ফুলকৌড়ি (৪১) #লেখনীতে_শারমীন_ইসালম

0
299

#ফুলকৌড়ি
(৪১)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসালম

কৌড়িকে নিয়ে যাবার জন্য ভদ্রমহিলা বেশ চেপেই ধরলেন।পাঁচ সন্তানের জননী,বুদ্ধিমতী নারীটা বুঝালেন বিপদ যখন কেটে গিয়ে ছায়া হয়েছে অযথা নিজের বাড়ির মেয়ে পরের বাড়িতে আর কতোদিন?মেয়েটার সবকিছু থাকতেও পরের বাড়িতে আশ্রিতা হিসাবে পড়ে আছে,এটা নিয়ে পাড়াপড়শির যেমন বিভিন্ন কানকথা বলেছে আরও নানা ইঙ্গিতমূলক বাক্য, আচারন।উনার নিজেরও বিষয়টা মানতে কষ্ট হলেও কৌড়ির কথা ভেবে সবার সব কথা নীরবে সয়ে গেছেন।আজ যখন সবকিছু ঠিকঠাক।সেখানে মেয়েটা নিজের পরিবার, নিজের পিতৃভূমি,তার সকল হক থেকে দূরে থাকবে কেনো!সেখানে বিশেষ কোনো যুক্তি দেখিয়ে উনাকে রোধ করার ফাঁকফোকর পেলেননা জাহিদ সাহেব।তবে হ্যা না-ও কিছু বললেন না।শুধু বিচক্ষণ মানুষের মতো চুপচাপ শুনলেন।আর কিছু ভাবলেন।কাওকে তিনি কথা দিয়ে রেখেছেন।কথা দিয়ে রেখেছেন কী!ছেলেটা এই প্রথম মুখফুটে নিঃসঙ্কোচে উনারকাছে কিছু চেয়েছে।দৃঢ়রূপে পাওয়ার আশা করেছে।বিশ্বাস ভরসা করে কৌড়িকে পাওয়ার আবদার আবেদন জানিয়েছে।
জানিয়েছে–উনি থাকতে যেনো কৌড়ি,নিভান ব্যতিত দ্বিতীয় কারও নাহয়।সরাসরি কথাটা না বললেও, নিজের চতুর কথাদ্বারা বুঝিয়ে তেমনটা।সেই ছেলেটার উনার কাছে করা প্রথম আবদার, চাওয়া তিনি বিফলে ফেলে যেতে দেবেন কি করে!এমন পরিস্থিতিতে ভদ্রমহিলার কাছে প্রস্তাব রাখাও শোভনীয় দেখায়-না।আবার কৌড়ির পরিক্ষার আগে নিভান এবিষয়ে কথা তুলতেও নিষেধ করেছে।তার মা’কেও আপতত এবিষয়ে জানাতে বারণ করেছে।তবে কি করবেন?সেই ভাবনায় ডুবে রইলেন।ভদ্রমহিলা আরও কিছুক্ষণ কথা বলে,চা নাস্তা সেরে চলে গেলেন।এতোসময় নীহারিকা বেগম সবটা নীরবে শুনেছেন এবং নিজেকে স্বামীকে চুপ থাকতে দেখেও আশ্চর্য হয়েছেন।তবে তিনি-ও চুপ ছিলেন।কিছু বলতে গিয়ে-ও কেনো যেনো অধিকার বোধের ঘাটতিতে কিছুই বলতে পারলেন না।ভদ্রমহিলা চলে যেতেই নীরবতা ভেঙে ততক্ষণাত বললেন।

‘কৌড়িকে কিন্তু আমি যেতে দেবো না।বলে দিলাম।বাবা মা নেই যখন মেয়েটাকে আমার কাছে রাখবো।জানি মেয়েমানুষ,একদিন পরের হাতে তুলে দিতে হবে।আমার তো আর অনেকগুলো ছেলে নেই যে, নিজের কাছে রাখবো।যদিও নিভান যদি রাজী থাকতো,তবে দ্বিতীয়বার ভাবতাম না।ওকে আমার নিভানের বউ করে পুতুলের মতো আদর যত্নে রাখতাম।তা যখন হওয়ার নয়,তখন আমি নিজ ছেলে দেখে ওকে বিয়ে দিয়ে আমার কাছাকাছি রাখবো।মান্যতা মৌনতার মতো এবাড়ি আসা যাওয়া করবে ও।উনি বাড়িতে নিয়ে যেতে চান,নিয়ে যাবেন।কিন্তু কয়েকদিনের জন্য।ঘুরেফিরে আবার চলে আসবে।

একনাগাড়ে বলে চলা নারীটাকে বেশ খেয়ালী আর সুগভীর নজরে পর্যবেক্ষণ করলেন।ফের মনেমনে হাসলেন।ছেলের বউকে নাকি অন্য ছেলে দেখে বিয়ে দেবে নীহারিকা।নিভান জানলে মায়ের উপর কিরাগ হবেনা!আচ্ছা নীহারিকা কি ছেলের মনের খবর রাখেনা।সহসা তিনি প্রশ্ন করলেন।

‘তোমার কি ইদানীং নিভানের পরিবর্তন নজরে পড়ছে না?মনে হচ্ছে না,নিভানের মাঝে পরিবর্তন এসেছে?

‘মানে?

কৌড়ির কথাটা বলতে গিয়েও বললেননা।নিচ্চয় নিভান বুঝেশুনে তাকে কৌড়ির কথা অন্য কাওকে জানাতে নিষেধ করেছে।তবে ছেলের পরিবর্তন নজরে পড়ছেনা, আর ছেলের মনের খবর নীহারিকা আন্দাজ করতে পারছেনা।এটাতে বেশ আশাহত হলেন।সময়ও বা কৈই তার।উনাকে সেবা করতেই তার যায় দিন।ছেলেমেয়েদের দিকে বিশেষ খেয়াল ধ্যান দেবে,এই সময়টাও বা পাচ্ছে কোথায়!মনেমনে ব্যথা অনুভব করলেন।নিজের স্ত্রীর কথার উত্তর সরূপ বললেন।

‘মানে কিছু না।তবে এক ছেলে বিয়ে করে সংসার করছে এবার অন্য ছেলের দিকে খেয়াল ধ্যান দাও।তারওতো সংসার গুছিয়ে দেওয়ার দ্বায়ভার আমাদের।
আর ছেলে কি চাইছে সেটাও বুঝতে চেষ্টা করো।বড় হয়েছে সবকিছু মুখফুটে বলতে পারেনা,চাইতে পারেনা।খেয়াল রাখো।

স্বামীর কথাগুলো বিশেষ মনোযোগে শুনলেও এই মূহুর্তে এই কথাগুলোর অর্থ খুঁজে পেলেন না।হচ্ছিলো কৌড়ির কথা সেখানে নিভান এলো কোত্থেকে!আশ্চর্য। মনেমনে কথাগুলো বলতে গিয়েও তিনি যেনো কেমন নিভে গেলেন।নিভানের পরিবর্তন!জাহিদ সাহেবের বলা শব্দটা মনে ঘুরপাক খেতে লাগলো।নিভানের পরিবর্তন নজরে পড়েছেও উনার।তবে সেটাতে বিশেষ কোনো খেয়াল ধ্যান দেওয়ার মতো কিছু আছে বলেও তো মনে হলো না উনার।নিভানের প্রসঙ্গ নিয়ে বিশেষ ভাবতে বসলেন না তিনি।কৌড়ির দাদীআপার কথাগুলো মাথায় বিশেষ ঘুরপাক খেতেই তিনি সেদিকে খেয়ালী হয়ে ফের জাহিদ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন — সে যাই হোক।আপনি কৌড়িকে দাদিআপাকে ভালোভাবে বলে দিয়েন,কৌড়িকে কিন্তু আমি ছাড়ছিনা।

‘সে তোমার ছেলে তোমার চেয়ে আরও ভালোভাবে বুঝে নেবে’ বাক্যগুলো ভিতরে আওড়ালেও জিহ্বা ভেদ করে ঠোঁট পর্যন্ত নিয়ে আসলেন না।কারণ হিসাবে নিভানের সতর্কবার্তা মানলেন।শুধু মুখে বললেন।

‘আমি দেখছি,কি করা যায়।

স্বামীর কথায় শান্ত হলেন নীহারিকা বেগম।উঠতে গিয়ে ফের কিছু একটা ভেবে বললেন–ছেলের বিয়ের কথা ভাবছেন,মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত সে কথা ভাবছেন না!এতো ভালো ভালো প্রস্তাব আসছে।নাকচ কেনো করছেন?বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে ঘরে বেশিদিন রাখা ঠিক নয়।একসময় প্রস্তাব আসলেও বাছতে বাছতে দেখবেন মেয়ের আর উপযুক্ত পাত্র মিলছেনা।চৌধুরী সাহেবের ছেলে বিহান ছেলেটা খারাপ কিসে ছিলো?উনাদের প্রস্তাবটা কেনো নাকচ করলেন?

‘বিয়ের আগে তো দেখতে শুনতে জানাশোনা ছেলে হিসাবে সিয়ামও তো খারাপ ছিলোনা।তবে বিয়ের পরে দীবার কি হলো?সেখানে আর সংসারই করতে চাইছে না!নিজের মেয়ের বেলাও কি তাই চাইছো?শুধু বাহিরের চাকচিক্য দেখে মেয়ের উপযুক্ত বলে মনে করছো!বিয়ের মতো কাজে ভেবেচিন্তে বুঝেশুনে এগোতে হয়।আমার মেয়ের কপাল অন্তত দীবার মতো পর্যায়ে গিয়ে ঠেকুক আমি বাবা হয়ে তা অন্তত চাইনা।নিভান মানা করেছে মানে কিছু একটা ভেবে বুঝে মানা করে দিয়েছে।আর দ্বিতীয়ত আমার মেয়ের বাবা ভাইয়ের ঐশ্বর্য কম নেই।তাই বিত্তশালী পরিবারের ছেলে নয়,একটা উপযুক্ত ভালো সৎ ছেলের হাতেই তুলে দিতে চাই আমার মেয়েকে।দরকার পড়লে আমিই গুছিয়ে দেবো মেয়ের সংসার। তবুও আমার মেয়ের ভালো থাকা চাই।বাদবাকি ভাগ্য আছে তাইই হবে।

নীহারিকা বেগম আর কোনো কথা বাড়ালেন-না।কারণ জাহিদ সাহেবের কথা উনার অযৌক্তিক বলে মনে হয়নি।তবে জাহিদ সাহেব কথা শেষ করে কিছু একটা ভাবতে বসলেন।

রান্নাঘরে রাতের খাবারের গোছগাছ করছেন নীহারিকা বেগম।মনেমনে তখন জাহিদ সাহেবের বলা নিভানের বিষয়টা নিয়ে গভীর ভাবনায় ডুবে।মাথায় বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে।ছেলের পরিবর্তন!সেভাবে কৈ কিছু নজরে পড়েছে।তবে প্রথম যেদিন কৌড়িকে পরিক্ষা দিতে নিয়ে যাওয়ার কথা বললো,বিষয়টা উনার হজম হয়নি।ঠিকঠাক লাগেনি।কেমন যেনো নিভানকে অন্য রকম মনে হয়েছিলো।তবে ইভান যখন সবার সামনে বললো,তার শরীর খারাপ তাই দাদাভাই কৌড়িকে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।ভাবনার বিষয়টা সেখানেই ডুবিয়ে দিলেন। তবে আজ জাহিদ সাহেব কিসের পরিবর্তনের কথা বললেন? অপেক্ষিত নজর সদর দরজার দিকে আপনাআপনি পড়তেই, মূহুর্তেই যেনো ভুলিয়ে দিলো মাথায় ঘুরপাক খাওয়া ভাবনাগুলো। রাত হয়ে গেছে অথচ ছেলেমেয়ে দুটো এখনো ফেরেনি।এতো দেরিতো হয়না!তবে দেরী হচ্ছে কেনো?সন্ধ্যার পর একবার খোঁজ নিয়েছিলেন,তারপর আর খোঁজ নেওয়া হয়নি।এরমধ্যে কেউ কিছু না বললেও ননদ এসে কটুক্তি করে গেছেন– সামর্থ্য দুটো ছেলেমেয়ে, এভাবে কেউ ছাড়ে।কখন কি ঘটিয়ে ফেলে, কি ঘটে যায়!তার ঠিক আছে!কি যে বাবা মা হয়েছেন আপনারা আল্লাহ মাবুদ জানেন।

আরও কতো কথা।কানে নেননি নীহারিকা বেগম।তবে পাশে থাকা স্বান্তনা রহমান সেই কথার উত্তরে কিছু বলতে গেলেও উনাকেও চোখ দিয়ে ইশারা করে আটকিয়ে দিয়ে চুপ থাকতে বললেন।শুধু শুধু তর্ক বাড়বে।মনমালিন্য হবে।তা না করে যার যা স্বভাব সেই তাই করে নিজের মনের খোরাক মিটাক।যদিও ডালিয়ার কথাগুলো অযৌক্তিক নয়।আর না ভুল।তবে তার বলার দৃষ্টিভঙ্গি আর যাদের নিয়ে ধারনা করে কথাগুলো বলছে সেটা ভুল।ভুল হয়তো নয়।সামর্থ্য দুটো ছেলেমেয়ে, সত্যিই তো।কিন্তু উনার মায়ের মন এমন দুটো ছেলেমেয়েকে নিয়ে ডালিয়া কটুক্তি করে কথা বলছে,যা উনার মন কখনো সায় দেয়না।ওরা কিছু খারাপ করতে পারতে এই ধারনার সৃষ্টি হয়না মনে।
তাই তিনি বিষয়টা অযথা বাড়ুক এটা চাননা।ডালিয়ার উত্তর সরূপ বললে উনি অনেক কথাই বলতে পারবেন।জানাতো আছে উনার অনেক কিছু। তবে ঝামেলা বাড়ুক আপতত এটা তিনি চাইছেননা।তাই সুযোগ বুঝে আরও এটাওটা বলে,যখন নীহারিকা বেগমেকে টলাতে পারলেননা চলে গেলেন ডালিয়া বেগম।তিনি চলে যেতেই স্বান্তনা রহমান মুখলেন।

‘আমাকে কিছু বলতে দিলে না কেনো?নিজের মেয়ের বেলায় কি কি করছে, কি মেনেগুনে চলছে তা দেখিনি।যখন তখন বিবাহবহির্ভূত দুটো ছেলেমেয়েকে চলতে ফিরতে দিয়েছে।মানা করেছে কখনো?বরং নিজেই নিজের মেয়েকে এগিয়ে দিয়েছে। যত্তসব!এখন এসেছে বানী শোনাতে।ছেলেমেয়ে দুটো কি ঘুরতে গেছে!অদ্ভুত সব চিন্তা ভাবনা।

‘থাক।বাদ দে।শুনলে আবার অযথা ঝামেলা বাড়বে।আমরা তো জানি ওরা কেমন,তাই না?

‘তোমার এই চুপ থেকে সহ্য করাটাতেই উনি আশকারা পান।আর এতো কিছু বলতে সাহস করেন।নাহলে বড়ো ভাইয়ের বউ হিসাবে তোমাকে, উনার সীমিহ এবং মেপে কথা বলা উচিত ছিলো।

‘বাদ দে তো!তোর ভাই কি বলছিলো জানিস?

কথা ঘুরাতে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললো,এটা বুঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বান্তনা রহমান বেজার গলায় শুধালেন।-কী?

‘নিভানের পরিবর্তন নজরে পড়েছে কি-না?মানে কি বলতো?ছেলেটার আবার কিসে আর কেনোই বা পরিবর্তন হবে!বরাবর যেননটা দেখি তেমনটাই তো দেখছি। উনার আবার কি আলাদা নজরে পড়লো কে জানে!

দীর্ঘশ্বাস এবার শব্দ করে ছাড়লেন স্বান্তনা রহমান।এই রোবটের মতো সেবারত নারীটার বিরুদ্ধে কিছু মন বলতে না চাইলেও মুখ অধৈর্য্য হয়ে বলে ফেললো।

‘তোমার কি ছেলের দিকে নজর দেওয়ার সময় আছে নাকি যে,তার পরিবর্তন তোমার নজরে পড়বে!

আশ্চর্য হলেন নীহারিকা বেগম। কেমন অদ্ভুত গলায় প্রশ্ন শুধালেন–তারমানে তোরও মনেহয় নিভানের মাঝে পরিবর্তন এসেছে?কৈ আমার তো নজরে পড়েনি!

‘পড়বে কি করে?ছেলেটার দিকে ফিরে তাকানোর সময় আছে তোমার?

হঠাৎই মন খারাপ হয়ে গেলো।বিষন্ন গলায় বললেন–
‘সেজন্য তো ওর খেয়াল রাখার জন্য বিয়ে দিয়ে একটা বউ আনতে চাইলাম।রাজি হয় ছেলেটা?মায়ের ব্যস্ততা দেখে না!একটা অসুস্থ মানুষের সারাদিন খেয়াল ধ্যান রাখা।ও বোঝেনা?

‘বোঝে বলেইতো অভিযোগ করেনা।যাইহোক কৌড়িকে তোমার কেমন লাগে বলো-তো?

‘কেমন লাগে মানে?মান্যতা মৌনতার আর ওরমধ্যে কোনো তফাৎ আমি করিনা।আর ও কতো ভালো মেয়ে এটাতো তুইও জানিস।সেখানে ওর দাদিআপা আরও নিয়ে যেতে চাইছেন বলে আমি তোর ভাইকে সাফসাফ জানিয়ে দিয়ে আসলাম,ওকে কিন্তু যেতে দেবোনা।সেখানে ওকে আমার কেমন লাগে জানতে চাইছিস!ওর মতো মেয়ে সহজে মেলেনা।

হাসলেন স্বান্তনা রহমান। তিনি খুব ভালো করে জানেন এবং চিনেন বড়জাকে।আর কৌড়ির প্রতি উনার মায়া ভালোবাসাও খেয়াল করেছেন।তবুও কথাটা জানতে ইচ্ছে হলো বলে প্রশ্ন করলেন।উত্তর পেয়ে মজার ছলে বললেন–‘তাহলে ছেলের বউ বানিয়ে একেবারে রেখে দাও।

‘আমার আর-ও ছেলে থাকলে অবশ্যই কৌড়িকে তার বউ করে রেখে দিতাম।আর যদি ‘নিভান রাজি থাকতো তাহলে তো কথাই ছিলানা। অবশ্যই নিভানের বউ করে রেখে দিতাম।

‘আমার মনেহচ্ছে তোমার ছেলের,কৌড়িকে মনে ধরেছে।

তড়িৎ বড়োবড়ো চোখ করো বিস্ময় নজরে স্বান্তনা রহমানের দিকে তাকালেন নীহারিকা বেগম।সেটা দেখে একগাল হাসলেন।ফের ভ্রু নাচিয়ে বললেন–ওভাবে তাকিয়ে পড়লে কেনো?বউমা হিসাবে কি কৌড়িকে তোমার পছন্দ নয়?

‘নিভান!তুই সত্যি বলছিস?কি আশ্চর্য কথা!

নীহারিকা বেগমের বলার বিস্ময়কর ভঙ্গিমাতে একটু হাসলেন স্বান্তনা রহমান। ফের বললেন–আরেহ আমি সত্যি মিথ্যা এসব জানিনা।শুধু নিভানের চোখ, কৌড়ি যেখানে থাকে সেখান থেকে সরেনা।এটা খেয়াল করেছি।আরও কিছু বিষয় নজরে পড়েছে,।তাতে মনে হয়েছে, কৌড়ির প্রতি ওর ভালোলাগা জন্মেছে।সেই ধারনা থেকে বলছি।

বিস্ময় কাটিয়ে নীহারিকা বেগম উৎফুল্ল গলায় বললেন–তাহলে তো বলতেই হয় আমার ছেলের সুমতি হয়েছে।

নীহারিকা বেগমের উৎফুল্ল মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন স্বান্তনা রহমান।মানুষটাকে অনেক বৎসর যাবৎ চেনে, জানে মানে।তবুও মনের মধ্যে খুূদমুূূদ করা একটা প্রশ্ন শুধিয়েই ফেললো।–তোমার কৌড়িতে কোনো প্রবলেম নেই তো বুবু?

‘কি সমস্যা থাকবে?ও যেমন মেয়ে,কোনো সমস্যা থাকার কথা?

কথাটা বলেই স্বান্তনা রহমানের মুখের দিকে তাকিয়ে পড়লেন তিনি।সময় নিয়ে বুঝলেন।কেনো,সে এমন কথা শুধিয়েছে।হয়তো শ্বাশুড়িদের ভালো চরিত্রও পাল্টে যায় ছেলের বউদের ক্ষেত্রে।ছেলে যেমনই হোক বউ নির্বাচন করতে পৃথিবীর সেরা নিখুঁত অদ্ভুত রকমের মানুষ হয়ে উঠেন।যেমনটা নিজের শ্বাশুড়িমাকে দেখেছেন।তিনি নিজের ছেলেদের জন্য বউমা নির্বাচনে সবদিক থেকে পারফেক্ট চেয়েছিলেন। রূপেগুনে প্রাচুর্যে, সবদিক থেকে নিখুঁত।হয়নি।বিশেষ করে বড় ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রে।হয়তো এখন এই বিয়সে এসে সব ঠিক।কিন্তু একটা দীর্ঘসময় উনার অসন্তুষ্টতা নিয়েই সময় কেটেছে।কেটে গেছে বহুবছর।
হয়তো প্রতিটি মায়ের চাওয়া এমন।তবে উনার চাওয়া ভিন্ন।দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।ফের স্বান্তনা রহমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন।

–যদি নিভান কৌড়িকে পছন্দ করে থাকে।আর সেই প্রস্তাবে কৌড়ি যদি রাজি হয়।আমি কখনোই না করবো-না।আমি দেখবো না,কৌড়ির আগেপিছে কিছু ছিলো বা আছে কি-না।সে এতিম, নাকি আমার ছেলের অর্থপরিমান তার বাবা মায়ের অর্থবিত্ত ঐশ্বর্য আছে কিনা। আমার শুধু আমার নিভানের জন্য একটা সুন্দর মিষ্টি বউ চাই।যে আমার বাচ্চাটার সকল অপূর্ণতার, পূর্ণতা হবে।ওর সুখ দুঃখ,বুঝবে।ওর ভালোমন্দের খেয়াল রাখবে,সর্বোপরি ওকে বুঝবে।ওকে ভালোবাসবে,ওকে ভালো রাখবে।ও সুখে- শান্তিতে থাকবে এই কমনায় সবসময় একটা সুন্দর মনের মেয়ে, ওর বউ হিসাবে আনতে চেয়েছিলাম বা চাই।কৌড়ি,আমার নিভানের জন্য মোটেই মন্দ হবে-না।মেয়েটার বলা, চলা,সবকিছু নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করি সবসময়।তুই বল মেয়েটার মধ্যে ত্রুটি পেয়েছিস কখনো?আমি তো পাইনা।জানিনা ভাগ্যে কি লেখা আছে তবে আমার কৌড়িকে খুব ভালো লাগে।যেমনটা আমার তন্ময়ীকেও ভালো লাগে।জানিনা কখনো ওদের মায়ের মতো হতে পারবো কি-না।মা হতে পারবো কি-না।তবে ছেলে বউদের ক্ষেত্রবিশেষ শ্বাশুড়ি নামটা পেয়েছি যখন,তখন শুধু শ্বাশুড়ি নয় শ্বাশুড়ি-মা হতে চাই।জানিনা ওদের মা হতে পারবো কিনা।তবে হতে চাই।

স্বান্তনা রহমান অমায়িক হাসলেন।ফের উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন–‘তুমি ভালো মেয়ে,ভালো মা,ভালো স্ত্রী, ভালো বউমা, ভালো জা,ভালো মামি চাচি,ভালো বোন তো বটেই ,ভালো ভাবী এবং ভালো শ্বাশুড়িও হবে ইনশাআল্লাহ।আর নিভানের বউ যদি কৌড়ি হয়,সেও দেখবে রূপেগুনে একদম তোমার মতো হবে।পারফেক্ট শ্বাশুড়ির পারফেক্টে বউমা।

‘আমার পারফেক্ট বউমা হওয়া লাগবেনা।আমার নিভানের মনের মতো হলেই হবে।ওকে ভালো রাখলেই হবে।তবে দোয়া কর তোরা যা ভাবছিস তাই যেনো হয়।কৌড়ির দিকেই যেনো ওর মনটা ঝোঁকে। ওরকম একটা মেয়েকে সারাজীবন আমার কাছে রেখে দিতে চাই।

‘তাই হবে দেখে নিও।আমার নজর, মন বলছে নিভান কৌড়িকে পছন্দ করে।

এবার নীহারিকা বেগম নিজেও বেশ সন্তুষ্ট নিয়ে হাসলেন।সত্যি যদি কৌড়ি নিভানের বউ হয়,পুতুলের মতো আদর যত্নে রাখবেন উনি মেয়েটাকে।মনেমনে আরও হাজার সন্তুষ্টির ভাবনায় ডুবে ভাবতে থাকলেন অনেক কিছু।তবে ছেলের মন বুঝতে পারলেন না,এটা তে মনেমনে একটু নিজের প্রতিও ক্ষুন্ন হলেন।এতোদিন বিয়ে কর,বিয়ে কর বলে পাগল করলেন।বিয়ে করবো না,বিয়ে করবোনা,বলে যে ছেলে উল্টো গেয়ে আসলো।সেই ছেলের পরিবর্তন নজরে পড়লোনা!কিকরে?সেদিন মনটা একটু খুদমুদ করছিলো,তবে নিভানের কঠিন করে রাখা মুখাবয়ব আর নির্বিকার স্বভাবের কাছে বিষয়টা টেকেনি।যাই হোক,ছেলে এখন প্রস্তাব রাখলেই হয়।

চিন্তিত মুখে নিজের বেডে পা ঝুলিয়ে বসে আছে মান্যতা।চিন্তার বিষয়টা কৌড়িকে নিয়ে।হঠাৎ ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে সেদিকে তাকালো সে।কৌড়ি তারদিকে ফিরতেই সহসা প্রশ্ন করলো সে।

‘তোর না সেদিন শরীর খারাপ হলো?পনেরো দিন হয়েছে?পনেরো দিন যেতে না যেতে আবার পিরিয়ড!সমস্যা কি আর কবে থেকে?

এসব বিষয় নিয়ে কারও সাথে খোলামেলা কথা বলতে বা আলোচনা করতে কৌড়ির ভালো লাগেনা।কেমন যেনো অস্বস্তি অনুভব হয়।যার কারনে পিরিয়ডের এই অনিয়মিত কষ্টদায়ক পীড়া মাসের অধিকাংশ সময় সহ্য করে চলছে তবুও কাওকে মুখ ফুটে কিচ্ছু বলতে পারছেনা।মুলত বলতে চাইছেনা সে।বিষয়টা টের পেয়েছে মান্যতা।কারণ আগে নিজে বাহিরে বের হয়ে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনলেও,এই মাসের মধ্যে সেভাবে বাহিরে বের হওয়া হয়নি।যার কারনে এমাসের মধ্যে কয়েকবার প্যাড কিনতে বাধ্য হয়ে মান্যতাকে বলতে হয়েছে। আর বিষয়টা সেভাবেই নজরে পড়েছে তার।এর আগেও জিজ্ঞেস করেছিলো,এড়িয়ে গেছে সে।

‘কৌড়ি,আমি একটা মেয়ে।আর আমাকে অসুবিধা খুলে বলতে সমস্যা কোথায়?এরআগেও তোর কাছে জিজ্ঞেস করেছি উত্তর দিসনি।বিষয়টা আমার কাছে ভালো ঠিকছেনা।এবাড়িতে এসেছিস মাত্র চারমাসের মতো, অথচ তোর শরীর খারাপ হয়েছে কতোবার।একবছরের প্যাড ইউজড করে ফেলেছিস তুই।সমস্যা কি?আমাকে বল?প্লিজ!

লজ্জায় আড়ষ্ট হলেও, মান্যতার পাশে এসে বসলো কৌড়ি।কিছুটা আড়ষ্টতা নিয়ে বললো-যে সময়টা থেকে আমার পিরিয়ড শুরু হয়েছে। সেখান থেকেই অনিয়মিত।আগে বছরে প্রায় দুই তিনবার শরীর খারাপ হতো।প্রায় তিন চারমাস পরপর একবার।পনেরো বিশদিন করে সমস্যা থাকতো।বিষয়টা নিয়ে কখনো কারও সাথে খোলামেলা কথা হয়নি।তাই সেভাবে ভালোমন্দ জানা ছিলো-না।আর অতোটাও সমস্যা মনে হয়নি।দেরীতে হচ্ছে হোক,সমস্যা কোথায়?তাই কাওকে নিজের অসুবিধার কথাও জানানো হয়নি।তবে বিগত পাঁচ ছয়মাসের অধিক সময়,উল্টো সমস্যা দেখা দিয়েছে।এখন চার পাঁচমাস পরপর আর হয়না।এখন অনিয়মমাফিক হতে থাকে।কেনো জানিনা।প্লিজ আপু কাওকে বলোনা।কেউ এবিষয়ে জানলে আমার লজ্জা লাগবে।

মান্যতা অবাক হলো।মাসে একবার তাই কয়েকটাদিন কি ব্যথা,যন্ত্রণা অস্বস্তিতে ভুগতে হয়।সেখানে এই মেয়ে বলে কি!তবে।কৌড়ি যে ধরনের মেয়ে,বিষয়টা চেপে রাখা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

‘এটাতে লজ্জা পাওয়ার কি আছে কৌড়ি?নিয়মের বাহিরে গেলে যেকোনো বিষয়ই অসুখ বলে ধরা উচিত।আমার মনে হচ্ছে তোর বিষয়টা নিয়ে চুপচাপ থাকা উচিত নয়।তোর বলতে অস্বস্তি হলে আমি আম্মুকে জানাই।তবে ডাক্তার দেখানো অবশ্যই প্রয়োজন।

‘বিষয়টা সবাই জেনে গেলে সত্যিই আমি ভিষন লজ্জা পাবো।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো মান্যতা।হতাশ গলায় বলল-দাদাভাই জানলে কি হবে বুঝতে পারছিস?এমনিতেই ডক্টর মৌমিতাকে দেখানোর কথা ছিলো।দেখাসনি।কিছু বলে নি।একবার যদি কোনোভাবে জেনে যায়,বিষয়টা কিন্তু ভালো হবেনা।

মুখ ছোটো হয়ে গেলো কৌড়ির।এজন্য তো সেদিন ডক্টরের কাছে যেতে আপত্তি জানিয়েছিলো সে।যায়নি।এবার সত্যিই যদি জেনে যায়।মানুষটার এমনিতেই চারদিকে নজর খোলা থাকে।আর তারউপরে তো এক্সট্রা।মনেমনে শঙ্কিত হলো।মান্যতাকে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘উনি জানবেন কিকরে?এজন্য তো বলছি কাওকে কিছু বলার দরকার নেই।

‘দরকার আছে কিনা,সেটা তোর কাল পরীক্ষা হয়ে যাক তারপর দেখছি।

‘কাল পরিক্ষা দিয়ে তো আর এবাড়িতে আসা হবেনা।

মন খারাপ করে কথাটা বলতেই তড়িৎ মান্যতা বললো–তুই দাদাভাইকে এখনো ঠিকঠাক চিনে উঠতে পারিসনি।তোর মনেহয় এবাড়িতে আর আসা হবেনা?দাদাভাই তোর ওবাড়িতে চলে যাওয়া বা থাকা সহজে মেনে নেবে?মানবেনা কখনো।যাই হোক,দাদাভাই জানে দাদিআপা কাল তোকে একেবার নিয়ে যেতে চাইছেন?

কৌড়ি মাথা নাড়ালো।ফের মুখে বললো–‘না।

‘এবার এই বাড়িটা না ভাঙচুর করে ফেলে।

মজার ছলে হেসে কথা বলতেই কৌড়ির ভিতরে ভিতরে আতঙ্কগ্রস্থ হলো।সত্যিই তো!তবে বলবে কিকরে সে!আজ তিনদিন মানুষটা বাড়িতে নেই।ফোনে অতি প্রয়োজন ছাড়া যোগাযোগ হয়না তাদের।দুদিন আগে পরিক্ষার খবর নেওয়ার পর আর কথা হয়নি।তবে কি কৌড়ি ফোন দিয়ে জানাবে?জানানো উচিত?না জানালে যদি আগের রাগের ভাঙচুরের ঘটনাগুলোর মতো পুনরাবৃত্তি কোনো অঘটন ঘটায়!

‘যাই হোক,পড়।আমি আসছি একটু।

কথাটা বলে চলে গেলো মান্যতা। কৌড়ি দ্বিধায় পড়ে গেলো কি করবে।বলবে?নাকি বলবে না?কখনো মানুষটাকে নিজ থেকে ফোন দেওয়া হয়নি,সেই দ্বিধায় আরও সংকোচিত হলো মন।উফ কি এক জ্বালা।উঠে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসলো সে।সময় অতিবাহিত হলো তবুও পড়ায় মন বসলো না।মনে ঘুরপাক খেতে লাগল বিষয়টা।ফোন নিয়ে ডায়ালে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত নামের নাম্বারটা নিয়েও বেশ কিছুসময় ঘাটাঘাটি করলো।তবে দুপা এগোলেও তিন পা পিছিয়ে যেতে যেতে,রাতের খাবারের সময়টা পর্যন্ত গড়িয়ে গেলো তবুও ফোন দেওয়া হলোনা।রাতে খাবার খেয়ে এসে ফের পড়ার টেবিলে বসতেই মান্যতাকে তারদিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে দেখে মনে প্রশ্ন জাগলো। তবে কোনো এক দ্বিধায় প্রশ্ন করতে পারলো-না।আশা করেছিলো, মান্যতা নিজ থেকে কিছু বলবে।কিন্তু মান্যতাকে কিছু না বলে শুয়ে পড়তে দেখে,নিজেও পড়ায় মনোযোগ দিলো।

ফজরের আযানের পর বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো কৌড়ি।সারারাতে ঘন্টা দুই ঘুমিয়েছে।সেই ঘুম ভেঙেছে ফজরের আযানের পর।নামাজ না থাকায় ফ্রেশ হয়ে বেলকনিতে এসেছে।বাহিরের প্রকৃতি এখনো অন্ধকারে আচ্ছন্ন।হাতের ফোনটার দিকে তাকালো।সারারাতে যতবার ঘুম ভেঙেছে মনে হয়েছে মানুষটাকে তার যাবার কথা জানানো উচিত কি?তবে এই উচিত অনুচিতের দ্বিধায় এখন মনেহচ্ছে,এখন যদি ফোন না দেওয়া হয় আর জানানোর সুযোগ হবেনা।আর তার যাওয়ার পর বিষয়টা জানলে,আবারও না কোনো উল্টোপাল্টা কান্ড ঘটিয়ে বসে।এবার আর অন্তত সেরকম কিছু চাইছেনা কৌড়ি।নিজের আড়ষ্টতা নিয়ে ফোনের দিকে বেশ কিছুসময় তাকিয়ে ফোন লাগালো কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে।সময় নিয়ে ফোন রিসিভ হলো।ফোন রিসিভ হতেই বুকের যন্ত্রণার মৃদুমৃদু কম্পন অস্বাভাবিক হলো।তবে কাঁপা কন্ঠে সালাম জানতে ভুললোনা।ওপাশের মানুষটা সময় নিয়ে সালামের উত্তর দিলো।ঘুম জড়ানো ভারী কন্ঠস্বর তার।শিরশির করে উঠলো কৌড়ির সর্বাঙ্গ।শিহরণে বুঁজে এলো চোখ।ওপাশ থেকে তখন ঘুম জড়ানো মিষ্টি কন্ঠের ডাক এলো।

‘কৌড়ি।

কৌড়ির মুদিত চোখজোড়া যেনো আবেশে আরও ডুবে এলো।এই মানুষটার ডাক কেনো এরকম কলিজা কাঁপিয়ে দেয়?উফফ!তখন কিযে অনুভব হয়!নিজেকে যেনো নিজের মধ্যে মনে হয়না।সহসা নিজেকে ধাতস্থ করলো।চোখ বুঁজেই কথার সূচনা করলো।

‘এই ভোরবেলা আপনাকে বিরক্ত করলাম।

অবান্তর কথা।কৌড়ি জানে।তবুও করলো।সেরকমই উত্তর দিলো অপরপাশের মানুষটা।

‘ফোনটা তুমি দিয়েছো কৌড়ি।সেখানে সময়টা,রাত না দিন,ভোর না সকাল,সময় না অসময়, তোমার অপেক্ষা গুরুত্ব হতে পারেনা।তোমার কখনো মনে হওয়া উচিত না,আমি বিরক্ত হয়েছি।

প্রসঙ্গ এড়াতে চাইলো কৌড়ি।—আজ শেষ পরিক্ষা।

‘জানিতো আমি।

‘দাদিআপা আজ একেবারে নিয়ে যেতে চাইছেন আমাকে।

দুপাশে নীরবতা চললো কিছুসময়।ফের শান্ত কন্ঠের বার্তা এলো।–যাও।

সহজে মেনে নিলো?হঠাৎই কৌড়ির মনেহলো তার যাবার বিষয়ে সে না বললেও মানুষটা জানে।এখন কি উপায়ে জেনেছে কৌড়ির জানা নেই।সে বিষয়ে প্রশ্নও করলোনা।নিশ্চয় মানুষটা ভেবেচিন্তে তাকে যেতে বলছে।না হলে তার একেবারে চলে যাওয়ার বিষয়টা শুনে ক্ষিপ্র হয়ে কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াতো তার জানা আছে।মানুষটা সম্পর্কে ইদানীং ধারণা হয়েছে সুগভীর।নিভানের কথা মেনে শান্ত এবং সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো সে।

‘হুম।রাখছি তবে।

তড়িৎ আবারও সেই ঘুমঘুম ভারী গলার ডাক পড়লো।
—কৌড়ি।

সহসা ডাক শুনলো কৌড়ি।—হুমম।

‘মান্যতা যাচ্ছে তোমার সাথে।তাই ভুলেও মন খারাপ করবেনা।পরিক্ষা মনোযোগ সহকারে এবং সুন্দরভাবে দেবে। কেমন?

এবার নিশ্চিত হলো কৌড়ি।তার যাবার বিষয়টা সম্পর্কে মানুষটা নিশ্চিত জানে।নাহলে বিষয়টা এতো তাড়াতাড়ি মেনে নেওয়া কথা না। আর না এতো শান্ত থাকার কথা মানুষটাকে!হঠাৎই কালরাতে মান্যতার মুচকি মুচকি হাসির বিষয়টা মনে পড়লো।তাহলে কি আপুও জানে?হয়তো।মান্যতা যাবে!মন উৎফুল্ল হলো কৌড়ির।ফের সংক্ষিপ্ত পরিসরে উত্তর দিলো।—হুমম।

একটু সময় নিয়ে কৌড়ি ফের বললো-রাখছি তবে।উঠে নামাজ পড়ে নিন।

সময় নিয়ে ওপাশ থেকে উত্তর এলো।–হুমম।

কথার পরিসমাপ্তি ঘটার পরও কেউ ফোন কাটলো না।বালিশে মুখ গুঁজে কানে ফোন রাখা নিভানের।ওপাশ থেকে মৃদুশব্দে কৌড়ির ধীমেধীমে পড়া নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সময় নিয়ে বেশ কিছুসময় সেই ছন্দময় শব্দ শুনলো নিভান।কোমল কন্ঠে ফের ডেকে উঠলো।

‘কৌড়ি

কৌড়ির কেনো যেনো মনে হচ্ছিলো ওপাশের মানুষটার বলা এখনো শেষ হয়নি।আর তারও এখনো নিজের মনের মধ্যে জমা খচখচানো কাঙ্ক্ষিত কথাগুলো শোনা বাকি আছে।যা সে শুনতে চায়।নিভান ডাকতেই সহসা উত্তর দিলো।—বলুন।

কৌড়ির বলার ভঙ্গিমা,ওপাশের মানুষটাকে শান্তি দিল।হাসলো সে।যা বালিশের তলানিতে মিলিয়ে গেলো।
মনের মধ্যে কতো কথা,শত অনুভূতি চেপে রাখা মেয়েটাকে আর অপেক্ষা করালো-না নিভান।যেনো ওই মেয়েটার মনের কথাগুলো বুঝে আবার তাকেই অভিব্যক্ত করাটা তার দ্বায়।হ্যাঁ দ্বায়ই তো।মেয়েটাকে ভালো রাখতে চায় যে সে।তাইতো দুজনের মনের অভিব্যক্তর দ্বায় সে নিয়েছে।ভাবনার একপর্যায়ে ঘুম জড়ানো অনুভূতিপূর্ন নির্মল কন্ঠে বললো।

‘আমি কাল সন্ধ্যায় ফিরছি।পৌরশুদিন তোমার কাছে আসছি।শুধু আমি নই, আমরা আসছি।তোমাকে একেবারে আমার কাছে নিয়ে আসার জন্য আসছি।সে পর্যন্ত সাবধানে থাকবে কৌড়ি!আল্লাহ হাফেজ।

থামকালো কৌড়ি।থামকলো নিজের হ্দস্পন্দন।থামকালো যেনো সকল ইন্দ্রিয়ের কর্মাকর্ম।কি বলছে এসব মানুষটা!তন্মধ্যে তারমধ্যে নিভানকে বিদায় বার্তা জানাতে ভুললোনা।ফের ফোনটা সামনে নিয়ে নিষ্পলক সেদিকে তাকিয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো।

সেদিনের পরের দিন ফেরার কথা থাকলেও ফিরতে পারলোনা নিভান।তবে তার পরের দিন অফিস ট্যুর শেষ হতেই আর কোথাও এক সেকেন্ড সময় ব্যয় করলো না।বাড়িতে ফিরতেই কেমন যেনো নিস্তব্ধ পরিবেশে পা পড়লো মনেহলো।হওয়ারই কথা।কৌড়ির সাথে মান্যতা একা নয় মৌনতাও গিয়েছে।বাচ্চাপাটি বাড়িতে না থাকলে পরিবেশ তো নিস্তব্ধই থাকবে।তবে এই নিস্তব্ধতা কেমন যেনো অস্বাভাবিক ঠিকলো।তার গাড়ীর শব্দ হলো অথচ আজ মা দরজা খুললেন না।রানী সাহেবা খুললো।তাও তড়িঘড়ি করে খুলে দিয়ে চলে গেলেন।কেনো?বরাবরই অফিসের কাজে দূরে কোথাও ট্যুরে গেলে,বাড়িতে ফিরতেই গাড়ীর শব্দ পেতেই মা এসে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন।আজ ভিন্ন!মা বাড়িতে নেই?থাকার তো কথা।হাফিজ ভাইকে গাড়ী বের করতে দেখলো।মা বাড়িতে না থাকলে হাফিজ ভাইয়েরও থাকার কথা নয়।ভাবনার একপর্যায়ে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়ালো নিভান।তখনই হন্তদন্ত হয়ে বোরকার পর্দায় আবৃত নীহারিকা বেগমকে দেখেই কপাল কুঁচকে গেলো নিভানের।বাহিরের পোশাক!এই অসময়ে মা কোথায় যাচ্ছেন?কিছুক্ষণ বাদে তন্ময়ী আর ইভানকেও রেডি হয়ে বের হতে দেখে প্রশ্নটা মনে চড়াও হলো।নিভানকে দেখে নীহারিকা বেগম কিছু বলতে যাবেন।তার আগেই নিভান প্রশ্ন করলো।—এই অসময়ে কোথায় যাচ্ছো মা?নানুমা ঠিক আছেন তো?সকালেই তো কথা হলো তিনি ঠিক আছেন।তবে এতো তাড়াহুড়ো করে…

নিভানের কথা কেড়ে নিয়ে নীহারিকা বেগম ব্যস্ত এবং বিচলিত গলায় বললেন—তোর নানুমা ঠিক আছেন।তবে কৌড়ি নাকি কাল থেকে ভিষণ অসুস্থ।কাল কেউ জানায়নি আমাদের।সকালে মান্যতা ফোন দিয়ে বললো,মেয়েটা নাকি হসপিটালে ভর্তি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here