দ্বিতীয়_ফাগুন #পর্ব_সংখ্যা_৬ #লেখিকা_Esrat_Ety

0
332

#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্ব_সংখ্যা_৬
#লেখিকা_Esrat_Ety

২২

নিজের ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় রোদেলা। ক্লান্তিতে তার চোখ বুজে আসছে। অফিসের কাজের চাপ আর অসভ্য জিএম এর অত্যাচারে তার জীবন ওষ্ঠাগত প্রায়। রোদেলার এখন মনে হচ্ছে ডলি খালার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়ে বিয়ে করে নেওয়াই ভালো, ইতালিতে বসে বসে স্বামীর সাথে সারাদিন পিৎজা খাওয়া যাবে।
আয়েশা ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়,পর্দা সরিয়ে রোদেলাকে দেখে।
“ভাত খাবেনা রোদেলা?”

রোদেলা মাথা কিছুটা উঁচুতে তুলে আয়েশার দিকে তাকিয়ে বলে,”বিছানা থেকে একটুও উঠতে ইচ্ছা করছে না। খুব ক্লান্ত আমি। ভাত খাওয়ার মতো শক্তিও শরীরে অবশিষ্ট নেই।”

আয়েশা কিছুক্ষণ নিরব থাকে। তারপর বলে,”আমি ভাত মেখে খাইয়ে দেবো?”
রোদেলা আয়েশার দিকে তাকিয়ে আছে। আয়েশা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়। কেনো যে সে বলতে গেলো এই কথাটা! তার হাতের রান্না খায় বলে কি তার হাতের মাখা ভাত খাবে নাকি! বলাটা ঠিক হয় নি।

রোদেলা মৃদু হাসে। তারপর আয়েশাকে অবাক করে দিয়ে বলে,”ঠিকাছে।”
আয়েশার মুখ প্রস্বস্ত হয়ে যায় হাসিতে। সে প্রায় দৌড়ে যায় রোদেলার জন্য খাবার আনতে।
রোদেলা আনমনে হেসে ফেলে , মনে মনে বলে, “আপনার মতো সৎ মা যদি সবাই পেতো আন্টি!”

আয়েশা রোদেলাকে খাইয়ে দিচ্ছে। রুহুল আমিন ক্রাচে ভর দিয়ে রোদেলার ঘরে ঢোকে। বিষন্ন মুখে বলে,”মেঘলাকে ফোন দিচ্ছি ধরছেই না। মাইনুল ও ধরছে না। মেঘলার শাশুড়ির নাম্বার আছে তোর কাছে? আমাকে দে,ফোন দেই উনাকে…

রোদেলা খেতে খেতে বলে,”তুমি এতো টেনশন করো নাতো। কাল আমি নিজে গিয়ে আপুকে নিয়ে আসবো ও বাড়ির লোকদের বুঝিয়ে। তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো। যাও।”

_তুই একটা ফোন দে না। দিয়ে দেখ না।
_আচ্ছা দেবো সকালে। এখন অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। তুমি যাও।

রোদেলার ফোন দিতে হয়না কাউকে। রুহুল আমিনের ফোনেই কল আসে মাইনুলের। তখন রাত দুইটা বেজে গিয়েছে। মেঘলাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। পা পিছলে ওয়াশ রুমে পরে গিয়ে নাকি পেটে প্রচন্ড ব্যাথা পেয়েছে সে।

২৩
বাবা রুহুল আমিন ছিলো একজন মালয়েশিয়ান প্রবাসী। সেজন্য মায়ের সাথে তাদের ছোটো বেলাটা নানাবাড়িতেই কেটেছে। ছোটো বেলায় প্রচন্ড দুষ্টু একটা মেয়ে ছিলো রোদেলা। এজন্য মা প্রচুর মারতো ওকে। মাকে সে প্রচন্ড ভয় পেতো,কিন্তু দুষ্টুমি তার কমতো না। মেঘলা আপু ছিলো বরাবর শান্ত স্বভাবের মেয়ে। তার বয়স যখন দশ, মেঘলা আপুর বয়স তখন বারো। বৃষ্টি ছিলো দু’বছর বয়সী। একদিন হঠাৎ করে তাদের মা উধাও হয়ে গেলো, গোটা দু দিন মাকে তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো। তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেলো না। দুদিন পরে তার দুজন মামা গিয়ে কোথা থেকে খুজে নিয়ে আসলো তাদের মাকে। কিছুদিন পর বাবা দেশে এলেন, তারপর নানাবাড়িতে গিয়ে তাদের বড় দুবোনকে নিয়ে চলে এলেন। তাদের দাদীর কাছে রাখলেন। মা আর বৃষ্টি এলো না। দাদী বললো,”তোমরার মায়রে তোমরার বাপে তালাক দিসে। হে আর আইতো না।”
বৃষ্টিকে কোর্ট মায়ের কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নিলো, কিন্তু মা হয়তো সে সিদ্ধান্তে খুশি হয়নি। বাবা গিয়ে মাকে বললেন,”আমি বৃষ্টিকেও নিয়ে যাচ্ছি, তোমার আর অসুবিধা হবে না।”
মা সেদিন বৃষ্টিকে আটকাতে চায়নি। বৃষ্টি বড় হতে থাকলো মেঘলা আপুর হাতে। কিছুদিন পরে খবর আসলো তাদের মায়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। যে লোকটার সাথে বিয়ে হয়েছে তাকে রোদেলা চিনতো,ওই লোকটা প্রায়ই আসতো তাদের নানাবাড়িতে।

“আপা হসপিটাল পৌঁছায়া গেছি নামবেন না?”
ড্রাইভারের কথায় ঘোর কাটে রোদেলার। সে কিছুটা বিরক্ত হয় নিজের ওপর। একটু ডিপ্রেশড হয়ে পরলেই ছোটোবেলার সেদিন গুলোর স্মৃতি গুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
পাশে তাকিয়ে আয়েশা সিদ্দিকাকে বলে,”নামুন আন্টি।”

সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে তারা নেমে পরে। এতো রাতে কপাল ভালো ছিলো বলে তারা এই সিএনজি টাকে পেয়েছে,তাই ভাড়া একটু বাড়িয়ে দেয় রোদেলা। আয়েশা সিদ্দিকা চোখ বড় বড় করে সব দেখতে থাকে। শহরের এতো উঁচু উঁচু দালান খুব কমই দেখেছে সে তার জীবনে।

রোদেলাকে দেখতে পেয়ে জোবাইদা কান্নার মতো শব্দ করে ওঠে। পুরোটাই ভান। রোদেলা বিরক্ত হয়ে যায়। মেঘলার কেবিনের সামনে মাইনুল দাঁড়িয়ে আছে। রোদেলাকে দেখতে পেয়ে নাক চোখ কুঁচকে ফেলে। রোদেলা তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ডাক্তারকে জিগ্যেস করে,” কতটুকু ক্ষতি হয়েছে? বাচ্চা ঠিক আছে?”

ডাক্তার মুখের মাস্ক খুলে বলে,”ব্লিডিং হচ্ছে প্রচুর। আপনাদের পরে জানাচ্ছি। আপাতত ব্লাড ব্যাংক থেকে এক ব্যাগ ব্লাড দিয়েছি। এ বি নেগেটিভ রক্ত সন্ধানে রাখুন,আরো প্রয়োজন পরতে পারে।”

ডাক্তার হন্তদন্ত হয়ে চলে যায় মেঘলার কেবিনে। দরজার কাচ থেকে রোদেলা একবার উকি দিয়ে তাকায়, তার বুকটা হঠাৎ করে মোচড় দিয়ে ওঠে। মনে মনে বলে,”না রোদেলা। তোকে শক্ত থাকতে হবে। শক্ত থাকতেই হবে।”
মাথা ঘুরিয়ে মাইনুলের দিকে কঠিন দৃষ্টি দেয়, মাইনুল সে দৃষ্টি দেখে খানিকটা ভড়কে যায়।
রোদেলা বলে,”এসব কিভাবে হয়েছে?”
তার কন্ঠে ধমকের সুর। মাইনুল বিরক্ত ভাব নিয়ে বলে,”এভাবে চেঁচিয়ে জেরা করছো কেনো? এটা হসপিটাল। তোমার আপা ওয়াশ রুমে পরে গিয়েছে, শোনোনি সেকথা?”
_কি হয়েছে সেটা পরেই জানতে পারবো আপুর থেকে। আপাতত আপনি এবং আপনার মা এখান থেকে কেটে পরুন। আপনাদের চেহারা দেখলেই আমার মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে।
মাইনুল পাল্টা জবাবে বলে,”কেটে পরবো মানে? তোমার কথায় কেটে পরতে হবে? আমার বাচ্চা ঠিক আছে কি না তা আমাকে দেখতে হবে না? আর হসপিটালের বিল তো আমাকেই দিতে হবে।”

_আপনাকে কোনো বিল দিতে হবে না,আপনি যান এখান থেকে। বাচ্চার ব্যাপারে আপনাকে জানিয়ে দেওয়া হবে।

মাইনুল কিছুক্ষণ রোদেলার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর তার মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে। হাটুর যন্ত্রনা নিয়ে হসপিটালে থাকতে তার মায়ের কষ্ট হতে পারে। তাই সে মাকে নিয়ে বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু তার মনে ভয়, মেঘলার জ্ঞান ফিরলে যদি রোদেলাকে সব বলে দেয় সে !

২৪
মাইনুল তার মাকে নিয়ে চলে যাওয়ার পরে সারারাত রোদেলা এবং আয়েশা হাসপাতালের করিডোরে পায়চারি করতে থাকে। আয়েশা এসে এক ফাঁকে রোদেলাকে বলে,”তুমি যাও মেঘলার কেবিনে। ওখানে একটা বেড খালি পরে আছে। গিয়ে রেস্ট নাও। কাল তো তোমার অফিস আছে।”
_এখন একটুও স্থির হয়ে থাকতে পারছি না আন্টি। কাল অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নেবো। আপনি গিয়ে শুয়ে পরুন।
আয়েশা যায়না। রোদেলার মতো সকাল পর্যন্ত পায়চারি করেছে সে করিডোরে,একটু পরপর দরজায় উকি দিয়ে দেখেছে মেঘলাকে।

“স্যার,আপনি বোঝার চেষ্টা করুন। আমি তো এই মাসে কোনো লিভ নেইনি। আমার তো লিভ পাওনা আছে।”
রোদেলার কন্ঠে আকুতি। ওপাশ থেকে তাদের ডিপার্টমেন্টের হেড খলিলুর রহমান বলে,”তোমার সব কথা ঠিকাছে কিন্তু রোদেলা এখন তো অডিট চলছে অফিসে। এমতাবস্থায় আমি তোমাকে ছুটি দিতে পারবো না। একটা বেলারই তো ব্যাপার। আজ লাঞ্চের পরে সব এম্প্লয়িকে ছেড়ে দেওয়া হবে।”

_স্যার আপনি জিএম স্যারের সাথে একটু কথা বলে তো দেখুন।

_ক্ষেপেছো তুমি? জিএম স্যারের সাথে তার ওয়াইফের কোর্টে ঝামেলা চলছে কদিন ধরে। তার মন মেজাজ ঠিক নেই,তুমি বলছো তাকে বলি আমি? অসম্ভব। তুমি অফিসে এসো। লাঞ্চের পরপর ছেড়ে দেবো।

রোদেলা ফোন কেটে দিয়ে বসে থাকে চুপচাপ। তার ইচ্ছে করছে কিছুক্ষণ কাঁদতে, শব্দহীন কান্না। কিন্তু তার চোখে পানি আসছে না। আশ্চর্য!

২৫
মাথার চুলে বেনী করা, কপালের কাছে চুলগুলো এলোমেলো, গাঁয়ে যে শাড়িটা পরে আছে তার কুঁচি গুলোও এলোমেলো হয়ে আছে। শাড়ির সাথে আজ ম্যাচিং ব্লাউজ পরেনি রোদেলা। মেঘলার খবর পেয়েই রাতেই কোনো মতে শাড়িটা পাল্টে বেরিয়ে ছিলো আয়েশাকে নিয়ে। সকালে সোজা হসপিটাল থেকে রওনা দিয়েছে অফিসের উদ্দেশ্যে সে। এর মাঝে একটিবারো নিজের দিকে তাকানো সময় বা ইচ্ছে কোনটিই হয়ে ওঠেনি তার। দ্রুত পায়ে সাতাশ বছর বয়সী এই তরুণী তার বিদ্ধস্ত চেহারা নিয়ে অফিসে ঢুকে পরলে সবাই তাকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে। কেউ কেউ মনে মনে হাসতে থাকে তাকে দেখে। অফিসে সবাই যে যার ডেস্কে বসে আছে। রোদেলা নিজের ডেস্কে গিয়ে বসে থাকে চুপচাপ। একটু পর ফোন বের করে বাড়িতে ফোন দিয়ে বৃষ্টির থেকে জেনে নেয় রুহুল আমিনের কথা। মেঘলার খবরটা শোনার পরপর তার প্রেশার বেড়ে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পরেছিল সে।

জিএম স্যার তার কেবিনে রয়েছে। একটু পরেই সবাইকে মিটিং রুমে ডেকেছে সে। সবাই নিজেদের ডেস্কে বসে জিএম স্যারের কেবিন থেকে বের হবার অপেক্ষা করছে।

রোদেলা ফোন নামিয়ে ডেস্কে রেখে দেয়। অফিসের সিনিয়র পারসন ও ডিপার্টমেন্টের হেড খলিলুর রহমান হেসে হেসে সবার সাথে আড্ডা দিচ্ছে। খলিলুর রহমান অফিসে তার কাজের চেয়ে বেশি কৌতুকের জন্য বেশি পরিচিত।
“তো এখন আরেকটা জোকস্ বলি শুনুন আপনারা। এটা সর্দারজিদের জোকস্। আপনি যদি একটা স্বাভাবিক মানুষকে একটা পৃষ্ঠা ফটোকপি করতে দেন তাহলে সে সর্বোচ্চ তিন-চার মিনিট সময় নিয়ে সেটি ফটোকপি করে দেবে , কিন্তু সর্দারজিরা একটি পৃষ্ঠা পুরো একঘন্টা সময় নিয়ে ফটোকপি করে এনে দেবে। বলুন তো কেনো?”
অফিসের কিছু উৎসাহী এবং কৌতুহলী কর্মচারী বলে ওঠে,”কেনো?”

_কারন তারা মেইন পৃষ্ঠার সাথে ফটোকপি মিলিয়ে দেখে নেয় হুবহু ঠিক আছে কিনা।

সবাই উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। তাশরিফও হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে তার চোখ যায় রোদেলার দিকে। যেখানে অফিসের সবাই গা দুলিয়ে হাসছে সেখানে এই পেঁচা মুখী তার স্বভাব মতো কঠিন হয়ে বসে আছে। রামগরুরের ছানা,হাসতে তাদের মানা। হাসির কথা শুনলে বলে হাসবো না না না।

শারমিন নামের মেয়েটি রোদেলার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”কি ব্যাপার রোদেলা। আপনার হাসি আসছে না? নাকি আপনি জোকসটা ধরতে পারেননি!”
পাশ থেকে একজন বলে ওঠে,”মিস রোদেলা সর্দারজিদের মতোই ভোলাভালা, হা হা হা !”

রোদেলা তাদের দিকে শীতল চোখে তাকায়।
“আপনাদের জীবনে খুব আনন্দ তাই না? প্রচুর ফাজলামিতে ভরপুর আপনাদের জীবন।”
শারমিন খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে বলে,”আমি তো শুধু একটু মজা করছিলাম আপনার সাথে।”
রোদেলা কর্কশ কন্ঠে বলে,”জোকস্ টা আমি বুঝতে পেরেছি। একটা জোকস্ বোঝার মতো স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তা আমার আছে, কিন্তু আপনাদের তো একজন মানুষকে দেখে তার মুড বোঝার মতো স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তাই হয়নি এখনো। নয়তো আমার পোশাকের অবস্থা ইনফ্যাক্ট চেহারা দেখেই বুঝে যাওয়া উচিত আমি ডিস্টার্বড।”

শারমিন চুপ হয়ে যায়। অফিসে আর কেউ কথা বাড়ায় না। তাশরিফ আরো একবার রোদেলাকে দেখে। সত্যিই অস্বাভাবিক লাগছে আজকের রোদেলাকে। মনে হচ্ছে খুবই অসুস্থ সে। কি হয়েছে ওনার!

২৬

মিটিং প্রায় শেষ। রোদেলার ফোনে বারবার ফোন দিয়ে যাচ্ছে আয়েশা সিদ্দিকা। রোদেলা ফোন সাইলেন্ট করে ঢুকেছিলো মিটিং-এ।
মিটিং শেষ হয়ে গেলে অফিসের সব এম্প্লয়িকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আজ তাদের ছুটি। সকাল থেকেই বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে । অফিস থেকে সবাই বের হচ্ছে একে একে। রোদেলা ফোন বের করে সময় দেখার জন্য,তখন দেখতে পায় আয়েশা সিদ্দিকার ফোন থেকে অনেকগুলো মিসডকল। লিফট থেকে নামতে নামতে সে আয়েশাকে ফোন দেয়। ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে আয়েশা আহাজারি করে ওঠে,”তুমি ফোন ধরছিলে না কেনো রোদেলা।”

_আন্টি আপুর কি খবর বলেন। আপনার কথা এমন শোনাচ্ছে কেনো?
আয়েশা একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে,”তুমি ডাক্তারের সাথে কথা বলো।”

“আপনার বোনের বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে মিস রোদেলা। উই আর সরি। এবং……..”
ডাক্তারটা কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে যায়। রোদেলার গলা কেঁপে ওঠে,চেঁচিয়ে বলে,”এবং কি ডক্টর?….”

“ওনাকে বাঁচাতে আমাদের অপারেশন করতে হয়েছে এবং ওনার জরায়ু কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। আপনার বোন আর কখনো মা হতে পারবে না রোদেলা।”

রোদেলা থমকে যায়। বাইরে বৃষ্টি পরতে শুরু করেছে। হু হু করে বাতাসের বেগ বাড়ছে।
আয়েশা সিদ্দিকা ডাক্তারের থেকে ফোন নিয়ে কেঁদে ফেলে,বলে,”তাড়াতাড়ি এসো রোদেলা। তুমি তাড়াতাড়ি এসো।”

ফোন কেটে দিয়ে রোদেলা এদিক ওদিক দেখতে থাকে। রাস্তা এতো ফাঁকা কেনো। সামান্য বৃষ্টি হচ্ছে বলে রাস্তা এভাবে ফাঁকা হয়ে যাবে ! দুয়েকটা রিক্সা তার সামনে দিয়ে যেতেই সে চেঁচাতে থাকে,”চাচা ঢাকা মেডিকেল হসপিটাল যাবেন?”
রিক্সা ওয়ালা মাথা ঝাঁকিয়ে না বলে দেয়।
_আরে ডাবল ভাড়া দেবো চাচা!
কন্ঠে আকুতি রোদেলার।
রিক্সাওয়ালা ডাবল ভাড়ার লোভেও থামে না। তার বাড়ি ফেরার বড্ড তাড়া।
রোদেলা এদিক সেদিক তাকাতে থাকে।‌ বৃষ্টি খুব জোরে পরতে শুরু করেছে। তার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই, সে অপেক্ষা করছে একটা গাড়ির জন্য। অপেক্ষা করছে তার বোনকে দেখার জন্য।

অফিসের বাইরে কলিগদের নিয়ে টং-এর দোকানে চায়ের আড্ডা দিচ্ছিলো তাশরিফ। বৃষ্টি দেখে বাইক একটা ছাউনির নিচে দাড় করিয়ে রেখেছে সে। হঠাৎ দেখতে পায় রোদেলা নামের মেয়েটি বৃষ্টির মধ্যে মেইনরোডের মাঝখানে দাড়িয়ে রিক্সা থামানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। কৌতুহলী হয়ে একটু সামনে আগায় সে,”আরে এই মেয়ে পাগল নাকি! বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিসের এতো তাড়া মেয়েটির!”

রোদেলা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে। ব্যাগের মধ্যে তার মোবাইলের রিংটোন বেজে যাচ্ছে। সে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। কয়েক মূহুর্ত যেতেই ডুকরে কেঁদে ওঠে সে। তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। বৃষ্টির মধ্যে সেই কান্নার আওয়াজ বেশি দূরে যেতে পারে না।
কিন্তু তাশরিফ ঠিকই দেখতে পাচ্ছে তাদের অফিসের সবথেকে রাগী, বদমেজাজি,দেমাগী এবং অভদ্র মেয়েটি হাউমাউ করে ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে, একটু পরপর তার শরীর কাঁপছে।
চায়ে চুমুক দিয়ে মনে মনে বলে ওঠে,”বাহ। এই পেঁচা মুখী তো দেখছি কাঁদতেও পারে!”

তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে রোদেলাকে লক্ষ্য করতে থাকে সে। হঠাৎ করে সে টের পেলো এই মাত্র, হ্যা ঠিক এই মাত্র সে রোদেলা নামের বদমেজাজি, অভদ্র মেয়েটির প্রেমে পরে গিয়েছে।

অঝোর ধারায় বৃষ্টি পরতে শুরু করেছে। চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে বিল মিটিয়ে বাইকের কাছে গিয়ে বাইক স্টার্ট করে সে। বাইক ঘুরিয়ে রোদেলার সামনে গিয়ে থামে। রোদেলা চমকে গিয়ে তার দিকে তাকায়। তাশরিফ রোদেলার দিকে এক পলক তাকায়। ঠান্ডায় জমে গিয়ে ঠোঁট দুটো নীল বর্ণের হয়ে গিয়েছে। বৃষ্টির পানি আর চোখের পানি মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে।
সে মাথা ঘুরিয়ে সামনে তাকিয়ে রোদেলাকে উদ্দেশ্য করে বলে,” কোথায় যাবেন,বাইকে উঠুন। আমি পৌছে দিচ্ছি।”

চলমান……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here