#চিত্রলেখার_কাব্য
ত্রয়োদশ_পর্ব
~মিহি
“তুমি চিত্রলেখা, তাই না?” রঙ্গনের মেসেজে অনেকটাই বিস্মিত হলো চিত্রলেখা। রঙ্গন কীভাবে জানলো এটা? চিত্রলেখা কি অস্বীকার করবে বিষয়টা?
-অস্বীকার করে লাভ নেই চিত্রলেখা, তুমি ধরা পড়েছো।
-কিভাবে চিনলেন?
-তোমার ডিটেইলস ফ্রেন্ডস করা ছিল কারণ তোমার লিস্টে কোনো ফ্রেন্ড নাই কিন্তু আমাকে এড করার পর সেসব তুমি হাইড করতে ভুলে গেছো।
-ওহ আচ্ছা। কলেজের নাম দেওয়া আছে শুধু, তাতেই চিনলেন?
-না, ইমেইল আইডি দিয়ে রেখেছো। যাই হোক, আমি যে চালাক তা প্রমাণ হলো।
-আপনি যে দুঃখী চালাক তা বুঝতে পারলাম।
-দুঃখ ভাগ করে নেও। কেউ তো মানা করেনি!
-আমার জীবনে যেন দুঃখের খুব অভাব পড়েছে।
-অহম কল করেছিল। তোমাকে নাকি মিস করছে।
-আসলে আমার পরীক্ষা তাই পড়াতে নিষেধ করেছে ভাইয়া।
-বুঝতে পেরেছি।
-আচ্ছা আমার ক্লাস আছে ভাইয়া, টা টা।
-বাই!
চিত্রলেখা ফোন রাখলো। মিথ্যে বলেছে সে। এখন তার ক্লাস নেই তবে রঙ্গনের সাথে কথা বাড়াতে অপরাধবোধ হচ্ছে তার। আশফিনা আহমেদ তাকে নওশাদের কবল থেকে বাঁচিয়েছেন। তাকে দেখেই বোঝা যায় তিনি চান না চিত্রলেখা ভুলেও রঙ্গনের আশেপাশে থাকুক। এ জিনিসটা আশফিনা আহমেদের চোখ দেখেই বুঝতে পেরেছিল সে। রঙ্গনের সাথে কথা বাড়ানো তার জন্য ক্ষতিকারক। চিত্রলেখা ফোন পাশে রেখে বই নিয়ে বসলো। একটু বাদেই সঞ্চারী এলো তার কাছে।
-কী পড়ছিস?
-রসায়ন। তুই কোথায় গিয়েছিলি?
-এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে।
-বন্ধু? ছেলে বুঝি?
-হুম।
-বাব্বাহ!
-ধূর! উল্টোপাল্টা ভাববি না একদম!
-আচ্ছা বেশ। নাম কী আপনার বন্ধুর?
-অভিক।
-ভালোই।
সঞ্চারীর মুখের লাজুক আভা নজর এড়ালো না চিত্রলেখার। মেয়েটা নিশ্চিত অভিককে পছন্দ করে মনে মনে। চিত্রলেখা সেসব ভাবার সময় পেল না। দুদিন বাদে পরীক্ষা অথচ পড়াশোনার অবস্থা বেহাল। বইয়ে মনোনিবেশ করলো সে।
________________
সাথী বেশ অনেকক্ষণ ধরে অনিকের ফোন নম্বরে কল করছে। ফোন বারবার ওয়েটিং বলছে। সাথী বেশ বিরক্ত হলো। ছেলেটা ইদানিং নিজে থেকে কল করেনা একদম। অনিকের ব্যস্ততা বোঝে সাথী কিন্তু তবুও তার মন মানতে চায় না। প্রেমের বিয়ে, টানটা একটু বেশিই খাটে। এসব ভাবতে ভাবতেই অপর্ণার চেঁচামেচি কানে আসলো সাথীর। ফোন বিছানায় রেখে বাইরে আসে সে।
-কী হয়েছে আপা? এত চেঁচামেচি করছো কেন?
-আমার কাপড় ধুয়ে রেখেছিলাম ছাদে মেলতে দেওয়ার জন্য। রূপসার অত্যাচারে ভুলেই গেছি। তুইও তো একটু দেখতে পারতি!
-আমি রান্না করছিলাম আপা।
-ঐ এক রান্নার বাহানা! কাজ আমিও করি, সংসার করতে হলে সবদিকে মন ঠিক রাখতে হয়। প্রেম করে বিয়ে করছো তো সংসারে মন টেকে না।
-সকাল থেকে সব কাজ করলাম আমিই অথচ সংসারে মনও আমারই টেকেনা? আপনি ঠিক কোন কাজটা করে সংসারে মন বসাচ্ছেন আপা?
সাথীর ঝাঁঝালো প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকালো অপর্ণা। সাথী কখনো এভাবে কথা বলে না তার সাথে। সাথীর মন এমনিতেই বিক্ষিপ্ত অনিকের কারণে, তার উপর অপর্ণার চেঁচামেচি সে কিছুতেই সহ্য করতে পারেনি। খানিকটা উগ্র স্বরেই উত্তর দিয়েছে।
-সাথী, বাড়াবাড়ি করবি না একদম।
-কী করবেন? মাকে দিয়ে আমাকেও নোংরা গালিগালাজ করবেন? আমি চিত্রলেখা নই আপা। অর্ণব ভাই সত্যিটা জানলে আপনার সংসার বাঁচবে তো? আমার সাথে লাগতে আসিয়েন না।
সাথী চুপচাপ নিজের ঘরে ঢুকলো। অপর্ণার সাথে সে কখনো উচ্চবাচ্য করেনি তবে অপর্ণার কীর্তিকলাপে সে এখন বিরক্ত। চিত্রলেখাকে যতটা বাজেভাবে অপমানিত করেছে তার মা, এরপরও কোন মুখে সে এ বাড়িতে কর্তৃত্ব ফলাতে চায় বুঝে উঠতে পারে না সাথী। অনিকের নম্বরে আরেকবার কল করলো সে। এবার কল রিসিভ হলো। ঊপর পাশ থেকে মোলায়েম স্বরে একটি মেয়ে কণ্ঠ সালাম দিল।
-ওয়ালাইকুম সালাম। আপনি কে? অনিকের কল কেন রিসিভ করেছেন?
-স্যার মিটিংয়ে আছেন, আমি ওনার অ্যাসিস্ট্যান্ট।
-কিন্তু ওনার পি.এস তো জাহিদ ভাই ছিল।
-উনি রিজাইন করেছেন ম্যাম।
-আচ্ছা অনিক আসলে আমাকে বলবেন কল করতে।
-আচ্ছা ম্যাম।
সাথী কল কাটলো। বিরক্তি আরো বেড়েছে তার। একজনের কল কেউ এভাবে রিসিভ করে যতই পি.এস হোক! স্বভাবসুলভ হিংসেটা জেগে উঠে তার মনে। পরক্ষণেই গ্যালারিতে ঢুকে তার এবং অনিকের আগেকার ছবিগুলো দেখতে থাকে।
_____________________________
সময় বড্ড দ্রুত অতিবাহিত হয়। চোখের পলকেই সপ্তাহ দুয়েক পেরোলো। এর মধ্যে চিত্রলেখা ফেসবুকে ঢোকেনি আর। নওশাদের বিষয়টাও ধামাচাপা পড়েছে। সিয়াম অবশ্য প্রতিদিন পরীক্ষার খোঁজ নিয়েছে। চিত্রলেখার মাঝে মাঝে মনে হয় সিয়াম তাকে প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই করুণা করে।
পরীক্ষা শেষ হওয়ায় এক সপ্তাহের ছুটি দিল কলেজ থেকে। চিত্রলেখা ভেবেছিল বাড়িতে যাবে না কিন্তু কেউই থাকবে না হলে, সঞ্চারীও চলে যাচ্ছে। শেষমেশ বাধ্য হয়েই চিত্রলেখাকে বাড়িতে ফিরতে হলো। অনিকও ছুটি নিয়ে এসেছে। বাড়ির পরিবেশ বেশ ঠাণ্ডা। সবাই আছে কিন্তু কিছু একটা নেই এমন অবস্থা। চিত্রলেখা কিছু বুঝতে পারে না। সাথীর আশেপাশে ঘুরঘুর করছে সে। সাথী লক্ষ করলো।
-কী হয়েছে তোর?
-আশেপাশে এভাবে ঘুরঘুর করছিস কেন?
-বাড়ি এমন শান্ত কেন ভাবী? মনে হচ্ছে কিছু হয়েছে।
-অনেকদিন পর এসেছিস তাই এমন ভাবছিস। কিছু হয়নি। তাড়াতাড়ি বাড়িতে পিরে আয়। তোকে ছাড়া বাড়িটা মরুভূমি হয়ে গেছে।
-হয়েছে পাম দিও না এতো।
দুজনে খিলখিল করে হেসে উঠলো। চিত্রলেখাকে হাসতে দেখে মনের ভার কমলো সাথীর। সে দুশ্চিন্তায় ছিল হলে না জানি কেমন করে থাকছে চিত্রলেখা।
-তোর হলে অসুবিধা হচ্ছে নাকি?
-একদম না। একটা বান্ধবী আছে, খুব ভালো। সবসময় খেয়াল রাখে আমার আর আরেকজনের সাথে কথাবার্তা হয়নি তেমন তবে দুডনেই যথেষ্ট ভালো।
-বাড়ির মতো পরিস্থিতি নাকি ওখানে শান্তি খুঁজে পাস?
চিত্রলেখা উত্তর দিতে পারলো না। যত যাই হোক, বাড়িতে সে যে স্বস্তি পায় তা কি আদৌ হলে পাওয়া সম্ভব? বোধহয় না! নীরব থাকলো সে।
-তোর ভাইয়াকে চা দিয়ে আয় যা।
-ছোট ভাইয়া আমাকে দেখলে বিরক্ত হবে ভাবী।
-বেশি বুঝবি না! যাহ!
চিত্রলেখা চুপচাপ চায়ের ট্রে হাতে নিল। তার ছোট ভাবী যে তাকে এবং তার ভাইকে মেলানোর এ ব্যর্থ প্রচেষ্টা কতবার করেছেন হিসাব নেই।
চায়ের ট্রে বেডসাইড টেবিলে রেখে আশেপাশে তাকালো চিত্রলেখা। আশেপাশে অনিক নেই। বাথরুম থেকে পানির আওয়াজ আসছে। সেখানেই গেছে বোধহয়। আচমকা চিত্রলেখার চোখ পড়লো বিছানায় পড়ে থাকা ফোনটার উপর। কারো ইনবক্স ওপেন করা। একটু পরেই একটা ছবি আসলো সেখানে, একটা মেয়ের হাস্যোজ্জল ছবি। চিত্রলেখা খানিকটা বিস্মিত হলেও কিছু বললো না।
-আরে লেখা তুই? হঠাৎ আমার রুমে?
-হ্যাঁ চা দিতে এসেছিলাম ভাইয়া।
-ওহ, বস। পড়াশোনার খবর কী?
-এইতো ভালোই।
-তোদের বয়সী মেয়েদের মাথায় সমস্যা আছে বুঝলি? দুদিন ধরে একজন খুব জ্বালাচ্ছে। ভেবেছিলাম অল্পবয়সী, বকাঝকা করবো না। এখন দেখ ছবি পাঠিয়েছে। এখন রাগারাগি করলে দোষ তো আমার দিবে।
-ব্লক করে দাও ভাইয়া। অযথা ঝগড়া করে কী হবে?
অনিক মাথা নেড়ে সায় জানালো। চিত্রলেখার সংকোচ কিছুটা দূর হলো। অনিক আর সাথীর প্রেমময় দিনগুলির কথা চিত্রলেখা জানে। ভাবী তাকে সব স্মৃতি হুবহু বলে রেখেছেন। চিত্রলেখা এই দুজনের দিকে তাকায় আর ভাবে, তারা যেন সুখী হয় সর্বদা।
“তোমার বোনকে আবার কেন এনেছো? আমি কিন্তু বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।” অর্ণব অপর্ণার কথার উত্তর দিল না। অযথা এই মেয়ের প্রলাপ শোনার ধৈর্য দেখিয়ে লাভ নেই। কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করার ইচ্ছে শেষ হলে নিজে থেকেই চুপ করবে। অপর্ণা দেখলো অর্ণব তার কথায় কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখাচ্ছে না। এবার সে খানিকটা সাহস পেল। দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে বলে উঠলো,”চিত্রলেখার জন্য একটা ভালো পাত্রের প্রস্তাব এসেছে। ছেলে যথেষ্ট বড়লোক। ওকে সুখে রাখবে। সময় থাকতে বিয়েটা পেরে ফেলি চলো নাহলে আবার কার না কার হাত ধরে চলে যাবে আমাদের চুনকালি মাখিয়ে!”
চলবে…
[চোখে মারাত্মক সমস্যা শুরু হয়েছে যার কারণে আজ ছোট পর্ব দিলাম। দুঃখিত :3]