আমৃত্যু_ভালোবাসি_তোকে #লেখনীতে_সালমা_চৌধুরী #পর্বঃ০৩

0
719

কোন এক আশঙ্কায় আবিরের মাথায় চিনচিন ব্যথা অনুভব হয়, ভীতিতে রুদ্ধ হয় তার শ্বাস। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আনমনে কি যেনো ভেবে যাচ্ছে আবির। দূরে ঐ চাঁদটার দিকে তাকিয়ে আছে চক্ষুযূগল এক মুহুর্তের জন্যও সরছে না, পল্লব ও পড়ছে না একটিবার, তার দুর্বোধ্য দৃষ্টি।

হঠাৎ কারো অস্তিত্ব বুঝতে পেরে সাবলীল ভঙ্গিতে নড়েচড়ে দাঁড়ায় দৃষ্টি সরিয়ে নেয় চাঁদ থেকে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নেয় মানুষটাকে তারপর, ধীরস্থির কন্ঠে জানতে চাই,

‘কিছু হয়েছে?’

তানভির সরলমনে বলে, ‘বড় আব্বু বুঝতে পেরে গেছে তুমি মারপিট করেছো, তাই তোমাকে সাবধান করতে বলেছে যেনো মারপিট আর রাজনীতিতে না জরাও।’

‘আরকিছু?’ অবহেলায় প্রশ্ন টা করলো আবির

‘না, তেমন কিছু না ব্যবসার হাল ধরতে বললো৷ ‘ তানভির উত্তর দিলো।

আবির: আচ্ছা ঠিক আছে৷ আর কিছু বলবি?

তানভির: ভাইয়া, মাথা ঠান্ডা করো তুমি। বাদ দাও প্লিজ৷ আমি তোমাকে শুধু জানিয়েছিলাম বিষয়টা। তুমি যে এভাবে দেশে চলে আসবে আর এইভাবে ঝামেলা হবে এটা আমি ভাবতে পারি নি৷ বুঝতে পারলে আমি আগেই ব্যাপার টা সলভ করে ফেলতাম৷

আবির: তুই আমায় বাদ দিতে বলছিস? বাহ

তানভির: আমি ঐভাবে কিছু বলি নি ভাইয়া। যা হবার তো হয়েছে৷৷ তুমি যা করেছো এরপর আশা করি আর কিছু হবে না। তাই বলছিলাম ঐসব চিন্তা বাদ দিয়ে একটু রেস্ট নাও। অনেকটা জার্নি করে এসেছো।

আবির: আচ্ছা তুই এখন যা, এরপর থেকে আমার ব্যাপারে তোকে যেনো কেউ কিছু না বলে এটা সবাইকে বলে দিস। এতবছর বাহিরে ছিলাম। এখন তো আমি বাড়িতে আছি, যার যা কথা সব যেনো আমায় বলে সরাসরি। আর আগামীকাল ১২ টার আগে কেউ যেনো ডাকতে না আসে আমায়।

তানভির: আচ্ছা৷ আসছি আমি৷

এতক্ষণে মেঘে ঢেকে গেছে চাঁদ। অসীম দূরত্বে তাকিয়ে কি যেনো ভাবছে ছেলেটা৷ তারপর রুমে ঢুকে দরজা আটকে ব্যাগ থেকে একটা সিগারেট বের করে বারান্দায় বসে সিগারেট জ্বালিয়ে ঠোঁটে ধরে…

দৃষ্টি পরে দূরে গাছের পাতার ফাঁকে ল্যামপোস্টের ক্ষুদ্র আলোর দিকে, তারনিচে ২-৩ টা কুকুর আপন মনে চিল্লাচিল্লি করছে।

সিগারেট খাওয়াটা আবিরের নিত্যদিনের অভ্যাস না, যখন সে খুব রাগান্বিত বা চিন্তিত থাকে, যখন নিজেকে কন্ট্রোল করার সব শক্তি হারিয়ে ফেলে তখন সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্যে নিজের কষ্ট, রাগ,চিন্তা আর অভিমান গুলোকে উড়িয়ে দেয়।

সিগারেটে কয়েকটা টান দিয়ে সিগারেট টা ফেলে দেয়। তারপর টানটান হয়ে শুলো নিজের বিছানায় মাথার নিচে দুহাত রেখে চোখ বুজলো।

★★★

মেঘ খাবার খেয়ে রুমে এসে ২-৩ ঘন্টা টানা পড়াশোনা করলো।। HSC পরীক্ষা শেষ হলো এক মাস ও হয় নি কিন্তু পড়াশোনা যেনো ৩ গুণ বেড়ে গেছে। এডমিশন একটা মস্তবড় যুদ্ধ যার একমাত্র অস্ত্র হলো পড়াশোনা তার সাথে অঙ্গাঅঙ্গী ভাবে জরিয়ে আছে ভাগ্য। HSC র রেজাল্ট কবে দিবে ঠিক নেই, পাশ করবে কিনা তাও জানা নেই৷ কিন্তু অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি আগেভাগেই নিতে হচ্ছে। বয়সের তুলনায় মেয়েটা পড়াশোনায় একটু বেশিই এগিয়ে গেছে। ১৮ বছর বয়সে পা দিলো সবেমাত্র ২ মাস হয়েছে। তারমধ্যে HSC পরীক্ষা শেষ । কয়েকমাস পরে সে স্নাতক শিক্ষার্থী হতে চলেছে ভাবতেই কেমন যেনো নিজেকে বড় বড় মনে হয় মেঘের।

পড়াশোনা শেষ করে নিজের বিছানায় শুয়েছে হাতে তার নতুন মোবাইল। কিন্তু করবে কি সে, না আছে ফেসবুক আর না আছে অন্য কোনো একাউন্ট। ইউ*টিউবে ঢুকে কয়েকটা ভিডিও দেখে মোবাইল রেখে দেয়।

শুয়ে ভাবতে লাগে আবির ভাইয়াকে ধন্যবাদ জানানো দরকার কিন্তু সে তো ভয়ে দাঁড়াতেই পারবে না আবিরের সামনে.. পুরোনো স্মৃতিগুলো ভাবতে থাকে…

মেঘ সবেমাত্র ৫ম শ্রেণিতে উঠেছিল । বয়সের গন্ডি ৯-১০ এর মাঝামাঝি । তখন মেঘের একটা বন্ধু হয়েছিল নাম জয়৷ ছেলেটা স্কুলে নতুন এসেই বন্ধত্ব করেছিল মেঘের সাথে। ছোটবেলা পিচ্চিদের বন্ধুত্ব যেমন ছিল, চকলেট শেয়ার করা,টিফিন শেয়ার করা,একসাথে খেলাধুলা করা। ১ টা সপ্তাহ ও হয়নি তাদের বন্ধুত্বের। ৭ দিনের মাথায় আবির স্কুলে গিয়ে মেঘকে আর জয়কে একসাথে খেলতে দেখে। স্কুলের সবার মাঝখানে মেঘের গালে কয়েকটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছিল আর রাগান্বিত স্বরে বলেছিল তোকে যদি আর কোনোদিন কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে বা খেলতে দেখি তাহলে তোর খবর আছে। তারপর বোনকে টানতে টানতে বাড়িতে নিয়ে আসে, একটাবার বোনের দিকে তাকিয়েও দেখে নি। দুগালে আবিরের ৫ আঙুলের দাগ বসে গেছিলো।

সেইযে থাপ্পড় দিয়েছিল মেঘ এক সপ্তাহ জ্বরে পরে ছিল। মেঘ ছোট বেলা থেকেই খুব অভিমানী ছিল। ছোট্ট মেয়েটা এই থাপ্পড়ের ভয়ে আর আতঙ্কে আর কখনো আবিরের দিকে চোখ তুলে তাকায় নি, কথা বলা তো দূরের বিষয়, আবির বাসায় থাকাকালীন রুম থেকে বের ই হয় নি মেঘবালিকা । আবির ও কখনো খোঁজ নেয় নি মেয়েটার। ছোট্ট মেঘের মনে তখনই জন্ম নেয় আবির ভাই এর প্রতি অভিমান, সীমাহীন অভিযোগ, কষ্ট আর বিতৃষ্ণা। ২ বছর পর দেশ ছাড়ে আবির। এই সময়ের মাঝে মেঘ আবিরের সাথে এক টেবিলে খেতেও বসতো না। আবিরকে দেখলেই যেনো ছুটে পালাতো মেঘ৷ আবির বিদেশ চলে যাওয়ার পর মেঘ আবিরের ভয় থেকে নিজেকে সাবলীল করে আপন মনে রাজত্ব করতে থাকে খান বাড়িতে৷ আবিরের পাশের রুমটায় তার দখলে চলে আসে আবির থাকলে হয়তো কখনোই সে এই রুমে আসতো না।

বিদেশ যাওয়ার পর আবির সবার সাথে ভিডিও কলে কথা বলেছে কিন্তু কথা হয় নি মেঘের সাথে, ২-১ বার মেঘের কথা জিজ্ঞেস করেছিল ঠিকই কিন্তু মেঘ আতঙ্কে কথা বলতে চাই নি। এর পর থেকে আবিরও কখনো মেঘের কথা জিজ্ঞেস করে নি।।

এতবছর পর ভাই বাড়ি এসেছেন, এখনও দেখা হয় নি তারসাথে এরিমধ্যে মারপিট করে ফেলেছেন৷ ছোটবেলায় অনুভূতি প্রকাশ না করতে পারলেও আজ আবিরের কর্মকাণ্ডের কথা শুনে মেঘের মনে একটা নাম ই ঘুরপাক খাচ্ছে সেটা হলো ‘হিটলার’। হিটলারের সাথে আবিরের কতটা মিল বা বেমিল তা বিবেচনা করার বিন্দুপরিমাণ ইচ্ছে নেই তার ।। মাথায় একটা চিন্তায় ঘুরছে ধন্যবাদ জানানো উচিত কিন্তু সে কি আদোঃ কথা বলতে পারবে হিটলারের সাথে..??

এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পরলো সে

★★★

ভোর বেলা থেকেই বাড়িতে রান্নার ধুম পরে যায়। তিনভাই সকাল সকাল খেয়ে অফিসে চলে যায়। মীম আর আদিও স্কুলে চলে যায়। মেঘ ঘুম থেকে উঠে ৮ টায়, রাত জাগার কারণে সকালে উঠতে পারে না সে। মাঝে মাঝে গোসল করে খেয়ে বের হয় মাঝে মাঝে এমনিতেই চলে যায়।। ১০-২টা পর্যন্ত বাহিরে কোচিং,তারপর টিউশন শেষ করে বাড়ি ফিরে, ফ্রেশ হয়ে খেয়ে একটু ঘুমাই। বিকালে একটু হৈ-হুল্লোড় করে তারপর পড়াশোনা করে। এই তার বর্তমান জীবন। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।। খেয়ে কোচিং এর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরেছে, বাসার গাড়িই তাকে দিয়ে আসে আবার কল দিলে গিয়ে নিয়ে আসে।

ঠিকঠিক ১২ টায় ঘর থেকে বের হয় আবির ধীরগতিতে নিচে আসে , চিন্তিত মুখ দেখে মা মালিহা খান ভীতস্বরে ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কিছু হয়েছে তোর বাবা.?’

আবির মুখের ভারিভাব বজায় রেখে উত্তর দিলেন…
‘কিছু হয় নি, খেতে দাও’

ছোটবেলার চঞ্চলতার ছিটেফোঁটাও নেই ছেলেটার মধ্যে এটা ভেবেই বারবার হতাশ হচ্ছেন মালিহা খান। হঠাৎ চোখ পরে ছেলের হাতে ব্যান্ডেজের দিকে, হাতটাও ফুলে গেছে অনেকটা।৷

আবির খাবার খাচ্ছে আর তার মা শান্তস্বরে ছেলেকে বুঝাচ্ছেন, এটা করো না, সেটা করো না, মনে হচ্ছে ৫ বছরের শিশু সে, আগুন পানি চিনে না।। যদিও বাবা মায়ের কাছে সন্তানরা সারাজীবন শিশুই থাকে। খাওয়া শেষে মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায় আবির৷

★★★

মেঘ বাড়ি ফিরেছে ১ ঘন্টা হবে, শাওয়ার নিয়ে নিচে এসেছে খেতে। খাওয়া শেষ।

তানভির রুম থেকে ছুটে এসে জিজ্ঞেস করে
‘বড় আম্মু আবির ভাইয়া কোথায়?’

আঁতকে উঠেন মালিহা খান, ‘ও তো ২-৩ ঘন্টা আগেই খেয়ে বের হয়েছে, কেন?’

‘ইশ,মিস করে ফেললাম’

মালিহা খানঃ কি হয়েছে বাবা?

মেঘ নিরবে তাকিয়ে, ভাই আর বড় আম্মুর কথোপকথন শুনছে আর বুঝার চেষ্টা করছে ঘটনা টা কি৷

তানভির ভাইকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় আছো?’

আবির কি যেনো বললো শুনা যায় নি… তানভিরের চোখে মুখে উত্তেজনা স্পষ্ট।

বড় আম্মু,আম্মু, কাকিমনি বাহিরে চলো

কেউ প্রশ্ন করার আগেই তানভির ছোটে গেলো বাহিরে, তার পিছন পিছন মীম,আদি,মা কাকিরা সবাই দরজা পর্যন্ত গেলো,সবার পিছনে মেঘও গেলো সেখানে৷

এরিমধ্যে বাইকে বাড়ি ঢুকলো আবির, নীল রঙের চকচকে একটা সুন্দর বাইক,হেলমেট টাও নীল।
হেলমেট খুলতে খুলতে তাকায় বাড়ির মানুষের দিকে…. মেঘ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে
সেই কবে দেখেছিলো আবিরকে সেই আবিরের সাথে এই আবিরের চেহারার কোনো মিল নেই। হেলমেট খুলাতে চুল গুলো এলোমেলো হয়ে গেছে আবিরের, চোখে সানগ্লাস, নেভিব্লু রঙের শার্ট কালো প্যান্টের সাথে ইন করে পরেছে, হাতে কালো ফিতার একটা ঘড়ি, পায়ে শো জুতা। আপাদমস্তক দেখলো আবিরের, হৃদপিণ্ডের চারপ্রকোষ্ঠ ছটপট করতে লাগলো মেঘের। আবিরের দিকে বিভোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে৷

আবির বাড়ির সকলের উদ্দেশ্যে বললো, ‘বাইক টা কিনেছি,কেমন হয়েছে?’

আবিরের কন্ঠ মেঘের মনের গহীনে ধাক্কা খায় এতে হুঁশ ফিরে তার। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না সে। একদৌড়ে নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকে শুয়ে পরে মেঘ ।।

মীম আর আদি হৈ-হুল্লোড় করছে, আবির ভাইয়ার কাছে আবদার করছে ওদের বাইকে নিয়ে ঘুরার জন্য ।

মালিহা খান ছেলের পানে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘বাসায় ২-৩ টা গাড়ি থাকার পরও বাইক কেনো কিনলে?’

‘আমার গাড়িতে চলাচল ভালো লাগে না’,অবলীলায় উত্তর দিলো আবির।

পিচ্চিরা খুশি হলেও খুশি হতে পারেন নি মালিহা খান, হালিমা খান আর সালেহা খান। কারণ এই বাড়িতে বাইক ব্যবহার নিষেধ করেছিলেন স্বয়ং আহমদ আলী খান নিজেই। তিনি কোনো এক বয়সে বাইকে এক্সিডেন্ট করেছিলেন সেই থেকে বাইক কিনা বা বাইকে চলাচল নিষিদ্ধ করেছেন। ইকবাল খানের খুব ইচ্ছে ছিল বাইক কেনার কিন্তু বড় ভাইয়ের নিষেধ অমান্য করার সাধ্য নেই তাই কিনতে পারেন নি। তানভির খুব করে চাইছিল বাইক কিনতে, রাজনীতির সুবাদে অনেক জায়গায় চলাচল করতে হয় বাইক থাকলে সুবিধা হয়। বাবা মোজাম্মেল খানকে বলেও ছিল সে, কিন্তু বাবার এক কথা , তোর বড় আব্বু বাইক পছন্দ করে না তোর দরকার পড়লে তুই একটা গাড়ি সবসময় ব্যবহার করিস তারপরও বাইক কিনার নাম মুখে নিস না।

আবির বাড়ি ফিরেছে ২৪ ঘন্টা হবে হয়তো, এরমধ্যে ই বাইক কিনে ফেলছে, এর পরিণাম কি হবে তা ভেবেই ভয়ে আঁতকে যাচ্ছেন বাড়ির তিন বউ।।

পেইজঃ গল্প কথা
★★★

অষ্টাদশীর হৃদয় কাঁ*পছে, কেমন জানি অস্থির লাগছে সবকিছু। পরিচ্ছন্ন নয়নে তাকিয়ে আছে রুমের জানালার দিকে, দৃষ্টি তার অসীম দূরত্বে। কি জানি কি ভাবলো কতক্ষণ হঠাৎ ঝলমলিয়ে উঠলো মেঘ সঙ্গে সঙ্গে চোয়াল শক্ত করে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলো,

‘ বাই এনি চান্স আমি কি হিটলারটার উপর ক্রাশ খেয়েছি……???’

চলবে……

#আমৃত্যু_ভালোবাসি_তোকে
#লেখনীতে_সালমা_চৌধুরী
#পর্বঃ০৩

#বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন,গল্পটা কেমন লাগছে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। লাইক শেয়ার দিয়ে পাশে থাকবেন। ধন্যবাদ🤎

📌গল্প কপি করা নিষিদ্ধ 📌

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here