দ্বিতীয়_ফাগুন #পর্বসংখ্যা_১৮ #লেখিকা_Esrat_Ety

0
544

#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্বসংখ্যা_১৮
#লেখিকা_Esrat_Ety

“তুই এখানে ঘাপটি মেরে বসে আছিস কেনো?”

আদিল ভাইয়ের ডাকে চমকে ওঠে। ভীত চোখে তাশরিফের দিকে তাকায়। লজ্জায় তার ভাইয়ের চোখে চোখ রাখতেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে এরকম একটা কান্ড ঘটে যাবে কখনোই বুঝে উঠতে পারেনি সে ! এখন বৃষ্টির সামনেই বা কিভাবে যাবে! বাবা মা,বন্ধু বান্ধব সবাইকে কিভাবে ফেইস করবে দু’জনে। সমাজ দুটো খোঁচা মেরে কথা শুনিয়ে দিতে ছাড়বে না!
তাশরিফ আদিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আদিলকে ধমকে বলে,”কি ব্যাপার। এখানে এভাবে লুকিয়ে আছিস কেনো?”

আদিল চুপ করে আছে। যে ভাইয়ার সাথে সে এতটা ফ্রি আজ তার চোখে চোখ রাখতেও পারছে না সে। তাশরিফ আবারো ধমকে ওঠে,”সমস্যা কোথায়?”

_মা বাবার সামনে যেতে খুব লজ্জা করছে ভাইয়া। আমাকে যদি মা জুতাপেটা করে?
তাশরিফ হেসে ফেলে,”তুই বাবা হতে যাচ্ছিস। এজন্য তোকে জুতাপেটা করবে কেনো? এটা কি জুতাপেটা করার মতো কোনো খবর? মা ভীষণ খুশি হয়েছে। মায়ের চোখ দেখে আমি বুঝেছি।”

আদিল মাথা নিচু করে রাখে। তাশরিফ বলে,”তোর শশুর বাড়ীর লোক এসেছে। তোর শশুর এসেছে। চল এখন। তারা কি মনে করছে বলতো? তোকে কান্ডজ্ঞানহীন ভাবছে সবাই।”

_ভাবলে ভাবুক। আমি ওই সিমেন্ট আপুর সামনে কিছুতেই যেতে পারবো না। আমাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। আমাকে ছেড়ে দাও ভাইয়া। আমি ওই মহিলার সামনে যেতে চাইনা।

তাশরিফ ভাইয়ের হাত ধরে,”কিচ্ছু বলবে না। তুই আয় আমার সাথে।”
হাত ধরে টানতে টানতে বৃষ্টির কেবিনে নিয়ে যায় আদিলকে। মেঘলা বৃষ্টির বেডে বসে বোনকে আগলে ধরে রেখেছে,একটু পরপর চোখের পানি মুছছে,তাদের মান অভিমানের পালা শেষ হলো মাত্র। রুহুল আমিন সোফায় বসে মেয়ের দিকে স্নেহমাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেদিনের সেই ছোট্ট বৃষ্টি আজ কতো বড় হয়ে গিয়েছে। দুদিন পরে সেও মা হবে! কোনো এক অজানা কারনে সে খুশি হয়েছে।

কেবিনের এক কোনায় রোদেলা থমথমে মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আদিলকে দেখে চোখ মুখ শক্ত করে ফেলে সে। আদিল ভয় পেয়ে একটা ঢোক গিলে ফেলে। রুহুল আমিনের কাছে গিয়ে নিচুস্বরে বলে,”আসসালামুয়ালাইকুম বাবা।”
মাথা উঠিয়ে রুহুল আমিন আদিলকে দেখে। তারপর সালামের উত্তর দেয়। মেঘলার দিকে তাকিয়ে সালাম দিলে মেঘলাও সালামের উত্তর দেয়। ভয়ে ভয়ে রোদেলার দিকে তাকিয়ে আদিল মৃদু স্বরে বলে,”আসসালামুয়ালাইকুম আপু।”

রোদেলা সালামের উত্তর না দিয়ে মাথা নাড়ায় শুধু। তাশরিফ বলে,”বৃষ্টিকে ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছে। ওকে এখনি নিয়ে যেতে পারবো বাড়িতে।”

রোদেলা বলে ওঠে,”আমার বোনকে আমি আমাদের সাথে নিয়ে যাবো। ও এখন থেকে এই কয় মাস আমাদের কাছে থাকবে।”

তাহমিনা অবাক হয়ে বলে,”তোমাদের সাথে নিয়ে যাবে মানে? ও আমাদের বাড়ির বৌ। এই অবস্থায় তোমাদের বাড়িতে যাবে কেনো? ওর স্বামীর বাড়িতে যাবে।”

রোদেলা কন্ঠে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে,”আপনার গুণধর ছেলে তো আমার বোনের পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে, এখন এই অবস্থায় আমাদের কাছে রাখলে একটু ভালোভাবে পড়তে পারবে। ওর ইয়ার লস যাক তা আমি চাচ্ছি না।”

তাহমিনা ভ্রু কুঁচকে ফেলে,”তোমার বোনকে দিয়ে আমি এই অবস্থায় কাজ করাবো নাকি যে ওর পড়াশোনা নষ্ট হয়ে যাবে? ওর কাজ হবে শুধু খাওয়া আর পড়া। ওকে জিজ্ঞেস করে দেখো কখনো ওকে দিয়ে কাজ করাই কি না কোনো, জিজ্ঞেস করো তোমার বোনকে।”

তাশরিফ একবার মায়ের দিকে আর একবার রোদেলার দিকে তাকিয়ে তাদের ঠান্ডা যুদ্ধ দেখতে থাকে। দু’জনেই সমান জেদী। এদের মাঝখানে পরে ভবিষ্যতে তাশরিফকে চিড়া চ্যাপ্টা হতে হবে তা তাশরিফ বেশ বুঝতে পারছে।
আদিল মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সে বৃষ্টিকে কিছুতেই এই অবস্থায় কাছ ছাড়া করবে না। কিন্তু জোর খাটিয়ে বলার সাহস ও পাচ্ছে না সে।
আফতাব হাসান বলে,”বৃষ্টি কোথায় থাকবে তা পরে দেখা যাবে। আগে মেহমান নিয়ে বাড়ি যাই কি বলিস তাশরিফ?”

_হ্যা। সেটাই।
তাশরিফ হেসে বলে। রোদেলা বলে,”আমরা কোথাও যেতে চাচ্ছি না এখন। বৃষ্টিকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে যাবো।”

তাহমিনা চেঁচিয়ে ওঠে,”এই মেয়েটা তো ভীষণ জেদি। মুরব্বিদের মুখের উপর কথা বলছে কিরকম।”
রুহুল আমিন রোদেলাকে ধমকের সুরে বলে,”কি হচ্ছে রোদেলা।”

রোদেলা বাবার কথা গায়ে না মেখে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,”তুই বল। তুই কোথায় যাবি। আমাদের সাথে যাবি? নাকি ওনাদের সাথে যাবি?”

বৃষ্টি সবার মুখের দিকে তাকায়। এতদিন পরে মেজো আপু তার কাছে এসেছে এখন যদি মেজো আপুকে ফিরিয়ে দেয় তাহলে কেমন হবে! মেজো আপু আবারো কষ্ট পাবে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে বৃষ্টি নিচু স্বরে বলে ওঠে,”আমি আমার শ্বশুরবাড়িতে যেতে চাই আপু।”

রোদেলা বোনের দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে। আদিল খুশি হয়ে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে,”এই না হলে আমার বৌ!”

***
হসপিটাল থেকে রোদেলারা বাড়িতে চলে আসে। আফতাব হাসান যদিও অনেকবার বলেছিলেন তাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা। তারা যায়নি।
রোদেলার মেজাজ ঠিক নেই। বৃষ্টির ওপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার,সেই সাথে হিংসাও হচ্ছে খুব। কয় মাসের মধ্যে ওই বাড়ির লোক এতোটা আপন হয়ে গেলো বৃষ্টির!
আয়েশা সিদ্দিকা দরজা খুলে দিলে রোদেলা সরাসরি নিজের ঘরে চলে যায়। মেঘলা বসার ঘরে ঢুকে দেখে সুহা আর সিরাত সোফাতে বসে আছে। সে আয়েশার দিকে তাকায়। আয়েশা বলে,”অনেকক্ষণ হলো এসেছে দুজন। তোমার কথা বারবার বলছে,তুমি কখন আসবে জিজ্ঞেস করছে। ওদের দাদী এসেছিলো নেওয়ার জন্য এইমাত্র। যায়নি।”

মেঘলা সিরাত আর সুহার দিকে তাকিয়ে হাসে। ওরাও হাসে।

“নাও এটাও খাও।”
তাহমিনা বৃষ্টির প্লেটে আরো এক পিস মাংস তুলে দিয়ে বলে। বৃষ্টি মাথা নিচু করে খাচ্ছে। তার ভীষণ লজ্জা লাগছে কারো মুখের দিকে তাকাতে।
আফতাব হাসান বলে,”রাগ যখন পরেই গিয়েছে ওনাদের একদিন দাওয়াত করে দে তাশরিফ। বৃষ্টির কাছে ওনাদের আসা যাওয়া থাকবে, বৃষ্টির ভালো লাগবে।”

তাশরিফ মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। তাহমিনা বলে,”মেজো মেয়েটাকে আমার একটুও ভালো লাগলো না। অনেক ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করলো দেখলি। বড় টাকে ঠিকঠাক মনে হলো।”

তাশরিফ মাকে চোখ রাঙানি দেয়। বৃষ্টি কিছু বলে না শাশুড়ির কথায়,খাওয়া শেষ করে উঠে চলে যায় ঘরে। আদিল বৌয়ের পিছু পিছু যায়। তাশরিফ কন্ঠে বিরক্তি নিয়ে বলে ওঠে,”মা এভাবে বৃষ্টির সামনে কেন বললে? বৃষ্টির খারাপ লাগে না?”
_বৃষ্টির খারাপ লাগেনি। কিন্তু তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে তোরই খারাপ লেগেছে।
তাশরিফ থতমত খেয়ে যায়। তাহমিনা বলতে থাকে,”কেনো ভুল বলেছি নাকি? বলে কিনা আমাদের বাড়ির বৌকে তাদের কাছে নিয়ে রাখবে। মামার বাড়ির আবদার নাকি?

_বাদ দাও না মা। বৃষ্টি খুব ছোটো তো তাই তাদের টেনশন হচ্ছে।

_হুম বুঝলাম।
আদিলের প্লেটের দিকে তাকিয়ে তাহমিনা বলে,”দেখেছিস গাধাটা না খেয়েই বৌয়ের পিছু পিছু রুমে চলে গেলো। এতো পুরো বৌ পাগলা হয়েছে!

তাশরিফ হাসে। তাহমিনা বলে,”তুই হাসছিস কেনো। তোর বিয়ে তো মনে হয় এই জন্মে আমি দেখে মরতে পারবো না ‌। আদিলকে সবসময় বলতাম তোর পা ধোয়া পানি খেতে। এখন তোকে বলছি, ছোটো ভাইয়ের পা ধোয়া পানি খা যা।”

তাশরিফ শুকনো হাসি হাসে। মনে মনে বলে,”ঠিক বলেছো মা। এজন্মে আমার বিয়ে হয় কি না সন্দেহ।”

***
মেঘলার অস্বস্তি হচ্ছে খুব। মাইনুল সেদিন যেসব বাজে কথা শুনিয়ে দিয়ে গিয়েছে তারপর থেকে সাদাফের সামনে মেঘলা পরেনি। কিন্তু এই নিষ্পাপ বাচ্চা দুটো তাকে বারবার সাদাফের সম্মুখীন করে দিচ্ছে।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সাদাফ নিচু স্বরে বলে,”সুহা সিরাত কে নিতে এসেছি। মা বললো ওরা আপনার কাছে।”

_হু।
মৃদু স্বরে বলে মেঘলা।
_ডেকে দিন ওদের।
_ওরা ঘুমিয়ে গিয়েছে।

সাদাফ মেঘলার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘলা দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। সাদাফ খানিকটা বিব্রত মুখ নিয়ে ভেতরে ঢোকে। মেঘলা আঙ্গুল দিয়ে তার ঘর দেখিয়ে দিয়ে বলে,”ওরা ওই ঘরে ঘুমিয়ে আছে।”
সাদাফ ধীরপায়ে মেঘলার ঘরে যায়। এভাবে একজন ভদ্রমহিলার শোবার ঘরে ঢুকতে তার মন একটুও সায় দিচ্ছে না। মেঘলা পিছু পিছু এসে বলে,”দুজনকে একসাথে কিভাবে নিয়ে যাবেন? আমি একজনকে পৌঁছে দিয়ে আসবো?”

_আপনি পারবেন না। আমি সুহাকে নিচে রেখে এসে সিরাতকে নিয়ে যাচ্ছি।

সাদাফ ঘুমন্ত সুহাকে কোলে করে নিয়ে যায়। মেঘলা সিরাতের মাথার কাছে বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর সাদাফ আসে। সিরাতকে কোলে উঠানোর আগে মেঘলার দিকে একপলক তাকায় সে। নিচু স্বরে বলে,”আমার বাচ্চা দুটো আপনাকে খুব বিরক্ত করে।”

মেঘলা একটা হাসি দিয়ে বলে,”অসুবিধা নেই। আমার জীবনে তো বিরক্ত করার মতো কেউ নেই। আর কখনো হবেও না।”

***
“এখানে কি হচ্ছে?”

রোদেলা পা বাড়িয়ে এপার্টমেন্টের কেয়ার টেকার রিয়াজের দিকে এগিয়ে যায়।
রিয়াজ রোদেলার দিকে ভীত চোখে চায়। এই আপাটাকে সে প্রচন্ড ভয় পায়। যখন তখন,যাকে তাকে চড় থাপ্পড় মারে।

বেবী রোদেলাকে দেখে চেঁচিয়ে বলে,”আপা দেখেন এই রিয়াজ আমাকে দেখলেই বেবী ট্যাক্সি বলে ডাকে।”

রোদেলা রিয়াজের দিকে তাকিয়ে চোখ গরম করে বলে,”তুমি বেবীকে বেবী ট্যাক্সি বলো কেনো? এসব কোন ধরনের অসভ্যতামি। সালমান সাদাফের কাছে জানাতে হবে নাকি?”
রিয়াজ ভয় পেয়ে বলে,”না আপা,না আপা,আমি তো একটু মজা করছি। আর করবো না।”
রিয়াজ দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে যায়। রোদেলা বেবীর দিকে তাকিয়ে বলে,”ফের যদি তোমাকে বিরক্ত করে সোজা সাদাফ ভাইয়ের কাছে বলবে। ঠিকাছে?”
বেবী মাথা নাড়ায়। রোদেলা বলে,”এখন কোন বাসায় কাজের পালা?”
_চার তলায়, ডাক্তার সাহেবের ফ্ল্যাটে। আপনাদের ফ্ল্যাটে পানি দিয়ে এসেছি।

“ঠিকাছে” বলে রোদেলা সামনের দিকে পা বাড়ায়। বেবী পেছন থেকে ডেকে ফেলে,”আপা।”

রোদেলা তাকায়। বেবী বলে,”একটা কথা ছিলো।”
_কি বলো।
রোদেলা বেবীর দিকে তাকিয়ে আছে। বেবী এদিক ওদিক তাকিয়ে গলার স্বর নিচু করে বলে,”আগে কসম কাটেন আমি যে আপনাকে বলছি তা কাউকে বলবেন না। আমার চাকরি চলে যাবে তাহলে।”

রোদেলা বলে,”আচ্ছা ঠিকাছে বলবো না।”
বেবী রোদেলার আরো কাছে এগিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলে,”মেঘলা আপাকে নিয়ে এই বিল্ডিং-এর অনেক লোকে আজেবাজে কথা বলে।”

রোদেলা হতভম্ব হয়ে যায়,”আজে বাজে কথা বলে মানে? কি বলে?”

_দুই তলার স্যারের বৌ আর চার তলার ডাক্তার সাহেবের বৌ সেদিন বলছিলো মেঘলা আপা নাকি সাদাফ ভাইজানের গায়ে পরতে চায়। তার বাচ্চা দুইটাকে হাত করে তার গলায় ঝুলে পরতে চায়।

রোদেলা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। সে কি বলবে কিছু বুঝতে পারছে না। বেবী বলতে থাকে, “চার তলায় যে সীমা আপারা আছে না? তারা নাকি বলাবলি করছিলো মেঘলা আপা প্রায়ই খালি বাসায় সাদাফ ভাইয়ের কাছ যায়। সীমা আপাদের কাজের মেয়ে শেলী আমাকে বলেছে। সারাদিন মেঘলা আপা আর সাদাফ ভাইকে নিয়ে কেচ্ছাকাহিনী বলে।”

রোদেলা নিশ্চুপ হয়ে থাকে। বেবী বলে,”আমি আপনাকে খুব পছন্দ করি আপা,তাই আপনাকে বললাম। দয়া করে আমার নাম বলবেন না আপা।”

_ঠিকাছে। বলবো না। তুমি যাও।
অস্ফুট স্বরে বলে রোদেলা। বেবী চলে যায়। রোদেলা চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে।

***
মেঘলা দরজা খুলতেই সিরাত সুহা তার উপরে ঝাপিয়ে পরে। মেঘলা দুজনের ওজন সামলাতে না পেরে মেঝেতে পরে যায়। তারপর তিনজনই উচ্চশব্দে হাসতে থাকে। হাসি থামিয়ে মেঘলা বলে,”এখন না তোমাদের স্কুলে থাকার কথা? এখানে কি করছো? ”
_আজ স্কুলে যাইনি আন্টি।
_ওমা,তা কেনো?
_আজ বাবার বার্থডে। আমরা বাবাকে সারপ্রাইজ দেবো তাই বাবার জন্য গিফট কার্ড বানাচ্ছি। বাবাকে বলেছি আজ পেটে ব্যাথা আমাদের। তাই স্কুলে যাবো না।
_একসাথে দুজনের পেট ব্যাথা? এটা বাবা বিশ্বাস করেছে?

সুহা গম্ভীর হয়ে বলে,”না। প্রথমে বিশ্বাস করেনি। পরে মিথ্যা করে কান্না করেছি, তারপর বিশ্বাস করেছে।”

মেঘলা হাসে। তারপর সুহার নাক টিপে দিয়ে বলে,”তা আমার কাছে কি দরকারে এলে? আমি কি করতে পারি?”

_তুমি গিফট কার্ড বানিয়ে দেবে আমাদের। চলো চলো এক্ষুনি নিচে চলো।
মেঘলার হাত ধরে সুহা টানতে থাকে। মেঘলা চিন্তায় পরে যায়। সিরাতের দিকে তাকিয়ে বলে,”বাড়িতে এখন কে কে আছে তোমাদের? তোমার বাবা আছে?”
সিরাত বলে,”না। শুধু দাদী আছে। বাবা তো কোথায় চলে গিয়েছে।”
মেঘলা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সাদাফ বাড়িতে নেই। তাহলে তো যাওয়াই যায়।

অফিসে গিয়ে রোদেলা শুকনো মুখ করে বসে আছে। বেবীর থেকে যা শুনেছে তাতে রোদেলা একটুও স্বস্তি পাচ্ছেনা। তাদের সাথেই এমনটা কেনো হচ্ছে বারবার! মেঘলা আপুর সরলতা মেঘলা আপুর জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে আপুকে অপদস্থ হতে দেখতে পারবে না। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় আজ বাসায় গিয়েই সালমান সাদাফকে জানিয়ে দেবে তারা তার ফ্ল্যাট ছেড়ে দেবে। এই কথা গুলো যদি ঘুনাক্ষরেও মেঘলা আপু শুনতে পায় তবে আপু ভীষণ কষ্ট পাবে। তার আগে এখান থেকে তাদের চলে যাওয়াই ভালো।

***
সাদাফদের ফ্ল্যাটে ঢুকে মেঘলা এদিকে ওদিকে তাকিয়ে বলে,”তোমাদের দাদী কোথায়?”

_দাদী ঘুমিয়েছে। দুপুর হলেই দাদী ঘুমিয়ে যায় আর নাক ডাকে।
কথাটি বলেই সিরাত হাসে। মেঘলাও হেসে ফেলে। সুহা মেঘলার হাত ধরে টানতে টানতে তাদের ঘরে নিয়ে যায়,”এসো আন্টি। কালার পেপার গুলো বাবার ঘরে। এসো।”

মেঘলা অস্বস্তি নিয়ে পা বাড়ায়। দরজা ঠেলে যেই না ভেতরে ঢুকবে অমনি ভেতর থেকে সাদাফ বলে ওঠে,”সুহা সিরাত,এভাবে দরজা খোলা রেখে উপরে গিয়েছিলে কেনো?”

মেঘলা থমকে দাঁড়িয়ে থাকে। সাদাফ একটা ট্রাউজার পরে আছে,খালি গায়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে দরজার দিকে তাকিয়ে মেঘলাকে দেখতে পেয়ে থতমত খেয়ে যায়।

মেঘলা বিব্রত হয়ে ঘুরে যায়। সাদাফ তড়িঘড়ি করে একটা টি-শার্ট গায়ে চাপিয়ে নেয়। সিরাত আর সুহাও অবাক হয় তাদের বাবাকে দেখে। বাবা তো বাইরে গিয়েছিলো। এখানে কিভাবে এলো? এখন তো তাদের প্ল্যানের কথা বাবা জেনে যাবে!

মেঘলা অস্বস্তি নিয়ে বলে,”ওরা টেনে এনেছে আমাকে, আপনার জন্য গিফট কার্ড বানিয়ে দিতে।”

সুহা আর সিরাত কপাল চাপড়ে চেঁচিয়ে বলে,”আন্টি তুমি বাবাকে বলে দিলে !”

মেঘলা অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। ঘাবড়ে গিয়ে সে বলে দিয়েছে সুহা সিরাতের গোপন কথা। সে তার দোষ ঢাকতে বলে,”কোনো সমস্যা নেই সুহা সিরাত,গিফট কার্ড বানাবো বলেছি। আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে বানিয়ে তারপর সারপ্রাইজ দেবো। চলো বানিয়ে দেই।”
সুহা সিরাতের হাত ধরে মেঘলা বসার ঘরের দিকে যায় রঙ্গিন কাগজ গুলো নিয়ে।

সুহা সিরাত মন খারাপ করে বসে আছে। মেঘলা ওদের শান্তনা দিয়ে বলে,”দেখবে এমন সুন্দর গিফট কার্ড বানাবো যে বাবা চমকে যাবে। লাফিয়ে উঠে বলবে “ওয়াওও”!

দু’জনেই আগ্রহী হয়ে ওঠে। মেঘলা পেন্সিল বক্স থেকে একটা লাইটার উঠিয়ে ওদের দিকে তাকায়,”এটা এখানে কেনো? এটা কার?”

_বাবার ড্রয়ার থেকে চুরি করেছে সুহা।
সিরাত ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে।

মেঘলা নিজের কাজে মন দেয়। কি করবে সে সেটাই বুঝতে পারছে না। কাগজ কেটে ফুল বানাতে থাকে সে। অবাঞ্ছিত টুকরো কাগজ গুলি পাশে স্তুপ করে রাখে।

সুহা সিরাত ক্যান্ডেল গুলো বের করে একটা বক্স থেকে। তাদের বার্থডেতে বাবা এনেছিলো, সেখান থেকেই এগুলো বেঁচে গিয়েছে। তারা দাদীর কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছে।
মেঘলার দিকে তাকিয়ে সিরাত বলে,আন্টি ক্যান্ডেল গুলো জ্বালিয়ে দেবো?
_না হাতে লেগে যাবে।
_তুমি জ্বালিয়ে দাও তবে।
মেঘলা লাইটার দিয়ে একটা ক্যান্ডেল জ্বেলে দেয়। সুহা সিরাত বাকি ক্যান্ডেল গুলো জ্বালাতে থাকে। হঠাৎ একটা লাল রঙের ক্যান্ডেল নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া লেগে যায়। দু’জনেই ক্যান্ডেলটা জ্বালানোর জন্য ইচ্ছুক। ক্যান্ডেলটা ধরে টানাটানি করছে দুজনে। মেঘলা ওদের থামাতে চেয়ে সামনে এগোতেই মেঘলার হাতের ধাক্কা লেগে একটা জ্বেলে রাখা ক্যান্ডেল কাত হয়ে পরে যায় কাগজের উপরে। কাগজগুলো চোখের পলকেই দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে।

মেঘলা দিশেহারা হয়ে বাচ্চা দুটোকে আগলে নিয়ে পিছিয়ে যায়। দেখতে দেখতে সবগুলো কাগজ জ্বলে ওঠে। মেঘলা একটা বিকট চিৎকার দেয়। সাদাফ নিজের রুম থেকে প্রায় ছুটে আসে। মেঘলা বাচ্চা দুটোকে দুহাত দিয়ে আগলে রেখেছে শক্ত করে। সাদাফ হতভম্ব হয়ে যায়, দিকবিদিক শূন্য হয়ে একটা ফুলদানি দিয়ে আগুন চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে গিয়ে তার হাতে আগুনের আঁচ লেগে যায়।
জাহানারা ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে আসে। একটা পানির বোতল এনে আগুনে ঢেলে দেয়। মেঘলা আতংকিত হয়ে সাদাফের দিকে তাকিয়ে আছে। হাতটা পুড়ে গিয়েছে কিছুটা বোধ হয় লোকটার। মুখটা কেমন যন্ত্রনায় নীল হয়ে গিয়েছে।

আগুন নিভে গিয়েছে। মেঘলা দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে একটা বাটিতে পানি নিয়ে আসে। সাদাফের কাছে এসে তার হাতটা টেনে বাটির মধ্যে ডুবিয়ে দেয়।

সাদাফ মেঘলার দিকে তাকিয়ে তাকে দেখছে। কিছুক্ষণ আগে সুহা সিরাতকে আগলে ধরে মেঘলার দাঁড়িয়ে থাকা,এখন আবার সাদাফের কেয়ার নেওয়া। সবকটা দৃশ্য সাদাফের মনে অদ্ভুত একটা অনুভুতির সৃষ্টি করে দেয়। হঠাৎ তার মনের কোনো একটা স্থান থেকে কেউ বলে ওঠে,”খারাপ হয় না সাদাফ! কেউ এভাবে সুহা,সিরাত আর তোমার কেয়ার নিলে সত্যিই খারাপ হয়না। ”

***
” স্যার শুনুন”

তাশরিফ পিছনে ফিরে তাকায়। তার পেঁচা মুখী তার দিকে এগিয়ে আসছে। সে খুশি হয়ে যায়। ব্যাপার কি! আজ সূর্য কোনদিক থেকে উঠলো!
রোদেলা তাশরিফের কাছে চলে আসে। তাশরিফের চোখে চোখ রেখে বলে,”বাসায় যাচ্ছেন?”
তাশরিফ মনে মনে বলে,”হ্যা। তবে আপনি চাইলে কাজী অফিসে যাবো এখন।”
কিন্তু মুখে বলে,”হ্যা। কেনো?”
_আমি বৃষ্টির জন্য কিছু হেল্থ ড্রিংকস আর ফল কিনে দিতে চাচ্ছিলাম। কষ্ট করে নিয়ে যাবেন একটু?

তাশরিফ হেসে বলে,”বাড়িতে ওর জন্য এগুলো সব কিনে রেখেছি আমি।”
_আপনি কিনে দিয়েছেন বলে আমি কিনে দিতে পারবো না?

_না না তা কেনো। অবশ্যই পারবেন।
_তাহলে চলুন,পাশেই একটা বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আছে। ওখানে যাই।
রোদেলা হাঁটতে থাকে,তাশরিফ বাধ্য ছেলের মতো রোদেলার পিছু পিছু হাটে।

লিস্ট দেখে দেখে সবকিছু উঠিয়ে শপিং কার্টে রাখতে থাকে রোদেলা। তাশরিফ চুপচাপ তাকে দেখছে। কখনোও যদি তাদের বিয়ে হয় তাহলে এভাবে দুজন একসাথে শপিং করবে। সেদিনের কথা কল্পনা করে আনমনে হাসে তাশরিফ।

“আরে তাশরিফ যে।”
তাশরিফের কলেজের এক বান্ধবী পেছন থেকে ডাকে। তাশরিফ ঘুরে তাকায়। মেয়েটি বলতে থাকে,”সাথে কে? ভাবী নাকি? বিয়ে করলি কবে?”

তাশরিফ থতমত খেয়ে যায়। তার এই বান্ধবী একটু ফটর ফটর বেশি করে।‌ তাশরিফ মেয়েটিকে কিছু বলতে যাবে তখন মেয়েটি আবারো বলে,”এখানে ম্যাটার্নিটি জোনে কি করছিস? কার জন্য কিনছিস এসব? প্রেগন্যান্ট কে? ভাবী প্রেগন্যান্ট?”

তাশরিফ তার বান্ধবীকে চোখ রাঙানি দিয়ে থামিয়ে দিয়ে ভয়ে ভয়ে রোদেলার দিকে তাকায়। রোদেলা চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে।

মেয়েটি চলে গেলে তাশরিফ রোদেলাকে বলে,”বুঝতে পারেনি।”

রোদেলা ঠান্ডা গলায় বলে,”বুঝতে না পারলে এতো কথাই বা বলতে হবে কেনো? আচ্ছা একটা কথা বলুন তো আপনারা সব বন্ধুরাই কি সস্তা ধরনের রসিকতা করার স্পেশাল কোর্স করেছিলেন কোনো ইনস্টিটিউট‌ থেকে?”

চলমান……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here