দ্বিতীয়_ফাগুন #পর্বসংখ্যা_১৭

0
344

#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্বসংখ্যা_১৭
#লেখিকা_Esrat_Ety

দরজার ওপাশে সাদাফকে দেখে খানিকটা বিব্রত হয় মেঘলা। অস্বস্তি কাটাতে সাদাফকে বলে,”আন্টি কোথায়?”
সাদাফ দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়,বলে,”আমার বোন এসেছে বেড়াতে। মাকে নিয়ে আমার বোন একটু বের হয়েছে। কোনো দরকার?”

_সিরাতের কি অবস্থা?
_আজ একজন নার্স এসে সেলাইয়ের সুতা কেটে দিয়ে যাবে।

মেঘলা কয়েক মুহূর্ত দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। বাড়িতে সাদাফ আর সুহা,সিরাত ছাড়া আর কেউ নেই। এখন ফ্ল্যাটে ঢোকা টা কি ঠিক হবে?

মেঘলা ঢোকে। সাদাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”সিরাত কোথায় আছে?”
সাদাফ আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সিরাতের ঘর।

সুহা একটা পুতুল নিয়ে খেলছিলো। মেঘলাকে দেখে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। কিন্তু সিরাত খুব খুশি হয়। সে দুদিনেই মেঘলাকে বেশ পছন্দ করে ফেলেছে। বিছানায় গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে সে।
মেঘলা গিয়ে বিছানার এক পাশে বসে। সিরাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”কি অবস্থা এখন আমার সিরাত বাবুর?”

সিরাত লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসে। মেঘলা আন্টির মুখে “সিরাত বাবু” ডাকটা তার বেশ পছন্দ হয়েছে। মৃদু স্বরে বলে,”অল্প ব্যথা করছে আন্টি। বেশি ব্যথা করছে না।”
সাদাফ ঘরে ঢোকে। সিরাত মেঘলাকে বলে,”আমি চাউমিন খাবো আন্টি। আমাকে চাউমিন বানিয়ে দাও।”

সাদাফ সিরাতকে বলে ওঠে,”বাবা ফুপি এসে বানিয়ে দেবে। আন্টিকে বিরক্ত করো না।”

মেঘলা সাদাফকে বলে,”বিরক্ত হইনি আমি। বানিয়ে দিচ্ছি। আমার কোনো অসুবিধা নেই। দেখছেন না ভদ্রলোক অসুস্থ,তার আদেশ অমান্য করা ঠিক হবে না।”
তারপর সিরাতের দিকে তাকিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,”ঠিকাছে জাহাপনা। এক্ষুনি আপনার সামনে আমি চাউমিন হাজির করছি।”

সিরাত মজা পেয়ে হোহো করে হেসে ফেলে। সাদাফ মুগ্ধ হয়ে সিরাতের হাসি দেখে। অনেকদিন পর সে তার ছেলেকে এভাবে হাসতে দেখছে।

সুহা দূরে দাঁড়িয়ে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে মেঘলার দিকে। সিরাতকেই শুধু ভালোবাসে ওই মেয়েটা। তাকে কেনো ভালোবাসে না? সেও ভালোবাসবে না ওই মেয়েটাকে। রাগে ফুঁসছে সে।

মেঘলা রান্নাঘরের দিকে যায়। সুহা এসে তার বাবাকে বলে,”ওই আন্টিকে চলে যেতে বলো। ওকে এক্ষুনি চলে যেতে বলো।”
সাদাফ বিরক্ত হয়ে বলে,”কি হচ্ছে সুহা? এমন করছো কেনো তুমি?”

_ও কেনো আমাদের কিচেনে ঢুকেছে। ওকে চলে যেতে বলো।

“শুনছেন। আমি টমেটো কেচাপ টা খুজে পাচ্ছি না। একটু কোথায় আছে বলবেন?”

মেঘলা রান্নাঘর থেকে গলার স্বর কিছুটা উঁচুতে তুলে সাদাফকে বলে।
সাদাফ সুহার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,”চুপচাপ এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে। আন্টির সাথে কোনো বেয়াদবি করবে না।”

তারপর সে রান্নাঘরের দিকে যায়। সুহা চোখ মুখ কঠিন করে ফেলে।

সাদাফকে দেখে মেঘলা লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,”টমেটো কেচাপ টা কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।”

সাদাফ ফ্রিজ খুলে কেচাপের বোতলটা বের করে মেঘলাকে দেয়। মেঘলা হেসে বলে,”ফ্রিজের কথাটা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো। আমি কেবিনেট গুলোতে খুঁজছিলাম।”
এমন সময় খট করে দরজা লক হবার শব্দ হয়। মেঘলা চমকে উঠে সাদাফের দিকে তাকায়। রান্নাঘরের দরজা সুহা লক করে দিয়েছে। সাদাফ দরজার কাছে গিয়ে ধমকের সুরে বলে,”এসব কি হচ্ছে সুহা! দরজা খোলো।”
বাইরে থেকে সুহা খিলখিল করে হাসে। মেঘলা বিব্রত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আজ একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। কেন যে সে এখানে ঢুকতে গেলো! দরজা থেকেই সিরাতের খবর নিয়ে চলে যাওয়া উচিত ছিলো।

সাদাফ কিছুক্ষণ দরজায় ধাক্কা দিয়ে মেঘলার দিকে তাকায়। মেঘলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সাদাফ অপরাধী গলায় বলে,”এতো দুষ্টু হয়েছে! আপনি একটু অপেক্ষা করুন। দেখছি কি করা যায়।”

সাদাফ সুহাকে ডাকে,”সুহা দরজা খোলো‌।”
সুহা বাবাকে নকল করে বলে,”সুহা দরজা খোলো।”

এমন সময় কলিংবেলের আওয়াজ হয়। সাদাফ সুহাকে ডেকেই চলেছে। সুহা দরজা খুলছে না। কিছুক্ষণ পরে দরজা খোলার শব্দ হয়। দরজা খুলে জাহানারা মেঘলা আর সাদাফের দিকে তাকিয়ে থাকে। জাহানারার পেছন থেকে উকি দেয় সাদাফের ছোটো বোন সেতু। তারা অবাক হয়ে মেঘলা আর সাদাফকে দেখে। সাদাফ নিচু স্বরে বলে,”উনি সিরাতের জন্য চাউমিন বানাচ্ছিলেন‌। আমি টমেটো কেচাপের বোতলটা দিতে এসেছিলাম। সুহা বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।”

মেঘলা কয়েক মুহূর্ত থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে তারপর এক দৌড়ে সাদাফদের ফ্ল্যাট থেকে বেড়িয়ে যায়।

ঘরে ঢুকে মেঘলা দরজা লাগিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। আজ একটা বিরাট বড় কেলেঙ্কারি হয়ে যেতে পারতো। ভাগ্যিস সাদাফের মা বোন এসেছিলো,অন্য কেউ হলে তো কেচ্ছাকাহিনী রটিয়ে ফেলতো। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ইহ জনমে আর সালমান সাদাফের ফ্ল্যাট মুখো হবে না সে।

***
এপার্টমেন্টের গেইটের সামনে একটা কুকুর বসে আছে। দাঁড়োয়ান চাচাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কুকুরটা তার যায়গা থেকে নড়ছে না। রোদেলা দাঁড়িয়ে কুকুর টাকে দেখে। কুকুরটা তারদিকে তাকিয়ে আছে। রোদেলা বলে,”কি? যেতে দিবি না আমায়?”
কুকুরটা লেজ নাড়ে। রোদেলা বলে,”সর বলছি।”
কুকুরটা যেন বাধ্য ছেলে হয়ে যায় রোদেলার ধমকে। উঠে একপাশে গিয়ে বসে পরে আবার। রোদেলা ভেতরে ঢোকে। আজ সে একটু বেশিই ক্লান্ত।

কলিং বেল টিপে রোদেলা দাঁড়িয়ে থাকে। মেঘলা এসে দরজা খুলে দেয়। তার মুখ থমথমে হয়ে আছে। রোদেলা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,”কিরে তোর কি হলো আপু!”
কথাটি বলেই সে তাকিয়ে দেখে তাদের বসার ঘরের একটা সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে তাশরিফ হাসান।‌ রোদেলা ভুত দেখার মতো চমকে উঠে বলে,”আপনি?”

তাশরিফ ঠোঁট প্রস্বস্ত করে হাসে। একটা হাই তুলে বলে,”হুম আমি।”
_এখানে কি করছেন?
_বসে আছি।
_বসে আছেন তা তো দেখতে পাচ্ছি। এখানে কেনো এসেছেন?

মেঘলা রান্নাঘর থেকে এককাপ চা নিয়ে এসে তাশরিফের হাতে দেয়। তারপর বিড়বিড় করে রোদেলাকে বলে,”উনি মেহমান রোদেলা। এভাবে কথা বলছিস কেনো?”
তাশরিফ মেঘলার দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে চায়ের কাপটা নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে রোদেলাকে বলে, “আমার ভাইয়ের বৌয়ের একাডেমিক সব কাগজপত্র নিতে এসেছি। একটু কষ্ট করে সব গুছিয়ে দিন।”

রোদেলা তাশরিফের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেঘলা উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”বৃষ্টি কেমন আছে? ও ভালো আছে তো? জ্বর বাধায়নি তো আবার?”

তাশরিফ হেসে বলে,”আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছে। চিন্তা করবেন না।”

রোদেলা মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলে,”এতো জানতে হবে কেনো তোর? ভালো থাকবে বলেই তো এ বাড়ি ছেড়েছে তাইনা?”

কথাটি বলেই রোদেলা ঘরে চলে যায়। রুহুল আমিন এসে তাশরিফের কাছ থেকে বৃষ্টির ব্যাপারে খোজ খবর নিচ্ছে। তাশরিফ অত্যন্ত বিনয়ের সাথে রুহুল আমিনের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে রুহুল আমিন তো তারও শশুর হবে। বিনয়ে সে যেনো নুয়ে যাচ্ছে।

মেঘলা তাশরিফকে বলে,”রোদেলার মুখে শুনেছি আপনি আমাকে রক্ত দিয়েছিলেন। সেজন্য আপনাকে একটা ধন্যবাদ দিতে চাই।”

তাশরিফ লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসে। মেঘলা বলে,”বৃষ্টিকে একটু দেখে রাখবেন। রোদেলার অভিমান কবে ভাঙবে তা তো জানি না। চার মাস হয়ে গিয়েছে বোনটাকে দেখি না। ওকে একটু দেখে রাখবেন। খুব নাজুক একটা মেয়ে। একটু আগলে আগলে রাখবেন।”

_আচ্ছা আপনাকে আমি আপু বলে ডাকি? আপু আপনি চিন্তা করবেন না। বৃষ্টির কোনো অযত্ন আমি হতে দেবো না।

_হ্যা অবশ্যই আপু ডাকবেন। আপনি বৃষ্টির ভাইয়ের মতো, তবে তো আমার আর রোদেলারও ভাই হলেন। অবশ্যই আপু ডাকবেন।

মেঘলার কথায় তাশরিফ বিষম খেয়ে যায়। খুকখুক করে কাশতে থাকে। মেঘলা পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। তাশরিফ পানি খেয়ে মনে মনে বলে,”আমি শুধু বৃষ্টি আর আপনার ভাই আপু,রোদেলা আমিনের নয়। এমন ভয়ংকর কথা আর কখনো বলবেন না।”

রোদেলা একটা ফাইল নিয়ে এসে টেবিলের উপর রাখে। গম্ভীর হয়ে বলে,”এই নিন। এখানে ওর জন্মনিবন্ধন সনদ থেকে শুরু করে পিএসসি পরীক্ষার সার্টিফিকেট সবকিছু গুছিয়ে রাখা আছে।”

তাশরিফ ফাইলের থেকে চোখ সরিয়ে রোদেলার দিকে চায়। রোদেলা অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। তারপর রুহুল আমিনের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলে,”আমি উঠি আংকেল।”

_না না,রাতের খাবার খেয়ে তবেই যাবে বাবা। তুমি বসো।
রুহুল আমিন তাশরিফকে বাঁধা দিয়ে বলে।

মেঘলা বলে ওঠে,”আপনি বসুন ভাই। এভাবে তো যেতে দিতে পারি না আপনাকে।”

তাশরিফ রোদেলার দিকে তাকায়। কতটা অভদ্র এই পেঁচা মুখী। একটিবার নিজের মুখে তাশরিফকে সৌজন্যতা করেও বলছে না খেয়ে যেতে। আত্মীয়তার সম্পর্ক বাদ দিলেও তো তাশরিফ রোদেলার বস, একটি বার নিজের মুখে বললে কি হয়? একদিন তো ঠিকই সেবা যত্ন করতে বাধ্য থাকবে। আজ এভাবে মুখ ফিরিয়ে আছে,একদিন তো ঠিকই তাশরিফ এলে বলবে,”রাতের খাবার না খেয়ে যেতে পারবে না।”

তাশরিফ মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলে,”না আপু। যেদিন বরফ গলে যাবে,সেদিন এসে কব্জি ডুবিয়ে ভাইয়ের শশুর বাড়ি খেয়ে যাবো। আজ উঠি।”

রোদেলা তাশরিফের দিকে আড়চোখে তাকায়। তাশরিফ রোদেলাকে দেখে একটা মুচকি হাসি দেয়।

***
“তুই কি আর বিয়ে টিয়ে করবি না? সংসার টা ভেসে যাচ্ছে দেখেছিস?”

সেতু ভাইয়ের প্লেটে মাংস তুলে দিতে দিতে বলে। সাদাফ খাওয়া থামিয়ে সেতুর দিকে চায়,”ভেসে যাচ্ছে মানে? কোথায় ভেসে যাচ্ছে? সংসার তো সংসারের যায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে।”

_ভাইয়া সব সময় মজা করে উড়িয়ে দিস না সবকিছু। আমাকে তো বিয়ে দিয়ে দিলি,মা বুড়ো হচ্ছে দিনকে দিন। তোর নিজের কথা না ভাব, রাজনীতি নিয়ে তো স্বর্গে যাবি। ছেলে মেয়ে দুটোর কথা তো ভাববি?

_ওদের কথাই তো সারাদিন ভাবি। উঠতে,বসতে,খেতে,ঘুমিয়ে।

সেতু চোখ রাঙানি দিয়ে তাকায়। সাদাফ হেসে বলে,”আমার মতো বুড়ো একজনকে কে বিয়ে করবে যার দুটো বাচ্চা আছে? আর সৎ মায়েরা কত খারাপ হয় জানিস? টিভিতে তো খবর-টবর কিছু দেখিস না। দেখলে বুঝতে পারতি পৃথিবী কত নির্মম হয়ে গিয়েছে। তার চেয়ে যেমন আছে সবকিছু তেমনি থাক। ওরা দেখতে দেখতেই বড় হয়ে যাবে।

***
“কি হলো? খাচ্ছো না কেন?”
বৃষ্টি মাথা তুলে তাহমিনার দিকে চায়। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে মিনমিন করে বলে,”কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না মা। কেমন বমি পাচ্ছে।”

_গ্যাস্ট্রিক আলসারের সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলেছো দেখছি। স্বামী রোজ ফুচকা, আজেবাজে সব খাবার শখ করে নিয়ে আসে। সেগুলো নিশ্চিন্তে খেতে থাকো। স্বাস্থ্যের কথা তো চিন্তা করতে হবে না।

বৃষ্টি চুপ করে থাকে। আদিল খাওয়া শেষ করে উঠে বৃষ্টিকে বলে,”আজ আমার ক্লাস নেই। তোমাকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দিয়ে আসবো,তুমি রেডি?”

বৃষ্টি মাথা নাড়ায়। শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,”মা আসছি।”
বলেই ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে ওঠে বৃষ্টির। তাহমিনা দাঁড়িয়ে যায়, উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”শরীরটা বোধ হয় বেশি খারাপ,আজ যেও না বরং।”

_না মা,আজ ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস আছে একটা।
বৃষ্টি গুটি গুটি পায়ে সদর দরজার দিকে যায়। আদিল ঘরে ঢুকে বাইকের চাবি নিয়ে আসে।

***
সেদিনের পর থেকে রাশেদুজ্জামান রোদেলাকে বিরক্ত করছে না,এটা বেশ স্বস্তিদায়ক একটি ব্যাপার রোদেলার কাছে। কিন্তু সে স্বস্তি পাচ্ছেনা। এই তাশরিফ হাসান বলে লোকটা তার পিছু ছাড়ছে না। যখন তখন কেবিনে ডেকে নেয় এই কাজ – সেই কাজের বাহানায়। চায় কি আসলে? সে যে রাশেদুজ্জামানের মতো কফি খেতে নিয়ে যেতে চায়না তা জানে রোদেলা। ভদ্রলোককে রোদেলা পছন্দ না করলেও ভদ্রলোক তো প্রকৃত ভদ্রলোকই। এটা তো মানতেই হবে। কিন্তু রোদেলাকে এতো টর্চার কেনো করে।

“এই রোদেলা।”
মেহরিনের গলার আওয়াজে রোদেলা তার দিকে তাকায়।

_আজকের হিসাব টা দেখা হয়েছে?
রোদেলা মাথা নাড়ায়,”না আপা। এখনো হয়নি। খুব চিন্তা হচ্ছে, তাশরিফ স্যার আজ হাতে চেয়েছেন। দিতে না পারলে তো কথা শুনতে হবে।”
মেহরিন হাসে,বলে,”টেনশন করো না। আজ তো তাশরিফ আসেনি। লিভ নিয়েছে। কিন্তু হঠাৎ লিভ নিলো কেনো বুঝলাম না।”

_কোনো পাত্রী দেখতে গিয়েছে বোধ হয়। উনি তো এজন্যই লিভ নেয় মাসে তিনবার।

মেহরিন চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। রোদেলা জিভ কেটে বলে,”সরি আপা। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তাশরিফ স্যার আপনার পেয়ারের লোক।”

মেহেরিন রাগ নিয়ে বলে,”সবসময় তাশরিফকে ছোটো করে কথা বলো তুমি। সত্যিই বিরক্তিকর !”
রোদেলা হেসে বলে,”সরি আপা। আর বলবো না। আচ্ছা আপনার ননদের সাথে তাশরিফ হাসানের বিয়ের ব্যাপারে কতদূর এগোলেন?”

মেহেরিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”আর বলো না। ননদের রিলেশন আছে। একটা বাঁদরের মতো দেখতে ছেলের সাথে। তার জন্য হাত কেটে একাকার কান্ড করে ফেলেছে। বড় মুখ করে তাশরিফের মায়ের কাছে প্রস্তাব রেখেছিলাম। এখন তো লজ্জায় কি বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

রোদেলার খুব হাসি পায়। এই সম্মন্ধটাও ভেস্তে গেলো! তাশরিফ হাসানের কপালে বোধ হয় বিয়ে লেখা নেই। বেচারা! এতো সুদর্শন পুরুষ হয়ে লাভ কি হলো!

***
“দাঁড়াও মেঘলা।”

অত্যন্ত পরিচিত পুরুষ কন্ঠটি মেঘলাকে নাড়িয়ে দেয়। পেছনে ঘুরে তাকানোর আগে একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে নেয়। তারপর ঘুরে তাকায়। ম্লান হেসে বলে,”তুমি! ঠিকানা কিভাবে খুজে পেলে নতুন বাসার! এসো আমাদের ফ্ল্যাটে নিয়ে যাই। চা খেয়ে যাও।”

মাইনুল ধমকে ওঠে,”ফাজলামি করছো? চা খেতে আসিনি আমি। এসেছি তোমার সাথে বোঝাপড়া করতে।”

_বোঝাপড়া মানে? সব বোঝাপড়া তো হয়ে গিয়েছে!

মাইনুল চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে থাকে,”নাটক করা হচ্ছে? কিছুই বুঝতে পারছো না তাইনা? আমার হবু বৌয়ের বাপের বাড়ির লোকদের কাছে আমার ব্যাপারে কি বলেছো তুমি মেসেজ দিয়ে? কেনো বলেছো?”

মেঘলা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে,তারপর মাইনুলের দিকে কঠিন দৃষ্টি রেখে বলতে থাকে,”বলেছি তুমি একটা ইতর,নারীবাজ, চরিত্রহীন।”

মাইনুল রাগে কাঁপতে থাকে। মেঘলা বলতে থাকে,”লজ্জা করে না? এখন একটা স্কুল পড়ুয়া স্টুডেন্টের জীবন নষ্ট করতে যাচ্ছো বিয়ে বিয়ে খেলা খেলে? লজ্জা করে না?”

মেঘলা চেঁচিয়ে বলে কথাটি। মাইনুল দাঁত কিড়মিড় করে বলতে থাকে,”এসব তোর ঐ অসভ্য বোন শিখিয়েছে তোকে তাইনা? অসভ্য মেয়ে। আমার জীবনে নাক গলাচ্ছিস। একটা চড় দিয়ে তোকে……”

মাইনুল চড় দিতে হাত উঠাতে নিলে পেছন থেকে সালমান সাদাফ ডেকে ওঠে,”এক্সকিউজ মি।”

মাইনুল মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। সালমান সাদাফ এগিয়ে যায়। মাইনুল সাদাফের দিকে তাকিয়ে আছে, কেমন চেনা চেনা লাগছে লোকটাকে। সাদাফ গম্ভীর কন্ঠে বলে,”আপনি ওনাকে মারতে যাচ্ছিলেন কেনো?”

মাইনুল মেজাজ নিয়ে বলে,”আপনি কে? এভাবে অন্যদের মাঝখানে ঢুকে কথা বলছেন?”

_আমি কেউ না ‌। একজন পথচারী। আপনি ওনাকে মারতে যাচ্ছিলেন কেনো সেটা আগে বলুন।

মেঘলা ভীত চোখে সালমান সাদাফের দিকে তাকায়। এই লোকের মেজাজ বিগড়ে গেলে যদি মাইনুলকে মারধোর করে! পুলিশের গায়ে হাত তুললে তো উলটো তাকে হাজত খাটতে হবে! মেঘলা সাদাফের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলে,”উনি আমার পরিচিত। আপনি যান।”

_উনি আপনার স্বামী হলেও আপনার গায়ে হাত তোলার অধিকার নেই ওনার। এটা সালমান সাদাফের এলাকা,এখানে কোনো নারী নির্যাতন সালমান সাদাফ বরদাস্ত করবে না।

মাইনুল হা হয়ে যায়। তাহলে এই লোকের নাম সালমান সাদাফ! কিছুক্ষণ মেঘলাকে আর সাদাফকে দেখে তারপর মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলে,”বাহ! ডিভোর্স হতে না হতে নাগরও জুটিয়ে ফেলেছো দেখছি! তোমাকে তো ভুল বুঝেছিলাম। তুমি তো যথেষ্ট চালু মহিলা!”

মেঘলা কেঁপে ওঠে কথাটি শুনে। সালমান সাদাফ তেজী কন্ঠে বলে ওঠে,”মুখে লাগাম টেনে এখান থেকে কেটে পরুন নয়তো……”

_সে তো আমি যাচ্ছি। আপনাকে বলে দিতে হবে না।
তারপর মেঘলার দিকে তাকিয়ে একটা বিকৃত হাসি দিয়ে বলে,”তোমাকে একটা ফ্রি তে জ্ঞান দিয়ে যাই মেঘলা, এই ধরনের নেতাশ্রেনীর লোক কখনো তোমার মতো একটা ডিভোর্সী,বন্ধ্যা মেয়েকে বিয়ে করবে না। এরা যেটা করবে তা হলো কিছুদিন তোমাকে রক্ষিতা হিসেবে পালবে। তাই বুঝে শুনে পা ফেলো। বেশি খেতে গিয়ে সব গলায় আটকে ফেলো না।”

কথাটি বলে মাইনুল হাঁটতে শুরু করে। সাদাফ মেঘলার দিকে তাকায়। মেঘলা মুখে আঁচল গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে এপার্টমেন্টের গেইটের ভেতরে দৌড়ে যায়। সাদাফ দীর্ঘক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ।

***
ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই রোদেলার ঘোর কেটে যায়। সে এতক্ষন বসে বসে ঝিমাচ্ছিলো।
ফোনটা হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ে দেখতে পায় তাশরিফ হাসানের নাম্বার। বিরক্ত হয়ে যায় রোদেলা। সমস্যা কি এই লোকের! নিজে ছুটিতে থেকেও রোদেলার হাড় জ্বালাচ্ছে !
রিসিভ করে বিরক্ত ভাব নিয়ে বলে,”বলুন স্যার।”

তাশরিফ ওপাশ থেকে বলে,”আপনি একটু লাইফ কেয়ার হসপিটালে আসতে পারবেন?”

_কেনো স্যার?
অবাক হয়ে জানতে চায় রোদেলা।

_বৃষ্টির একটা ছোট এক্সিডেন্ট হয়েছে।

_মানে???
চেঁচিয়ে ওঠে রোদেলা। তার গলা কাঁপছে।

_ঘাবড়াবেন না। সামান্য এক্সিডেন্ট। আপনি চাইলে আসুন। আমরা অপেক্ষা করছি।

তাশরিফ ফোন কেটে দেয়। রোদেলা ধপ করে চেয়ারে বসে পরে। তার সমস্ত শরীর কাঁপছে।

সিএনজি থেকে নেমে তাশরিফের নাম্বারে ফোন দিতে থাকে রোদেলা। তাশরিফ ফোন রিসিভ করে বলে,”আপনি এসে গিয়েছেন?”
_হ্যা, বৃষ্টি কোথায়?
_আপনি দোতলায় ২০৯ নাম্বার কেবিনে আসুন।

ফোন রেখে রোদেলা দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। ২০৯ নাম্বার কেবিনের কাছে গিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পরে সে।

বৃষ্টি বেডে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। তার চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে। হাতে ব্যান্ডেজ করে দেয়া হয়েছে। তার শরীরে স্যালাইন চলছে। নার্স ঠিক ঠাক করে দিচ্ছে সবকিছু।
সবাই রোদেলাকে দেখছে। বৃষ্টি বোনের দিকে তাকিয়ে আছে,তার চোখ ভিজে উঠেছে এতদিন পরে বোনকে দেখতে পেয়ে। কেবিনের মধ্যে বৃষ্টি ছাড়াও রয়েছে তাশরিফ আর বৃষ্টির শশুর, শাশুড়ি। যদিও রোদেলা তাদের চেনে না,আন্দাজ করে নিয়েছে। বৃষ্টির স্বামী কোথায়! এতোটা দায়িত্ব জ্ঞানহীন যে বৌয়ের এই অবস্থায় পাশে নেই!

রোদেলা তাশরিফের দিকে তাকিয়ে বলে,”কিভাবে হয়েছে এসব?”

_বাইক থেকে পরে গিয়েছে।
রোদেলা বৃষ্টির দিকে চায়। চেঁচিয়ে বলে,”এমন একটা আহাম্মককে বিয়ে করেছিস যে বাইক চালাতেও জানে না ঠিকভাবে।”

তাহমিনা কপাল কুঁচকে ফেলে,”এই মেয়ে! আহাম্মক কাকে বলছো? আমার ছেলে ঠিক ভাবেই বাইক চালাতে জানে। ক্লাস এইট থেকে সে বাইক চালাতে এক্সপার্ট।”
তাশরিফ মাকে থামিয়ে দিয়ে রোদেলাকে বলে,”বৃষ্টি মাথা ঘুরে পরে গিয়েছিলো।”
রোদেলা মাথা ঘুরিয়ে নার্সের দিকে তাকায়, চেঁচিয়ে বলে,”এটা কিসের স্যালাইন চলছে ওর? কি হয়েছে ওর?”

নার্স মৃদু হেসে বলে,”আপনি রোগীর কি হন?”

রোদেলা বলে,”বোন।”

নার্স একটা প্রস্বস্ত হাসি দিয়ে বলে,”অভিনন্দন। আপনি খালামনি হতে যাচ্ছেন। আর এটা দুর্বলতা কাটানোর জন্য রোগীকে দেওয়া হচ্ছে। টেনশনের কিছু নেই।”

রোদেলা বৃষ্টির দিকে তাকায়। বৃষ্টি মাথা নিচু করে রেখেছে। তাশরিফ রোদেলাকে দেখছে। রোদেলা হতভম্ব ভাব নিয়ে বিড়বিড় করে বলে,”বাহ!!! চমৎকার!!!!”

চলমান……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here