আমৃত্যু_ভালোবাসি_তোকে #লেখনীতে_সালমা_চৌধুরী #পর্বঃ০২

0
1569

এতবছর পর নিজের রুমটা আশ্চর্যান্বিত নয়নে দেখছে আবির। সেই পরিচিত ঘ্রাণ যেখানে সে নিজের জীবনের ১২ টা বছর কাটিয়েছিলো। যেই রুমটা ছিল তার একান্ত ব্যক্তিগত, আজও তাই আছে। একটা জিনিসও এদিক সেদিক হতে দেন নি আবিরের মা ‘মালিহা খান’। এমনকি রুমে বছরের পর বছর তালা দিয়ে রেখেছেন তিনি৷ যখন ই ছেলের কথা মনে হতো ছেলের রুমে এসে নিরবে কেঁদে যেতেন যেনো কেউ বুঝতে না পারে৷

আবির রুমে ঢুকে লাগেজ খুলে নিজের পরনের টিশার্ট হাতে শাওয়ার নিতে চলে যায়। শাওয়ার শেষে বের হলেন একটা কফি কালার টিশার্ট আর একটা টাওজার পরে হাতে টাওয়েল নিয়ে মাথার চুল মুছতে মুছতে। খাটে বসে আছে তানভির। লাগেজ নিয়ে এসে রুমেই বসে আছে সে৷

তানভির কে দেখে আবির জিজ্ঞেস করছে,
‘কি হলো, কিছু বলবি?’

তানভির মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করছে
‘আচ্ছা ভাইয়া ঐ লাগেজটা ধরতে দিলি না কেন? কি আছে ঐটাতে?’

আবিরের চক্ষুদ্বয়ে উদ্বেগ স্পষ্ট, চোয়াল শক্ত করে উত্তর দিলো
‘ঐটাতে আমার পার্সোনাল কিছু জিনিস আছে৷’

তানভির হাসতে হাসতে উত্তর দেই,
‘ সেই পার্সোনাল জিনিস গুলো দেখতে চাচ্ছে আমার অবুঝ মন, কি করবো বলো?’

স্বভাবসুলভ গম্ভীর কন্ঠে উত্তর দিলো আবির
‘কাউকে দেখানোর জিনিস আশা করি পার্সোনাল হবে না?’

তানভির ভাইয়ের আপত্তিস্বর বুঝতে পেরে এই বিষয়ে আর কিছু বলে নি৷
শুধু জিজ্ঞেস করে,’ বিকালে কি বের হবে? ‘

আবির উপর নিচ মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানায়৷

তানভির কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ বিদায় নেয় রুম থেকে৷

আবির খাটের এক কোণায় বসে মোবাইল হাতে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু চেক করতে ব্যস্ত হয়ে পরে।

★★★

মেঘ নিজের রুমে ঢুকে শপিং ব্যাগ খুলে ৩ টা ড্রেস বের করলো। ৩ টা জামা ই অসাধারণ সুন্দর। ২ টা গাউন ড্রেস আর একটা গর্জিয়াছ কাজের থ্রিপিস। ল্যাপটপ টাও খুলে দেখে, তার প্রয়োজনীয় সকল এপ ব্রাউজার অলরেডি ল্যাপটপে সেট করা আছে।

মেঘের দৃষ্টি যায় রেপিং পেপারে মোড়ানো বক্সের দিকে। রেপিং পেপার খুলতেই চোখে পরে ৩ টা উপন্যাসের বই যেগুলোর উপরে ছোট একটা চিরকুটে লিখা ‘এডমিশনের পরে পড়বি’৷ তারসাথে একটা ছোট বক্স যেখানে একবক্স রঙিন পাথর। মেঘের এই পাথর গুলো ছোটবেলায় খুব পছন্দ ছিল। তার সাথে একটা iPhone 13 pro max মোবাইলের বক্স। ফোন দেখে মেঘের চক্ষু চরখগাছ। অনেকদিন যাবৎ মনের কোণে সুপ্ত ইচ্ছে ছিল একটা আইফোন কেনার৷ কিন্তু কাউকে বলার মতো সাহস হয় নি তার। এগুলো দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে পরেছে মেঘ৷

ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়াকালীন মেঘের যখন কলেজ, প্রাইভেট, কোচিং সব মিলিয়ে ব্যস্ততায় দিন কাটছিলো, তখন তানভির তার পুরোনো একটা ফোন দিয়েছিল মেঘকে। সীমটাও ছিল তানভিরের, বাসার মানুষের বাহিরে শুধু ৩-৪ জন বান্ধবীর নাম্বার ছিল সেই ফোনে। এমনকি স্যারদের কেও নাম্বার দিতে নিষেধ করেছিল কড়া ভাষায়।। তানভির বরাবর ই বোনের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস৷ ভাইরা বোনকে শাসন করে ঠিক আছে কিন্তু তানভীর মেঘকে একটু বেশিই শাসনে রেখেছে এত বছর৷

HSC পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে নিজের মায়ের পেটের ভাই তানভিরকে খুব সাহস করে বলেছিলো,

‘ভাইয়া পরীক্ষা শেষ করে আমায় একটা নতুন ফোন কিনে দিবা?’

অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তানভির, যেনো মস্ত বড়ো অন্যায় করে ফেলছে।

তারপর মেঘ নতুন ফোনের আশা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছিল।

আজ সে না চাইতেই আইফোন পেয়ে গেছে, ল্যাপটপ পেয়ে গেছে৷ এ যেনো মেঘ না চাইতেই জল৷ আনমনে ভাবছে, মনে হয় তানভির ভাইয়া বলেছে ফোন আনতে আর ল্যাপটপ আনতে নাহলে ওনি কিভাবে জানবে আমার ফোন নেই।

★★★

এদিকে ১ ঘন্টা যাবৎ ফোনে মনোযোগ দিয়ে কি যেনো কাজ করছে আবির। হঠাৎ আদি দৌড়ে এসে দাঁড়ায় দরজায়

আদিঃ ভাইয়া তোমায় খেতে ডাকছে?
আবিরঃ যা আসছি।

১০ মিনিটের মধ্যে সাদা শার্ট পরে রেডি হয়ে নিচে নামলো আবির।
অসময়ে তেমন কেউ নেই নিচে৷ বিকাল ৪ টা বাজে৷ সবার খাওয়া শেষ অনেক আগেই। মালিহা খান বসে ছিলেন ছেলের জন্য।

ছেলের ফিটফাট হয়ে রেডি হওয়া দেখে মালিহা খান জিজ্ঞেস করছেন, ‘কোথাও যাবি?’

আবির,’ হ্যাঁ,একটু কাজ আছে!’

আবির চুপচাপ খাবার খাচ্ছে। ছোটবেলা যা যা সে পছন্দ করতো সব রান্না হয়েছে আজ। সব খেতে পারে নি যতটুকু সম্ভব খেয়ে উঠে পরেছে।

এরিমধ্যে তানভির হাজির হয়েছে…
‘ভাইয়া রেডি আমি, এখন যাবে নাকি লেইট হবে?’

আবির, ‘এখনই বের হবো’

মালিহা খান রান্নাঘর থেকে ডেকে বলছেন, ‘গাড়ি নিয়ে বের হবি না? চাবি নিয়ে যাহ…’

আবিরঃ গাড়ি লাগবে না আম্মু

দুই ভাই বের হয়ে গেলো……

★★★
যৌথ পরিবারগুলোর সবচেয়ে আনন্দময় সময় হলো সন্ধ্যাবেলা। বাড়ির সকলে মিলে হৈচৈ করে বিকালের নাস্তা খাওয়া,একটু টিভি দেখা, খেলাধুলা করা,আড্ডা দেয়া৷

সমস্যা শুধু বড় ভাই, তানভির সবসময় মেঘকে চোখে চোখে রাখে৷ কি করছে,কি না করছে, কখন খাচ্ছে, পড়াশোনা করছে কি না এসবকিছু দেখায় যেনো তার একমাত্র কাজ। কিন্তু মীম আর আদিকে কোনোদিন একটা ধমক পর্যন্ত দেয় নি তানভির। এ কেমন দুমুখো ব্যবহার। তানভির যতক্ষণ বাসার বাহিরে থাকে মেঘ ততক্ষণ মুক্ত,স্বাধীন ।

তানভির বাসায় না থাকায় তিনভাই বোন মিলে ছোটাছুটি করছে। মেঘ যা বলে ছোট ২ টা তাই করে। মেঘ আর আবিরের এখনও দেখা হয় নি। মেঘ কোচিং থেকে এসে রুমে যে ঢুকেছিল। তার গিফট নিয়ে ব্যস্ততার কারণে সবে মাত্র রুম থেকে নিচে এসেছে। অন্যদিকে আবির বাসা থেকে চলে গেছে আরও ২ ঘন্টা আগে৷

মেঘ,মীম আর আদির ছোটাছুটি শেষ হয় বড় আব্বু ‘জনাব আলী আহমদ খানের’ বাসায় প্রবেশ দেখে৷ আহমদ আলী খান বাসায় ঢুকতে ঢুকতে নিজের স্ত্রী মালিহা খানকে জিজ্ঞেস করলেন ‘আবির কোথায়?’

মালিহা খান উত্তর করলেন ‘ও তো তানভিরকে নিয়ে বের হলো বললো কি কাজ আছে’

আলী আহমদ খান সোফায় বসতে বসতে মেঘের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘পড়াশোনার কি অবস্থা আম্মু?’

মেঘ শান্তস্বরে উত্তর করলো, আলহামদুলিল্লাহ ভালো বড় আব্বু। তবে

‘তবে কি?’ প্রশ্ন করলেন আলী আহমদ খান

আমার ফিজিক্স আর ম্যাথে একটু সমস্যা, কোচিং এর সাথে কুলাতে পারছি না। প্রাইভেটগুলোতেও অনেকটা এগিয়ে গেছে।

আলী আহমদ খান, ‘ ঠিক আছে তোমার জন্য প্রাইভেট টিউটর নিয়ে আসবো। কাল বা পরশুর মধ্যেই ম্যানেজ করতেছি , তুমি চিন্তা করো না মন দিয়ে পড়াশোনা করো আম্মু৷ তোমার ভাই তানভির তো আমার কোনো কথা শুনে না আর না শুনে তোমার আব্বুর কথা, কোথা থেকে মাথায় ভূত চেপেছে রাজনীতি করবে৷ পড়াশোনায় গুরুত্ব না দিয়ে রাজনীতিতে গুরুত্ব দিচ্ছে। তুমি পড়াশোনা করো ভালো করে, মেডিকেলে অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেনো চান্স টা হয়ে যায়’

‘জ্বি বড়আব্বু, চেষ্টা করবো।’

‘খেয়েছো কিছু তোমরা?’ আলী আহমদ খান জিজ্ঞেস করলেন

এবার উত্তর টা মীম দিলো, ‘হ্যাঁ বড় আব্বু খেয়েছি আমরা’

ঠিক আছে এখন রুমে গিয়ে পড়তে বসো।

৩ ভাই বোন কোনো কথা না বলে তিনদিকে যার যার রুমে চলে যায়।

★★★
রাত ৯ টায় বাড়িতে ঢুকে আবির আর তানভির। খাবার টেবিলে খেতে বসেছেন ৩ ভাই আর আদি। মীম, মেঘ কেউ নেই। রান্নাঘরে তিন ঝা খাবার রেডি করছেন।

বিকেলে আবির সাদা শার্ট পরে বেরিয়েছিল। সাদা শার্টের ২-৩ জায়গায় একটু একটু রক্ত লেগে আছে আর আবিরের হাতে ৩ টা ওয়ানটাইম ব্যান্ডেজ লাগানো, নজরে পরে ছোট চাচ্চু ইকবাল খানের।

‘কিরে আবির,তোর হাতে কি হয়েছে? শার্টেই বা দাগ কিসের?’

এই কথা শুনে ছুটে আসেন মালিহা খান, কি হয়েছে আবির?
বুকের ভেতর ছ্যাত করে উঠেছে, একমাত্র ছেলের শরীরে একটা আচড় ও মা সহ্য করতে পারেন না।

আবিরঃ তেমন কিছু না, হাতে একটু লেগেছিল । ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা করো না।

আর কথা না বাড়িয়ে সিঁড়ির কাছে চলে যায় আবির।

আলী আহমদ খান ছেলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন, ‘খাবে না?’

‘না আব্বু। বিকেলে খেয়েছি খিদে নেই। ‘ এই বলে রুমের দিকে চলে যায় আবির।

আবিরের কন্ঠ শুনে মেঘ রুম থেকে বের হয় তাড়াতাড়ি, এতগুলো গিফট দিলো অবশ্যই ধন্যবাদ জানানো উচিত, ৭ বছরে ভাইয়ের মুখটাও দেখে নি সে৷ কিন্তু কেয়ার রুম থেকে বের হতে হতে আবির রুমে ঢুকে পরেছে।

মেঘের চোখ মুখে নিরবতা, নিচে গিয়ে সবার সাথে খেতে বসে, তানভির ও খেতে বসেছে হাতমুখ ধৌয়ে।

ইকবাল খান তানভিরের উদ্দেশ্যে বলে, ‘তুই তো ছিলি আবিরের সাথে কি হয়েছে বল?’

তানভির: চাচ্চু আমি তো ভাইয়ার সাথে বের হয়েছিলাম কিন্তু পরে আমি পার্টি অফিসে চলে গিয়েছিলাম৷ তাই সঠিক জানি না৷

মেঘ যেনো কিছুই বুঝতে পারছে না। বাড়িতে এসেছে ৭-৮ ঘন্টা হয়ে গেছে মানুষটার, অথচ সে এখনও দেখেই নি তাকে তারমধ্যে আবার কি অঘটন ঘটিয়েও ফেলেছে। সে শুধু চাচ্চু আর ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছে বার বার৷

আহমদ আলী খান গম্ভীর স্বরে তানভিরকে বললেন, ‘সে তো তোমার ভাই কম বন্ধু বেশি৷ তাকে বলে দিও কোনো প্রকার মারপিট আর রাজনীতিতে যেনো না জরায়। আর এটাও বলে দিও তাকে, তার বয়সটা কিন্তু আমি পার করে এসেছি৷ তাকে দেশে এনেছি মারপিট করার জন্য না, আমাদের ব্যবসার হাল ধরার জন্য । ‘

তানভির: আসলে বড় আব্বু সামান্য হাতটা কেটেছে ভাইয়ার৷

আলী আহমদ খান: থাক আমায় কিছু বুঝাতে হবে না। কোনটা মারপিটের কাটা আর কোনটা কেটে যাওয়া আমি তা বুঝি৷ তুমি তো নিজের রাস্তা বেছেই নিয়েছো অন্তত তাকে বুঝাও এসবে যেনো না জরায়

তানভিরঃ জ্বি বড় আব্বু৷

মেঘ আচমকা প্রশ্ন করে বসে, ‘কি হয়েছে? ‘

তানভির মেঘের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকায়, ‘তুই চুপচাপ খা’

ইকবাল খান বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আবির কেনো মারামারি করবে,এতবছর বাহিরে ছিল ছেলেটা, এখানে ওর কে এমন শত্রু আছে?’

বাড়ির সবার মধ্যে নিরবতা কেউ কোনো কথা বলছে না।

মেঘ মনে মনে ভাবছে, ‘আবির ভাইয়া মারপিট করেছে? কিন্তু কেনো? এত বছর ভাবতাম আমার ভাই ই পঁচা, রাজনীতি করে, আমায় শাসন করে।৷ কিন্তু আবির ভাই তো দেখা যাচ্ছে পুরাই হিটলার’

চলবে…….

#আমৃত্যু_ভালোবাসি_তোকে
#লেখনীতে_সালমা_চৌধুরী
#পর্বঃ০২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here