামলা চালানোর চেষ্টা, সেখান থেকে অরুনিকাকে আহরারের উদ্ধার করা, পরবর্তীতে প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে শাহাদাতের পুনরায় আহরারকে আক্রমণ করা, সমস্ত ঘটনা সকলের সামনে তুলে ধরলো আহরার। নিজের বলা শেষে থামলো সে। সকলে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে শুনে গেলো সবটা। বেশ কিছুটা সময় নীরবতায় কাটিয়ে আচমকা কেঁদে ওঠেন আরজু বেগম। কপালে হাত ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে কেঁদে যাচ্ছেন তিনি। অরুনিকা মাকে আগলে নেয়, মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে শান্তনা দিতে থাকে। সকলের মুখ চোখের অবস্থা থমথমে। এতো কিছু ঘটে গেছে অথচ কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি। জাহেদ আর সেলিনা ভীত হয়ে পড়েছেন। আজ যদি শাহাদাতের সাথে বিয়ে হয়ে যেতো আদ্রিকার তবে কি হতো? মেয়েটার জীবনটা নষ্ট হয়ে যেতো। আর এরজন্য দায়ী থাকতেন তারাই। অরুর দাদা জসীমউদ্দিন বলে ওঠেন,

–এখন শাহাদাতের যেই হাল আয়াজ করেছে তাতে ওর বাবা মা তো চুপ করে বসে থাকবেনা।

আহরার শান্তনা দিয়ে বললো,

–চিন্তা করবেন না দাদু, আমি পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেছি। ব্যাপারটা আইনি পর্যায়ে চলে গিয়েছে। শাহাদাত সুস্থ হলেই তদন্ত হবে এবং পুলিশ সবকিছু তদারকি করবেন। চাইলেও শাহাদাত বা ওর বাবা-মা আপনাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবেনা।

সেলিনা বলে উঠলেন,

–এ তুমি কি করলে বাবা? পুলিশ পর্যন্ত ব্যাপারটা কেন নিয়ে গেলে? এটা গ্রাম। তারওপর আদ্রিকা এখনো কুমারী, বিয়ে হয়নি। এই ঘটনা পুরো গ্রামে ছড়িয়ে যেতে সময় লাগবেনা। এখানে টিকে থাকা তো কঠিন হবেই সেই সাথে আদ্রিকার বিয়ে দেওয়াটা রীতিমতো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

খানিকটা শক্ত কন্ঠেই আহরার জবাব দেয়,

–কেন চাচী? আপনাদের কেন সমস্যা হবে? আপনারা তো কোনো অন্যায় করেননি। অন্যায় যদি কেউ করে থাকে তবে সেটা শাহাদাত। আর ওর ব্যবস্থা তো আমি করছিই। আপনারা সবাই নিশ্চিন্তে থাকুন। আমি থাকতে আপনাদের কোনো বিপদ হতে দিবোনা। সব আমি সামলে নিব। একটু ভরসা রাখুন।

আহরারের কথায় সকলেরই স্বস্তি মিললো। তবে যেই ঝড়টা গেলো তার ধকল সামলাতে কিছুটা সময় তো লাগবেই।

সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সেদিন রাতেই ওরা তিনজন বেরিয়ে পড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে। সবাই রাতটা থেকে যাওয়ার অনুরোধ করলেও আহরারের ব্যস্ততার অযুহাতে থাকা হলোনা। এদিকে আদ্রিকার বিয়ের দায়িত্ব আহরার নিয়েছে। সে কথা দিয়ে এসেছে সে নিজে ভালো ছেলে খুঁজে এনে তার সাথে আদ্রিকার বিয়ের ব্যবস্থা করবে।
এই এতো কিছুর মধ্যেও আয়াজ কোনো কথা বলেনি। পুরোটা সময় নিশ্চুপ ছিলো সে। মনে হচ্ছে কোনো কিছু নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়েছে। বাড়িতে ফিরতেই আহরার নিজের ঘরে চলে গেলো, অরুনিকা চলে গেলো শ্বাশুড়িদের সাথে দেখা করতে। এদিকে আয়াজ ড্রয়িংরুমে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো। তারপরই উঠে চলে গেলো। নিজের ঘরে না গিয়ে আহরারের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। দুবার নক করতেই ভেতরে যাওয়ার অনুমতি পেলো সে। আহরার ফ্রেশ হয়ে বেরোলো মাত্র। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছে। আয়াজকে দেখে হালকা হেসে জিজ্ঞেস করে,

–কিরে, কিছু বলবি?

নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে উত্তর দেয় আয়াজ,

–আমার একটা প্রস্তাব ছিলো ভাইয়া। যদি রাগ না করো তাহলে বলতে পারি।

আহরার ঘুরে দাঁড়ায়। জহুরি চোখে আয়াজকে আগাগোড়া পরখ করে নেয়। কিছুটা গাম্ভীর্যের সাথে বলে,

–রাগ করবো কিনা তা তো নির্ভর করছে কথাটা কি বা কেমন তার ওপর। আগে বল শুনি।

সেকেন্ড কয়েক সময় নিলো আয়াজ। তারপর ভাইয়ের দিকে না তাকিয়েই সংকোচ ছাড়াই গড়গড় করে বলে দিলো,

–যদি তোমরা রাজি থাকো তো আদ্রিকাকে আমি বিয়ে করতে চাই।

কথাটুকু বলেই হাঁপ ছাড়লো আয়াজ। আহরার তখনো গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এবার আয়াজের একটু ভয়ভয় লাগছে। তার ভাইয়া কি রেগে গেলো? হুট করে তাকে চমকে দিয়ে আহরার ঘর কাঁপিয়ে হেসে ওঠলো। আয়াজ বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। মাথা চুলকে ভাবতে বসলো, সে আসলে কি বলেছে? আহরার দমফাটা হাসি হাসছে। হাসতে হাসতে আয়াজের কাছে এগিয়ে এসে সশব্দে কাঁধে চাপড় মারলো। হাস্যরত সুরেই বলে ওঠে,

–আমি ঠিকই ধরেছিলাম, আদ্রিকাকে নিয়ে কিছুতো তোর মধ্যে আছেই। শুধু অপেক্ষা করছিলাম কখন তুই নিজের মুখে বলবি।

এবার লজ্জায় পড়ে গেলো আয়াজ। অস্বস্তি নিয়ে বললো,

–ইয়ে না মানে ভাইয়া, ব্যাপারটা তেমন নয়।

–ঠাটিয়ে মারবো এক চড়। আমাকে কি বুঝাতে চাইছিস তুই। ভুলে যাস না ওই পথ কিন্তু আমিও পাড়ি দিয়ে এসেছি।

আয়াজ সলজ্জ হেসে মাথা নামিয়ে ফেলে। আহরার আবারো হেসে মাথায় চাটি মারে তার। তারপর বলে,

–চিন্তা করিস না। ভাইয়ের কাছে চেয়েছিস কিছু, ভাই ফিরিয়ে দিবেনা। আমার ওপর ছেড়ে দে। এখন যা গিয়ে বিয়ের প্রস্তুতি নে।

আয়াজ বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে বলে,

–কি বলছো কি ভাইয়া, এতো সহজে?

–কি মনে করিস তুই আমাকে? উমম!

–না মানে আমি ওভাবে বলতে চাইনি..

–শোন, তোকে এতোকিছু ভাবতে হবেনা। আমি দেখে নিব সব। তোকে যেটা বলেছি তুই শুধু সেটা কর।

–থ্যাংক ইউ ভাইয়া।

এই বলে আহরারকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আয়াজ। আহরারও হেসে জড়িয়ে নিলো ভাইকে।

আয়াজ চলে যেতেই অরুনিকা ঘরে ঢোকে। আহরারের মুখে হাসি দেখে কৌতুহলী স্বরে প্রশ্ন করে,

–কি ব্যাপার? খুশি খুশি মনে হচ্ছে।

–জানো কি হয়েছে?

আহরারের উৎফুল্ল স্বর শুনে অরুনিকা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। আহরার বলে ওঠে,

–আদ্রিকাকে বিয়ে করতে চায় আয়াজ। একটু আগে আমাকে সেটাই বলে গেলো।

–কিহহহ!

–ভাবতে পারো ভাই আমার ডুবে ডুবে জল খেয়েছে এতোদিন কিন্তু বুঝতে দেয়নি। আজ ওর আচরণ দেখেই তো আমার সন্দেহ হলো।

–আমারো সন্দেহ হয়েছে জানেন। যখন থেকে আয়াজ ভাইয়া আদ্রিকার বিয়ের খবর শুনেছে তখন থেকেই কেমন অদ্ভুত আচরণ করছিলো। আমার সন্দেহ হলেও তখন মাথা ঘামাতে পারিনি। তার মানে ব্যাপারটা সত্যি?

–তা আর বলতে।

অরুনিকা হাসে। সেই হাসি দেখে আহরার ঘুরে এসে অরুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,

–যখন থেকে তোমার প্রতি অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিলো আমার আমিও ঠিক ওরকমই হয়ে গিয়েছিলাম। শাহাদাত যখন তোমার দিকে হাত বাড়ায়, পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমি। ওকে টেনে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলার ইচ্ছে হচ্ছিল। আজ আয়াজের মধ্যেও আমি তেমনটাই দেখেছি। তাই তো চট করে মাথায় আসলো বিষয়টা।

–আপনি বড্ড পাগল জানেন। তখনও পাগল ছিলেন, এখনও পাগলই আছেন।

–তাই? আমি পাগল তাইনা?

বলতে বলতে আহরার কুট করে ছোট্ট একটা কামড় বসিয়ে দিলো অরুনিকার কানের লতিতে।
অরুনিকা মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,

–আমার কিন্তু আপনার দূর্বলতা জানা আছে।

–আচ্ছা, দেখাও আমার দূর্বলতা।

–নিন তবে মজা..

এই বলে অরুনিকা ঘুরে দাঁড়িয়ে আহরারের কোমরে সুড়সুড়ি দিতে লাগলো। আহরার বারবার এঁকেবেঁকে যাচ্ছে। অরুনিকাকে থামতে বলতে গিয়ে হো হো করে হেসে ওঠে। কোমরে বড্ড সুরসুরি তার। একদম সয়না। অরুনিকা একেবারে জায়গামতো মেরেছে। আহরার হাসছে আর বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে পিছিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অরুনিকা ছাড়ার পাত্রী নয়। সুরসুরি দিয়েই যাচ্ছে। একটা সময় আহরারের অবস্থা দেখে সেও খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। আহরারকে ছেড়ে দিয়ে হাসতে হাসতে শুয়ে পড়ে বিছানায়। আহরারও পেট চেপে ধরে ধপাস করে শুয়ে পড়ে অরুনিকার পাশে। পাশ ফিরে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে অরুনিকার প্রাণখোলা হাসি। কারণ এই দৃশ্য তার জীবনের অন্যতম সুন্দর দৃশ্যগুলোর মধ্যে একটি। এমন দৃশ্য দেখার সুযোগ হাতছাড়া করতে নেই। তার শ্যামবতীকে মনভরে দেখার সুযোগ সে কখনোই ছাড়েনা। যতই দেখে মন চায় আরোওও দেখতে। শ্যামবতীকে দেখার রেশ কাটেনা তার কখনোই। হাজার বছর ধরে দেখলেও যেন তৃপ্তি হবেনা তার। হুট করে মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে যেতেই টুপ করে গালে একটা চুমু দিয়ে বসলো সে। থেমে গেলো অরুনিকার হাসি। ঝট করে ফিরে তাকাতেই আহরার হড়বড় করে উঠে দাঁড়ায়। ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,

–মা বোধহয় খেতে ডাকছে। উফফ! বড্ড ক্ষিদে লেগেছে।

আহরারের কান্ড দেখে অরুনিকা আবারো হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে বলে,

–আমার পাগল একটা।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here