#রূপবানের_শ্যামবতী
#৩৩তম_পর্ব
#এম_এ_নিশী
(১৮+ এলার্ট)
অবশেষে খান বাড়িতে আরো এক আনুষ্ঠানিকতার সূচনা ঘটতে যাচ্ছে। বাড়ির সকলকে নিয়ে আহরার আলোচনায় বসেছিলো। আলোচনার বিষয়বস্তু – আয়াজ, আদ্রিকার বিয়ে। যদিও আয়াজ আদ্রিকাকে পছন্দ করে বলেই বিয়ের কথা সে নিজ মুখে বলেছে। তবে আহরার সেটা সকলের সামনে প্রকাশ করলো না। সে বিষয়টি এমনভাবে উপস্থাপন করলো যেন – আদ্রিকার বিয়ের কথাবার্তা চলছে তাই আহরারই চায় আয়াজের সাথে আদ্রিকার বিয়েটা হোক। বাড়ির কারোরই এ ব্যাপারে কোনো আপত্তি না থাকলেও তাসফিয়া খানিকটা গাঁইগুঁই করছেন। কারণটা এই নয় যে তিনি আদ্রিকাকে পছন্দ করেন না বা বিয়েতে মত নেই। তার আপত্তি হলো গুলবাহারের অনুপস্থিতি নিয়ে। বাড়ির ছেলের বিয়ে অথচ একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য উপস্থিত থাকবেন না ব্যাপারটা একদমই ভালো দেখাবেনা বলেই তার দ্বিমত পোষণ করা। এ পর্যন্ত আলোচনা ভালোই চললেও তাসফিয়ার এমন আপত্তি আহরারকে রাগিয়ে দিলো। সে বহুবার তার মাকে ভালোভাবে বুঝিয়েছে এই মুহূর্তে গুলবাহারের এমন শাস্তি প্রয়োজনীয়। এতে তার নিজেরই মঙ্গল। নিজের ভুল বুঝে তা সংশোধন করতে সাহায্য করবে তাকে এই শাস্তি। কিন্তু তাসফিয়া বুঝেও বুঝতে চায়ছেন না। আহরার আর তর্ক-বিতর্ক, বোঝাবোঝি বাদ দিয়ে আসর ত্যাগ করলো। রেগেমেগে গটগটিয়ে বেরিয়ে গেলো একেবারে বাড়ির বাইরে। তা দেখে আফতাব সাহেব তাসফিয়ার উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন,
–তুমিও না তাসফি, কেন বারবার ওই এক ক্যাঁচাল লাগিয়ে রাখো ছেলেটার সামনে বলো তো?
তাসফিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত কন্ঠে জবাব দেন,
–এতো বছর ধরে সংসার করছি। কতো কটু কথা শুনে শুনে কাটিয়েছি তার কি হিসেব আছে? পার তো করেই ফেলেছি। চাইলেও তো সেসব দিন আর পাল্টাতে পারবোনা। তবে কি দরকার এই শেষ বয়সে এসে মানুষটাকে এতো কঠিন কঠিন শাস্তি দেওয়ার।
তাসফিয়ার কথায় সম্মতি জানিয়ে ফারজানা বলে ওঠেন,
–আমারও একই কথা। এখন আর ওই মানুষটাকে শাস্তি দিয়ে কি লাভ? আর কদিনই বা বাঁচবেন তিনি।
ফারজানার কথার জবাবে আফজাল সাহেব বলেন,
–আহরার যখন এমন একটা পদক্ষেপ নিয়েছে অবশ্যই ভেবে চিন্তেই নিয়েছে। আমি মনে করি ভালোটাই ভেবেছে সে। আমাদের ওর প্রতি বিশ্বাস রাখা উচিত।
বড় ভাইয়ের কথায় মাথা নাড়িয়ে সায় জানান আফতাব সাহেব। বাকিরা নিশ্চুপ। এই কথার বিপরীতে আর কারো কিছু বলার মতো রইলোনা।
আহরার বাড়িতে ফিরলে অরুনিকা বেশ অনেকক্ষণ যাবত তার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে থাকলো। বোঝায় যাচ্ছিলো যে সে কিছু বলতে চায়। কিন্তু আহরার যেভাবে রেগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিলো এখনও সে রেগে আছে নাকি ঠান্ডা আছে বুঝতে পারছিলোনা অরু। তাই নিজের কৌতুহলী প্রশ্নগুলো করার মতো সাহস হচ্ছে না তার। বারবার এসে এসে এটা সেটা ভুজুংভাজুং জিজ্ঞেস করে চলে যাচ্ছে। একটাসময় ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আহরার গমগমে গলায় ডেকে ওঠে,
–অরুনিকা..
চমকে ওঠে অরু। একেতো পুরো নাম ধরে ডেকেছে তারওপর কেমন গম্ভীর কন্ঠস্বর। তার মানে এখনো রেগে আছে। আহরারের দিকে তাকাতেই পুনরায় একই স্বরে বলে,
–এদিকে এসো, আমার পাশে বোসো।
অরুনিকা ধীরপায়ে এগিয়ে এসে বসে পড়ে আহরারের পাশে। কিছুটা ভয় পাচ্ছে সে। যদি আহরার তাকে বকে এই ভয়ে। কিন্তু তার ভয়কে সত্যি হতে না দিয়েই আহরারের কন্ঠস্বর বদলে গেলো। কোমলস্বরে বলে ওঠে,
–তুমি কি কিছু বলতে চাচ্ছো অরু? আমার কাছে কিছু বলতে তোমার এতো হেজিটেশন কেন হচ্ছে? মানা করেছিলাম না এতো হেজিটেট করতে।
আহরারের কোমল স্বর শুনে ভয় কেটে গেলো অরুর। ধাতস্থ হয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয় প্রশ্ন গুলো করার জন্য। দু একবার কেশে গলা পরিষ্কার করে নেয় সে। অতঃপর ক্ষীণ স্বরে বলে,
–আচ্ছা, দাদীজানের ওপর আপনার রাগটা কেন সৃষ্টি হলো? ওইদিন ঘুমের ভান ধরে থেকে মিথ্যে বলার জন্য, মায়ের ওপর করা অত্যাচারগুলো সম্পর্কে জেনে নাকি আরো অন্যকোনো কারণ আছে?
অরুনিকার কথা শুনে ফোঁস করে শ্বাস ফেলে আহরার। খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলতে শুরু করে,
–তোমরা শুধু এটুকুই কারণ জানো অরু কিন্তু এর বাইরেও আরো কিছু কারণ আছে। আমি শুধুমাত্র ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে দাদীজানকে এক দিনের জন্যই বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার পরিকল্পনা করেছিলাম। যেদিন সকালে তাকে নিয়ে বেরোবো বলে ডাকতে গেলাম, সেদিন ঘরের বাইরে দাঁড়াতেই কিছু কথা আমার কানে আসে। দাদীজান কাওকে বলছিলেন, তার পরিকল্পনা ছিলো তোমাকে চরিত্রহীন প্রমাণ করার তবে যেই লোককে দিয়ে কাজটা করাতে চেয়েছেন সেই লোকটা তোমায় মেরে ফেলতে চেয়েছিলো। এটা নিয়েই রাগারাগি করছিলেন উনি। বিশ্বাস করো সেদিন আমার মনের অবস্থা যে কি হয়েছিল তা তোমাকে বোঝাতে পারবোনা। যেই দাদীজানকে আমি এতো ভালোবাসতাম, এতো সম্মান করতাম সে এতো নীচ, এমন হীন কাজ কি করে করতে পারে? প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল এই সত্যিগুলো মেনে নিতে। তারপরও নিজেকে শক্ত করে রেখেছিলাম। একপ্রকার কঠিন হয়ে গিয়েই আমি দাদীজানকে রেখে আসলাম একেবারে।
এতোক্ষণ বিস্মিত হয়ে আহরারের সব কথা শুনলেও শেষ কথাটুকু শুনে চমকে ওঠে অরুনিকা। তড়িৎ গতিতে প্রশ্ন করে,
–একেবারে মানে?
আহরারের চোখমুখ শক্ত হয়ে এসেছে। কন্ঠে কাঠিন্য ভাব বজায় রেখে জবাব দিলো,
–একেবারে মানে একেবারে। দাদীজান আর এই বাড়ি ফিরবেন না। এখন থেকে উনার স্থায়ী ঠিকানা – বৃদ্ধাশ্রম।
এই বলে অরুনিকাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই আহরার হনহন করে বেরিয়ে গেলো ঘর ছেড়ে। অরুনিকা হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে আহরারের চলে যাওয়া দেখলো কেবল।
যেহেতু গুলবাহারকে ছাড়াই বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে হবে তাই বাড়ির কেউই খুব এজটা আত্মীয় স্বজন নিয়ে আয়োজন করতে চাচ্ছেন না। আপাতত তাদের ইচ্ছে ঘরোয়া ভাবেই বিয়েটা হোক, পরে গুলবাহার ফিরলে বড় আয়োজন করা হবে সকলকে নিয়ে। ঠিক যেমনটা আহরার – অরুনিকার হয়েছিলো। আহরার এতে কোনো দ্বিমত পোষণ করেনি। তবে সকলে এমন চিন্তাভাবনা করলেও অরুনিকা তো জানে, ওই অনুষ্ঠান কখনোই হওয়া সম্ভব নয়। কারণ আহরার আর গুলবাহারকে এবাড়ি ঢুকতে দেবেনা।
ফোনালাপের মাধ্যমেই কথাবার্তা পাকা করা হয়। বাড়ির সকলে একসাথে যাবে একদিন এবং ওইদিনই বিয়ে পড়িয়ে নিয়ে চলে আসবেন আদ্রিকাকে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী দুদিন পরই বিয়ের তারিখ নির্ধারিত হয়। আগের দিন বাড়ির সকলে মিলে ছোটোখাটো পরিসরে আয়াজের গায়ে হলুদ করে। বাড়ির ছাদেই সবাই ইচ্ছেমতো হলুদ মাখামাখি, আনন্দ – উৎসব করেছে। আয়াজ ভিষণ খুশি ছিলো। বহুদিন পর তাকে এতোটা প্রাণোচ্ছল দেখা গেলো। বাকিদের চোখে সেই উৎফুল্লতা স্বাভাবিক নজরে এলেও আহরার এবং অরুনিকা ঠিকই এর গভীর মর্মার্থ উদ্ধার করে ফেললো। দুজনের মধ্যে দু একবার চোখের ইশারাও হয়েছে ব্যাপারটা নিয়ে। আর সেটা আহিয়ার নজরে পড়তেই তাদেরকে নিয়ে মজা লুটতে শুরু করলো। সেই সাথে তাল মিলালো বাকি সকলেই। হাসি ঠাট্টার মধ্যে সাধারণ ভাবে অসাধারণ, সুন্দর এক গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো।
পরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লো সবাই। হৈ হুল্লোড় করতে করতে বউ আনতে চললো। দুপুরের আগে আগেই ওই বাড়িতে পৌঁছে গেলো তারা। বাড়ির সকলেই সাদরে আপ্যায়ন শুরু করলো সবার। অরুনিকা সোজা চলে গেলো আদ্রিকার কাছে। লাল টুকটুকে বউ সেজে খাটের মাঝে বসে আছে আদ্রিকা। অরুনিকা ঘরে ঢুকতেই আদ্রিকাকে এমন রূপে দেখে থমকে গেলো। আদ্রিকা এমনিতেই অনেক সুন্দরী, তারওপর এমন লালরঙা বউ সাজে তাকে অপরূপ অপ্সরা লাগছে। যা দেখে অরুনিকারও চোখ আটকে গিয়েছে। সে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলতে লাগলো,
–মাশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ। আদ্রি, আমার বনু। কি সুন্দর লাগছে রে তোকে।
অরুনিকার গলা শুনে মাথা তুলে তাকায় আদ্রিকা। মুহুর্তেই উত্তেজিত হয়ে “বুবু, বুবু” করতে লাগলো সে। অরুনিকা কাছে এসে আদ্রিকার মুখখানা দুহাতে ধরে চোখ বুজে বিড়বিড় করে কিছু সূরা পড়ে নিলো। তারপর কপালে ফু দিয়ে দিলো বারকয়েক। বোনকে বুকে জড়িয়ে বললো,
–কারো নজর না লাগুক আমার সোনা বোনটার ওপর।
অরুর বুকে মুখ গুঁজতেই দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো আদ্রিকার। অরু ভাবলো সবাইকে ছেড়ে চলে যাবে বলে হয়তো মন খারাপ, কিন্তু কেবল আদ্রিকাই জানে এটা তার সেই মন খারাপ নয়। এই বিয়েটা মন থেকে মেনে নিতে না পারার কষ্ট।
আয়াজ ভালো ছেলে। তার সাথে বিয়েতে মানা করার মতো কোনো সুযোগ আদ্রিকার নেই। এদিকে তার আহরার ভাই নিজে এই প্রস্তাব এনেছে। সে-ই দায়িত্ব নিয়ে সবকিছু করছে। এখানে নিজের মনের কথাটা জানানোর মতো দুঃসাহস আদ্রিকা দেখাতে পারেনি। বলতে পারেনি, তার মনে অন্য কারো বসবাস। আয়াজকে মন থেকে স্বামী হিসেবে মেনে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
পরপর তিন বার “কবুল” বলার মাধ্যমে আয়াজ – আদ্রিকার বিয়েটা সুসম্পন্ন হলো।
বিয়ের কার্য সম্পাদিত হতেই খাওয়া দাওয়ার পালা চললো। এরপর দুই পারিবার তুমুল আড্ডায় কাটিয়ে দিলো লম্বা একটা সময়। এবার বিদায়ের পালা। সন্ধ্যার আগে আগেই তারা বউ নিয়ে ফিরতে উদ্যত হলো। বিদায়ের বিষাদীয় ক্ষণ বেশ করুণ হলো। সকলকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে, কষ্টে বাঁধনহারা কান্নায় ভেঙে পড়লো আদ্রিকা সহ বাড়ির সকলেই। আরজু বেগম তার ছোটো মেয়েরও বিদায় দিয়ে ফেললেন। এবার যে বাড়িটা পুরোপুরি খালি হয়ে গেলো। তবুও মেয়ের মা হয়েছেন যখন বুকে পাথর চেপে সত্যি মেনে নিতে হলো। আদ্রিকাকে নিয়ে চলে গেলো খান পরিবারের সদস্যরা।
খান ভিলায় পৌঁছাতে রাত নয়টা পেরিয়ে গেলো। বাড়িতে ঢুকেই আদ্রিকাকে অরুনিকার ঘরেই বসিয়ে রাখা হলো। ওদিকে আহরার বাসর ঘর সাজানোতে লেগে পড়লো। সঙ্গে যোগ দিয়েছে দাইয়ান, রাদিফ, ঈশানও। বেলুন ফোলাতে ফোলাতে রাদিফ আফসোসের সুরে বলতে থাকে,
–ছোটো ভাইটারও বিয়ে হয়ে গেলো। আমরা এখনো বিয়ে খাইয়া বেড়াই।
সঙ্গে সঙ্গে দাইয়ান তার মাথায় ঠাস করে চাটি মেরে দিলো। ঈশান ব্যঙ্গাত্নক সুরে বলে ওঠে,
–তোর মতো হাবারে কে বিয়ে করবে?
রাদিফ চোখমুখ কুৃঁচকে বলে,
–আমার মতো ছেলে তুই এই তল্লাটে আর একটাও পাবিনা, বুঝলি।
–হ্যা, পাবো না। কারণ তোর মতো বলদ এই তল্লাটে আর একটাও নেই।
আহরারের জবাব শুনে রাদিফ আহাম্মক হয়ে তাকিয়ে থাকে। করুণ সুরে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,
–আহরার, তুই আমাকে এভাবে বলতে পারলি?
আহরার ফোঁস করে বলে ওঠে,
–বলবোনা তো কি করবো? গর্দভ! বেলুন ভেবে তুই কি ফোলাচ্ছিস তাকিয়ে দেখ একবার।
আহরারের কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে সকলের দৃষ্টি রাদিফের হাতের দিকে গেলো। সত্যি রাদিফটা কতো বোকা। সে কোথা থেকে এই ক*** তুলে এনে ফোলাতে শুরু করেছে কে জানে। খেয়াল করার সাথে সাথে “আআআআ” করে চিৎকার করে ছুড়ে ফেলে দিলো সেটা। “ওয়াক, ওয়াক” করতে করতে ছুট্টে বাথরুমে চলে গেলো। সেই সাথে তুমুল হাসিতে ফেটে পড়লো বাকি তিনজন।
রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি। খাওয়া দাওয়া সেরে সকলেই যার যার ঘরে চলে গিয়েছে। আদ্রিকাকে বাসর ঘরে বসিয়ে দিয়ে আসা হয়েছে। বিয়ের কথাবার্তা শুরু হওয়া থেকে আজ বিয়ে হওয়া পর্যন্ত একবারও আয়াজের সাথে কথা হয়নি আদ্রিকার। সে তো তাকায়ওনি। কিভাবে তাকাবে? যাকে মন থেকে মানতে পারছেনা তার দিকে দৃষ্টি ফেরাবে কি করে?
ঘরে বসে বসে আপনমনে এসব কথাই ভেবে যাচ্ছে আদ্রিকা। আয়াজ এখনো আসেনি। কিন্তু আসবে তো। তারপর? কি হবে তারপর? আদ্রিকার গলা শুকিয়ে আসে ভয়ে। আয়াজ তার স্বামী। তার ওপর আয়াজের সম্পূর্ণ অধিকার আছে। যদি সে স্বামীর অধিকার খাটাতে চায়? তখন কি করবে আদ্রিকা?
আদ্রিকার বুক ফেটে কান্না আসে। সেই “অপরিচিতের” কথা ভেবে। নিজের অজান্তেই কখন যে ওই মানুষটাকে মন দিয়ে বসেছে আদ্রিকা, বুঝতেই পারেনি। আচ্ছা, আদ্রিকা না হয় পরিস্থিতির কারণে যোগাযোগ করতে পারেনি, তার কি সমস্যা ছিলো? সে কেন যোগাযোগ করার চেষ্টা করলো না? সে তে বলেছিলো, সে আদ্রিকাকে চেনে, আদ্রিকার ঠিকানাও জানে। আদ্রিকা যখন আর যোগাযোগ করতে পারছেনা তাহলে সে একবার এলোনা কেন? তার মানে কি এই অনুভূতি একতরফা? শুধুই আদ্রিকার দিক থেকেই? ওই মানুষটার মনে তবে আদ্রিকার জন্য কোনো অনুভূতিই জন্মায়নি? নাকি সবটা তার নাটক ছিলো?
আর ভাবতে পারছে না আদ্রিকা। তার মাথা ফেটে চিন্তায়। আয়াজকে কিভাবে আটকাবে সে? মনে মনে ঠিক করে নিলো, আয়াজকে সব সত্যি বলে দিবে। তারপরও যদি সে জোর করে তবে..
খট করে দরজা খোলার আওয়াজে ভাবনার সুতো ছিঁড়লো তার। তটস্থ হয়ে বসে রইলো। আয়াজ এসেছে। গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতিটা বুঝিয়ে দিলো সে। দরজাটা আটকে ধীরপায়ে এগিয়ে আসছে আদ্রিকার দিকে। আদ্রিকা কি করবে না করবে ভাবতে ভাবতে ঝট করে খাট থেকে নেমে দাঁড়ালো। আচমকা আদ্রিকার এমন আচরণে ভড়কে গেলো আয়াজ। দাঁড়িয়ে পড়লো ওখানেই। আদ্রিকা এদিক ওদিক তাকিয়ে বেডসাইড টেবিলে থাকা জগটা হাতে তুলে নিলো। ধুম করে সেটা আয়াজের সামনে ধরে ভয় পাওয়া গলায় কিছুটা জোর আনার চেষ্টা করে বললো,
–খ..খবরদার.. আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না। এই..এই জগটা দিয়ে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিব।
আয়াজ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো। মেয়েটার কি মাথায় সমস্যা নাকি? আদ্রিকা এবার করুণ স্বরে বলতে লাগলো,
–দেখুন, আমি অন্য একজনকে পছন্দ করি। আমার পক্ষে আপনাকে মেনে নেওয়া সম্ভব না।
মুহুর্তেই আয়াজের চোখেমুখ কঠিন আাকার ধারণ করে। তেজালো স্বরে জবাব দেয়,
–এটা কি সিনেমা পেয়েছো যে মেনে নিতে পারিনা বললেই ছাড় পেয়ে যাবে? তুমি আমার বিয়ে করা বউ। তোমার ওপর আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে।
এই বলে আয়াজ এগিয়ে আসতে থাকে। আদ্রিকা পিছিয়ে যাওয়ার কোনো পথ পায়না। নিজেকে নিরুপায় ভাবতেই অসহায়ত্ব ভর করলো যেন। ধপ করে ওখানেই মেঝেতে বসে পড়ে সে। হু হু করে কাঁদতে শুরু করে। তা দেখে আয়াজের ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে ওঠে। সেও আদ্রিকার মুখোমুখি হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। আদ্রিকার কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়া এক অশ্রুকণা নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলে ধারণ করে নেয়। সেই অশ্রু বিন্দুর দিকে তাকিয়ে কন্ঠ গলে বেরিয়ে আসে কিছু বাক্য,
“রূপসীর আঁখিযুগল
হতে ঝড়া এই মুক্তকণা,
যার ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য
কেবল আমার, আমার এবং আমারই।”
নিমিষেই কান্না থেমে যায় আদ্রিকার। চকিতে ফিরে তাকায় আয়াজের দিকে। মানুষটার উচ্চারিত সেই শব্দ, “রূপসী” কানে বাজতে লাগলো তার। কিছু বলার চেষ্টা করেও বলতে পারেনা। আশ্চর্যের ন্যায় তাকিয়ে হাতটা বাড়িয়ে রাখে। বড় বড় চোখ করে, মুখ হা করে রেখেছে সে। বহুকষ্টে বলে ওঠে,
–আ..আ..আপনি..আপনি.. সেই অপরিচিত?
সশব্দে হেসে ওঠে আয়াজ। ঝুঁকে পড়ে আদ্রিকার মুখের ওপর। চোখে চোখ রেখে মোহনীয় স্বরে বলে ওঠে,
–এরপরও কি কোনো সন্দেহ আছে..?
কথাটুকু বলে শেষ করতে না করতেই আদ্রিকা এলোপাতাড়ি কিল ঘুষি মারতে থাকে আয়াজের বুকে। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
–অসভ্য, অসভ্য, অসভ্য, আমার সাথে নাটক। কত্তো কষ্ট দিয়েছেন আমায়। আপনি খুব খারাপ, খুব খারাপ।
আয়াজ হাসতে থাকে। হাসতে হাসতেই জড়িয়ে নেয় প্রিয়তমাকে। আদ্রিকা তখনও ছটফট করে যাচ্ছে। কিছুসময় পর নিজেই শান্ত হয়ে চুপটি করে মুখ লুকিয়ে রাখে প্রিয় পুরুষের বুকে। কিন্তু অভিমান তখনও গলেনি। যা ক্ষণে ক্ষণে ফোঁপানোর আওয়াজ হয়ে বেরিয়ে আসছে।
~~~
ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। ঠান্ডা শীতল হাওয়া। বারান্দায় বসে আছে আহরার। মাঝে মাঝে হাওয়া এসে গা ছুঁইয়ে দিতেই গুনগুন করে গেয়ে ওঠে,
“শোন গো দখিন হাওয়া
প্রেম করেছি আমি।
শোন গো দখিন হাওয়া
প্রেম করেছি আমি,
লেগেছে চোখেতে নেশা
দিক ভুলেছি আমি।
শোন গো দখিনো হাওয়া
প্রেম করেছি আমি।।”
অরুনিকা ঘরে ঢুকে দেখে আহরার নেই। তখনই বেলকনি থেকে গুনগুন করে গাওয়া গান ভেসে আসতেই অবাক হয়ে অরুনিকা এগিয়ে গেলো সেদিকে। আহরার গাছের কাছে বসে কি যেন করছে আর গান গাইছে। অরুনিকা কৌতুহলী স্বরে প্রশ্ন করে,
–কি করছেন?
আহরার ঘাড় বাঁকিয়ে চায়। অরুনিকাকে দেখতেই স্নিগ্ধ হাসি ফুটে ওঠলো তার ঠোঁটে। সম্পূর্ণরূপে ঘুরলো সে তবে উঠে দাঁড়ালোনা। হাঁটু গেড়ে বসে দুই হাত অরুনিকার সামনে তুলে ধরলো। যাতে রাখা আছে একগোছা গন্ধরাজ ফুল। আহরার এতোক্ষণ ফুলগুলো তুলে সেগুলোকে বাঁধছিলো। অরুনিকা আসতেই তার দিকে ফুলগুলো বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“ওগো শ্যামবতী,
তুমি কি চিরকাল আমার শ্যামবতী হয়ে রবে?
প্লিইইজজ.. থুক্কু.. এমন কবিতার মধ্যে ” প্লিজ” ঢোকে ক্যামনে? ধুরর! কি যে বলি.. আসলে এতোটাও কাব্যিক হতে পারিনা গো। এটুকু ম্যানেজ করে নাও প্লিইইইজজজ।”
আহরারের কথা বলার ধরন দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে অরুনিকা। হাসতে হাসতে চোখে পানি এসে পড়ে তার। আঙুল দিয়ে সেটা মুছে নিয়ে হাত বাড়িয়ে ফুলগুলো নিয়ে নিলো। আহরার উঠে দাঁড়ায়। অরুনিকার হাসি এখনো পুরোপুরি থামেনি। কোনোরকম হাসি কন্ট্রোল করে বলে,
–আপনি এতো পাগল কেন?
আহরার কোনো জবাব দেয়না। কেবল লাজুক হেসে মাথা চুলকোতে থাকে।
পাশাপাশি দু ঘরে দুটো মধুরতম সম্পর্কের মধুময় কাব্য রচিত হতে থাকে। এক জুটি কিছু স্নিগ্ধ ভালোবাসা রচনা করছে আরেকজোড়া অভিমানে মেশানো মিষ্টি অনুভূতির সূচনা ঘটাচ্ছে।
দখিনা শীতল হাওয়ায় আঁধারিয়া আকাশে দেখা দিয়েছে অর্ধচন্দ্র, যে কিনা দাঁড়িয়ে রয়েছে এই দু জোড়া কপোত-কপোতীর প্রিয় মুহুর্তের সাক্ষী হয়ে।
চলবে…