চিত্রলেখার_কাব্য একাদশ_পর্ব ~মিহি

0
683

#চিত্রলেখার_কাব্য
একাদশ_পর্ব
~মিহি

“ভাবী, এসব কথা যেন ভাইয়া না জানে প্লিজ। তোমাকে আমার কসম ভাবী।” সাথী নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকালো। এক ভাই বোনের স্বার্থে কথা গোপন রাখতে বলেছে তো অন্যদিকে বোন ভাইয়ের সংসারের স্বার্থে কথা গোপন করতে বলছে।

-ভাবী, আমার কথা রাখবে তো তুমি?

-তুই অন্যায় আবদার করছিস লেখা।

-বাড়িতে থেকে আমার আসলেই পড়াশোনায় সমস্যা হচ্ছে ভাবী। এত হইচইয়ের মধ্যে আমার মনোযোগ বসে না।

-এই কালো পর্দা তোমার ভাইয়ের জন্য রাখো, আমার জন্য না।

-তুমি আমার কথা না মানলে ঐ মহিলার কথা সত্যি হবে ভাবী। তোমার ননদের উপর আনা অপবাদ সত্যি হোক তুমি সেটা চাও?

-লেখা!

-তাহলে আমার কথা মেনে নাও ভাবী, দোহাই লাগে তোমার।

সাথী আবারো অসহায়ের মতো তাকালো। চিত্রলেখা আর কথা না বাড়িয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে বের হলো। আজ কলেজে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না কিন্তু এ মুহূর্তে বাড়িতে থাকলে তার মন আরো বিষণ্ণ হয়ে পড়বে।

চিত্রলেখা বাড়ি থেকে বেরোতেই অর্ণবের কল আসলো সাথীর ফোনে।

-সাথী, লেখা কোথায়?

-কলেজে গেছে ভাইয়া।

-অনিক কবে আসবে?

-ও এই মাসে আসতে পারবে না, কাজের চাপ আছে।

-আচ্ছা। আমি সরাসরি মার্কেটে যাচ্ছি। আর অপর্ণা বা ওদের ওখান থেকে কি কল করেছিল কেউ?

সাথী নীরব রইলো। কী বলবে বুঝতে পারছে না। চিত্রলেখার কথা অমান্য করলে সে আর কখনো সাথীর প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারবে না।

-কী হলো সাথী? কল আসছিল?

-না ভাইয়া।

-আচ্ছা, রাখো।

-আল্লাহ হাফেজ।

সাথী কল কাটলো। সে এখন উভয় সঙ্কটে পড়েছে। অর্ণবের কথা চিত্রলেখাকে বলতে পারছে না আবার চিত্রলেখার কথা অর্ণবকে বলতে পারছে না। সাথী একবার ভাবলো অনিককে কল করে জানাবে কিন্তু অনিক এসব বিষয়ে বড্ড ভাবলেশহীন। বোনের ব্যাপারে তার যেন কোনো ভাবনাই নেই। অনিক বাড়িতে থাকলেও চিত্রলেখার সাথে তেমন কথা বলে না। আবারো ভাবনায় পড়লো সাথী। বড়সড় ঝড়ের পূর্বাভাস পাচ্ছে সে।

কলেজে এসে আরো বিরক্ত হলো চিত্রলেখা। সুবহা আসেনি আজ। কলেজের বড় রুমটাতে শত শত স্টুডেন্টের মধ্যে একাকীত্ব অনুভব করার মতো যন্ত্রণা বোধহয় আর হয়না। শেষের দিকের কর্ণারের একটা বেঞ্চে বসলো সে। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করলো। রঙ্গনের মেসেজ চেক করার ইচ্ছে গতকাল হয়নি। দুদিনে যা হয়েছে তাতে যথেষ্ট মানসিক অবসাদে পড়েছে সে তবুও এখন রঙ্গনের মেসেজটার রিপ্লাই দিতে ইচ্ছে করছে তার। রঙ্গন লিখেছে,”অপরিচিতা ভাববো নাকি পরিচিত কোনো ব্যক্তির হাস্যরসের প্রচেষ্টা?”

-যার জীবনে এত দুঃখ, তাকে হাসানোর প্রচেষ্টা নিছক মজা নয় কি?

রঙ্গন অনলাইনেই ছিল। রিপ্লাই আসতে বড়জোর দু’মিনিট লাগলো।

-কথা মন্দ বলেন নি, অপরিচিতা তবে দুঃখ শেয়ার না করে বারবার খোঁচা দেওয়া কিন্তু মন্দ অভ্যেস।

-আমি মানুষটাই মন্দ, অভ্যেস কী করে ভালো হয়?

-আপনি মানুষটা রহস্যময়ী।

চিত্রলেখা সিন করলো না। তার চোখে অদ্ভুত একটা জ্যোতি খেলা করলো। এ জ্যোতির রহস্য অনুভব করে সে আপনাআপনি পুলকিত হলো। ফোনটা ব্যাগে রেখে ক্লাসে মনোযোগ দিল।

_______________

চিত্রলেখা সন্ধ্যের পর থেকে নিজেকে প্রস্তুত করছে, বারবার ভয় এসে জেঁকে ধরছে তাকে। বড় ভাইকে কিভাবে রাজি করাবে ভাবতে ভাবতে অস্থির সে। অর্ণব বাড়িতে ফিরলো নয়টার পর। মুখে হাসির লেশমাত্র নেই। সাথী খাবার বাড়লো। অর্ণব হাতমুখ ধুয়ে এসে খেতে বসেছে। চিত্রলেখা আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। সে অপেক্ষায় আছে কখন তার ভাইয়ের খাওয়া শেষ হবে। অর্ণব বেশ ধীরেসুস্থে খাওয়া শেষ করে চিত্রলেখাকে ডাকলো। ভয়ে আড়ষ্ট চিত্রলেখা অর্ণবের সামনে দাঁড়ালো।

-কিছু বলবি? এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছিস!

-আসলে একটু কথা ছিল ভাইয়া।

-হ্যাঁ তো বল সেটা।

-আমি আসলে কলেজের হলে শিফট করতে চাচ্ছি ভাইয়া।

-কেন?

-বাড়ি থেকে যেতে আসতে অনেকটা সময় লাগে, তার উপর এখানে একটু নিরিবিলিতে পড়াও যায়না। পরীক্ষার সময়টুকু হলে থাকলে ভালো হতো।

-আমি সবাইকে বলে দিব তোকে পড়ার সময় বিরক্ত না করতে। যা ঘরে যা।

-ভাইয়া আমার এখানে পড়াশোনায় মনোযোগ বসেনা, সবসময় বাচ্চাদের সাথে খেলতে মন চায়।

-মনকে নিয়ন্ত্রণ করে পড়।

-হলে থাকলে এমনিতেই মনোযোগ বসবে।

-হলের খাবার খেতে পারবি তুই? ওখানে এক রুমে তিনজনের সাথে ম্যানেজ করতে পারবি?

-ভাইয়া, তুমি কি ভাবছো খরচ বেশি হয়ে যাবে? আমি আমার জভানো টাকা থেকে খরচ দিব, তোমার দিতে হবে না।

-বেশি বকিস না, ইচ্ছে যখন হয়েছে যাও তবে পড়াশোনার জন্য যাচ্ছিস। এটা মনে রাখিস।

-জ্বী ভাইয়া। ভাবী কবে আসবে? আমি তো পরশুর মধ্যে শিফট করবো। বাচ্চাদের সাথে দেখা করে যেতাম।

-কাল নিয়ে আসবোনি।

চিত্রলেখা মাথা নেড়ে নিজের ঘরের দিকে এগোলো। এখনো অনেক কাজ বাকি তার।

অর্ণব খানিকটা চিন্তায় পড়লো। চিত্রলেখা হঠাৎ হলে যাওয়ার জেদ করছে কেন? অপর্ণা কি কিছু বলেছে? সাথীকে ডাকলো সে।

-সাথী, অপর্ণা কি লেখাকে কিছু বলেছে যার জন্য ও হলে যেতে চাইছে?

-না ভাইয়া, তবে আপা সারাক্ষণ ওকে এটা সেটা করতে দেয়। হলে গেলে হয়তো বেচারার পড়ায় কোনো বাধা থাকবে না।

-আচ্ছা যাও।

সাথী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কথাটা যদিও মিথ্যে নয় তবুও ভয় করছে সাথীর। অপর্ণার মায়ের কলের বিষয়টা অর্ণবকে জানাতে পারলে বোঝ কমতো তার কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়।

চিত্রলেখা ফেসবুকে ঢুকলো। রঙ্গনকে এক্টিভ দেখে মুচকি হাসলো সে।

-আপনার পরিবারের সবাই কি আপনার মতো ফুল? রঙ্গনের বোন কি গোলাপ?

-না না, আমার বোন নেই। ভাই আছে ছোটো।

-ওহ আচ্ছা। আপনার পরিবারের ছবি দেখলাম অনেক আগের, আপনার পাশে একজন যুবক। উনি আপনার বড় ভাই?

-না, উনি আমার মামা। বয়স্ক কিন্তু বয়স বোঝা যায় না।

-ওহ আচ্ছা। নায়কের মতো হাবভাব।

-তা বলা যায় তবে উনি আপাতত রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের এলাকার চেয়ারম্যান।

-ওহ আচ্ছা।

-আপনার পরিবার সম্পর্কে বলুন এবার অপরিচিতা।

-আমার পরিবারে কেউ নেই।

-স্যরি টু আস্ক ইউ।

-সমস্যা নেই। পরে কথা হবে।

ফেসবুক থেকে বেরিয়ে এলো সে। যা দরকার ছিল তা জেনে গেছে। এখন শুধু কাজটা করার অপেক্ষা।

_________________

চিত্রলেখা পরশুদিন হলে চলে গেল। অপর্ণার মুখ দেখেই বোঝা গেল সে বড্ড খুশি। অর্ণব আজ সকালেই তাকে এনেছে। চিত্রলেখা রূপসা রাদিফকে আদর করে অর্ণবের সাথে বেরোলো। কোনোরকম কান্না আটকে রেখেছে সে। অর্ণব যদি একবার জানতে পারে চিত্রলেখা কেন এসব করছে তবে বাড়িতে আর শান্তির চিহ্নটুকুও অবশিষ্ট থাকবে না।

-লেখা, তুই থাকতে পারবি তো হলে?

-পারবো ভাইয়া, খুব পারবো।

-বেশ। কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবি।

-সব সমস্যা তুমি সমাধান করলে আমি কী করে সমস্যা মোকাবিলা করতে শিখবো?

-সমস্যা মোকাবিলা শিখতে হয় না। পরিস্থিতিই তোকে শিখিয়ে দিবে কখন কী করতে হয়। আর তুই জানিস সেটা, জানিস বলেই হলে যাওয়ার জেদ করেছিস।

চিত্রলেখা কথা বাড়ালো না। অর্ণবের কথায় সে বুঝতে পারছে অর্ণব কিছুটা আন্দাজ করেছে। অর্ণব আর বেশি কিছু বললো না। চিত্রলেখাকে হলে রেখে সব বুঝিয়ে ফিরে গেল। চিত্রলেখা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। একটা যুদ্ধ এখনো বাকি আছে, নিজের সাথে যুদ্ধ। নিজের অস্তিত্বকে জাগ্রত করার সে যুদ্ধ!

____________

নওশাদ মাত্র গোসল সেরে বেরিয়েছে। ইদানিং মন মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে তার। চিত্রলেখার উপর না মেটাতে পারা ঝাঁঝটা এখনো তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাকে। ফোনের মেসেজ টিউন শুনে ঘোর কাটলো তার। ফোন হাতে নিয়ে মেসেঞ্জারে ঢুকলো সে।

-আপনি দেখতে তো বেশ সুদর্শন, বিয়ে করেননি কেন?

-আপনার মতো কখনো কেউ সুদর্শন বলেনি তাই।

নওশাদের মনে জ্বলতে থাকা আগুনে পানির ছিটে পড়লো। অবশেষে কেউ স্বেচ্ছায় তার জালে পা বাড়াতে এসেছে। চিত্রলেখার উপর না মেটানো ঝাঁঝটা এর উপরেই মেটানো যায়।

-আপনাকে দেখে মনে হয় আপনি বেশ শক্তসামর্থ্য পুরুষ।

-সন্দেহ আছে?

-থাকতেই পারে।

নওশাদ বুঝতে পারলো মেয়েটা তাকে কী ইঙ্গিত করছে। এসব মেয়েদের সে ভালোমতো চেনে। ভদ্রবেশী প্রস্টিটিউটের মতো আচরণ এদের। মুখে কিছু বলবেনা অথচ ইঙ্গিতে সব চায় তাদের। নওশাদ খানিকটা ঝোঁকের মধ্যেই ছিল তখন, আগে-পিছে কিছু ভাবলো না। নিজের একটা ছবি মেয়েটির ইনবক্সে পাঠালো সে, অপ্রীতিকর সে ছবিটি যে তার জন্য কাল হয়ে আসতে চলেছিল তা তখনো অনুভব করেনি সে।

চলবে…

[নওশাদের ভালোই ব্যান্ড বাজতে চলেছে 🥱]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here