ফুলকৌড়ি পর্ব(২৩)কপি করা নিষিদ্ধ। #লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

0
1100

#ফুলকৌড়ি
পর্ব(২৩)কপি করা নিষিদ্ধ।
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

ঋতুতে সময়টা হেমন্তকাল।হালকা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব পড়েছে।রুমের পশ্চিমের জানালা দিয়ে বিকালের নিভে আসা স্বর্নালি রোদটা শরীরে কেমন মিঠামিঠা ভাব দিচ্ছে।নিজের রুমের ছোটোখাটো বেলকনির চেয়ারে বসে আছে কৌড়ি।মান্যতা আপু এখনো ভার্সিটি থেকে ফেরেনি।মৌনতা এই সময়টাতে আপতত ব্যাচে থাকে।আসার সময়টা অবশ্যই হয়ে গেছে।আর নাফিম, তাকে হয়তো বকে ধমকিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে ছোটো-মা।নাহলে বাড়িতে থাকাকালীন ছেলেটা তার রুমেই থাকে।আজ ছেলেটাকে কলেজ থেকে ফিরে এখনো দেখিনি কৌড়ি।খোঁজ নেওয়া উচিত ছিলো।যদিও কৌড়ি খোঁজ নেয়।তবে আজ মনটা তার কোনো কিছুতেই বসছে না। একজন নিজের গম্ভীর কথাকাজ দ্বারা তার মনমস্তিষ্কে জ্বালা বাঁধিয়ে দিয়েছে।বিধায় আজ কলেজের ক্লাসটাও ঠিকঠাক মতো করতে পারেনি সে।শুধু ওই মানুষটাকে আর তার কথাকাজগুলো ভেসে বেড়িয়েছে মন মস্তিস্কের অলিগলিতে।কিসব কথাবার্তা বলে তার ছোট্ট মনটাকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে দিলো মানুষটা!ওই গম্ভীর মানুষটাকে,ভাবলেই তার দম বন্ধ হয়ে আসে।সেখানে তাঁকে ঘিরে ওই মানুষটার শান্ত চাহুনি,কিসব আবোলতাবোল বার্তা!উফফ,কখনোই তা কি সম্ভব!কিভাবে সম্ভব!ওই মানুষটা আর সে!ওরে আল্লাহ, কখনোই সম্ভব’না।আর সে-সব কিভাবে ভাবতে পারে মানুষটা।ক্ষনে ক্ষনে এসব মনমস্তিস্কে ঘুরছে,আর বুকটা তার অস্বাভাবিকভাবে কেঁপে কেঁপে উঠছে।বিধায় মন স্থির বসাতে পারছেনা কোথাও।উফফ কি এক জ্বালা বাঁধিয়ে দিলো!অদৃশ্য ভঙ্গিতে মাথা ঝেড়ে মনেমনে বললো–সে আর ভাববে না এসব নিয়ে।আর না সহজে ওই মানুষটার সামনে পড়বে।ফের মনেমনে নিজের মনকে বুঝ দিলো,শহরের ছেলেরা মোটেই ভালো হয়না।আর বড়োলোকর বাপের ছেলেরা তো মোটেই নয়!

মূহর্তেই আবার মনমস্তিস্কের ভাবনা পাল্টে গেলো কৌড়ির।এবাড়ির ছেলেগুলো তো তেমনটা নয়।বিগত দু-মাসে কারও সেরকম কোনো অসংগত আচার ব্যবহার তো পায়নি সে।তবে অকপটে কিকরে বলতে পারে, শহরের ছেলেরা ভালো নয়।পৃথিবীতে ভালোমন্দ মিলে মানুষ।কে ভালো কে খারাপ তার যেনে-বুঝে লাভ আছে কি!দাদিআপা বারবার এসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলেছে।কখনো যেনো এসব বিষয়ে মন-কান না দেওয়া হয়।এমনকি যখনই উনার সাথে ফোনে কথা হয়,বরাবরই একটাই সতর্কতা।–খবরদার আপা,ওসব ফাঁদে কখনো পা দিসনা যেনো।পরের বাড়িতে বাপের মান রাখিস।ওসবে জড়িয়ে বাপ মায়ের সম্মান যেনো নষ্ট করিস না।কেউ কখনো যেনো তোর দিকে বা তোর মরা বাপ মায়ের দিকে আঙুল তুলে কথা বলতে না পারে,এমন কোনো কাজ করিসনা মনের ভুলেও।নিজের আচার ব্যবহার নম্র রেখে সবসময় সাবধানে চলাফেরা করবি।আর খবরদার ছেলেদের মন ভোলোনাে কথায় কখনো দূর্বল হবি-না।

হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেলো কৌড়ির।কেনো সে নিজেও যানে না।ফোনের আওয়াজে ভাবনা ছেঁদ হলো তার।উঠে দাঁড়ালো সে।রুমে গিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো, তার বান্ধবী বিথী ফোন দিয়েছে।মেয়েটার সাথে যোগাযোগ করেছিল,মান্যতা আপুর ফোন দিয়ে।তারপর মাঝেমধ্যে কথা হতো।এই ফোনটা পাওয়ার পর বিথীকে জানিয়ে দিয়েছে।তারপর প্রায় বিকালে কথা হয় তাদের।কলটা রিসিভ করে সালাম দিয়ে ভালোমন্দ কথাবার্তা সারলো দু’জনে।ফের এটাওটা নিয়ে কথা বলতে থাকলো।কথার একপর্যায়ে বিথীর মনেহলো কোনো কারনে কৌড়ির মন খারাপ।মেয়েটা আজ হা হু ছাড়া সেভাবে কথাই বলছে না।বরং বিথীকে বারবার বলতে হচ্ছে,কৌড়ি শুনছিস?মেয়েটা তখন অমনোযোগীর মতো বলছে,কি বলেছিস আমি খেয়াল করিনি,বুঝতে পারিনি আবার বল।অথচ মেয়েটা এমন তো নয়।তবে আজ কি হলো।কথা প্রসঙ্গে বিথী বললো।

‘এই কৌড়ি কি হয়েছে তোর?,আজ কোনো কারনে কি মন খারাপ?

একটু চমকালো কৌড়ি।কথার মধ্যে নিজের অমনোযোগীতা টের পেলো।সহসা বললো।–আরেহ না।মন খারাপ কেনো থাকবে!

কৌড়ির সহসা উত্তরেও স্পষ্ট দ্বিধা।সেটা বুঝতে পেরে
ওপাশ থেকে বিথী কিছুটা অনুযোগী স্বরে বললো–আগে কিন্তু তুই আমার কাছ থেকে কিচ্ছু লুকােতিস না, আমাকে তোর সবটা বলতিস।একবারে এ টু জেট।আর এখন দূরে গিয়ে পর হয়ে গিয়েছিস,কিচ্ছু বলতে চাস না।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো কৌড়ি।সত্যি বলতে বিথী আর তার বন্ধুত্ব শিশু বয়স থেকে,বলতে গেলে স্কুলে পড়ার আগে থেকে।স্কুল যাওয়ার আগ থেকেই মেয়েটা তার খেলার সঙ্গী ছিলো।তারপর একসাথে স্কুল পড়াকালীন গভীর বন্ধুত্ব তৈরী হয়।সেই বন্ধুত্বের জোরে,আলাদা আলাদা বিভাগে পড়া সত্ত্বেও একই কলেজ ভর্তি হয়েছিলো।দুজনের এমন কোনো খুটিনাটি বিষয় নেই।যে তারা দুজনে একে অপরেরটা জানেনা।দু’জনে একজায়গায় হলেই একে অপরের ভালো মন্দটা মন খুলে বলতো, জানাতো।প্রান খুলে গল্প করতো।দুজন দু’জনের যেনো একটা বিশ্বাস,একটা ভরসার জায়গা ছিলো।আর সেই বিশ্বাস ভরসার জায়গাটা সবসময়ের জন্য দু’জনেই অটুট রাখার চেষ্টা করেছে।রেখেছে-ও।তবে নিভানের কথাটা বিথীকে বলতে তার যেনো কেমন একটা অনুভব হচ্ছে। তাই ভিতর থেকে চেয়েও বলতে পারছে না।তবে প্রিয় বান্ধবীটাকে অনুযোগ তো করতে দেওয়া যায়না।তাই বললো।

‘আরেহ তেমন কিছুনা?এমনিতেই মনটা কেমন কেমন করছিলো।কেনো যানি কিচ্ছু ভালো লাগছে না।

‘কিন্তু কেনো?

বলবে না বলবেনা করে-ও কৌড়ি সময় নিয়ে রয়েসয়ে নিভানের ইদানীং তার-প্রতি করা আচার ব্যবহার এবং তার বলা কথাগুলো বিথীকে জানালো।বিথীও চুপচাপ শুনলো।যেদিন থেকে কৌড়ির সাথে যোগাযোগ হয়েছে, সেদিন থেকেই ওবাড়ির সবার কথা টুকটাক শুনছে সে।ইদানীং ওবাড়ির সবার বিষয়ে মোটামুটি ধারণা এসে গেছে তার। সবাই বেশ ভালো মনের মানুষ।তবে যে মানুষটার কথা আজ কৌড়ি বলছে,তারকথা এতোদিনে কোনোদিন কৌড়ির মুখে শোনেনি সে।কি জানি কেমন ছেলেটা।তবে কৌড়ি শান্তশিষ্ট হলেও অবুঝ নয়।যথেষ্ঠ বুঝদার মেয়ে।নিশ্চয় বুঝেশুনে পা এগোবে।তবুও প্রিয় মানুষটার ভালো বিবেচনা করে সর্তকতা সরূপ বললো।

‘তোর কথা শুনে-তো মনহচ্ছে উনি তোকে বেশ পছন্দ করেন।তবে কৌড়ি সাবধান।এটা যদিও আবেগের বয়স যারতার কথায় গলে যাস না যেনো।ওরা শহরের ছেলে।আর শুধু শহরের ছেলে বলে কথা নয়,কার মনে কি আছে বলা তো যায়-না।এখন কিন্তু প্রায়শই মেয়েরা ছেলেদের এমন কথায় দূর্বল হয়ে নিজেদের সবকিছু খুইয়ে চরিত্র হারাচ্ছে।তাই সাবধান।

নিভানকে তার কখনো খারাপ মনের ছেলে বলে মনে হয়নি কৌড়ির।এমনকি সারাক্ষণ তার পিছে লেগে থাকা ইভানকেও না।বিথীর সবকথা মানতে পারলে-ও, কেনো জানি উনি ভালো ছেলে নাও হতে পারে!এই কথাটা মন কিছুতেই মানতে চাইলো না।সেটা বিথীর কথার প্রেক্ষিতে বলেই ফেললো।

‘আমার মনে হয়না,উনি তেমন ছেলে।

আশ্চর্য হলো বিথী।তবে কি ছেলেটার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়লো কৌড়ি।আশ্চর্যতা গলায় জিজ্ঞেস করলো–তবে তুই কি তাকে প্রশ্রয় দিতে চাইছিস?

তড়িঘড়ি করে বললো কৌড়ি–আরেহ না।আমি প্রশ্রয় দেওয়ার কথা বললাম কখন!তবে আমার কেনো জানি মনে হয়-না,তিনি খারাপ মন- মানসিকতার ছেলে।

কথাটা বলে চোখ বুঁজে ফেললো কৌড়ি।সত্যিই কি সে প্রশ্রয় দিতে চাইছে?না-হলে সারাদিন সবকিছু ফেলে ওই মানুষটা মাথার প্রতিটি নিউরনে নিউরনে ঘুরছে কি করে! আর কেনোই বা সে ওই মানুষটার হয়ে সাফাই গাইছে?হোক ভালো বা মন্দ তাতে তার কি!সে তো ওসবে মনোযোগ দিতে চায়না।ডালিয়া ফুপির ভাস্যমতে লোভী হতে চায়না সে।তবে কেনো ওই মানুষটার বিরুদ্ধে উল্টো পাল্টা কথা শুনতে পারছে-না।চাইছেনা মন শুনতে।উফফ,এ কেমন জ্বালা বাঁধলো মনে।বিথীর কথায় ভাবনা কাটলো তার।

‘তুই যে উনার পক্ষ নিয়ে মন্দটা ভাবার আগে ভালো মনোভাবটা প্রকাশ করছিস ওটাইকেই প্রশ্রয় দেওয়া বলে কৌড়ি।তবে সাবধান।ভালো মন্দ বুঝেশুনে।যেমনটা নাহিদ ভাইয়ার ক্ষেত্রে বুঝশুনে চলতিস।তেমনভাবে চলিস,পাখি।আমি কখনো তোর খারাপ খবরটা শুনতে চাই না।এমনকি তুই কোনোপ্রকার পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিস সেই খবরটা-ও না।তোকে আমি নিজের আপনজনের মতোই ভালোবাসি।এইটা অন্তত বিশ্বাস রাখিস পাখি।

‘আমি বিশ্বাস এবং ভরসা দুটোই করি তোকে।তুই আমার খারাপ চাইবিনা কখনো,এটাও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।তোকে সেটা বলে বোঝাতে হবেনা।আর সত্যি বলতে,তুই আর দাদিআপা হলো আমার সহজ সরল পথের বন্ধু, সঙ্গীনি।তাদের কথা না মানি কি করে?আমি নিজেকে সাবধানে রাখার চেষ্টা করবো।প্রতিটি পদক্ষেপে পা বাড়ানোর আগে বুঝে-শুনে পা বাড়াবো।ভাবিস-না আমাকে নিয়ে।

‘লাভ ইউ সো মাচ্ পাখি।আমি সত্যি তোর খারাপ চাই না,আমার কথাগুলো তুই অন্যভাবে নিস না।

‘লাভ ইউ সো মাচ্ ট্যু বিথীরানি।আমি জানি সেটা।আর আমি মোটেও তোর কথাগুলো অন্যভাবে নেয়নি।নিচ্ছিও না।

কথার একপর্যায়ে দুই বান্ধবী আবার-ও বিভিন্ন কথায় মত্ত হলো।কথা শেষ হতেই ফোনটা চোখের সামনে নিতেই আবারও,সেই মানুষটার খেয়াল মনের নজরে ভেসে উঠলো।পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া তপ্তহীন সূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলো নির্বিশেষে।ফের চোখ বন্ধ করে নিতেই ভেসে উঠলো,সেই ধারালো স্থির শান্ত বাদামীবর্ন নজরজোড়া।সুডৌল কাটকাট শ্যামবর্ণ মুখাবয়ব।সেদিন বৃষ্টিভেজা দিনে,তাকে দেখে মানুষটার ক্ষীন হাসি।দুহাত হাটুতে ভর দিয়ে জোরেজোরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা।কাছে গিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করা,খুব ভয় পেয়েছো তাইনা?এইতো আমি এসে গেছি আর ভয় কিসের?তার নিজ চোখে দেখা সবটা কিকরে ছলনা হয়?তাকে হেনস্তা করার জন্য ওই ছেলেগুলােকে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দেওয়ার মতো অবস্থা করা।সকালের সোজাসাপ্টা উত্তরটা,ওরা নিভানের ঠিক কেথায় ছুঁতে চেয়েছিলো তোমার হয়তো জানা নেই।এই ইঙ্গিতপূর্ন কথাগুলো তার মনমস্তিস্কে আজ সারাদিন পীড়া দিয়ে চলেছে।এখনো দিচ্ছে।তবে বিথীর বক্তব্য অনুযায়ী তার কেনো জানি মনেহয়,ওই মানুষটার ব্যাক্তিত্বের আড়ালে অন্য কোনো মানুষ নেই।আর যদিও থেকে থাকে তবে কৌড়ির জানি বিশ্বাস সেখানে কোনো ছলনা নেই।এমন বিশ্বাস ভরসা কেনো তৈরী হতে চাইছে?কেনো মনে হচ্ছে মানুষটা একটুও খারাপ নয়?

সৃষ্টিকর্তার ধরাবাঁধা নিয়মানুযায়ী আবারও একটা সকালের সূচনা হলো।নিয়ম অনুযায়ী খাওয়া দাওয়া সেরে যে যার মূখ্য গন্তব্য চলে গেলো।সকাল থেকেই কৌড়ির শরীরটা কেমন যেনো ভালো লাগছে না।ক্ষনে ক্ষনে অসম্ভব পেটব্যথা করছে সাথে পিরিয়ড হওয়ার পূর্বলক্ষণীয়।বিধায় আজ কলেজে যায়নি সে।যেতে মন চাইনি তার।বড়মা,আঙ্কেলের চেকআপে জন্য সকাল সকাল হসপিটালে ছুটেছেন।যাবার আগে তাকে দেখে বলে গিয়েছেন–বেশি শরীর খারাপ লাগলে যাওয়ার দরকার নেই।বাড়িতে পড়াশোনা কর।বিশ্রামও হয়ে যাবে সাথে পড়াশোনাও।

সকালের খাবারটা খেতে একটুও রুচি হচ্ছেনা কৌড়ির।তবুও ছোটোমা কয়েকবার ডাকতে পাঠিয়েছেন।তার না যাওয়াতে শেষমেশ নিজে-ও এসে ডেকে গিয়েছেন।বিধায় নিজের ভালো না লাগাটা একরকম একপাশে ফেলে রেখে ডায়িংয়ের উদ্দেশ্য ছুটলো সে।তবে খাবার উদ্দেশ্য নয় ছোটোমাকে বুঝিয়ে বলার উদ্দেশ্য।ডাইনিংয়ে এসে স্বান্তনা রহমাকে না পেয়ে রান্নাঘরে ঢুকল।কৌড়িকে ঢুকতে দেখেই স্বান্তনা রহমান তড়িঘড়ি করে বললেন।

‘কিচেনে কেনো তুই।ডায়নিংয়ে খাবার দিয়েছি খেয়ে নে।

মানুষ গুলোর ব্যবহার দেখলে মনেহয়,কতো চিরচেনা পরিচিতি তারা।কত-শত আপনজন।অথচ এবাড়িতে এসেছে সে মাস দুই হবে।কিন্তু নিজদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে আর তারমধ্যে কোনো বিষয়ে কখনো তফাৎ করে দেখেনি।কখনো তাদের আচার ব্যবহার তারপ্রতি বিরূপ দৃষ্টি ফেলেনি।কৌড়ির ইদানীং মনেইহয়না,সে এবাড়িতে এই মাস দুয়েক আগে এসেছিলো।তার মনেহয়,সে জন্ম থেকে এবাড়িতে থেকে আসছে।

‘কি হলো,দাঁড়িয়ে রইলি কেনো?কতো বেলা হয়েছে খেয়াল আছে?টেবিলে সব গুছানো,যা খেয়ে নে।

‘আমার খেতে ইচ্ছে করছেনা, ছোটোমা।

চুলায় নরম ডাল খিচুড়ি পাকাচ্ছিলেন স্বান্তনা রহমান।হুট করে শ্বাশুড়িমা খেতে চেয়েছেন।অসময়ে তারই বন্দবস্ত করছিলেন তিনি।কৌড়ি কথাটা বলতেই হাতের কাজ ফেলে রেখে,তার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালেন।সহসা কপালে গলায় হাত উল্টে পাল্টে রেখে বললেন।

‘কেনো ভালো লাগছে-না খেতে?হঠাৎ কোনো কারনে শরীর খারাপ লাগছে নাকি?

‘তেমন কিছুনা।এমনিতেই ভালো লাগছেনা খেতে।

কৌড়ির মুখের দিকে দৃষ্টি ফেললেন স্বান্তনা রহমান।শুভ্র মায়াভরা মুখটা আজ কেমন মলিন মলিন ভাব,সাথে ক্ষনে ক্ষনে কপাল কুঁচকে মেয়েটা ব্যাথা হজম করছে মনেহচ্ছে।ব্যাপার কি?কিছু আন্দাজ করতে পেরে বললেন–পেট ব্যাথা করছে নাকি?

দৃষ্টি নত রেখে কৌড়ি বললো —ওই একটু।

কৌড়ির কথার সুরেই যেনো বাকিটা বুঝে নিলেন স্বান্তনা রহমান।দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।প্রত্যেক মাসে এই সময়ের ব্যথা বেদনা দিয়ে বিভিন্ন সমস্যা পার করার থেকে একটা করে বাচ্চা প্রসব হয়ে যাওয়া ভালো। এটা উনার পিরিয়ড টাইমের জন্য মনে হয়।জানেন না মেয়েটার কি হয়।তবে নিজেরটা দিয়ে উপলব্ধি করে বললেন।

‘অন্যকিছু বানিয়ে দেবো?খাবি?না খেলে আরও খারাপ লাগবে তো!

‘আমার টোটাল খেতে ইচ্ছে করছেনা ছোটোমা।বিশ্বাস করো,খাবার গালে তুললেই বমি আসবে মনেহচ্ছে।

ফের বিড়বিড় করে বললো —বমি আসবে কি,এই সময়টাতে পেটব্যথা মাথাব্যথা হাতপা চিবানো।খাবারে অরুচি এমনকি বমিটাও বাদ যায়না তার।দুনিয়ায় শত অসহ্যতা সব এসে ভর করে শরীরে।

স্বান্তনা রহমান কিছু একটা ভাবলেন।ফের বললেন –আচ্ছা ঠিক আছে।আপতত খেতে হবেনা।তোর দাদুমার জন্য নরম খিচুড়ি রান্না করছি,হয়ে যাক।পাঠিয়ে দিচ্ছি তোর রুমে।খাবার চেষ্টা করিস,নাহলে আরও বেশি শরীর খারাপ লাগবে।মৌনতাকে দেখিস না,এসময়ে তিনদিন বিছানার সাথে লেগে থাকে।যা রুমে গিয়ে বিশ্রাম নে।

এই সময়টাতে তারপ্রতি দাদিআপার যত্ন ছিলেও অমায়িক।অথচ সেই যত্ন এখানেও পাবে আশা রাখেনি কৌড়ি।যদিও মানুষগুলো তার প্রচন্ড খেয়াল রাখে, ভালোবাসে।স্বান্তনা রহমানের কোমল গলার কথাগুলোতে আবেগপ্রবণ হলো সে।খিচুড়ি নাড়াচাড়া করা রান্নারত স্বান্তনা রহমানকে খুব কাছে দাঁড়ালো। দ্বিধান্বিত হয়েও,হঠাৎ পিছে থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে আবেগপ্রবণ গলায় বললো।—তুমি, বড়মা সবাই এতো ভালো কেনো ছোটোমা।

শান্তশিষ্ট মেয়েটা সহজে পাশ ঘেঁষে না।যদিও সম্পর্কটা তাদের অনেকটা আপনজন টাইপ নর্মাল হয়ে গিয়েছে।তবুও মেয়েটা তাদের দেওয়া নেওয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকে।আগ বাড়িয়ে নিজে থেকে কোনো কিছু চাওয়া পাওয়ার চেষ্টা করেনা। এমনকি উনাদের আদর যত্নটাও নয়।সেই মেয়ে আজ উনাকে নিজ ইচ্ছেতে জড়িয়ে ধরেছে।কাছে এসেছে।মমতাময়ী মন আরও নরম হলো উনার।হাতের খুন্তি ছেড়ে,নিজের কাঁধে রাখা কৌড়ির মুখে হাত দিয়ে বললেন।-মা যে তাই।তোদের ভালোমন্দ বোঝাটাই তো আমাদের মায়েদের দায়দায়িত্ব।আমরা না বুঝলে কে বুঝবে শুনি!এখানে মায়েদের বিশেষ ভালো হওয়া লাগেনা।প্রয়োজন পড়েনা। মায়েরা ভালো হোক বা মন্দ,সন্তানের সুখসুবিধা, ভালোমন্দতে তারা কোনো বেনিফিট ছাড়াই মমতাময়ী,স্নেহভাজন যত্নশীল,দরদী।বুঝলি?

‘হুমম।বুঝলাম।

স্বান্তনা রহমানকে জড়িয়ে থাকা অবস্থায় কিছু সময় কেটে গেলো।তিনিও সরতে বললেননা,কৌড়িও সরলো না।কিছুসময় যেতেই তিনি বললেন–এভাবে জড়িয়ে থাকলে আমি কাজ করবো কিভাবে?রুমে গিয়ে বিশ্রাম নে,যা।একটু পরে আমি খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।

রয়েসয়ে সরে দাঁড়ালো কৌড়ি।বললো–কি করতে হবে বলো?আমি তোমাকে করে দিচ্ছি।

‘তুই বললি না তোর খারাপ লাগছে,এখন আবার কাজ করতে মন চাইছে?আর এখানে আপতত কোনো কাজ বাকী নেই,শুধু এই রান্নাটুকু ছাড়া।আর কাজ থাকলেও করা লাগবেও না তোকে।আর যেটুকু আছে,রানি একটু বাহিরে গিয়েছে এসে করে নেবে।

‘আমার খারাপ লাগছে,খেতে ইচ্ছে করছেনা।তবে কাজ করার মতো অসুস্থতা আমি অনুভব করছিনা।

কৌড়ির পানে চাইলেন স্বান্তনা রহমান। কপাল কুঁচকে কিছুটা রাগ দেখিয়ে বললেন–এই তুই মৌনতার মতো মুখে মুখে তর্ক করতে শিখে গেছিস?শিখবি না কেনো, সঙ্গ দোষ বলে কথা।যাই হোক রুমে যেতে বলছি,রুমে যা।

কৌড়ি মুখ ছোটো করে ফেললো।বললো-আচ্ছা যাচ্ছি।

রান্নাঘর থেকে ধীরপায়ে বেরিয়ে এলো কৌড়ি।বেরিয়ে
ডায়নিং স্পেস।সেখানে নজর পড়তেই দেখলো,ইভান চুপচাপ খাবার খাচ্ছে।ছেলেটাক বেশ কয়দিন ধরে সেভাবে বাড়িতে দেখা যায় না।ইদানীং সকালে খাবার টেবিলে ছাড়া তাকে খুব একটা বাড়িতে দেখা যায় না।তবে আজ আর খুঁচিয়ে কথা শুনতে চাইলো না বলে নিজের রুমের দিকে চুপচাপ হাঁটা দিলো কৌড়ি।খেতে খেতে ইভানের নজরে সেটা পড়তেই তিরস্কারপূর্ন গলায় বললো।—বাড়ির বড় বউ।অথচ কোনো দিকে তার নজর নেই।কে খেলো,কে না খেলো।কোথায় কি আছে, কোথায় কি নেই।সেদিকে তার কোনো মন কান নেই।সে আছে নিজের খেয়ালে।বাড়িতে দেবর ননদের মেলা।তাদেরও তো খাতির যত্ন করা বড় বউয়ের দায়িত্ব অথচ তার সেদিকে মন নেই।এ-কেমন বড়ো বউ তুমি ফুলকৌড়ি?আমার দাদাভাইকে দেখো,সে কেমন সব দিকের দায়িত্ব পালন করে চলেছে।অথচ তুমি?সেই দাদাভাইয়ের ব….

কৌড়ির পা থেমে গিয়েছে অনেক আগেই।আর মুখ করুণ করে ইভানের কথাগুলো শুনছিলো।তবে ছেলেটা বলে যাচ্ছে লাগামহীন।যদিও লাগাম রেখে বলে কখন!তাই তাকে থামিয়ে দিতে বললো।

‘ইভান ভাইয়া।আপনার কি সারাদিন এসব উল্টো পাল্টা কথাবার্তা ছাড়া আর কোনো কথা মাথায় আসে-না?

‘এগুলো তোমার উল্টো পাল্টা কথাবার্তা মনেহলো?আশ্চর্য!আর বাড়ির বড় বউ হয়ে দায়িত্বে অবহেলা করলে তো অবশ্যই দেবর ননদের বেশি কথা শুনতেই হবে।এখন থেকে অভ্যাস করে নাও।যাই হোক আমাকে একজগ পানি এনে দাওতো বাড়ির বড় বউমা।

টেবিলের দিকে তাকালো কৌড়ি।সত্যিই জগে একফোঁটাও পানি নেই।সহজভাবে বললেই তো হতো।তারজন্য এতো উল্টো পাল্টা কথা বলার প্রয়োজন ছিলো?দীর্ঘশ্বাস ফেললো কৌড়ি।টেবিলে বসা ছেলেটা ইভান,মাথায় রাখা উচিত ছিলো তার।এগিয়ে যেতে যেতে বললো।

‘পানি লাগবে বললেই তো হতো।আবোলতাবোল বলার কি দরকার ছিলো?আমার না মাঝেমধ্যে আপনার উপর ভিষণ রাগ হয়,কিন্তু রাগটা কিভাবে দেখাবো সেটা বুঝে উঠতে পারিনা বলে রাগটাও আর দেখাতে পারি না।

চমৎকার হাসলো ইভান।কৌড়িকে আরও একটু ক্ষেপাতে বললো–তুমি রাগতেও জানো!এটা তো জানা ছিলোনা আমার।তা রেগে দেখাও দেখি একটু,ভবিষ্যতে আমার দাদাভাইয়ের কপালে কি আছে একটু বুঝে নেই।যদি-ও আমার দাদাভাইয়ের প্রচুর ধৈর্য্য,তোমার মতো শান্তশিষ্ট ফুলকৌড়ির রাগ সহ্য করাটা তার একটা তুড়ির ব্যাপার।যদি-ও আমার সেটা কোনো ব্যাপার বলেই মনে হয়না।

কৌড়ি কোনো জবাব দিলোনা।ডাইনিং টেবিলের কাছা- কাছি রাখা ফ্লিটার থেকে একজগ পানি এনে রেখে দিলো টেবিলে।ফের হুমকি সরূপ বললো–আপনি এই বিষয় নিয়ে আর একদিনও উল্টো পাল্টা কথা বললে আমি বড়মাকে বলে দেবো।

‘আরেহ,তুমি যে এবাড়ির বড় বউমা,এটা তোমার বড়মা ও জানেন।আর তোমার বড়মাকে থোড়াই না আমি ভয় পাই।তবে তুমি যদি দাদাভাইয়ের ভয় দেখাতে,যে দাদাভাইকে বলে দেবে তুমি তবে হয়তোবা কিছুটা ভয় পেতাম।যদিও তুমি বরের কান ভাঙানো টাইপ বউ নও এটা বুঝেই তো আমি তোমাকে আমার বউমনি আর দাদাভাইয়ের বউ বলে মেনে নিয়েছি।

‘আপনি আসলেই খুব খারাপ?

‘সত্যি তুমি রেগে যাচ্ছো দেখি!আচ্ছা রেগে যেও-না।তবে তোমাকে একটা কথা জানানোর আছে?শুনতে চাও?শুনতে না চাইলেও,বাড়ির বড়বউ হিসাবে শোনাটা দায়িত্ব তোমার।

ইভানের ফাজলামো সম্বোধন কানে না তুলে কৌতুহল বশত কৌড়ি বলে ফেললো। –কি?

‘আমার বউটার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছি আমার শ্বাশুড়ি আর শালাবাবু। এখন বলোতো উপায় হিসাবে,আমার কি বিয়েটা ভেঙে দেওয়া উচিত?নাকি তাকে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে আসা উচিত?

‘সত্যি আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে?আর আপনি বিয়ে করবেন?

‘কেনো?আমি কি দেখতে শুনতে খারাপ, যে আমার গার্লফ্রেন্ড থাকতে পারেনা? নাকি আমার বিয়ে করতে মানা?

কৌড়ি বেজার মুখে বললো–আমি কিন্তু সেটা মোটেই বলিনি।আপনি শুধু শুধু কথা ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বাড়ান।আমি বলতে চাইছি, আপনার সত্যি গার্লফ্রেন্ড আছে কি-না?

আবার-ও গাল ভরে হেসে দিলো ইভান।ফের বললো–‘আরেহ,মুখ ওরকম পেঁচার মতো করে ফেললে কেনো ফুলকৌড়ি।তুমি আমার বড় বউমনি না,মায়ের মতো ধৈর্য্য রাখবা সবসময়।আর সেদিন না বললাম আমার গার্লফ্রেন্ড নেই আর ও গার্লফ্রেন্ড নয়।বিয়ে না করা বউ,বুঝলে?আমি তাকে গার্লফ্রেন্ড নয় বউ বানাতে চেয়েছিলাম।এখন কি করা যায় সেটাই বলো?বিয়ে করে তোমার জা বানিয়ে নিয়ে আসি,কি বলো?

‘আপনি আপনার দাদাভাইয়ে আগে বিয়ে করবেন বলছেন?

‘কেনো,দাদাভাইয়ের আগে বিয়ে করলে সমস্যা কোথায়?মান ইজ্জত যাবে বলছো?সে যায় যাক,তবে যাকে বউ করবো বলে ভাবছি তাকে তো আর অন্য কারও হতে দেওয়া যায়-না।মানা মুশকিল হয়ে যাবে।
সেজন্য বিয়ে তো আমাকে করতেই হবে।আর দাদাভাইয়ের জন্য তুমি টেনশন নিও-না।তারজন্য তো তুমি কনফার্ম সিলেক্টেড।সে এখান থেকে দশসেকেন্ড পরে হোক বা দশবছর পরে,বউতো তুমি দাদাভাইয়েরই হবেই।

কৌড়ির যেনো সয়ে গেছে ইভানের এসব কথাবার্তা।তবে আর ভালো লাগছে না ঘুরেফিরে সেই মানুষটাকে নিয়ে তাঁকে পেঁচিয়ে কথা বলাগুলো শুনতে।কেনো জানেনা,মন খারাপ হয়ে যায় তার।বিথীর কথাগুলো মনে পড়ে যায়।তবে মন এটাও বলে আর যাই হোক,মানুষটা চারিত্রিক দিক দিয়ে মোটেই খারাপ নয়।
কৌড়ির ভাবনার মধ্যে নিভান এসে চেয়ার টেনে বসে পড়লো।চেয়ার টানার মৃদু শব্দ কানে যেতেই খেয়ালী হলো কৌড়ি।ইভানের সম্মুখীন অপরপাশের চেয়ারটাতে,পুরো ফর্মাল ড্রেসআপে সেই মানুষটাকে দেখে অযাচিত কারনে বক্ষস্থল কেঁপে উঠলো তার।সঙ্গে সঙ্গে নজর ফিরিয়ে নিয়ে,নিজের রুমের দিকে যাবার উদ্যোগ নিতেই ভারী কন্ঠের আওয়াজে থেকে গেলো পা।

‘কৌড়ি,আমার খাবারটা ছোটোমাকে দিতে বলো-তো?

আপনি আমার নাম ধরে কখনো ডাকবেন নাা।আপনার মুখে আমার নামটা নেওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ!না-হলে অকালে আমার মৃত্যুর জন্য আপনি দ্বায়ী থাকবেন। কথাগুলো ওই মানুষটাকে উদ্দেশ্য করে খুবই বলতে ইচ্ছে করে কৌড়ির।তবে চাইলেই কি আর সব ইচ্ছেটা পূর্ণ হয়।যেমনটা সে মনেমনে ইচ্ছে পোষণ করেছিল,এই মানুষটার সামনে সহজেই পড়বেনা।অথচ পড়তেই তাকে হলো।উফফ..

পিছে ফিরলো না কৌড়ি।আবারও রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দিলো।অন্যদিন গলা চড়িয়ে রানিসাহেবাকে ডেকে বলে আর আজ তাকে ঘটক ধরলো কেনো?ধরবে নাই বা কেনো!এদের দু-ভাইয়ের জন্মশত্রু তারসাথে।তাকে না জ্বালালে হয়!তাহলে শান্তিতে থাকবেন কিকরে উনারা।একজব জ্বালাতে জ্বালাতে সবে ক্ষান্ত দিয়েছে।তো আরেকজন এসে হাজির।মনেমনে কতশত প্রলাপ বকতে বকতে রান্নাঘরে গিয়ে স্বান্তনা রহমানকে জানালো,তাদের নবাবপুত্র এসেছে।ভাত রুটি বাদ দিয়ে তাহার স্পেশাল খাবার চাইছে।সকালের ভারী খাবারটা নাকি তাহার মুখে রোচে না।হালকা খাবারেই তিনি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পার করে দেন।এই স্যান্ডউইচ জেলি আর একমগ কফি।এই সাধারণ অল্প খাবারেই নাকি তিনি অভ্যস্ত।কৌড়ির বুঝে আসেনা,এটুকুও খাওয়ার দরকারটা কি!না খেলেই তো পারে।যদিও উনার ইনকাম,তিনি খাবেন নাকি বাঁচাবেন সেটা তিনি বুঝবেন।তবে তাকে মাঝখানে ঘটক ধরে অস্বস্তিতে ফেলার প্রয়োজন কি?

‘ধর।

ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বে-ও খাবার ট্রেটা হাতে নিলো কৌড়ি।স্বান্তনা রহমান বললেন—ট্রে-তে পানির গ্লাস দেই-নি।পানিটা একটু কষ্ট করে ওকে ঢেলে দিস।ছেলেটা সহজে বাড়িতে খায়না।আর খেলেও সীমিত।সেখানে ত্রুটি রাখলে চলে?আর অন্যদের মতো সামনে পেলেই খেয়ে নেবে।এমনটা নয় ও।নিজে তো কিছু নিয়ে খাবে না, এমনকি পানিটুকু টেবিলে না পেলে সেটা না খেয়ে চলে যাবে।তাই ওর বেলায় একটু খেয়াল রাখতে হয়।

আশ্চর্য হলো কৌড়ি।-পানিটাও ঢেলে খেতে পারবে-না।যেখানে ইভান ভাইয়া,খাবার সামনে পেলেই চুপচাপ খেয়ে যায়।সেখানে ইনিতো দেখি নাফিমের চেয়ে আরও দুকাঠি উপরে।

‘যা।আবার দেরী হলে না খেয়ে চুপচাপ চলে যাবে!

মনের ভিতরে একগাদা অস্বস্তি নিয়ে আবার ডায়নিংয়ের দিকে পা বাড়ালো কৌড়ি।এই নবাব সাহেবের বউ যে হবে।তাকে তো সেবাযত্ন করতে করতে জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যেতে হবে।খাবারের ট্রেটা কোনোমতে নিভানের সামনে টেবিলের উপর রেখে চলে যেতে উদ্যোগক্ত হতেই ফের নিভান বললো।

দাঁড়াও।

পুনরায় পা থেমে গেলো কৌড়ির।সামনে বসা ইভানের দিকে তাকালো সে।মিটিমিটি হাসছে আর খাচ্ছে ছেলেটা।সেই মিটিমিটি হাসিটা তাকে যেনো অদৃশ্য ভঙ্গিতে ভৎসনা করে বলছে–কি ব্যাপার ফুলকৌড়ি!দাদাভাইয়ের কথা দেখি অক্ষরে অক্ষরেই পালন করে চলছো।ব্যাপার স্যাপার কি বল-তো,ফেঁসে গেলে নাকি?নাকি ভিতরে ভিতরে কিছু-মিছু চলছে?হুমম?

মনেমনে ভাবলে-ও দুই ভাইয়ের ভাবসাব এমন যেনো কেউ করাও কথাকাজে নেই।ইভান খেয়ে উঠে চুপচাপ চলে গেলো।যাবার আগে কৌড়ির দিকে ফিরে একগাল হেসে দিয়ে গেলো।ইভান চলে যেতেই নিভান বললো।

‘বসো।

কথাটা স্পষ্ট শুনতে পেলেও কৌড়ি গাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।সেটা বুঝতে পেরে খাবারের ট্রে থেকে নজর হাঁটিয়ে কৌড়ির পানে চাইলো নিভান।সঙ্গে সঙ্গেই সামনের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো কৌড়ি।মনেমনে হাসলো নিভান।এইতো বাধ্য মেয়ে।ফের অতি স্বাভাবিক গলায় বললো।

‘যার দৌলতে শ্বশুর শ্বাশুড়ি ননদ দেবরের সেবাযত্ন করে চলেছো,তাকে সেবাযত্ন করতে সমস্যা কোথায়? আমার জানামতে আগে তাকে সেবাযত্ন করে সময় বাঁচলে তারপর,ননদ দেবর বা অন্যঅন্য পারিপার্শ্বিকতা।কিন্তু তুমি দেখি ভিন্ন পথের যাত্রী। আগে পারিপার্শ্বিকতা তারপর যার দৌতলে ননদ দেবর শ্বাশুর শ্বাশুড়ি পেলে,শেষে গিয়ে সে।তবে তুমি মানলেও,এটা কিন্তু সে মানতে নারাজ।প্রিয় মানুষটা বলতে সে কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে হিংসুক ছেলেটা।

কৌড়ির মনেহলো,সে মরে যাক।অবশ্যই বুকের যন্ত্রটা যে বেগে লাফাতে শুরু করছে,মরণ তার হতে সময় লাগবেনা।অথচ সামনের মানুষটা নির্বিকার খাবারের দিকে মনোযোগী।তারদিকে চেয়ে নেই।অথচ পৃথিবীর সমস্ত অস্বস্তি লজ্জা যেনো ঠেলে তার সমস্ত অঙ্গে মাখিয়ে দিয়েছে।কেনো বলছে এমন মানুষটা!কেনো বুঝতে পারছেনা,সে লোভী হতে চাইছেনা!

স্যান্ডউইচ খাওয়া শেষে কফির মগটা হাতে নিলো নিভান।মাথা উঁচু করে কফির মগটা ঠোঁটে ছোঁয়াতেই, অস্বস্তিতে গাট হশে বসে থাকা কৌড়ির পানে নজর স্থির করলো।সঙ্গে সঙ্গেই চোখ নামিয়ে নিলো কৌড়ি।
এখান থেকে উঠার জন্য হাত পায়ের কচলানো বাড়লো যেনো।সেটা দেখে,সময় নিয়ে নিভান বললো।

‘তোমার পরামর্শ দাতা খুবই অনেস্ট।সাথে বিশ্বাসযোগ্যও।আর তারপ্রতি তোমার বন্ধত্বের ভরসা ও বিশ্বস্ততা মুগ্ধকর।বিধায় আমার দিকে তোমাকে একধাপ বাড়িয়ে দেওয়ার বদৌলে পিছিয়ে দেওয়াটাকে কিছু বলছিনা,আর বলবোও আমি।তবে তুমি আমাকে বিশ্বাস করেছো, এটা তোমার দিকে আর-ও একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে আমাকে।

বিস্মিত হলো কৌড়ি।একটু নয় অনেকখানি।অস্বস্তি লজ্জা ভুলে নিভানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে।
মানেটা কি?প্রথমে কথাগুলো না বুঝলেও,নিভান কথা এগোতেই বুঝতে পারলো।কালকে বিথী আর তার কথোপকথনের কথা বলছে মানুষটা।তবে তাদের কথা শুনলো কোথা থেকে?আর কিভাবে?আশ্চর্য! তার রুমে কখনো মানুষটা আসবে বা আসতে পারে এটা কখনোই বিশ্বাস করে না সে।আর আসিওনি যে।এটা নিজের চোখে দেখা।তবে কি করে?শত প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো কৌড়ির।তবে না সামনের ব্যক্তিটাকে প্রশ্ন করতে পারলো আর না তার সমাধান মিললো।কৌড়ির আশ্চর্য হওয়ার কারন বেশ বুঝলো নিভান।মৃদু হাসলো সে।কফি শেষ হতেই উঠে দাঁড়ালো।
তখনও কৌড়ি বিস্ময় নিয়ে হা হয়ে তাকিয়ে।সেই ডাগরডাগর কাজল কালো সচ্ছ চোখের পানি তাকিয়ে হঠাৎই তারদিকে ঝুকলো নিভান।সঙ্গে সঙ্গে চোখজোড়া বন্ধ করে পিছে সরে গেলো কৌড়ি।সেটা দেখে নিভানের মৃদু হাসি চওড়া হলো।চাপাস্বরে বললো।

‘তোমার ফ্রেন্ড ভুল কিছু বলেনি,শুধু ভুল মানুষের দিকে অবিশ্বাসের আঙুল তুলে দিয়েছে।তবে আমাকে বিশ্বাস করার জন্য,আমার পক্ষ থেকে তোমার পাওনা উপহারটা আপতত আমি সযত্নে আমার কাছেই গুচ্ছিত রাখলাম।তোলা রইলো।আমাদের কাছাকাছি আসাা যতো দেরী হবে, ততোই সুদের হারটা বাড়তে থাকবে।আর অপেক্ষার প্রহর যেদিন অস্তমিত হবে,সেদিন উপহারের আসলটাসহ শতগুনরূপে সুদটা ফেরত পাবে তুমি।খুব সযত্নে হালালরূপে ফিরিয়ে দেবো আমি।যতোই পিছু হাঁটো না কেনো,নিভানের দিকে এগোনো ছাড়া পিছাতে পারবেনা তুমি।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here