চিত্রলেখার_কাব্য দ্বিতীয়_পর্ব ~মিহি

0
690

#চিত্রলেখার_কাব্য
দ্বিতীয়_পর্ব
~মিহি

“পড়াতে এসে প্রথমদিনেই মাথা ঘুরে আমার বড় ছেলের কোলে ঢলে পড়লো আর তার কাছে আমি আমার ছোট ছেলেকে পড়াবো? টাকার অভাব নাকি আমার? কিছু টাকা ছুঁড়লে টিচারের লাইন লেগে যাবে!” কথাটা খানিকটা চেঁচিয়েই বলেছেন রঙ্গনের মা আশফিনা আহমেদ। দরজার বাইরে থাকা রঙ্গনের কানেও গেল বাক্যটা। সে চুপচাপ দরজার কাছ থেকে সরে গেল। আড়ি পেতে নিজের বাবা-মায়ের কথা শোনার ইচ্ছে তার নেই।

-তুমি মেয়েটাকে অযথা ভুল বুঝছো। অহম ওর পায়ের কাছে বাজি ফাটিয়েছে। ওর ভয় পাওয়া কী স্বাভাবিক নয়?

-রঙ্গনের কোলেই পড়তে হলো ওর? এ মেয়েকে আপনি বাদ দিন।

-আশফিনা, বেশি কথা বোলো না। আমি যখন বলেছি লেখাই অহমকে পড়াবে, তার মানে আমার কথাই শেষ কথা। এর উপর কারো কোনো মতামত আমি শুনতে চাইনা। তুমি ওকে সহ্য করতে পারোনা ঠিক আছে, অযথা ওর সাথে খারাপ আচরণ করবে না।

আশফিনা আহমেদ কিছু না বলেই চলে গেলেন। রঙ্গনের বাবা মাশরুর আহমেদ শান্ত স্বভাবের, তাই বোধহয় এমন রগচটা স্ত্রী লাভ করেছেন। অবশ্য আশফিনার রাগটা দিব্যি বুঝতে পারছে সে। আশফিনার ভাতিজি সাথীকে লেখার ভাইয়ের সাথে বিয়ে দেওয়ার ঘোর বিরোধী ছিল সে। এমনকি রাগ করে সে বিয়েতেও যায়নি। তার একটাই সমস্যা যে লেখার বাবা দুইটা বিয়ে করেছে, তার বাড়ির পরিবেশ সাথীর উপযুক্ত নয়। কথাটা ফেলে দেওয়ার মতোও নয় তবুও সাথী লেখার ভাই অনিককে ভালোবেসেছিল। তাদের ভালোবাসার কারণেই পরবর্তীতে দুই পরিবার রাজি হয় বিয়েতে। এ বিয়ের সূত্র ধরে আশফিনা এবং সাথীর বাবার সম্পর্ক প্রায় শেষ কিনারায় বললেই চলে। মাশরুর সাহেব এসব ভাবনা-চিন্তা রেখে অহমের ঘরের দিকে এগোলেন। এতক্ষণে নিশ্চিত লেখার জ্ঞান ফিরেছে।

________

চিত্রলেখার জ্ঞান ফিরতেই অনুভব করলো সে বেশ নরম বিছানায় হেলান দিয়ে আছে। চটজলদি উঠে পড়তেই সামনে ভ্রু কুঁচকে বসে থাকা ছেলেটা মুখ বিকৃত করলো।

-আপনি এত ভীতু? একটা বাজি ফাটাতেই এত ভয় পেলেন কেন? আপনার এ ভয় পাওয়ার জন্য কত বকা খেয়েছি জানেন? রঙ্গন ভাইয়া কত বকলো! আব্বুও বকলো। আচ্ছা ছাড়ুন, আপনি তো আমাকে পড়াবেন। নাম কী আপনার?

-চিত্র..লে..লেখা।

-এমা আপনি তোতলা?

-না।

-আচ্ছা, আমি অনেক দুঃখিত। এখন থেকে আমি একদম ভদ্র বাচ্চার মতো পড়বো, কোনো দুষ্টুমি করবো না প্রমিজ।

চিত্রলেখা ঢোক গিলল। কোন বিচ্ছুকে পড়াতে এসেছে সে! একবার মনে হলো মানা করে দেবে কিন্তু তাতে ছোট ভাবী মন খারাপ করবে। তাছাড়া টাকাটাও দরকার। এসব ভাবতে ভাবতেই মাশরুর আহমেদ অহমের ঘরে ঢুকলেন। চিত্রলেখা ততক্ষণে বিছানা থেকে উঠে সামনের চেয়ারে বসেছে। অহম বসেছে তার মুখোমুখি। মাশরুর আহমেদ আসতেই চিত্রলেখা দাঁড়িয়ে পড়লো।

-আরে বসো মা, দাঁড়াচ্ছো কেন? আমি শুধু একটু কথা বলতে এসেছি। আসলে আমার এ ছেলেটা এতটাই বাঁদর যে বলার মতো না! এখন তোমার উপরেই ওর দায়িত্ব। যেভাবে পারো এই গাধাটাকে কিছু শেখাও। অনেক টিচারই রেখেছি ওর জন্য, লাভ তো হয়নি। দেখো তুমি যদি আমার দেওয়া দায়িত্ব পালন করতে পারো।

-আমি চেষ্টা করবো আঙ্কেল।

-আচ্ছা তুমি ওর সাথে কথা বলে নাও। নিচে গাড়ি আছে, তোমাকে রেখে আসবে।

-ধন্যবাদ আঙ্কেল।

মাশরুর আহমেদ কথা বাড়ালেন না। তিনি চলে যেতেই চিত্রলেখার মুখে আবারো মলিন রেখা দৃশ্যমান হলো। অহম ছেলেটা সত্যিই দুষ্টু। প্রথমত তার বড় ভাইয়ের সাথে একটা ভুল বোঝাবুঝি হলো, তারপর আবার তার ছোট ভাই এমন দুষ্টুমি করলো। চিত্রলেখার মন সায় দিচ্ছে না এখানে থাকতে। এমনিতেই সে একটু অন্তর্মুখী স্বভাবের। তার উপর আজকের ঘটনার পর রঙ্গনের মুখোমুখি হওয়া তার জন্য কঠিন।

-ম্যাম, আপনি কী ভাবছেন?

-কিছুনা। তোমার সমস্যা কোন সাবজেক্টে?

-রসায়ন ছাড়া আমার কোনো সমস্যাই নেই। আমি সব সাবজেক্টেই ভালো করছি কিন্তু রসায়ন স্যার মোটেও ভালো পড়ায় না। তার উপর ওনার মেয়ের সাথে আমার আদা-কাঁচকলার সম্পর্ক তো, তাই ফেল করিয়ে দিয়েছে ইচ্ছে করে।

-ওনার মেয়ের সাথে তোমার কিসের শত্রুতা?

-আর বলবেন না ম্যাম! আমার গার্লফ্রেন্ড আছে তাও ছ্যাঁচড়ার মতো আমার পিছনে পড়ে থাকে। আমি তো লয়্যাল তাও কেমন কেমন করে। একদিন থাপ্পড় দিয়েছিলাম, সেটাই বাবাকে শুনিয়ে আমাকে ভিলেন বানিয়ে ফেলেছে।

-ইয়া আল্লাহ, খোদা! এটুক ছেলের গার্লফ্রেন্ড? এই তোমাদের জেনারেশন এত ফাস্ট কেন?

-ফাইভ-জি’র যুগে এসে স্লো হলে চলে ম্যাম?

চিত্রলেখা চুপ হয়ে গেল। কোন ধাতুতে গড়া এ ছেলে? একদিনের পরিচয়ে নিজের কীর্তিকলাপ সব কী সগৌরবে বাতলে দিচ্ছে! এমন ঠোঁটকাটা ছেলে সে কস্মিনকালেও দেখেনি।

-আচ্ছা বই বের করো।

-ম্যাম, একটা জিনিস বুঝান তো, নিউক্লিয়াস নিজের কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে উচ্চ শক্তিস্তর বা নিম্ন শক্তিস্তরে কিভাবে যায়? এই প্রশ্ন পরীক্ষায় এসেছিল। আমি উত্তর দিয়েছি, ইলেকট্রনের ইচ্ছা! জিরো দিয়েছে আমাকে।

-ঠিকই করেছে। দেখো, মনে করো তুমি ইলেকট্রন। এখন তোমার ক্ষুধা লেগেছে। তুমি খাবার খেয়ে মোটা হবে নাকি শুকিয়ে যাবে?

-যাহ ম্যাম! খাবার খেয়ে আবার কেউ শুকায় নাকি?

-ইলেকট্রনও তেমন শক্তি শোষণ করে উচ্চ শক্তিস্তরে যায়, তুমি যেমন খাবার খেয়ে মোটা হও। তারপর ধরো বেশি খেয়ে ফেললে তো আবার হাঁটাহাটি করে খাবার হজম করো, তাইনা?

-বুঝেছি ম্যাম। ইলেকট্রন শক্তি বিকিরণ করে নিম্ন শক্তিস্তরে আসবে। আরেহ! এটা তো সহজ, আমি অযথাই কনফিউজড ছিলাম এতদিন?

-রসায়ন ততটাও কঠিন না যতটা তুমি ভাবো। আচ্ছা আজ বেশি কিছু পড়াবো না। প্রথমদিন তো, তুমি বরং নিজের সমস্যাগুলো গুছিয়ে রাখো, আমি পরবর্তী দিন থেকে সলভ করাবো।

-আচ্ছা।

-তবে আমি আসি আজ।

-ম্যাম, একটা কথা বলি?

-বলো।

-আপনার কলেজে চান্স না হলে কি আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে?

চিত্রলেখা কী উত্তর দিবে বুঝতে পারলো না। বাচ্চাটার মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে এ কলেজে না হলে তোমার জীবন শেষ! কী অদ্ভুত মোহময় জগতে বাস করছে মানুষ। চিত্রলেখা অহমের মাথায় হাত রাখলো।

-আমার কলেজে চান্স না পেলে তোমার জীবন এখনকার মতোই চলবে।

-সত্যিই?

-হ্যাঁ তবে তোমার বুঝতে হবে তোমার জীবনে তুমি কী করতে চাও।

চিত্রলেখার জটিল কথাটা বোধহয় অহমের মাথায় ঢুকলো না তবুও সে মুচকি হাসলো। চিত্রলেখা হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে নিচে নামতেই সকালের লোকটার সাথে দেখা হলো। চিত্রলেখার মনে খানিকটা চাপা রাগ আছে লোকটার প্রতি। লোকটা তো বলতে পারতো রঙ্গন এ বাসার বড় ছেলে। তার ইজ্জতের তো ফালুদা হতো না। চিত্রলেখাকে দেখেই লোকটা এগিয়ে এলো।

-ম্যাম, আপনার জন্য বাইরে গাড়ি রাখা আছে। সাদা যে গাড়িটা, ঐটাতে বসবেন।

-জ্বী আচ্ছা।

চিত্রলেখা বের হয়ে আরেক বিপদে পড়লো। সামনে দুইটা সাদা গাড়ি। কোনটাতে উঠতে হবে বুঝতে পারলো না। একটা গাড়ির ড্রাইভিং সীট ফাঁকা। অপর গাড়িতে ড্রাইভিং সীটে সাদা সাদা পোশাক পড়া একজনকে দেখা যাচ্ছে। চিত্রলেখা বুঝতে পারলো এটাই তার যাওয়ার জন্য রাখা হয়েছে। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। চিত্রলেখা ঝটপট গাড়িতে বসে বলে উঠলো, “ড্রাইভার আঙ্কেল তাড়াতাড়ি চলুন, সন্ধ্যা হয়ে আসছে।” বলেই সে সীটবেল্ট লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সীটবেল্ট লাগানো শেষ করে সামনে তাকাতেই দেখলো রঙ্গন গম্ভীর ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

-সকালে ‘রঙ্গন’, এখন ‘আঙ্কেল’? চশমা বোধহয় ঠিকমতো কাজ করছে না আপনার। দ্রুত ডাক্তার দেখান।

-আপনি! আমি দুঃখিত। আসলে ঐ আঙ্কেল বললো সাদা গাড়ি..এখানে দুইটাই সাদা গাড়ি … আমি বুঝতেই পারিনা…

-আরেহ! শান্ত হোন। আমিই ড্রপ করে আসছি, এড্রেস বলুন।

-না..না, তার দরকার নেই।

-এটা আপনার আঙ্কেল বলার শাস্তি। ইউ কান্ট ডিনাই!

এরই মধ্যে ড্রাইভারকে আসতে দেখে চটজলদি ‘স্যরি’ বলে গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল চিত্রলেখা। রঙ্গন বিস্মিত হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। অদ্ভুত তো মেয়েটা! রঙ্গন কি তাকে রেখে আসতে পারতো না?

চিত্রলেখা যে রঙ্গনের গাড়িতে গিয়ে বসেছিল তা নিজের ঘরের বারান্দা থেকে স্পষ্ট দেখলেন আশফিনা আহমেদ। পরবর্তীতে চিত্রলেখার নেমে যাওয়া তাকে ততটা প্রভাবিত করলো না। চিত্রলেখার জন্য ভয়াবহ কিছু অপেক্ষা করছে তা মনে মনে স্থির করে ফেলেছেন তিনি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here