#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্বসংখ্যা_১৬
#লেখিকা_Esrat_Ety
“শোনো মেয়ে।”
সালমান সাদাফের রাশভারী গলার আওয়াজে সিঁড়ি তে দাঁড়িয়ে পরে রোদেলা। মাথা ঘুরিয়ে তাকায় সে। সাদাফ তার দিকে এগিয়ে আসে।
“অফিসে গিয়েছিলে?”
“জ্বি।”
রোদেলা এক শব্দে জবাব দেয়। তারপর বলে,”কিছু বলবেন?”
_হ্যা। তোমার আপুর খবর জানতে চাচ্ছিলাম। কপালের ব্যাথা সেরেছে?
_না, উল্টো জ্বর এসেছে।
সাদাফের মুখটা মলিন হয়ে যায় শুনে। অপরাধী গলায় বলে,”কি যে একটা অবস্থা হয়ে গেলো।”
রোদেলা স্বাভাবিক গলায় বলে,”সমস্যা নেই। আপুর এসবের অভ্যাস আছে।”
বলেই রোদেলা হাঁটতে শুরু করে। সালমান সাদাফ তার দিকে তাকিয়ে আছে। অভ্যাস আছে মানে? কি বোঝাতে চেয়েছে এই মেয়ে।
রোদেলাকে পেছন থেকে ডাকতে গিয়েও ডাকে না সে। মনে মনে ভাবে তার কি একবার যাওয়া উচিত মেঘলাকে দেখতে ?
মেঘলা বিছানায় শুয়ে আছে। রোদেলা টেবিলের ওপর ব্যাগটা রাখতেই মেঘলা ঘুরে তাকায়। রোদেলা হাত দিয়ে ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”উঠিস না। তুই শুয়ে থাক।”
গায়ে প্রচন্ড জ্বর মেঘলার। গলা কাঁপছে, মৃদু স্বরে বলে,”আজ রেজাল্ট পাবলিশড হয়েছে। কোনো খবর তো পেলাম না রে রোদেলা। বাবা বারবার এসে জিজ্ঞেস করছে,চিন্তা হচ্ছে খুব।”
_তোর আর বাবার তো কাজ নেই তাই চিন্তা করবি। চিন্তার কিছু নেই। ও নিজেই ওর ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবছে না। তোদেরও চিন্তা করার কিছু নেই। গোল্লায় যাক।
ফ্রেশ হয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে থাকে রোদেলা। ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে হঠাৎ। ফোনটা তুলে হাতে নিতেই দেখে স্ক্রিনে একটা অচেনা নাম্বার। নাম্বার টা কিছুটা চেনা চেনা লাগে, কিন্তু মনে করতে পারছে না সে। রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে,”আপু।”
কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে। রোদেলা একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে ফোনটা কেটে দিতে যাবে অমনি বৃষ্টি বলে ওঠে,”দোহাই তোমার আপু ফোনটা কেটো না।”
রোদেলা চুপ করে আছে। বৃষ্টি বলে,”আপু তোমার বোনকে ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডেকেছে। ডিপার্টমেন্ট অব মাইক্রোবায়োলজি।”
রোদেলা চুপচাপ শোনে। বৃষ্টি একটু থেমে বলে,”আপু আদিল ইলেকট্রিক্যাল এ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স পেয়েছে।”
রোদেলার থেকে কোনো কথা না শুনতে পেয়ে বৃষ্টি বলে,”আপু তুমি খুশি হওনি? ঢাকা ইউনিভার্সিটি তো তোমার স্বপ্ন ছিলো, তোমার বোন তোমার স্বপ্ন পূরণ করেছে,তুমি খুশি হওনি?”
_ওটা এখন আর আমার স্বপ্ন নেই। আমার স্বপ্ন তুই অন্য কাউকে দিয়ে দিয়েছিস। ফোন রাখ। আমি বাবাকে জানিয়ে দেবো।
কথাটি বলে রোদেলা নিজেই ফোনটা কেটে দেয়।
বৃষ্টি মাথা নিচু করে কান থেকে ফোনটা নামিয়ে তাশরিফের দিকে এগিয়ে দেয়। তার ঠোঁট কাঁপছে, এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে সে। তারপর এক দৌড়ে আদিলের রুমে চলে যায়।
আদিল বিড়বিড় করে বলে,”দিলো আবার আমার বৌটাকে কাঁদিয়ে। সিমেন্ট মানবী কোথাকার। আল্লাহ জানে কোন পাপীর সাথে বিয়ে হবে এর। তার জীবনটা সিমেন্ট দিয়ে ভরিয়ে দেবে এই সিমেন্ট মানবী রোদেলা।”
তাশরিফ ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
***
বেশ কয়েকবার কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলে কাউকে দেখতে না পেয়ে মেঘলা কিছুটা অবাক হয়। কে হতে পারে? বারবার ফাজলামি করছে এভাবে!
দূরের মাইক থেকে সালমান সাদাফ নামের লোকটার গুরুগম্ভীর ভাষণ শোনা যাচ্ছে। খুব কাছেই ঈদগাহ মাঠে আজ জনসমাবেশ ডেকেছে সে। সামনে নাকি ইলেকশনে লড়বে। মেঘলার খুব হাসি পাচ্ছে তার ভাষণ শুনে। নেতা শ্রেনীর লোকেরা নির্বাচনের আগে যে যে চাপা মেরে সাধারণ জনগণের মন জিতে নেয় তার একটিও বাদ রাখেনি এই লোক। আবার বলছে প্রত্যেকটা স্কুল পড়ুয়া বোনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। সে কিভাবে নিশ্চিত করবে? তাদের স্কুলে দিয়ে আসবে আর স্কুল থেকে নিয়ে আসবে,এভাবে?
আয়েশা সিদ্দিকা বেলের শরবত বানিয়ে টি-টেবিলের উপর রেখে গিয়েছে। মেঘলা হাত বাড়িয়ে শরবতের গ্লাসটা উঠিয়ে লক্ষী মেয়ের মতো শরবত খেয়ে নেয়। আজকাল আয়েশার সাথে খুব একটা বাজে ব্যবহার সে করে না।
কপালের ক্ষতটা এখনো বেশ ভোগাচ্ছে মেঘলাকে। সালমান সাদাফের মা এসে দেখে গিয়েছেন আজ সকালে। নাতীর হয়ে বারবার ক্ষমা চেয়েছেন।
আবারো কলিং বেলের আওয়াজ হয়। মেঘলা বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। কে এমন ফাজলামি করছে তাকে দেখতে হবে। দরজা খুলে আবারো কাউকে দেখতে পায়না। কিন্তু নিচ থেকে বাচ্চাদের হাসির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। মেঘলা বুঝে ফেলে এটা কাদের কাজ। সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে একটু মজা করবার জন্য। এবার যদি ওরা আবারো আসে তাহলে মেঘলাকে দেখে চমকে যাবে।
তিন মিনিট অতিবাহিত হয়। সুহা আর সিরাত পা টিপে টিপে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে থাকে। মেঘলা ভেতরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মেঘলাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যেই না সিরাত কলিং বেল টিপতে যাবে অমনি মেঘলা দরজা খুলে দেয়।
সুহা আর সিরাত চমকে ওঠে। মেঘলাকে দেখে ভয় পেয়ে সিরাত সিঁড়ির দিকে দৌড় লাগায়। সুহা ভয় পেয়ে দাঁড়িয়েই থাকে।
আচমকা ধপ করে কারো পরে যাওয়ার একটা বিকট আওয়াজ হয়। মেঘলা হতভম্ব হয়ে দৌড়ে সিঁড়ির দিকে যায়। গিয়ে দেখে ছোট্টো সিরাত মুখ থুবড়ে মেঝেতে পরে আছে। সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে পরে গিয়েছে সে। শরীরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে নিস্তেজ হয়ে যায় ছোটো শরীরটা। মেঘলা দিকবিদিক শূন্য হয়ে ধপ করে বসে পরে,সিরাত উল্টো হয়ে পরে আছে। মেঘলা সিরাতের মাথাটা নিজের কোলে নেয় , তখন টের পায় তার হাত দুটো রক্তে ভরে গিয়েছে। কলিজাটা যেন কেঁপে ওঠে মেঘলার। কয়েক মূহুর্ত পরে একটা বিকট চিৎকার দেয় সে।
***
রোদেলার ডেস্কের উপর একটা মিষ্টির প্যাকেট। প্যাকেট টা হাতে নিয়ে এদিকে ওদিকে তাকায় সে। অফিসে সবাই যে যার কাজ করছে। রোদেলা মেহেরিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”আপা! এটা কিসের জন্য?”
_ওহ ওটা,ওটা তো তোমার জন্য রোদেলা।
_কে দিয়েছে?
_তাশরিফ হাসান।
রোদেলা চোখ মুখ শক্ত করে মিষ্টির প্যাকেট হাতে তাশরিফের কেবিনের দিকে যায়। দরজার নব ঘোরানোর সাথে সাথে তাশরিফ বলে ওঠে,”আসুন রোদেলা আমিন।”
যেন সে আগে থেকেই জানতো এখন রোদেলা আসবে। রোদেলা কেবিনে ঢুকে তাশরিফের ডেস্কের উপর মিষ্টির প্যাকেট টা রাখতে রাখতে বলে,”স্যার এটা আমার টেবিলে রেখে এসেছিলেন।”
_হুম,আপনার টেবিলে রেখে এসেছিলাম আর আপনার জন্যই রেখে এসেছিলাম।
_কেন স্যার?
_আমার ভাই আর ভাইয়ের বৌ দুজনেই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে। অসম্ভব খুশির একটা খবর। আমি আনন্দিত। অফিসের সবাইকে মিষ্টি খাইয়েছি। আপনার জন্যও রেখেছি।
রোদেলা তাশরিফের দিকে তাকায়।
_স্যার। এটা আমাদের কাজের যায়গা। এভাবে প্রতিদিন পার্সোনাল ইস্যু নিয়ে নিমন্ত্রণ পত্র বিতরণ, মিষ্টি বিতরণ করা আমাদের কাজ নয়, এগুলোর জন্য আমাদেরকে বেতন দেওয়া হয় না।
তাশরিফ কয়েক মুহূর্ত রোদেলার দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ করে তার মেজাজ বিগড়ে যায়। হাত দিয়ে এক ঝটকায় মিষ্টির প্যাকেটটা টেবিলের ওপর থেকে ফেলে দেয়। রোদেলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তার দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। তাশরিফ গম্ভীর কন্ঠে বলে,”গেট লস্ট।”
রোদেলার মুখে কোনো ভাবান্তর নেই। দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। তাশরিফ দরজার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে,”হৃদয়হীনা।”
***
ছোট্টো একটা হাত মেঘলার শাড়ির আঁচলের একটা অংশ খামচে ধরে রেখেছে । মনে হচ্ছে মেঘলাকে সে প্রচন্ড ভরসা করে। এতো এতো অপরিচিত মুখের মধ্যে একমাত্র মেঘলার মুখটাই তার কাছে পরিচিত। মেঘলা সিরাতের গালে হাত দেয়। সিরাত পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। মাথায় আঘাত লেগে পেছনের দিকটা কেটে গিয়েছে। বেশি কিছু ক্ষতি হয়নি যদিও তবে সেলাই লেগেছে চারটা যা অতটুকু শরীরের জন্য যথেষ্ট বেশি। মেঘলা একটা হাত সিরাতের বুকের ওপর রাখে। আদুরে কন্ঠে বলে,”ভয় হচ্ছে বাবু? তোমার বাবা এক্ষুনি এসে যাবে।”
সিরাত মেঘলার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ ঘুরিয়ে মেঘলার কপালের দিকে তাকায়। মেঘলা মুচকি হেসে বলে,”আমার ব্যাথা সেরে গিয়েছে। তোমার ব্যাথাও সেরে যাবে।”
সিরাত খুবই ক্ষীণ কন্ঠে বলে,”পঁচা কাজ করলে আল্লাহ শাস্তি দেয় আন্টি?”
মেঘলা অবাক হয়ে সিরাতের দিকে তাকায়। সিরাত বলতে থাকে,”তোমাকে ব্যাথা দিয়েছিলাম তখন দাদী বলেছে পঁচা কাজ
করলে আল্লাহ শাস্তি দেয়। আমাকেও দেবে। তোমাকে ব্যাথা দিয়েছি বলে আল্লাহ আমাকে ব্যাথা দিয়েছে আন্টি?”
মেঘলা সিরাতকে আগলে নেয়। সিরাত বলতে থাকে,”আমার খুব ব্যাথা করছে আন্টি,আমি আর কখনো পঁচা কাজ করবো না।”
মেঘলা সিরাতের মাথাটা আলতো করে ধরে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। এই ছোট্ট জীবটার জন্য হঠাৎ করে তার মনে অদ্ভুত টান অনুভব করে সে যার ব্যখ্যা সে খুজে পায় না।
পেছন থেকে সালমান সাদাফ ডেকে ওঠে,”বাবা।”
মেঘলা মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। সাদাফ দৌড়ে এসে সিরাতকে আগলে ধরে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। কাতর কন্ঠে বলতে থাকে,”আমার বাবা। তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে আমার বাবা?”
মেঘলা সাদাফের অস্থিরতা দেখে। সাদাফের সন্তানের জন্য অস্থিরতা তাকে তার বাবার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। বাবাও ঠিক এতোটাই অস্থির হয়ে ওঠে তাদের কিছু হলে। মেঘলা স্বাভাবিক গলায় বলে,”ঘাবড়াবেন না। কেটে গিয়েছে শুধু। ডাক্তার সেলাই করে দিয়েছে। ওকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন।”
সাদাফ সিরাতকে শুইয়ে দিয়ে মেঘলার দিকে তাকায়। তারপর বলে,”ধন্যবাদ আমার ছেলেটির খেয়াল রাখার জন্য।”
মেঘলা ম্লান হাসে।
***
অফিস ছুটি হয়ে গিয়েছে। তাশরিফের বের হতে একটু দেড়ি হয়ে গিয়েছে। তাড়াহুড়া করে লিফটে ঢুকেই দেখে রোদেলা একা দাঁড়িয়ে আছে। তাশরিফ অন্যদিকে মাথা ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এখন এই পাষণ্ডীকে দেখার কোনো ইচ্ছা নেই তার। নূন্যতম ভদ্রতা জ্ঞান নেই এর। বৃষ্টির মতো মিষ্টি একটা মেয়ে এর বোন হয় কি করে। মনে দয়া মায়া বলতে কিচ্ছু নেই এই পাষণ্ডীর। খুব রাগ হচ্ছে তাশরিফের তার পেঁচা মুখীর উপরে। মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় সে, বিয়ের পরে এক মাসের মধ্যে এর তেজ মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে তাশরিফ। আঙ্গুলের ইশারায় নাচাবে এই হৃদয়হীনাকে।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে একবার আড়চোখে রোদেলার দিকে চায় সে। রোদেলা ফোন টিপছে। হঠাৎ করে পুরো লিফট অন্ধকার হয়ে যায়। রোদেলা চমকে ওঠে। লিফট থেমে গিয়েছে।
“ইলেকট্রিসিটি জনিত সমস্যা সম্ভবত, ঘাবড়ানোর কিছু নেই।”
তাশরিফ রোদেলাকে উদ্দেশ্য করে বলে।
রোদেলা ফোনের ফ্ল্যাশলাইট অন করে।
“আমি ঘাবড়ে গিয়েছি আপনাকে কে বললো স্যার?”
তাশরিফ চুপ থাকে। এই মেয়েটা ভাঙবে তবু মচকাবে না। একে ভালো কথা বললেও যে এর সমস্যা হয়ে যায় তা তো বহু আগেই প্রমান পেয়েছে তাশরিফ।
দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যায়। তাশরিফ ফোন বের করে কর্তৃপক্ষের নাম্বার ডায়াল করে ফোন লাগায়। কিন্তু ফোনের নেটওয়ার্ক না থাকায় আর ফোন দেয়া সম্ভব হয় না।
কয়েক মিনিট যেতেই রোদেলার ভয় হতে শুরু করে। এভাবে কতক্ষন আটকে থাকতে হবে! কেউ টের পায়নি নাকি! কেউ কিছু করছে না কেনো!
তাশরিফ ফোন উঁচুতে তুলে নেটওয়ার্ক ধরার চেষ্টা করছে। কোনো লাভ হচ্ছে না। রোদেলা মুখে “চ” কারন্ত শব্দ করে। বিড়বিড় করে বলে,”ধুররর!”
তাশরিফ ম্লান হেসে বলে,”এটা হচ্ছে আপনার শাস্তি। বৃষ্টির মতো একটা লক্ষী মেয়েকে কাদানোর শাস্তি। কাল সারাটা দিন কেঁদেছে মেয়েটা এতো ভালো একটা সুখবর পেয়েও।”
_তা আপনি কিসের শাস্তি পাচ্ছেন?
নির্বিকার ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে তাশরিফকে।
তাশরিফ কিছু বলে না উত্তরে , কিন্তু মনে মনে বলে,”আপনার মতো হৃদয়হীনাকে ভালোবাসার শাস্তি। প্রতিদিন পাচ্ছি।”
রোদেলা কয়েক মূহুর্ত পরে বলে ওঠে,”আপনার মনে হয় না স্যার একজন বসের যেরকম আচরণ করা উচিৎ আপনি তা করেন না? কোনো ওয়ার্ক পলিসি মেইনটেইন করেন না। মনে হয় না আপনার?
তাশরিফ রোদেলার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,”একজন বস হিসেবে আমার থেকে কি ধরনের আচরণ আপনি আশা করেন? কার মতো আচরণ করলে আমার ওয়ার্ক পলিসি মেইনটেইন করা হবে? রাশেদুজ্জামানের মতো? বলুন ?
রোদেলা হতভম্ব হয়ে তাশরিফের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাশরিফ বলে,”আপনি চাইলে আমি রাশেদুজ্জামানের মতো আচরণ করতে পারি।”
“দিস ইজ ঠু মাচ!”
রোদেলা বিরক্ত নিয়ে কথাটি বলে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তাশরিফ আরো একবার ফোনের নেটওয়ার্ক চেক করে মেঝেতে বসে পরে।
তারপর রোদেলাকে বলে,”এভাবে আমার মতো বসতে পারেন মেঝেতে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যথা হয়ে যাবে। লিফটের কি হয়েছে জানি না,আজ ঠিক হবে কি না তাও বলা যাচ্ছে না। অফিস ছুটি হয়ে গিয়েছে। হতে পারে সিকিউরিটি গার্ড অফিস তালাবদ্ধ করে দিয়ে চলে গিয়েছে। কাল সকালের আগে সম্ভবত তাদের চোখে পরবে না।”
রোদেলা খানিকটা ভীত চোখে তাকায় তাশরিফের দিকে। তাশরিফ বেশ মজা পায়,রোদেলাকে আরেকটু ভয় পাইয়ে দিতে বলে,”এরকম আগেও একবার হয়েছিলো জানেন। একজন ভদ্রমহিলা এভাবে লিফটে আটকা পরে ছিলো। সেদিন অফিসে সাত দিনের জন্য ঈদের ছুটি দিয়ে দিয়েছিলো। ভদ্রমহিলাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গিয়েছিলো তার স্বামী। সাতদিন পরে যখন সবাই অফিসে আসলো তখন লিফট বন্ধ হয়ে আছে দেখে মেরামত করে যেই না লিফটের দরজা খোলা হলো তখন পঁচা দুর্গন্ধে সবার বমি আসার উপক্রম। ভদ্রমহিলার গলিত পঁচা লাশ পরেছিলো লিফটের মেঝেতে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে দেখা গিয়েছে মহিলা পাঁচ দিন আগেই হার্ট অ্যাটাক করে মারা গিয়েছিলেন লিফটে।”
রোদেলা অনেকটা ভয় পেয়ে যায় তাশরিফের কথা শুনে। একটা ঢোক গিলে ফেলে সে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।
তাশরিফ কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,”আমাদের এতো ভয়ের কিছু নেই। কাল সকালেই তো সবাই অফিসে আসবে। মাত্র পনেরো ঘন্টার ব্যাপার। খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা না। হ্যা,তবে অক্সিজেনের সংকট দেখা দিতে পারে। খুব বেশি কিছু হলে আপনি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন শুধু। আমার কিছু হবে না,আমি পুরুষ মানুষ।”
রোদেলা দৃঢ় কন্ঠে বলে,”স্যার আপনি কি আমাকে ঘাবড়ে দিতে চাইছেন এসব বলে?”
_নাতো। আপনি ঘাবড়ে গিয়েছেন নাকি!
রোদেলা কিছু বলে না। চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার পায়ে খুব ব্যথা করছে। একটু বসতে পারলে ভালো হতো। সে ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে কয়েকটা কাগজ বের করে মেঝেতে বিছিয়ে নিয়ে বসে পরে।
কয়েক মুহূর্ত দু’জনেই চুপচাপ। তাশরিফ হঠাৎ করে গুনগুন করে গান গাইতে থাকে,
“এখানে,দুজনে, নিরজনে,সাজাবো প্রেমেরো পৃথিবী।”
রোদেলা হতভম্ব হয়ে তাশরিফের দিকে তাকায়। চোখ মুখ শক্ত করে চাপা স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে,”আপনি গান গাইছেন কেনো স্যার?”
_এই ভুতুড়ে পরিবেশটাকে একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছি। এই সময়ে আমাদের নার্ভ ঠান্ডা রাখা জরুরি। আপনিও একটা গান গেয়ে দেখুন। ভাল্লাগবে।
রোদেলা অন্যদিকে ফিরে বিরক্ত হয়ে বসে থাকে। তাশরিফ রোদেলাকে আড় চোখে দেখে। মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইটের আলোতে রোদেলার উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের মুখটা চীনা মাটির পুতুলের মতো লাগছে। এই মোহনীয় সৌন্দর্য দেখতে পেলে যে কেউ নজর লাগিয়ে দেবে। গালের ওই কালো তিলটা যেন সেই নজর আটকে দেওয়ার জন্যই ওখানে স্থান নিয়ে বসে আছে যেন।
তাশরিফ চোখ সরিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,”বৃষ্টি খুব মিষ্টি একটা মেয়ে। এরকম একটা মেয়ের উপরে কেউ রাগ করে থাকতে পারে? সত্যিই অবাক হচ্ছি।”
রোদেলা কোনো কথা বলে না। তাশরিফ বলে,”আমার ভাইটা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে তার বৌয়ের কাছে তার উপযুক্ত স্বামী হয়ে ওঠার জন্য। সবসময় বাবার টাকা,ভাইয়ের টাকা ওড়ানো ছেলেটা কিনা স্টুডেন্টদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে টিউশনি করিয়ে আসে। কারন তার বৌয়ের খরচ সে তার টাকায় মেটাবে।”
রোদেলা অস্ফুট স্বরে বলে,”ভালো কথা!”
তাশরিফ গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,”আসলে ভাইটা কার দেখতে হবে তো!”
রোদেলা তাশরিফের দিকে তাকায়। কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে,”তা আপনি এখনো বসে আছেন কেনো? আপনিও বিয়ে করে নিন। শুনেছি মাসের মধ্যে তিনবার পাত্রী দেখে বেড়ান। পছন্দ হয় না নাকি?”
তাশরিফ কিছুটা অপমানিত বোধ করে। শুকনো হাসি হেসে বলে,”আসলে মায়ের পছন্দ আর আমার পছন্দের সংঘর্ষে সব কিছু ভেস্তে যায়। মা সবসময় অল্পবয়সী স্কুল কলেজ পড়ুয়া মেয়ে খুঁজে বেড়ায়। আমার পছন্দ ভিন্ন।”
রোদেলা কথা বাড়ায় না। তাশরিফের পছন্দ কেমন তা জানতে সে আগ্রহী না । হঠাৎ করে লিফটের বাতি জ্বলে ওঠে। রোদেলা একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। তাশরিফ খুশি হয় না। কি সুন্দর একটা মুহূর্ত কাটাচ্ছিলো পেঁচা মুখীর সাথে। মনে মনে কর্তৃপক্ষের প্রতি বিরক্ত হয় এতো তাড়াতাড়ি লিফট ঠিক করার জন্য।
লিফট আবারো চলতে শুরু করে। রোদেলা উঠে দাঁড়ায়। তাশরিফও উঠে পরে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসে লিফটের দরজা খুলে যেতেই দেখে সিকিউরিটি গার্ড এবং কয়েকজন লোক উদ্বিগ্ন হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। রোদেলা আগে লিফটের বাইরে পা রাখে। একজন লোক এগিয়ে এসে বলে,”সরি ম্যাম। একটু দেড়ি হয়ে গেলো। এক্সট্রিমলি সরি।”
রোদেলা লোকটাকে ঝারি মেরে চলে যায়। লোকটা তাশরিফের দিকে তাকিয়ে বলে,”সরি স্যার। আর হবে না। আপনি প্লিজ কর্তৃপক্ষের কাছে কম্প্লেইন করবেন না।”
তাশরিফ লোকটার পিঠে চাপড় দিয়ে বলে,”থ্যাংকস।”
লোকগুলো অবাক হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে তারপর তাশরিফকে বলে,”থ্যাংকস কেনো স্যার?”
তাশরিফ কিছু বলে না। একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে চলে যায়।
চলমান………