ফুলকৌড়ি (৬) #লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

0
1140

#ফুলকৌড়ি
(৬)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

মায়ের কাছ থেকে হাজার বাহানা আর জোরাবাদী করে তারপর ফোনটা নিতে হলো মৌনতাকে।সেটার জন্যই ফিরে আসতে দেরী হলো তার।ছাঁদে দরজায় পা রাখতেই দেখতে পেল,ছোটোদাদাভাই কিছু বলে চলেছে আর তার সামনে তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কৌড়ি।

‘ছোটো দাদাভাই, তুমি এখানে?

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো কৌড়ি।ইভানও পিছনে ফিরল।পকেটে হাত গোঁজা অবস্থায় সেভাবেই সটান হয়ে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো–কেনো?ছাঁদটা কি তুই তোর নামে লিখে নিয়েছিস নাকি আছাড়ি বিবি?যে এখানে অন্য কার-ও প্রবেশ নিষেধ।

চঞ্চল পাজোড়া সহসা এগোলো মৌনতার।ফের গলায় তীক্ষ্ণতা ভর করে বললো।–ওসব বাজে নামে ডাকবেনা তুমি, আমায়।বলে দিলাম দাদাভাই।

মৌনতার বাজখাঁই গলায় কপাল আরও কুঁচকে ফেলল ইভান।ফের মৌনতাকে রাগাতে আবারও বললো–‘তোর ওই আছাড়ি বিবি নামটাই পারফেক্ট।কিন্তু ছোটো চাচা চাচিতো আর,তোর ওই বাচ্চা বেলার ভোলাভালা মুখটা দেখে বুঝে উঠতে পারেননি।তাই নাম রেখে ফেলেছিলেন মৌনতা।তুই নিজে বল, তোর সাথে তোর নামটা ঠিকঠাক যায়?নাকি আমি যে নামটা দিয়েছি, সেটা যায়?

ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো ইভান।সেটা দেখে আরও ক্ষেপে গেলো মৌনতা।কিছু বলবে তার আগে আবারও ইভান বললো।–সেজন্য চাচ্চু আর চাচির ভুলটা শুধরে দিলাম আমি,নাম দিলাম আছড়েবিবি।কিন্তু তোর আছাড় খাওয়ার সাথে সাথে গলার যা জোর বেড়েছে।নাম আবারও চেঞ্জ করতে হবে বলে মনে হচ্ছে।

‘দাদাভাই ভালো হচ্ছে না বলে দিলাম।এবার কিন্তু আমি বড়মাকে গিয়ে বলবো।

মৌনতার কাঁদোকাঁদো গলার কথাগুলো শুনে বেশ মজা পেলো ইভান।মেয়েটা ক্ষেপাতে তার যা লাগে না।আর তার কথায় ক্ষেপে যায়-ও মেয়েটা,এটাতে আর-ও বেশি মজা লাগে তার।ঠোঁটে তীক্ষ্ণ হাসি ফুটালো ইভান।ফের বললো।–বাবাহ,তা তোর বড়মার ভয়ে আমি কোথায় গিয়ে লুকাবো সেটা তো বলে দে।তাহলে আমার সুবিধা হয়।

‘দাদাভাই…

এবার কেঁদে ফেললো মেয়েটা।আর মৌনতার কান্না দেখে ইভান এবার হো হো করে হেসে দিলো।আশ্চর্য হয়ে দুই ভাইবোনের ঝগড়া দেখে গেল কৌড়ি।এতোবড় একটা ছেলে হয়ে এক পুচকি মেয়ের সাথে কিভাবে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করলো!আশ্চর্য! এখন আবার মেয়েটাকে কাঁদিয়ে হো হো করে হেসে চলেছে।কি অদ্ভুত।

মৌনতার দিকে পা বাড়ালো ইভান।সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়িয়ে মৌনতার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো।–আচ্ছা ঠিক আছে তোর নামটা নাহয় আছাড়ি বিবিই রইলো।চেঞ্জ নাহয় নাই করলাম।তবুও তুই এরকম গলা বাজিয়ে কাঁদিস না।লোকে দেখলে আমার আর নাম চেঞ্জ করা লাগবেনা।তারাই তোর নামের বদৌলে কাঁদুনিবিবি বলে ডাকবে।

অতিরিক্ত রাগে এবার ইভানের পেটে ধাক্কা দিয়ে দুরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো মৌনতা।যদিও শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ দেহের ইভানকে এক ইঞ্চিও নড়াতে পারলোনা।সেটা দেখে ইভানের পেটে দু-হাত চেপে দিয়ে ছাঁদের দরজার সম্মুখে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গেলো মৌনতা। যদিও ইভান সেটা নিজ ইচ্ছেতই এগোলো।নাহলে চিকনাচাকনা মৌনতার ক্ষমতা নেই তাকে এক ইঞ্চিও নড়ানোর। ঠেলেঠুলে দরজা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পর মৌনতা অভিমানি স্বরে বললো।

‘তুমি খুব খারাপ।তুমি আমার দাদাভাই নও।তোমার চেয়ে বড় দাদাভাই ভালো।সে আমাকে কত সুন্দর করে ডাকে।তোমার মতো বাজে নামে ডাকে-না।

হঠাৎই নিভে গেলো ইভান।মৌনতার কথার উত্তর দিলো না।কিছু সময় মৌনতার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে চুপচাপ সিঁড়ির পথ ধরলো।যদিও সে জানে, মেয়েটা এমনি এমনিই কথাগুলো বলেছে,তবুও।ওদের বড়দাদাভাই যে ওদের কাছে খুবই প্রিয়,এটাতো ইভান জানে।তবুও উহ্য করে বারবার কেনো বলে তার সামনে।

দুপুরে স্কুল থেকে ফেরার পর মায়ের ধমকের জন্য বাধ্য ছেলের মতো খেয়েদেয়ে ঘুমাতে হয়েছিলো নাফিমকে।সেই ঘুম থেকে সন্ধ্যার পর উঠেছে সে।মুলত উঠেনি সে,তাকে ডেকেডেকে উঠানো হয়েছে।কারনটা টিচার এসেছে,পড়তে হবে তাই।কোনোমতে পড়াটা কমপ্লিট করে কৌড়ির রুমে চলে এসেছে সে।ফুলকৌড়িকে তার কতো পছন্দ অথচ সারাদিনে একবার-ও তার সাথে দেখা করতে পারিনি সে।স্যারের কাছে কতো বাহানা দিয়ে তারপর আসতে পেরেছে।

‘ফুলকৌড়ি আজও কি তোমার মন খারাপ?

বিকালের তোলা ফুলের পিকগুলো কৌড়িকে দেখাচ্ছিল মৌনতা।হঠাৎ নাফিমের গলার স্বরে দুজনেই মাথা উঁচু করে তাকালো।কৌড়ি কিছু বলার আগে মৌনতা বললো।–ওই ফুলকৌড়ি কি!ওর নাম শুধু কৌড়ি।কতবার বলেছি তোকে?আর কৌড়ি আপু তোর বয়সের কতো বড় হয় তুই জানিস?নাম ধরে ডাকছিস কেনো?

‘ওর নাম যাই থাকুক,আমি তাকে ফুলকৌড়ি বলেই ডাকবো। তাতে তোর কি?

‘আমার কি মানে,আম্মুকে বলবো।বেশি পাক-না হয়ে গেছো তাইনা?

‘থাকনা মৌনতা।ওকে বকছো কেনো?ও যে নামে ডাকে ডাকুক না আমাকে।ও ফুলকৌড়ি বলে ডাকলে আমার নিজের আপন মানুষগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।দাদিআপা তো প্রায়সই এই নামেই ডাকতো আমাকে।আর মাঝে-মাঝে বাবা-ও ডাকতেন।ও ডাকলে আমার ভালোই লাগে।মনেহয় আপন কেউ ডাকছে।

কথাগুলো বলতে বলতে নাফিমকে কাছে টেনে নিলো কাৌড়ি।গোলুমোলু দেখতে ছেলেটা ভারী মিষ্টি।গোল ফ্রেমের চশমাটায় আরও দুষ্টমিষ্টি লাগে তাকে দেখতে।একদিনে, এবাড়ির ছেলেমেয়ে গুলো কি সুন্দর তাকে আপন করে নিয়েছে।নাফিম কে কাছে টেনে কোলের মধ্যে এনে বসাতেই,লজ্জা পেলো নাফিম।মাঝেমাঝে মায়ের কোলে বসার আবদার করলে,আপুরা তাকে বলে।তুই কোলে বসলে আম্মা ফেটে যাবে।রাগে ক্ষোভে সে আর মায়ের কোলে বসতে চায় না।এখন যদি ফুলকৌড়ি-ও সেই কথা বলে।তবে যে আর-ও লজ্জা পাবে।

‘ওকে কোলে নিয়েছো কেনো,চেপ্টা হয়ে যাবে তো তুমি!

‘বাজে কথা বলবিনা মৌনতার বাচ্চা।তুই আমাকে মোটু বলছিস,আমি যদি মোটু হই।তুই পাতলুর বউ বাতাসী।আমার চকলেট চুরি করে খাস আবার আমারই নিন্দা করিস।পাতলুর বউ কেথাকার।

‘কি বললি তুই?আর আমি তোর চকলেট খাইনা,তোর চকলেট ইঁদুর-বাদরে খায়।

‘সেই ইঁদুরটা- বাঁদরটা কে আমার জানা আছে।

দুজনের ঝগড়াটা সেই বিকালের ঝগড়ার মতো আশ্চর্য হয়ে দেখতে লাগলো।বিকালেরটা থামাতে না পারলেও, এবারের ঝগড়াটা থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো কৌড়ি।তবুও দু’জনে কিছুতেই থামলো গেল না।মান্যতা এতোসময় বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলো,ওদের ঝগড়াতে বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেটে দিয়ে রুমে এলো।দুজনকে বকে ধমকিয়ে থামানোর চেষ্টা করলো,কাজই হলো-না।হঠাৎ জলদগম্ভীর বজ্রকন্ঠের আওয়াজে পুরো পরিবেশ মূহুর্তেই বরফ শীতল আবহাওয়ার মতো ঠান্ডা হয়ে গেলো।

‘এখানে হচ্ছেটা কি?পড়ালেখা বাদ দিয়ে এখানে এতো চিল্লাপাল্লা কিসের তোমাদের?হোয়াট ইজ রং উই….

নাফিমের মোটাতাজা শরীরের বাহুভেদ করে একজোড়া ডগরডগর ভয়ার্ত কম্পিত চোখ উঁকি দিতেই তীক্ষ্ণ বাক্যদ্বয় সেখানেই থেমে গেলো নিভানের।নজরে নজর পড়তেই তড়িৎ গতিতে নজর আবারও নাফিমের মোটাতাজা শরীরের পিছনে লুকিয়ে নিলো কৌড়ি।কাল আসার সময় একপলক দেখেছিলো শ্যামবর্ণ লম্বা চওড়া সুঠাম দেহী এই মানুষটাকে।আজ আরও একপল দেখে কৌড়ির মনেহলো,মানুষটা যেমন তেমন থাক।এই ভয়ংকর গলার স্বরের জন্য একদিনও তার বউ টিকবেনা।আর বিয়ের আগে যদি সেই মেয়ে এনার গলার স্বর শোনে তবে বিয়েতেও জীবনে রাজী হবেনা।মরে গেলেও না।

ডগর ডগর নজরজোড়া নাফিমের পিছনে লুকিয়ে যেতেই নিভানের মনেহলো,এঘরে তার ভাইবোন ছাড়া অন্য কারও বাস আছে।এ রুমে যে বাহিরের একটা মেয়ে আছে,হঠাৎই খেয়াল ছিলোনা নিভানের।বাড়িতে ঢোকার পর,সিঁড়িতে উঠতে গিয়ে ড্রয়িংরুমের পাশ ঘেঁষে রুমটা থেকে তিনটা মানুষের এতোএতো হযবরল তর্কবিতর্ক ভেসে আসছিলো,মেজাজ শান্ত রেখে উপরে হয়ে উঠা হয়নি আর।তবে এটাও খেয়াল ছিলো না, তার অপরিচিত একজন মেয়ে এই রুমে আছে।পরিবেশ একদম শুনশান। পিছে মুড়ে গটাগট পা চালিয়ে চলে গেলো নিভান।পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতেই সশব্দে শ্বাস ফেললো সবাই।মান্যতা এবার দাঁতে দাঁত চেপে মৌনতাকে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘তোকে কতোবার বলছি নাফিম আর ছোটো দাদাভাই যেখানে থাকবে সেখানে তুই,থাকবি-না। যাবি-না।এখন হয়েছে তো!

‘আমি যাইনি তো,ও এসেছে।

‘আবার তর্ক করিস মুখেমুখে,ও এসেছেতো কি হয়েছে?ওকে খোঁচালি ক্যান তুই?

‘আমি খোঁচাই নি।আমি ভালো কথা বলেছিলাম,ও অযথা তর্ক শুরু…..

‘মৌন….

অতিরিক্ত রাগে মৌনতাকে ডেকে উঠায় আর কথা বাড়ালো না সে।চুপ হয়ে গেলো।সবাই শুধু তার দোষ দেখে,সবাই যে অকারণে তার পিছে লাগে এটা দেখেনা।
নিভানের গলার স্বর শুনে স্বান্তনা রহমান আর নীহারিকা বেগমও সেখানে হাজির হলেন।তবে নিভান চলে যাওয়ার পর।স্বান্তনা রহমান শঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন করলেন।

‘কি হয়েছে এখানে।নিভান চিল্লালো কেনো?নিশ্চয় এই দুটোতে আবার ঝগড়া বাধিয়েছে।

মান্যতা কিছু বলতে যাবে।তাকে বলতে না দিয়ে বিলাপ করে ফের স্বান্তনা রহমান নললেন।

‘আল্লাহ, একই মা’র পেটের ভাইবোন তোরা।কোনো সৎ ভাইবোন নোস।তবুও এক জায়গায় হতে পারিসনা ঝগড়াঝাঁটি মারামারি শুরু হয়ে যায়।তবে একজায়গায় হোস কেনো?এ কেমন ছেলেমেয়ে আমার।নতুন একটা মেয়ে এসেছে,তার সামনেও ঝগড়া।তাকেও মান্য করলো না।একি ছেলেমেয়ে হয়েছে আমার।

‘তুমি আবার কিসব বলা শুরু করলে ছোটোমা।

‘কিছু হয়নি তো নিভান চিল্লালো কেনো?অতিরিক্ত কিছু না হলে তো ছেলেটা উফফ তাক শব্দ করেনা?আর এই দুটোকে তুই এখন আমাকে নতুন করে চেনাচ্ছিস!আমি চিনিনা বুঝি এদের।

মান্যতা এবার পড়লো মহাবিপদে।এই দুটো ছোটোমাকে জ্বালিয়ে পড়িয়ে তার মাথা নষ্ট করে দিয়েছে।আগের ছোটমা কতো শান্ত ছিলো,এখন বকতে শুরু করলে আর থামে-না।মায়ের দিকে অসহায় নজরে তাকালো মান্যতা।সেটা বুঝে নীহারিকা বেগম,স্বান্তনা রহমানকে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ে গেলেন।তবুও স্বান্তনা রহমান মৃদুস্বরে নীহারিকা বেগমকে উদ্দেশ্য করে আওড়ালেন।

‘এই দুটোর জ্বালায় দেখবে একদিন আমি পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো।বাপটা সারা বছর এদেশ সেদেশ আরাম করে ঘুরে বেড়াবে,আর আমার হয়েছে যতোসব জ্বালা।

নীহারিকা বেগম জানেন,এবার স্বান্তনা রহমান ছেলেমেয়ে ঝাঁঝ,ছেলেমেয়ের বাপের উপরে উঠাবে। মুখে বকেবকে শান্ত হতে না পারলে, ফোন দিয়ে শাহেদকে ইচ্ছেমতো বকেবকে তার চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করবে।

নীহারিকা বেগম আর স্বান্তনা রহমান চলে যেতেই নাফিম কৌড়ির দিকে ফিরে মুখটা অসহায় ভঙ্গিমাকরে বললো।—বিশ্বাস করো ফুলকৌড়ি আমি মোটেই দুষ্ট ছেলে নই।ও সারাক্ষণ আমাকে মোটু বলে ক্ষেপায়।আমার রাগ হয়না বলো?আর আমার চকলেট গুলোও চুরি করে নিয়ে নেয়।আমার চকলেট গুলো ফেরত চাইলে,ইচ্ছেকরে আমার সাথে ঝগড়া বাধায়।আমি ওর কোনো কিছুতে হাত দিলে আম্মুকে বলে আমাকে বকা শোনায়।তবে আমি কোনো ওকে ভালো বলবো।ওর কথা শুনবো?তুমি বলো আমি দুষ্ট ছেলে?

মান্যতা আবার-ও বেলকনিতে চলে গিয়েছে। মৌনতা চুপচাপ বসে ছিলো,নাফিমের কথাগুলো শুনতেই ফোঁস করে উঠলো সে।কিন্তু কৌড়ির নজরে নজর পড়তেই থেমে গেল।চুপচাপ উঠে রুম থেকে চলে গেলো।নিজের কোনো ভাইবোন ছিলোনা বিধায় এসব ঝগড়াঝাঁটির ঝামেলা হয়নি।নাফিমের গোলুমোলু মিষ্টি চেহারায় অসহায় ভঙ্গিমা ভালো লাগলোনা কৌড়ির।মিষ্টি হেসে, নাফিমের গাল দুটো টেনে দিয়ে বললো।

‘নাফিমতো মোটেই দুষ্ট ছেলে নয়,খুব ভালো ছেলে।তবে আপু তোমার বড় হয়না,তার সাথে এভাবে ঝগড়া করা ভালো ছেলে হয়ে মোটেই ঠিক হয়নি তোমার।আর আপু
তোমাকে দুষ্টমী করে উল্টাে-পাল্টা নামে ডাকে,যদি-ও ঠিক নয়।তাই বলে আপুর সিক্রেট তুমি সবার সামনে এভাবে বলে দেবে?আপু লজ্জা পায় না।

‘আমাকে মোটু বলে,আমার ভালো লাগে?

নাফিমকে জবাবে কি বলবে ভেবে পেলো না কৌড়ি।তবুও ভালোমন্দ কথা বলে এটাওটা বোঝাতে লাগলো তাকে।

ঝরঝরে নজর মুগ্ধ হওয়ার মতো একটা সকাল।নিজের আরামদায়ক বিছনায় বালিশ আঁকড়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে নিভান।চোখ বন্ধ থাকলে-ও,জেগে আছে সে।স্বপ্ন দেখে ঘুমটা ভেঙেছে তার।একজোড়া মুগ্ধকর আঁখিদ্বয় অশ্রুবরণ করে চলেছে।অথচ সে নিটোল চোখে চেয়ে চেয়ে সেই চোখজোড়া দেখছে,কিন্তু কিছুই বলছেনা।শুধু যে আজ স্বপ্নটা দেখেছে,এমনটা নয়।এই স্বপ্নের উৎপত্তি হয়েছে,আজ থেকে তিনদিন আগে।হঠাৎ এরকম একটা স্বপ্নের মানে টা কি,বুঝে উঠতে পারছেনা নিভান।এমন স্বপ্ন এর আগে সে কখনো দেখেনি।অথচ আজ তিনদিন ধরে রাতে ঘুমালেই একই স্বপ্ন দেখে চলেছে।রাতে যেকাবার এই স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে,পুনরায় আবার ঘুমাতে গেলে সেই একই স্বপ্ন।
ওই একজোড়া ক্রন্দনরতা চোখ তাকে আজ তিনদিন ধরে অস্থির করে তুলেছে।রাতের আরামে ঘুমটা তার হারাম করে তুলেছে।আর সময় অসময়ে চোখ বুঁজলেই ওই একজোড়া চোখ ভেসে উঠছে,তার বদ্ধ দুয়ারের অন্তরিক্ষে।বিষয়টা বেশ অদ্ভুত লাগছে তার কাছে।এইযে চোখ বন্ধ করে আছে।সেই মোটামোটা ভেজা আঁখি জোড়া ভেসে বেড়াচ্ছে তার বদ্ধ আক্ষিপটে।

চেনা পরিচিত এরকম কোনো নজরে নজর পড়েছে বলে মনে তো হয়না নিভানের।তবে আকস্মিক এরকম একটা স্বপ্ন রোজ রোজ দেখে যাওয়ার মানেটা ঠিক কি?বালিশের পাশে থাকা ফোনের তীব্র ভাইব্রেশনে ভাবনা কাটলো নিভানের।চোখ না খুলেই নির্দিষ্ট জায়গা থেকে ফোনটা হাতড়িয়ে নিলো।দেখার বিশেষ প্রয়োজন মনে করলোনা।কলটা কে করেছে,হয়তো বুঝে নিতে পেরেই চোখ বন্ধ রেখেই রিসিভ করে কানে ধরলো সে।

‘বল

গম্ভীর কণ্ঠটা আর-ও গম্ভীর।সেটা বুঝে ওপাশের মানুষটা সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো।

‘সকালে দৌড়াদৌড়ি না করে,এখনো শুয়ে আছিস যে?
ব্যাপার কি? শরীর ঠিক আছো তোর?
আজ তোর অফিস বাদে-ও রেস্টুরেন্টে সময় দিতে হবে মনে আছে তো।

‘হুমম।

‘রেস্টুরেন্টের দিকে কয়টায় আসবি?

এবার চোখ খুলে উঠে বসলো নিভান।বেড থেকে নেমে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বললো–‘যে সময়টাতে রোজ বৃহস্পতিবার যাই।

‘ওকে।আয় তবে।দেখ,আরও একটু সময় নিয়ে তাড়াতাড়ি আসতে পারিস কি-না।এক সপ্তাহের মতো দেখা হয়না,একটু আড্ডা দেওয়া হবে।আল্লাহ হাফেজ।

নিভানের কাছে সময় চাওয়াটা অহেতুক তবুও বললো তৃনয়।নিভানও তৃনয়ের কথার উত্তর সরূপ কোনো জবাব দিলোনা,শুধু আল্লাহ হাফেজ বলে ফোনটা কেটে দিলো।


নিজেকে ফর্মাল ড্রেসে রেডি করে নিয়ে উপর থেকে নিচে নামতেই, ড্রয়িংরুমে দীবাকে-ও রেডি হয়ে বসে থাকতে দেখলো নিভান।সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে ডায়নিং খাবার রেডি করতে ব্যস্ত মায়ের দিকে তাকালো নিভান।স্বামী সংসার প্রিয় কাকে বলে এই নারীটিকে না দেখলে কেউ বুঝবেনা।

‘মা,আমি বের হচ্ছি।আল্লাহ হাফেজ।

‘সে-কি,খেয়ে যাবিনা।এইতো খাবার প্রায় রেডি।খেয়ে যা।

সামনের দিকে এগোতেই নিভান,নিহারীকা বেগমেকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলবে।তার আগেই দীবার পাশে বসা ফাতেমা বেগম গম্ভীর কন্টে বললেন।–নিভান, দাদুমনিকে একটু তোমার গাড়িতে করে তার গন্তব্য মতো পৌঁছে দিওতো।

ভদ্রমহিলা সম্পর্কে নিভানের দাদি হলেও তারসাথে বিশেষ সম্পর্ক নেই নিভানের।না নিভান উনাকে দাদীমা বলে ডাকে।আর না উনি নিভানকে অন্য নাতীদের মতো দাদুভাই বলে সম্বোধন করে।তবুও দুজন দু’জনের জায়গা থেকে সম্পর্ক ঠিক রাখার প্রয়াস করে যাচ্ছে।বিধায় দাদির চেয়েও গম্ভীর গলায় মা’কে উদ্দেশ্য করে তখনের উত্তরে নিভান বললো।

‘আমার আজ খেয়ে যাওয়ার সময় হবেনা মা।অফিসে ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে।আমি বাহিরে খেয়ে নেবো।আর কারও বাহিরে যাওয়ার প্রয়োজন হলে আমার গাড়ীটা বাদেও বাড়িতে আর-ও দুটো গাড়ী আছে।হাফিজ ভাইকে মাসে মাসে বেতনটা বেকার বেকার দেওয়া হয় না।

চলে গেলো নিভান।শ্বাশুড়ি আর ননদ ঝি’য়ের অসন্তুষ্ট মুখের দিকে নিষ্পলক কিছুসময় তাকিয়ে থেকে নিজের কাজে মন দিলেন নীহারিকা বেগম।জাহিদ সাহেবের খাবার নিয়ে কেটে পড়লেন সহসা।যদিও নিভানের এহেন ব্যবহার নিয়ে শ্বাশুড়িমা আগে অনেক অভিযোগ আর কথা শোনালেও,এখন যে শোনাবেন না।এটা তিনি জানেন।তবুও শ্বাশুড়ির এই অসন্তুষ্ট মুখটা ঠিক ভালো লাগলোনা উনার।দীবা হয়তো জানতো,সে বললে নিভান নিয়ে যাবেনা।তাই নানিমাকে হয়তো নিভানকে বলার জন্য হাত করেছে, বুঝিয়েছে।কিন্তু এটাতেও যে নিভান গলবে না।সেটা এতোদিন ধরে নিভানকে দেখার পরও বুঝিনি মেয়েটা!

সকাল সকাল বাড়ির পিছনের বাগানটাতে গিয়েছিলো কৌড়ি।মুলত রানীসাহেবা তাকে নিয়ে গিয়েছিলো, তার করা সবজি বাগান দেখাতে।সেখান থেকে ফিরছিলো কৌড়ি।বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে ড্রয়িংরুমের ঘটনাটা সদর দরজায় দাঁড়িয়ে দেখেছে সে।মানুষটা এমন অদ্ভুত টাইপের কেনো?কাল যে ধমকটা দিলো,তারপর আর ওই মানুষটার সামনে পড়তে চায়না কৌড়ি।যদি কোনো কারনবশত মানুষটার সামনে সেও কোনো ভুল করে ফেলে,আর সেই ভুলের জন্য যদি ওরকম ঘর কাপিয়ে একটা ধমক দেয়,ওই অদ্ভুত মানুষটা।তবেতো সে শেষ।সেদিনই তার জানাজার ব্যবস্থা করতে হবে।তাই রানিসাহেবা ভিতরে চলে গেলেও সে ভিতরে ঢুকতে পারলো-না।নিভান সদর দরজার দিকে আসতে দেখেই তড়িৎ গতিতে ফের বাগানের দিকে চলে গেলো সে।
নিভানও বুঝতে পারলো,কেউ তাকে দেখে দৌড়ে চলে গেছে।

বাড়ির লন এরিয়াতে পা রাখতেই কাওকেই সেভাবে নজরে পড়লোনা নিভানের।আর এসময়ে তো মৌনতা, নাফিম কেউই বাড়িতে থাকে-না।তবে?ভাবনা আর সামনে এগোলো না নিভান,গাড়িতে উঠে বসলো।তবে তার তীক্ষ্ণ অনুভব শক্তি বলছে,কেউ তাকে সুক্ষ নজরে পর্যবেক্ষণের করছে।হয়তো তার চলে যাওয়ারই অপেক্ষা করছে।গড়ীতে বসেই আরও একবার সতর্ক নজর আশেপাশে বুলালো নিভান।হঠাৎ নজর উপরের দিকে যেতেই দেখলো,সদ্য ঘুম থেকে উঠা ইভান বেলকনির রেলিঙে দুহাত দুপাশে ভর করে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে।দুই ভাইয়ের মধ্যে গলাগলি টাইপের বিশেষ সম্পর্ক নেই।তবে যেটুকু আছে দুজনের ভিতরে পুষে রেখেছে। কেউ কাওকে সেই অনুভুতি দেখাতে রাজী নয়।নিভান মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার আগেই ইভান তারদিকে তাকালো।কৌড়ির লুকানোর ব্যপারটা হয়তো কিছু বুঝে ফেলেছে সে।তাই নিভানকে চোখ দিয়ে বাগানের পাশে পিলারের আড়ালে নজর দিতে ইশারা করলো।ইভানকে ইশারা করতে দেখে একটু আশ্চর্য হলেও, ইশারা বুঝতে সময় নিলো না নিভান।কপাল কুঁচকে সেদিকে তাকাতেই নজর শিথিল হয়ে এলো তার।কাল রাতে নাফিমের মোটাতাজা শরীরের বাহুভেদ করে ডগরডগর যে নজরজোড়া উঁকি দিয়েছিলো,সেই ডগর ডগর নজরজোড়া আজ পিলারের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে।কাল কম্পিত ভয়ার্ত ছিলো আর আজ সে নজরজোড়া সতর্ক।কপাল এবার একটু নয় বেশ কুঁচকে গেলো নিভানের।

‘মানেটা কি?তাঁকে দেখে এরকম লুকানোর কি আছে?অদ্ভুত মেয়ে তো বটে,আশ্চর্য!তবে নিভানের মনেহলো ওই মেয়েটার ডগরডগর নজরজোড়ার সাথে কোথা-ও একটা খুব সাংঘাতিক মিল আছে।কাল রাতে-ও তার মনে হয়েছিল। তবে কোথায়?তার স্বপ্নে দেখা ক্রন্দনরত চোখজোড়া!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here