#ফুলকৌড়ি
(৪)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম
নিভানের সাথে কথা বলার একপর্যায়ে জাহিদ সাহেব লক্ষ্য করলেন,নিভানের চোখজোড়ার রক্তিম আভা।ছেলেটা কি কোনো কারনে অসুস্থ!প্রশ্নটা মনেমনে আওড়াতেই সংগোপিত দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।এই ছেলে নিজের ভালোমন্দটা সহজে কখনো কারও সামনে বুঝতে দিতে চায়না আর বহিঃপ্রকাশ করা তো দূর।করে-ও না।এই যেমন এখন,ভিতর অসুস্থতাবোধ করছে অথচ বাহিরটা কতোটা স্বাভাবিক রেখে উনার সাথে কথা বলে চলেছে ছেলেটা।মনেহচ্ছে সুস্থ সবল একজন মানুষ।অথচ নিভানের প্রতি সন্তান হিসাবে স্নেহ ভালোবাসা ছাড়াও উনার আলাদা একটা টান,মায়া রয়েছে।মনের ভিতরে দৃঢ়ভাবে কাজ করে সেই মায়া,সেই তীক্ষ্ণ টান।সেই মায়ার টান থেকে তিনি নিভানকে কিকরে জেনো বুঝে নিতে পারেন।নীহারিকাকে নিজের জীবনে জড়ানোর সাথে সাথে নীহারিকার এই অতি মূল্যবান রত্নটাকে-ও তো তিনি নিজের ভেবে নিয়েছিলেন।সেই মায়া,টান থেকেই তো নিয়েছিলেন।যদিও উনার মা সেটা চাননি।
নিজের অবিবাহিত সুদর্শন ছেলের জন্য হাজার বুঝিয়ে কোনোমতে নীহারিকাকে ছেলের বউ মানতে চাইলেও,নিভানকে ছেলের বাচ্চা হিসাবে মানতে চাননি।তবে নিজের ছেলের জেদের কাছে হয়তো হার মেনে গিয়েছিলেন।
‘তোমার কি কোনো কারনে শরীর খারাপ?
মাথাতো যন্ত্রণায় ফেটে যাওয়ার উপক্রম।তখন রানীসাহেবা কফিতো দিয়ে গিয়েছিলো কিন্তু তা আর
খাওয়া হয়ে উঠেনি,মান্যতার গলা ফাটিয়ে চিল্লানোর কারনে।রুম থেকে বের হয়ে চিল্লানোর কারনটা জানার আগেই নাফিমের সাথে দেখা হলো।ওর সাথে কথা বলে রুমে গিয়ে দেখলো কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে।রানীসাহেবা কে দিয়ে আবার কফি বানানোর আগেই জাহিদ সাহেব ডেকে পাঠালেন তাকে।তাই আসতেই হলো।অসহ্য মাথা যন্ত্রণা করছে।তবুও স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো নিভান।
‘তেমন কিছু না, আপনি কি বলছিলেন বলুন।
নিভানের এই অতি স্বাভাবিক থাকা জিনিসটা মাঝেমাঝে জাহিদ সাহেবের মেনে নিতে খারাপ লাগে।তবে ছেলেটার স্বভাবই যে এটা।দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।ফের বললেন—তুমি কোনো যন্ত্র নও নিভান।তুমি সুস্থ স্বাভাবিক একজন মানুষ।আর সেই মানুষের ভালো লাগা,খারাপ লাগা থাকবে।ভালোমন্দ সুস্থ অসুস্থতা সকল প্রকার অনুভূতি থাকা স্বাভাবিক।সেখানে নিজেকে এতো চেপে রাখা উচিত নয়। রাখলে চলে-না।নিজের ভালোমন্দ অনুভূতিগুলাো সবার কাছের প্রকাশ না করা গেলেও অর্থাৎ প্রকাশ করতে তুমি না চাইলেও, নিজের জীবন থেকে বন্ধুসুলভ কাওকে না কাওকে বেছে নিয়ে সেই ভালোমন্দ অনুভূতিগুলো প্রকাশ করা উচিত।সেটা বাবা,মা ভাই, বোন অথবা তোমার জীবনের একান্ত কোনো ব্যক্তি যেকেউ হতে পারে।তবুও বলতে হয়।নিজের জীবন নিয়ে এতোটা বেখেয়ালি বা অনুভূতিশূন্য হলে চলে না।
থামলেন জাহিদ হাসান সাহেব।আজ নুতন নয়,নিভানের নিজের প্রতি এই আচারনের জন্য এরকম উপদেশ আদেশ প্রায়শই তিনি দিয়ে থাকেন।তবে ছেলেটা বরাবর চুপচাপ শোনে।অতঃপর যা তাই।নিভানের শিথিল হয়ে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ফের বললেন।–আমার মনেহচ্ছে তুমি মাথাব্যথার অসুস্থতা অনুভব করছো।যাও গিয়ে রেষ্ট নাও।এবিষয়ে আমি পরে তোমার সাথে কথা বলে নেবো।
হুমম”শব্দটা উচ্চরন করে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে, টুল ছেড়ে উঠে দাড়ালো নিভান।ফের লম্বা কদম ফেলে কয়েক পা সামনে আগাতেই পিছন থেকে ফের জাহিদ সাহেব ডেকে উঠলেন তাকে।
‘নিভান।
হয়তো পিছে ডাকা মানুষটা তাকে পুনরায় ডেকে কি বলতে চাইছে এটা নিভানের জানা।চোখজোড়া বন্ধ করে শ্বাস ফেলে ততক্ষণাত আবার চোখজোড়া খুলে ফেললো সে।নিভান পিছে ফিরতেই জাহিদ সাহেব কিছুটা স্নেহশীল গলায় বললেন।
‘আমি তোমার বাবা।সেটা তুমি মানো কি না তা আমার বিশেষ জানা নেই,তবে আমি মানি।বাবা ছেলের সম্পর্কের জোরে বলছিনা,নিজেকে তোমার একজন বন্ধুসূলভ আপনজন ভেবে তোমার ভালোমন্দের অনুভূতিটা আমাকেও জানাতে পারো।নির্দ্বিধায় বলতে পারো তোমার ভালোমন্দটা আমাকে।
উত্তর সরূপ নিভান ফের মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো।সেদিকে নির্বাক নজরে তাকিয়ে রইলেন জাহিদ সাহেব।আপন রক্ত বলতে নিজের দুই সন্তান আছে উনার,মান্যতা আর ইভান।তবুও এই ছেলের মুখে বাবা ডাকটা শোনার জন্য কেনো এতো আকুল উনার হৃদয় গহ্বর।কেনো ব্যাকুলতাভাবে শুনতে চায় সেই ডাকটা মন।এটাই বুঝতে পারেন না তিনি।নীহারিকার সাথে সেই ছয় বছর বয়সে নিভান এবাড়িতে পা রেখেছিল, এসেছিলো।সেখান থেকে কতোগুলো বছর চলে গিয়েছে,অথচ কখনো নিভান তাকে ভুলেও বাবা ডাকেনি।শান্ত,গম্ভীরভাব অতটুকু ছেলে কি বুঝতো,না বুঝতো উনার জানা নেই।তবে কখনো ভুলেও বাবা বলে ডাকেনি।উনার প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান হয়তো যথাযথ দেখিয়ে গিয়েছে,কখনো তা ক্ষুন্ন করেনি।উনার আদেশ উপদেশ মেনেছে।কিন্তু সেই বাবা ডাকটা ডেকে নয়।কেনো ডাকেনা নিভান উনাকে বাবা?ভুলেও তো দু-একবার ডেকে ফেলা যায়।দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে বেডের হেডে মাথা এলিয়ে দিলেন জাহিদ সাহেব।
তবে কি বাবা নামক আচার ব্যবহার কোনো ক্রুটি থেকে গেছে উনার?
‘এতো তাড়াতাড়ি কথা শেষ হয়ে গেলো আপনাদের?
মূহুর্তেই বিষন্নতা কাটিয়ে নীহারিকা বেগমের লাবণ্যময় মুখের দিকে তাকালেন জাহিদ সাহেব।মূহুর্তেই বিষন্নতা কেটে গেলো উনার।বয়স বেড়েছে,তিন ছেলেমেয়ের মা হয়ে গিয়েছে।একটা গোটা সংসারের খেয়ালধ্যান, নিয়ন্ত্রণ কর চলেছে।অসুস্থ একজন রুগ্ন ব্যক্তিকে টেনে চলেছে বছরের পর পর।অথচ রূপ লাবন্যে কোথাও সেই বয়স, পরিশ্রমের ঘাটতি নেই।এই লাবন্যময়ী নারীর সেই আঠারো পার হয়ে গিয়েছে আড়াই যুগ আগেই। অথচ সেই রূপ সেই লাবন্য।বেশী হয়েছে ছাড়া, ঘাটতি পড়েনি।এই মুখটা দেখলে,সব কষ্ট, বিষন্নতা কেটে গিয়ে শান্তি ভর করে মনে।
‘ওকে এককাপ আদা চা বানিয়ে দাও নীহারিকা।
‘কাকে?
‘নিভানকে।ছেলেটার মাথা ধরেছে মনেহয়।
শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নীহারিকা বেগম।এই ছেলেকে নিয়ে আর পারলেন না তিনি।কাওকে না বলা যায়,মাকে তো নিজের ভালোমন্দটা একটু জানানো যায়।তবুও জানাবে না।এই মানুষটাকেও,নিভান নিজের অসুস্থতার কথা জানিয়েছে বলে-তো মনেই হয়-না নীহারিকা বেগমের।নিশ্চয় উনার মতো নিভানের চোখমুখের হাবভাব দেখে বুঝেছেন মানুষটা।নীহারিকা বেগম বাহিরের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে ফের জাহিদ সাহেবের দিকে ফিরলেন।জাহিদ সাহেবের কোলের মধ্য এলোমেলো কাগজের মেলা দেখে বললেন।
”কিসের কাগজপত্র ওগুলো?
এলোমেলো কাগজগুলো ফের ফাইলে গুছিয়ে রাখতে রাখতে জাহিদ সাহেব বললেন–আহসানের হাইস্কুলের বেতন বিষয়ক চেক,আরও অনন্য বিভিন্ন কাগজপত্র আর ওর নিজের সেভিংসের কিছু চেকবই, কাগজপত্র। ওর নামের জমির দলিলপত্রও আছে দেখছি।নিভানকে দিয়ে পাঠিয়েছেন চাচিমা।
কপাল কুঁচকে এলো নীহারিকা বেগমের।–কিন্তু এগুলো কেনো দিয়েছেন?
‘জানিনা।হয়তোবা নিজের অনন্য ছেলের লোভের হাত থেকে নিজের আদরের নাতনির হকটা বাঁচাতে।যাতে কৌড়ির হক নষ্ট না-হয়।তবে আমার মনেহয় চাচিমার এগুলো পাঠানো ঠিক হয়নি।প্রয়োজন ছিলো-না।
‘আপনার মনেহচ্ছে প্রয়োজন ছিলোনা তবে এবাড়িতে মেয়েটার বাঁচার জন্য আমার মনেহয় কাগজপত্রগুলো প্রয়োজন।চাচিমা বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছেন।
নীহারিকা বেগমের কিছুটা ক্ষোভান্বিত গলায় বলা কথাগুলো অর্থ হয়তো কিছুটা বুঝলেন জাহিদ সাহেব।তাই ওবিষয়ে আর কথা বাড়ালেন-না।নীরব ভুমিকা পালন করলেন।সেটা বুঝে নীহারিকা বেগমও চুপ হয়ে গেলেন।এবাড়িতে যে তুচ্ছতাচ্ছিল্য স্বীকার নিভান অথবা তিনি হয়েছেন।তাতে তো এই মানুষটার কোনো দোষ নেই।তবে কেনো কথার ছল বুঝিয়ে তাকে দোষটা বুঝিয়ে দিচ্ছেন।কথা ঘুরানোর জন্য তিনি জাহিদ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন।
‘মেয়েটাকে এখানে পাঠানোর বিশেষ কারনটা কি বললেন না-তো?তখন চাচিমা কিসব বললেন আমি ওই ছেলেটার বিষয় ছাড়া ঠিক বুঝতে পারিনি?ব্যাপারটা ঠিক কি?
‘তুমি নিভানকে চা বানিয়ে দিয়ে এসো তারপর বলছি।
চমকে উঠার মতো করে নড়ে উঠলেন নীহারিকা বেগম।কথায় কথায় ছেলেটার কথা ভুলে বসেছেন তিনি।আর কথা না বাড়িয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে।সেদিকে তাকিয়ে নির্বিশেষে রইলেন জাহিদ সাহেব।
.
রান্নাঘরে আসতেই রানীকে কফি বানাতে দেখলেন নীহারিকা বেগম।জিজ্ঞেস করতেই বুঝতে পারলেন কফিটা নিভান চেয়েছে।কফিটা বানানো শেষে তিনিই, নিভানের ঘরে সেটা নিয়ে গেলেন।ঠান্ডা পরিবেশের রুমটায় চারদিকের জানালা দরজায় ভারী ভারী পর্দা ছড়িয়ে থাকার কারনে,এই শেষ দুপুরের দিকেও ভর সন্ধ্যাবেলার মতো লাগছে।ভিতরে ঢুকতেই নীহারিকা বেগম মৃদুস্বরে নিভানকে ডাকলেন।
‘নিভান।
‘মা, আমি এখানে।
গলার স্বর পেয়ে নিভানের বেডের দিকে এগিয়ে গেলেন নীহারিকা বেগম।নিভানকে মাথা চেপে ধরে বসে থাকতে দেখে কফিটা দ্রুত বেড টেবিলের উপর রেখে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন।
‘ও বাবু, মাথা বেশি ব্যথা করছে?আমাকে বলিস নি কেনো?এতো ব্যথা করছে তবে ঔষধ খাসনি?
‘এই একটু ধরেছে মাথাটা, ব্যস্ত হওয়ার দরকার নেই।ঠিক হয়ে যাবে।
‘একটু কি কেমন সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছি।হয়তো তোদেরকে সময়টা ঠিকঠাক আমার দেওয়া হয়ে উঠেনা, দিতে পারি-না আমি কিন্তু তোদের ভালোমন্দটা বোঝার ক্ষমতা তো এই মায়ের আছে।ঠিক বুঝতে পারি আমি।
কথা না বাড়িয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো নিভান।ছেলের কালো ঘনো চুলের ভারী শক্তপোক্ত মাথাটা কোলের মধ্যে অনুভব হতেই পরাণ চড়াৎ করে কেঁপে উঠলো নীহারিকা বেগমের।কতোদিন পর ছেলেটা উনার কোলে মাথা রেখে শুয়েছে।নিশ্চয় ছেলেটার শরীর বেশি খারাপ লাগছে?অতিরিক্ত শরীর খারাপ ছাড়াতো ছেলেটা সহজে মায়েদের সান্নিধ্যে চায় না।নিভানের ঘন-কালো চুলের মধ্যে আঙুল ডুবিয়ে দিলেন।হালকা নড়াচড়া করতে করতে বেশ নমনীয় গলায় বললেন।
‘শুয়ে পড়লি যে,কফিটা খাবি-না?
‘লাগবেনা।তুমি যেভাবে মাথার চুলগুলো নড়াচড়া করছো ওভাবে কিছুক্ষণ নড়াচড়াকরতে থাকো।কফিটা আর লাগবেনা।
চাপা শ্বাস ফেলে নিভানের মাথার চুলগুলো আলতো হাতে নড়াচড়া করতে লাগলেন নীহারিকা বেগম।হালকা রূপে পর্দার ফাঁক ঘেঁষে আসা মৃদু আলোতে নিভানের মুখটা ঠিকঠাক দেখতে পেলেন না তিনি।তবুও সেই মায়ামায়া শ্যামবর্ণ মুখের দিকে নিটোল নজরে তাকিয়ে রইলেন।উনার আর দুই ছেলেমেয়ের গায়ের বর্ন বিদেশিনীদের মতো গৌররঙা অথচ নিভানের গায়ের রঙটা শ্যামবর্ণ হলেও তার চেহারায় আলাদা অদ্ভুত এক মায়া ছড়িয়ে আছে।শক্তপোক্ত চোয়ালের গম্ভীর চোখমুখের দিকে তাকালে আলাদা টান শান্তি অনুভব হয়।সেই মায়া টান অন্যদের গাৌররঙা মুখয়াবয়ে তিনি খুঁজে পাননা।যদিও সকল সন্তানদের প্রতি স্নেহ মমতা উনার সমান।তাদের সবাইকে তিনি সমানরূপেই ভসলোবাসেন।তবে নিভানের প্রতি মায়া টানটা জেনো অন্যরকম।হয়তো মা ডাকটা তিনি এই ছেলের মুখে প্রথম শুনেছিলেন তাই।নারীত্বের যে মা হওয়ার বড়সড় অনুভূতিটাও তো তিনি এই ছেলে জন্ম হওয়ার মধ্যেমেই লাভ করেছিলেন।তবে ছেলেটা এই মায়ামায়া চেহারাটা পেয়েছে,তার বাবার চেহারার মতো।সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নীহারিকা বেগম।তবে নিষ্পলক নজর নিভিনের আবাছা মুখাবয়ব থেকে সরালেন না।
ডাকলেন তিনি।
‘ও বাবু।
ছোটো করে ডাক শুনলো নিভান।–হুমম।
‘তোর তো ঠিকঠাক খেয়াল,খোঁজখবর রাখতে পারিনা আমি।ও বাবু একটা বিয়ে করে ফেল-না।বয়স তো কম হলোনা।
নীহারিকা বেগমের কথায় নীরব থাকলো নিভান।সময় গড়াতেই ছেলেকে উত্তর দিতে না দেখে ফের নীহারিকা বেগম বললেন।–কি-রে আমি কি বলছি শুনছিস?
নিভান ফের ছোটো করে উত্তর দিলো–হুমম।
‘কি হুম হুম করছিস।বয়স কতো হয়েছে খেয়াল আছে?এবার একটা লাল টুকটুকে বউ এনে দেনা ঘরে।যে তোর খুব খেয়াল রাখবে।আর সেটা দেখে আমি একটু নিশ্চিতে থাকবো।যে আমার ছেলেটার ভালোমন্দের খেয়াল রাখার একটা সুনিশ্চিত মানুষ হয়েছে।
উত্তর দিলো না নিভান।সেটা দেখে নীহারিকা বেগম মিছেমিছি বিরক্ত দেখিয়ে বললেন—কি হলো?বল না, মেয়ে দেখবো?
ঠান্ডা অথচ গম্ভীর গলায় বললো নিভান।–আমি আমার ভালোমন্দের খেয়াল রাখতে জানি,মা।সেখানে তোমার ছেলের খেয়াল রাখার জন্য দ্বিতীয় কারও প্রয়োজনীতা তো দেখছি না আমি।যেদিন প্রয়োজনীতা অনুভব করবো,সেদিন না হয় ভেবে দেখবো।
‘বয়স কতো হয়েছে খেয়াল আছে তোর?প্রয়োজন নেই মানে কি?তুই কি এখনো দিবার বিষয়টা নিয়ে আপসেট আছিস?
যদিও উত্তর দিতে ইচ্ছে করলো না নিভানের।কিন্তু দিবাকে সে নয়, মা তারজন্য পছন্দ করেছিলো।বাড়ির খুব ভালো মেয়ে,বাড়িতেই থেকে যাবে।আর সে দীবাকে যাচাই বাছাই না করে মায়ের পছন্দ,সম্মতিকেই স্বকৃীতি দিয়েছিলো।এখন যদি মায়ের কথার উত্তর না দেয় নিভান।তবে মা যে তার আরও মন খারাপ করবেন।তাই সময় নিয়ে ঠান্ডা গলায় উত্তর দিলো—আপসেট থাকার মতো কি এমন হয়েছে!তোমার ছেলেকে এতোটা দূর্বল মনেহয়?সবার নিজস্ব একটা পছন্দ অপছন্দতা আছে। তুমি তাকে ছেলের বউ করতে চয়েছিলে,আর তার তোমার ছেলেকে পছন্দ হয়নি।তাই সে তোমার ছেলের বউ হতে চায়-নি।অন্য কাওকে পছন্দ হয়েছে, আর তারসাথেই সংসার পেতেছে।দ্যাটস সিম্পল সাবজেক্ট।
এখানে আমাকে আপসেট থাকার মতো কি হলো?পছন্দ অপছন্দতা তার-ও থাকতে পারে।তাই বলে সেই বিষয়টা ধরে আমি আপসেট থাকবো,এটা তোমারও মনে হলো কিকরে?
থামলো নিভান।সময় নিয়ে ফের বিরক্তমাখা দৃঢ় গলায় বললো—আর কখনো এবিষয়ে কথা বলতে বা শুনতে চাইনা আমি।ওই বিষয়টা নিয়ে আমাদের কথা এখানেই শেষ।বিষয়টা নিয়ে আর কখনো নড়াচড়া করবেনা।
নিভানের দৃঢ় গম্ভীর গলার কথাগুলো শুনে আর কথা বাড়ালেন না নীহারিকা বেগম।যে বিষয়টা নিভানের পছন্দ নয়,তা নিয়ে দ্বিতীয়বার কথা বলার আগ্রহ সে দেখায় না।পছন্দ নয় তার।তবে নিভানের মতো ছেলের বউ হতে কেউ অস্বীকৃতি জানাবে বা না করতে পারে এটা নীহারিকা বেগমও মানতে ঠিক নারাজ।নিজের ছেলে বলে নয়।তবে নিভানের মতো আলাদা ব্যক্তিত্বপূর্ন ছেলে খুবই কম দেখা যায়।সেই নিভানের প্রতি দীবার চালচলন,চাহুনি,বলা এগুলো দেখেই তো তিনি দীবাকে নিভানের বউ করার প্রস্তাব রেখেছিলেন।যেটা নিভানও ঠিকঠাক জানতোনা।তবে কি কারনে হঠাৎই মেয়েটা নিভানের বউ হতে অস্বীকৃতি জানালো।সিয়ামের সাথে মেয়েটার আগে থেকে সম্পর্ক ছিলো এমনটাও তো নয়।তবে কি কোনোকারনে ডালিয়া মেয়েকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাহিরের সৌন্দর্য আর অর্থের চাকচিক্যের মোহে ডুবিয়ে দিয়েছে।যার পরিনতি এখন মেয়েটা হয়তো হাড়েহাড়ে অনুভব করছে।
.
সকালবেলা নিজেকে রেডি করে নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে যখন বের হচ্ছিলো নিভান।অচেনা একটা নম্বর থেকে কল এলো ফোনে।ফোনটা রিসিভ করতেই বুঝতে পারলো,আহসান আঙ্কেলের আম্মা। বৃদ্ধা মহিলা তার নাতনির সাথে কথা বলতে চান।কালকে নিভান চলে আসার সময় ভদ্রমহিলা তার নম্বরটা নিয়েছিলেন।আর এবাড়ির কারও সাথে আগে সেভাবে উনার যোগাযোগ না থাকায়,নিভানেরই নম্বরে কল করেছেন।
‘দাদু,আমার আপামনিটার সাথে একটু কথা কইয়ে দাও না।ছেড়ি’ডা যে ভালো নেই এইডা আমি জানি।কাল সারাদিন ছেড়িডার সাথে কথা কওয়ার জন্য কলিজাডা আমার ছটফটায়ছে,তয় সুযোগই পাই নাই।এখন একটু কথা কইয়ে দাওনা।
বৃদ্ধা মহিলার আকুলতার কাছে নীরব থাকলো নিভান।তার জীবনে কঠিন ত্রুটিগুলোর মধ্যে একটি হলো,সে কখনো কাওকে স্বান্তনাসরূপ মিষ্টিমিষ্টি বানী আওড়াতে পারে না।এবিষয়ে শূন্য অনুভূতি তার।ভদ্রমহিলা আবার-ও আকুলিত কন্ঠে,নিজের নাতনির সাথে কথা বলার জন্য অনুরোধ করলেন।
‘তোমাকে কি বিরক্ত করলাম, দাদু?একটু কি দেওয়া যায় না ছেড়িডার কাছে?
‘আপনি শান্ত হন,আমি দিচ্ছি।
সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছিলো নিভান।আশেপাশে নজর দিতেই দেখলো,ড্রয়িংরুমের আশেপাশে কেউ নেই।কি করবে ভাবতে সময় নিতেই দেখলো,মান্যতাকে ভার্সিটির জন্য রেডি হয়ে বের হতে।স্বভাব মতোই গম্ভীর গলায় ডাক দিলো নিভান।
‘মান্য।
দাঁড়িয়ে পড়লো মান্যতা। বরাবরই বড় দাদাভাইয়ের ডাকে কলিজা চমকিয়ে উঠে তার।কারন তার ডাকটা মানেই আতঙ্ক!
‘কিছু বলবে দাদাভাই?
বিনাবাক্যে নিজের ফোন মান্যতার দিকে এগিয়ে দিলো নিভান।ভরাট গলায় বললো—ওই মেয়েটার দাদু তারসাথে কথা বলতে চাইছে,ফোনটা দিয়ে এসো তার কাছে।
ফোনটা হাতে নিয়ে চঞ্চল পায়ে চলে গেলো মান্যতা।নিভান গিয়ে বসলো ডায়নিং টেবিলে।নীহারিকা বেগম সেখানে নেই।স্বান্তনা বেগম খাবার রেডি করছিলেন।নিভানকে ডায়নিং টেবিলে বসতে দেখে একটু আশ্চর্য হলেন।রাতের খাবার টেবিলে ছাড়া নিভানকে সহজে ডায়নিং টেবিলে দেখা যায় না।তবে স্বভাবসুলভ নিজের মৃদু হাসিটা একঝলক মুখে ফুটিয়ে খাবার দিতে ব্যস্ত হলেন।আজ আপতত সকালের ডায়নিং টেবিল ফাঁকা।
মৌনতা আর নাফিম হয়তো খেয়ে স্কুলে চলে গিয়েছে। সকাল সাড়ে আটটা থেকে তাদের স্কুল।মান্যতা হয়তো যাবার জন্য খেয়েদেয়ে বের হচ্ছিলো।আর ইভান?তার হয়তো কাল মাস্টার্সের এক্সাম শেষ হওয়ায়,রিলাক্সে নিশ্চিতে ঘুমাচ্ছে।আজ হয়তো তার সকাল হবে দুপুর দু’টো অথবা তারও পরে।জাহিদ সাহেবেরা চার ভাই।সম্পর্কের টানাপোড়েনে শুধু দু’ভাই এবাড়িতে থাকেন।জাহিদ হাসান আর উনার ছোটভাই শাহেদ হাসান।আপতত শাহেদ হাসান বাড়িতে নেই।অফিসের কাজে শহরের বাহিরে অবস্থান করছেন।নাহলে সকালের এই সময়টাতে তাকে-ও ডায়নিংয়ে পাওয়া যায়।
সকালে নিজের ইচ্ছাধীন নাস্তাটা,স্বান্তনা রহমান সামনে দিতেই খাবারে মনোযোগ দিলো নিভান।
.
মান্যতা গিয়ে কৌড়ির কাছে ফোনটা দিলো।কে ফোন দিয়েছে সেটাও বললো। ফোনটা কানে পাশে ধরতেই আচমকা একটা কড়া মিষ্টি সুবাস কৌড়ির নাক ছুঁয়ে মস্তিষ্কে গিয়ে বিধলো।সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠলো তার।এই সুগন্ধটার তীক্ষ্ণ সুবাসটা,সে আগেও অনুভব করেছে।কখন?কাল!হ্যা কাল সারাপথ এই সুবাসিত গন্ধটা তার নাকের চৌধারে ঘুরে বেড়িলছে।যতক্ষণ না পর্যন্ত সেই মানুষটার পাশ থেকে দূরে গেছে ততক্ষণ পর্যন্ত এই সুবাসটা ছড়িয়ে ছিলো তার আশপাশ।তবে ফোনটা কি সেই মানুষটার?
‘ও আপা।খুব রাগ হইছে এই দাদিআপার উপর?কথা কইবি না?ও আপা কেমন আছিস তুই?
চমকে উঠলো কৌড়ি!কোন খেয়ালে ডুবে ছিলো সে!ওপাশে যে দাদিআপা এক নাগাড়ে কথা বলে চলেছে তবুও সেদিকে খেয়াল নেই তার!খেয়াল হতেই ওপাশের মানুষের কথাতে মনোযোগী হলো।দাদিআপার আদূরী ডাকের কথাগুলোয় অভিমান হলো খুব।অভিমানী গলায় বললো।
‘তুমি একটুও ভালো না দাদিআপা।আমাকে কেনো এখানে পাঠিয়ে দিলে।আমার তোমাদের ছাড়া থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে।তুমিও ভালো নেই বলো,দাদিআপা?ও দাদিআপা আমাকে ছাড়া থাকতে পারছে তুমি?আমার যে তোমাকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হচ্ছে। আমাকে নিয়ে যাওনা দাদিআপা।বাবা নেই তো কি হয়েছে আমি তোমার সাথে থাকতে পারবো।
কথাগুলো বলতে বলতে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো কৌড়ি।
মাজিদা খাতুন ওপাশে নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।ফের নাতনিকে স্বান্তনা দেওয়ার কথায় লেগে পড়লেন।
মাাজিদা বেগমের বিভিন্ন বুঝদার কথায় একপর্যায়ে শান্ত হলো কৌড়ি।ওদিকের হালচাল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেও, তিনি সেভাবে উত্তর দিলেন না।তবে কথা শেষ করার আগে কৌড়িকে,ভালোভাবে চলাফেরা করার বেশ আদেশ উপদেশ দিলেন।সংযাত হয়ে ভেবেচিন্তে চলতে বললেন।যাতে পরের বাড়িতে কেউ খারাপ না বলে।যে উপদেশ নিষেধগুলো তিনি সবসময় কৌড়িকে দিয়ে থাকেন,সেগুলো দিয়ে একপর্যায়ে ফোন রাখলেন।
IPhone 15 PRO Max ফোনটার একের পর এক চেঞ্জ হওয়া স্কিন ফটো গুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো কৌড়ি।
নজর ফোনের দিকে থাকলেও,ভাবনা তার দাদিআপার এড়িয়ে যাওয়া কথাগুলোয়।তাঁকে এখানে পাঠিয়ে দেওয়য় ভালো রেখেছে কি,দাদিআপাকে ওই মানুষগুলো?যদি-ও নিজের আপনজন তারা?তবে তাদের স্বার্থপর কথাবার্তা,অতিলোভ,ব্যবহার নিজের আপনজন বলে তো পরিচয় দেয়না।সেখানে ওই বৃদ্ধা দাদিটা তার ভালো আছে কি?
‘মান্য, আমার অফিসের দেরী হয়ে যাচ্ছে।ফোনটা দাও।
জলদগম্ভীর ভরাট গলায়,ভুত দেখে লাফিয়ে উঠার মতো চমকে উঠলো কৌড়ি।ফোনটা হাত থেকে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলো।এরকম গম্ভীর গলা কারও হতে পারে জানা ছিলোনা কৌড়ির।তাকে থাকতে দেওয়া রুমের দরজায় সামনে থেকে গলার স্বরটা আসছে।তড়িৎ গতিতে রুমের আশেপাশে।কৈ মান্যতা আপুতো কোথাও নেই।কাল বিকাল থেকে সারারাত মান্যতা নামে আপুটা ছিলো তারকাছে।বিধায় আপুটা সম্পর্কে একটু জানাশোনা হয়েছে তার।কিন্তু মান্যতাকে কোথাও না দেখে,ফোনটা নিজে গিয়ে দেবে কি-না ভেবে পেলোনা।তারমধ্যে নিভান আবারও ডাকলো মান্যতাকে।তবে এবার গলা কিছুটা শান্ত তবে গম্ভীর।
‘মান্য।
নিশ্চয় মান্যতা ভিতরে নেই।নাহলে তার এক ডাকে সাড়া দেবে না।এটা হতেই পারেনা।তাই গলার স্বরটা নরম করে রুমে যে আছে,ফোনটা নেওয়ার জন্য তাকে উদ্দেশ্য করে মান্যতাকে ডাক দিলো সে।ফের মান্য ডাকটায় উঠে দাঁড়ালো কৌড়ি।চঞ্চল পায়ে এগিয়ে গেল ফোনটা দেওয়ার জন্য।পর্দার ফাঁক থেকে ফোনটা বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কৌড়ি।অথচ ফোনটা ধরলো না কেউ।ক্ষীন সময় পার হওয়ার পর কথা বলতে উদ্যোক্ত হলো কৌড়ি।তার আগেই ছো মেরে তার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে ধপাধপ পা ফেলিয়ে কেউ চলে গেলো।আশ্চর্য হলো কৌড়ি।মনেহলো,ফোনটা নেওয়ার অপেক্ষার জন্য,তাকে অপেক্ষা করিয়ে শোধ নেওয়া হলো।অদ্ভুত মানুষ তো!
চলবে……