ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয়
পর্ব ২
মাহিমকে শুরু থেকেই ভয় পায় চৈতালী। চৈতালীর বয়স যখন চৌদ্দ, তখন থেকে এই বাড়ির আশ্রয়ে ওদের নতুন জীবন শুরু হয়। মেঘনার পাড়ে ওদের নিজেদের বাড়ি ছিল। শৈশবটা কখনোই আদরে মাখামাখি ছিল না ঠিক, কিন্তু চৈতালী এর মাঝেই নিজের সুখ খুঁজে নিয়েছিল। পড়ালেখায় তেমন কোন বাঁধা ছিল না। বরং চৈতালী ভালো ছাত্রী ছিল বলে শেফালী আর রহিম তরফদার ওকে ভালো ফলাফল করতে উৎসাহ দিতেন। বলতেন একসময় চৈতালী ওনাদের দেখবে, ভাইদের দেখবে। চৈতালী হাতে হাতে মায়ের সাথে ঘরের সবকাজই করতো। গরুর দুধ দোয়ানো থেকে শুরু করে গৃহস্থালি কাজ, মাঠের ফসল ফলানোর কাজের ধারণা সবই আছে চৈতালীর। মাটির সংস্পর্শে মাটির সাথেই তার বেড়ে ওঠা। এরমাঝেও পড়ালেখা ঠিক রেখেছে। ছোটো দুই ভাইকেও তাদের পড়া পড়িয়েছে। মা বাবার আহ্লাদী আদর কখনোই পায়নি ঠিক, আর তার কারণও বোঝে চৈতালী। সংগ্রামময় কঠিন পরিবেশে কেউ মেয়ে সন্তানকে এত আদর আহ্লাদ দেয় না। তবু মা যখন এখনও ভাত মাখিয়ে আদর করে দুই ভাইকে খাওয়ায়, এটা ওটা বিক্রি করে জমানো টাকা বাবার চোখের আড়ালে ভাইদের হাতে গুঁজে দেয় তখন চৈতালীও স্মৃতিকাতর হয়ে যায়। কিন্তু ওর স্মৃতিতে কখনোই এমন কিছু ভাসে না। বুঝ হওয়ার পর থেকে নিজের সবকিছুর জন্য পরিশ্রম করেই ওকে আগাতে হয়েছে। স্কুল পর্যন্ত ভালো ছাত্রী হিসেবে বিনা বেতনে পার করেছে। ওর পড়ালেখার আগ্রহ দেখে অংক আর ইংরেজি স্যার বিনা পয়সায় টিউশনি দিয়েছেন। বাকিটা উপবৃত্তির টাকা, বৃত্তির টাকা দিয়ে চলেছে। এখন টিউশনি করায়। স্কুলে থাকাকালীন সময়ে মাঝে একবছর পড়া বন্ধ রাখতে হয়েছিল। না হলে একবছর আগে এইচএসসি দিয়ে দিতে পারতো। আর এখন ও কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ হয়তো পেয়ে যেত।
যে বছর চৈতালী ক্লাস এইটে পড়ে সে বছর মেঘনার নদী ভাঙনে ধীরে ধীরে সব হারাতে থাকে রহিম তরফদার। দুই ছেলে শরীফ আর শাহিনের পড়ালেখা বন্ধ না করলেও চৈতালীকে পড়া বন্ধ করতে হয়। দু বছর কোনোরকমে চালানোর পর যখন বাড়িটাও নদী গিলে নেয়, তখন তারা সাহায্যের আশায় আসে ফজলে আলী খানের ‘খান মঞ্জিলে’।
ফজলে আলী খান নিজেই খবর দিয়ে আনিয়েছিলেন। তার রক্তের সম্পর্কের কেউ মানবেতর জীবনযাপন করবে, এ তার নিজের জন্যই সম্মানহানির। রহিম তরফদারকে তাই স্ত্রী সন্তান নিয়ে নিজের বাংলা বাজারের সহায়সম্পদ দেখাশোনার কাজে লাগিয়ে দেন। নারকেল বাগান, চারটা পুকুর, খাস জমি, ফসলের মাঠ সহ অনেক সম্পদ রয়েছে বাংলাবাজারে। সেখানেরই একটা পুকুরপাড়ের বসতবাড়িতে পরিবার নিয়ে রহিম তরফদার নতুন জীবন শুরু করে। শহরের কাছাকাছি এসে চৈতালীর জন্য ভালো লেখাপড়া করার দরজা খুলে যায়। ফজলে আলী খান নিজে রহিম তরফদারকে বলে চৈতালীর ভর্তির ব্যবস্থা করে দেন। এরজন্য এই খান বাড়ির কাছে কৃতজ্ঞ চৈতালী। কিন্তু সেই কৃতজ্ঞতার মূল্য এভাবে চুকাতে হবে ভাবেনি কখনও। চৌদ্দ বছর বয়সে যখন এই বাড়িতে পা দেয়, তখনই বুঝেছিল এই বাড়ির মানুষগুলো রক্তের সম্পর্কে ওদের আত্মীয় হলেও, সামজিক সম্পর্কে মনিব ভৃত্য শ্রেণিতে তাদের অবস্থান। দুই বেনী ঝুলিয়ে, প্রসাধনবিহীন মুখে জংলী ছাপের সালোয়ার কামিজ পরে যখন এই বাড়ির আঙিনায় বানানো পাথরের বেদীতে বসে ছিল চৈতালী, মাহিমকে সেদিনই প্রথম দেখা। গাড়ির হর্ণ শুনে খান বাড়ির দারোয়ান গেট খুলে দিয়েছিল। কালো রঙের গাড়ির দরজা খুলে যখন মাহিম বের হয় চৈতালী অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। এরআগে এমন সুন্দর কোন পুরুষ দেখেনি চৈতালী। নদীর পাশে অবস্থিত গ্রামে সবসময় রোদের তাপে পুড়ে যাওয়া পুরুষ দেখে অভ্যস্ত চৈতালী অবাক হয়, কোন ছেলে মানুষও এতটা ফর্সা হতে পারে! সামান্য রোদ গায়ে পড়তেই যেন মাহিমের গালটা টমেটোর মতো লাল হয়ে গিয়েছে। গ্রামের বাইরে আগে কখনও আসা হয়নি বলে আধুনিক বেশভূষার মানুষের সংস্পর্শে আসা হয়নি। তাই মাহিমের পোষাক, ঘড়ি, গাড়ি সবই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে দেখছিল চৈতালী। মাহিম অবশ্য ওকে খেয়ালও করেনি। করার কথাও না। নিতান্ত আটপৌরে চেহারার, রোদে পুড়ে যাওয়া তামাটে বর্ণের সাধাসিধা গ্রামীণ কিশোরী তার নজর এড়িয়ে গিয়েছে। দারোয়ানের সাথে নিজের মতো কথা বলে বাড়িতে ঢুকে গিয়েছিল মাহিম। এর একবছর পরই মাহিমের বিয়ে হয়। চৈতালী তার মা-বাবা ভাই বোনের সাথে এসেছিল সেই বিয়েতে। মাহিমের স্ত্রী চন্দ্রিমাকে দেখে অভিভূত হয়েছিল। রাজযোটক যেন। রাজপুত্রের সাথে মানানসই রাজকন্যা।
এরপর এই বাড়ির সংস্পর্শে কেটে গিয়েছে আরও চারটি বছর। উত্সব, পালা পার্বণে নিয়ম করে এই বাড়িতে তারা এসেছে। বাড়ির লোকদের সাথে হাতে হাতে কাজ করেছে। মাহিম আর তার স্ত্রী চন্দ্রিমাকে আড়াল হতেই দেখেছে চৈতালী। মাহিম একমাত্র নাতি হিসেবে দাদার সহায়সম্পদ দেখাশোনা করা শুরু করেছিল। মাহিমের বাবা হামিদ আলী খানের চেয়ে এসব বিষয়ে নাতি মাহিম আলী খানকে বেশি ভরসা করছিলেন ফজলে আলী খান। তাই বিষয় সম্পদের গোপন সবকিছু নাতির সাথেই আলোচনা করতেন। বুঝিয়ে দিতেন কোথায় কতটা কী রয়েছে, কোনটা কিভাবে চালাতে হবে। দলিল পত্র গুলোও বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন নিয়ম করে। এর মাঝেও মাহিম আর তার স্ত্রীকে নিয়ম করে একসাথে দেখেছে। কখনোই অবশ্য মাহিমের সাথে সেভাবো কোন কথা হয়নি। তার স্ত্রী চন্দ্রিমাও অনেকটা চাপা স্বভাবের। চৈতালী তাদের দূর থেকেই দেখতো, কখনও তারা বাগানে বসে চা খাচ্ছে। কখনও নাস্তার টেবিলে বসে টুকটাক কথা বলছে, নাস্তা করছে। তবু এই জুটির মাঝে যেন প্রাণ নেই এমনটাই তার মনে হতো। আর আস্তে আস্তে বিষয়টা জটিল হয়ে সবার চোখেই ধরা দেয়। খান বাড়ির বংশধর পাওয়ার জন্য যে চন্দ্রিমার উপর চাপ আসছে এমন কিছু কথা বড়দের কাছে শুনেছিল চৈতালী। কখনও কখনও চৈতালীর মা শেফালী আলোচনা করতেন এই বাড়ির কাজের লোকদের সাথে। শেফালীর সাথে তো আর মাহিমের মা, দাদী এসব বিষয়ে কথা বলবে না। কাজের লোকজনই বলতো সব ঠিক নেই। চাপা একটা অস্বস্তি আর অশান্তি বিরাজ করছে পরিবারে। এর মাঝে ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ে চন্দ্রিমা। কী সমস্যা হচ্ছে ডাক্তার ধরতে পারছে না। কিন্তু ধীরে ধীরে শারীরিক শক্তি হারিয়ে ফেলছে চন্দ্রিমা, গায়ে র্যাশ উঠছে। আগে অনেক বমি হতো, সাথে পেট ব্যথা। ইদানীং হঠাৎ হঠাৎ স্মৃতি এলোমেলো হয়। অতীত, বর্তমান গুলিয়ে ফেলে। মাহিম স্ত্রীকে নিয়ে অনেক ছোটাছুটি করেছে। ইন্ডিয়াও নিয়ে গিয়েছিল। কিছুটা সুস্থ হয়ে ফিরেও এসেছিল। কিন্তু মা হওয়ার ক্ষমতা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। চন্দ্রিমার পরিবার কেন মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছে না জানে না চৈতালী। চন্দ্রিমার মা বাবা এসে মেয়েকে দেখে যান। কখনও কখনও এক দেড় মাসের জন্য নিয়েও যান। কিছুটা সুস্থ হয়ে চন্দ্রিমা নিজেই চলে আসে শুনেছে। তাছাড়া সে মায়ের বাড়ি থাকতেও চায় না।
এই বাড়িটা পুরোপুরি কালো ছায়া আর রহস্যে ঘেরা মনে হয় চৈতালীর। সবার স্বাভাবিক চেহারার পেছনে যেন আরেকটা অস্বাভাবিক চেহারা আছে। গোপন কিছু, নিষিদ্ধ কিছু রয়েছে সবারই ভেতর। আপাত স্বাভাবিক সবকিছুই যেন কেমন অস্বাভাবিকতায় ঘেরা। এমন একটা জায়গায় নিজের চেয়ে পনেরো বছরের বড় কারও দ্বিতীয় স্ত্রী হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই চৈতালীর। যেখানে তার বয়স সবে উনিশ ছুঁয়েছে, সেখানে মাহিম চৌত্রিশ বছর বয়সী একজন বিবাহিত পুরুষ। হয়তো চৌত্রিশ বছর খুব বেশি বয়স নয় পুরুষদের জন্য, অনেকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে গিয়ে এরচেয়ে বেশি বয়সেও বিয়ে করেন। কিন্তু মাঝের পনেরো বছরের বয়সের পার্থক্য কী করে মানিয়ে নেবে জানে না চৈতালী। আজকের আগে কখনও মাহিমের সাথে দুটো কথাও ভালো ভাবে হয়নি। স্বামীর স্থানে ভাবা দূর, মাহিমকে নিয়ে এমন কিছু মনেও আসেনি। হুট করে তার স্ত্রী বনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কী করে নেবে চৈতালী। যতই ধনী, আর সুপুরুষ হোক, এমন কিছু করা সম্ভব না চৈতালীর পক্ষে। কিন্তু পালিয়ে যাবে কোথায়, আর কার কাছে? তার নিজের পছন্দের কোন মানুষ নেই। খান বাড়ি ছাড়া আর কোন আত্মীয় স্বজনের কাছে আশ্রয় পাওয়ার উপায় নেই। বাবার ভাইদের কারও সাথে তার বাবার সম্পর্ক ভালো নেই। চাচাদের কারও কাছে তাই আশ্রয় পাওয়া সম্ভব না। নানা বাড়িতে কেউ ওকে সেভাবে গ্রহণ করবে না জানে চৈতালী। কেন জানি কখনোই সে নানাবাড়িতে সেই আন্তরিকতা আর ভালোবাসা পায়নি, যতটা তার দুই ভাই শাহীন আর শফিক পেয়েছে। একটু বড় হওয়ার পর তো মা নানাবাড়ি গেলে ওকে রেখেই যেতেন। দুইভাইকে সাথে নেয়। চৈতালীও যাওয়ার জন্য জিদ করে না। নিজের মতো করে একাই বাড়িতে থাকে।
“আপা।”
জানালার গ্রীলে মাথা রেখে যেন অতীতে হারিয়ে গিয়েছিল চৈতালী। ভাইয়ের ডাকে ধ্যান ভাঙে।
“শফিক, কিছু বলবি?”
“কাঁদিস না আপা। আব্বা, আম্মা অন্যায় করতেছে তোর সাথে।”
শফিকের কথায় খেয়াল হয় চৈতালীর। অবচেতন মনে কখন কাঁদতে কাঁদতে দু-চোখের পাতায় প্লাবন এনেছে, নিজেও জানে না। শফিক, চৈতালীর পিঠাপিঠি বয়সের। তাই ছোটোবেলা থেকেই তুই করে ডাকে। চৈতালীকে যদি কেউ ভীষণ ভালোবেসে থাকে তাহলে তা শফিক।
“আপা, আমাদের কলেজের ইংরেজি স্যার আছেন না। আরে জামিল স্যার। তোর এভাবে বিয়ে দিচ্ছে এই কথা আজ স্যারকে বলেছি। কী করা যায় জিজ্ঞেস করেছি। স্যার তো আমাদের খুব স্নেহ করেন। স্যার কী বললেন জানিস? বললেন স্যার তোকে আশ্রয় দিবেন। স্যারের বোনের বাসায় থেকে তুই পরীক্ষা দিবি। এরপর কোথাও চান্স হলে ভর্তি হয়ে সেখানে চলে যাবি। স্যারের বোনের বাসা অন্য শহরে। স্যার নিজে তোকে বাসে করে দিয়ে আসবে। দুপুরে আমি তোকে একফাঁকে বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করবো। বাস স্ট্যান্ডে স্যার থাকবে। আর নে, এই ফোনটা রাখ। এটা আমার ফোন তোকে দিলাম এটা দিয়ে যোগাযোগ করতে পারবি।”
চৈতালী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। তার ভাইটা তাকে নিয়ে এত ভাবে দেখে আনন্দে মনটা ভরে যায়। অবশেষে এখান থেকে পালানোর একটা পথ খুঁজে পাওয়ায় ভীষণ খুশি চৈতালী। দেখা যাক ভাগ্য তাকে কোথায় নিয়ে যায়।
(চলবে)