চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা #ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া #পর্ব-১৭

0
333

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-১৭
৫২.
পুতুলের স্কুল শুরু হয়ে গেছে৷সে এখন পড়াশোনা করছে।আগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার ম্যাম,স্যারেরা তাকে কত ভালোবাসত।কিন্তু হাইস্কুল পিন্সিপাল ম্যাম থেকে শুরু করে অনেকেই তাঁকে পছন্দ করে না।তাদের একটা কথাই কানে আসে।পুতুল এখানে বড্ড বেমানান।তাদের সাথে তার মিল নেই।সবাই কথা ব’লে মনের ভাব প্রকাশ করে।একে অপরের সঙ্গে কত কথা ব’লে।কিন্তু সেখানে পুতুল কথা শুনতে পারলেও বলতে পারেন না।এই কথা বলার ত্রুটি সবাই কেন ধরে বসে থাকে।সবাই কেন তাদের একজন ভাবতে পারে না?কেন এত অবহেলা করে।তার যে কষ্ট হয়।কেন কেউ বুঝতে চেষ্টা করে না?পুতুল টিফিন পিরিয়ডে ক্লাস রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে চোখের কোনে পানিটুকু মুছে নিলো।
নিজেকে স্বাভাবিক করে বেঞ্চে বসে কোনো রকম একটু খাবার পানি দিয়ে গিলে নিলো।বাসা থেকে টিফিন পিরিয়ডে জন্য খাবার দেওয়া হয়।সে যদি খাবারটা না খায়।মামা ঠিক বুঝে যাবে।তাই নিজে যতটুকু গিলতে ফেরেছে।ততটুকু শেষ করে বাকিটা ব্যাগে রেখে দিল।

কদম গাছের নিচে দাড়িয়ে আছে পুতুল।প্রচন্ড গরম লাগছে।ভাইদের স্কুল ছুটি হতেই বাড়ি পথে পা বাড়ায়।পুতুল ক্লাস সাড়ে সাতটা থেকে বারোটা পর্যন্ত হয়।আর সাজুদের ক্লাস দশটা থেকে বারোটা।সকালে পুতুল এবং তার দুই ভাই আলাদা আসলেও যাওয়াটা একসাথে হয়।বাসায় পৌঁছে তিনজনই স্কুল ড্রেস পাল্টে বিশ্রাম নিলো।যোহর আজান পড়তেই দুই ভাইকে গোসল করিয়ে,নিজেও গোসল করে নামাজ আদায় করলো।মামী শরীরটা এখনো পুরোপুরি সুস্থ নয়।সিজারের বাচ্চা হওয়া তার হাঁটাচলা কম করে।বেশি হাঁটলে সেলাইতে টান লাগে।তাই বেশি হাঁটাহাটি বারণ।বেবিকে বেশিখন কোলে রাখতে পারে না।শুধু খাবার খাওয়া সময় বেবি কোলে নেওয়া হয়।আর বাচ্চা হয়তো মায়ের কষ্ট বুঝতে পারে।তাই দিনের বেশিভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটায়।ঘুম ভাঙ্গলে চোখ খুলে খেলতে থাকে।যদি পেটে খিদে পায়।তাহলে কান্না করে।এছাড়া সে একদম শান্ত সৃষ্ট বাচ্চা।বাকি দুই ভাইয়ের মতো নয় সে।বাচ্চার নাম মায়ের নামের প্রথম অক্ষর “র” দিয়ে রাখা হয়েছে।মোঃরিফাত।আজ সাজু,মিলন টিভি দেখতে গঞ্জে যাবে।গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে কয়েকদিন হলো।সাদা কালো ছোট টিভিতে হানিফ সংকেত ইত্যাদি অনুষ্ঠান শুরু হবে সন্ধ্যার পর।পুতুলের ওমন ছোট বাক্স টিভি দেখতে ইচ্ছে করে।কিন্তু সে মেয়ে মানুষ।গঞ্জে টিভি দেখতে গেলে গ্রামের মানুষ ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখবে না।তাই নিজের ছোট চাওয়া প্রশয় দিলো না।আর দিলেও কিছু হতো না।

৫৩.
এশার আজান দিয়েছে অনেকখন।পুতুল হাতের কাজগুলো দ্রুত শেষ করে।অযু করে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলো।মোনাজাত শেষ করে জায়নামাজ ভাজ করে আলনায় রাখতেই,মিলন,সাজু স্বাধীনের হাত ধরে নাচতে নাচতে বাড়িতে চলে আসছে।তিন জনকে একসাথে দেখে পুতুল হাতের ইশারা সালাম দিলো।

আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।

মিলন,সাজু,স্বাধীন তিনজন একসাথে জবাব নিলো।

ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।

স্বাধীন বারান্দার মোড়ায় বসতেই পুতুল এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এগিয়ে দেয়।স্বাধীন মুচকি হেসে পানিটুকু প্রান করে।

রেনু খাবার খেয়েছে আম্মা।পুতুল মাথা নাড়িয়ে বল হ্যা খেয়েছে।

স্বাধীন খাবারের জন্য ঘরে চলে যেতেই।সাজু,মিলন একসাথে পুতুল কাছে গঞ্জের আলাপ নিয়ে বসে।তাদের আলাপ শেষ করে খাবার জন্য ঘরে যায়।মাটিতে পাটি বিছিয়ে নেয়।ভাত,তরকারি পেয়ালাগুলো বোনের দেখাদেখি নিজেরাও এগিয়ে নিয়ে আসে।স্বাধীন হাতমুখ ধুয়ে আসতেই খাবার বিসমিল্লাহ ব’লে মুখে তুলে।পুতুল সবার জন্য খাবার বেড়ে নিজেও খাবার মুখে তুলতে নিলেই হঠাৎ কারো চিতকারে হাত ফসকে ভাতগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে যায়।ততক্ষণে স্বাধীন,সাজু,মিলনের খাবার বন্ধ হয়ে গেছে।স্বাধীন দৌড়ে ছুটতেই,পুতুল হাতটা ধুয়ে দৌড়ে বের হয়।পাশের বাড়িতে কি হয়েছে দেখার জন্য?

সুমনা নামের মেয়েটি গলায় ওড়না দিয়ে ফাঁস দিয়েছে।মুখ দিয়ে কিসব পড়ছে।জিহবা বের হয়ে আছে।বাবার মতেই বিয়ে করেছিল।বিয়ে গন্ধ যার শরীরে এখনোও।হাতে রাঙা মেহেদী।সেই মেয়েটি ফ্যানের সাথে ঝুলছে।
পুতুল চারদিকে তাকায়।মেয়েটি মা জ্ঞান হারিয়েছে।বাবা কপাল চাপড়াচ্ছে।ঋণ করে ধুমধামে মেয়েকে বিয়ে দিলো।অথচ ঋণ পরিশোধ করা হলো না।মেয়ে তার লাশের পরিনত ঠিকই হলো।পুতুল আরো কিছু ভাবার আগেই স্বাধীন তার হাত টেনে বাড়িতে নিয়ে যায়।

আম্মা আপনি বাড়িতে থাকেন।ঘর ছেড়ে বের হবেন না।আমি দেখে আসছি।কি হয়েছে? পুতুল কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল আচ্ছা।কিন্তু চোখের সামনে ওমন ভয়ংকর কিছু দেখে পুতুলের বাসায় বসে থাকতে মন সায় দিচ্ছে না। সাজু,মিলনকে খাবার খাইয়ে ঘুমাতে দিয়ে চুপিচুপি ঘর থেকে বের হয়ে যায়।সুমনাদের বাড়ির মেইন গেটের দরজাটা হালকা খুলতেই দেখতে পায়।বাড়িতে পুলিশ এসেছে।মেয়েটি লাশ ততক্ষণে ঘর থেকে বাহিরে নামিয়ে মাটিতে পাটি বিছিয়ে শুয়ানো হয়েছে।পুলিশ কথা শুনে মনে হচ্ছে পোস্ট মর্ডেম জন্য হাসপাতালে নিবে।কাটাছিড়া পর নাকি মেয়েটির লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।কারো প্রতি কোনো সন্দেহ থাকলে পুলিশের কাছে জানাতে বলল।সুমনা শ্বশুর বাড়ি লোকদের ওহ খবর দেওয়া হয়েছে।তারা প্রায় চলে এলো ব’লে।

৫৪.
ঘরে যার নব সুন্দরী বধূ।সে বাহিরে পর নারীতে আসক্ত হয় কি করে জানা নেই পুতুলের।সুমনা মারা যা-ওয়ার সাত দিন পার হয়ে গেছে।সুমনা বর আগে থেকেই পরকীয়া করতো।সেই মেয়ে না-কি তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা।সেটা কোনোভাবে সুমনা জানতে পারে।ভালোবেসে যে স্বামীকে নিয়ে ঘর বাঁধলো।দিন শেষে সে ধোঁকা দিল।সুমনা মানতে পারেনি।বাবার বাড়িতে নায়ের হয়ে এসেছিল।কিন্তু বের হলো লাশ হয়ে।
পুতুল খারাপ লাগছে।মেয়েটি,মা,বাবার দিকে ফিরে তাকানো যায় না।সন্তান ছাড়া তারা কতটা অসহায়।সুমনা বড় ভাই কাজের সূত্রে ঢাকা পরেছিল।বোনের মৃত্যু খবর পেয়ে ছুটে আসে।সুমনা স্বামীকে জেলে নেওয়া হয়েছিল।কিন্তু তারা ক্ষমতাশালী হওয়া ছেড়ে দিলো।দশ লাখ টাকা বিনিময়ে সুমনা,শ্বশুর ছেলেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান।সুমনা শ্বশুর সেখানকার পুলিশ অফিসার ছিলেন।এখন রির্ডাড।সরকার থেকে বসে বসে টাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাসায়ন পান।তিনি প্রচুর সম্পত্তির মালিক।সুমনা বাবা হাজার চেষ্টা করে ওহ পারে নিই।মেয়েকে ন্যায় পাইয়ে দিতে।সে ব্যর্থ।

সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে।অসময়ে বৃষ্টি আগমনে কিঞ্চিত বিরক্ত পুতুল।জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে কৃষকের ফসলের ধান নষ্ট হচ্ছে।এই বৃষ্টি না আসলেই ভালো হতো।কত মানুষের ক্ষতি হচ্ছে।মিলন,সাজু আবদারে হাঁড়িতে খিচুড়ি চড়িয়ে দেয়।চাল,তিন পদের ডাল,মিষ্টি কুমড়ো ও আলু ছোট ছোট টুকরো দিয়ে আজকে এই খিচুড়ি।কিছুখন পর ঢাকনা সরাতেই খিচুড়ি গন্ধ আসছে।ভালোই হবে মনে হচ্ছে।গরম তেলে বেগুন ছেড়ে ভাজতে লাগল।ঘরে যা ছিল সবকিছু দিয়ে মোটামুটি খাবার আয়োজন হলো।মামী জলপাই আচার করেছিল।জলপাই শেষ হলেও তেল রয়ে গেছে।পিয়াজ কুচিকুচি করে কেটে নিলো।লবণ দিয়ে হালকা ঢলে তাতে জলপাই তেল ঢেলে একটা মজাদার খাবার করে নিলো।

মিলন,সাজু মজা পেয়ে খাবার বেশি খেয়ে ফেলেছে।মিলন পেট ফুলে ঢোল হয়ে গেছে।সাজু, মিলন কে খ্যাপাতে বলল,

থাকতুম থাকতুম বাজায়।মিলন মিয়া ঢোল।

মিলন ঠোঁট উল্টে বলল,

-;আমার পেটে বাচ্চা।মিলন মিয়ার বাচ্চা।মিলন মিয়ার বাচ্চা।

মিলন কথাটা বলতে বলতে বিছানায় শুয়ে কেঁদে ওঠে।

ওরে বাপরে খুদা বেশি লাগছিল।তাই শখ করে আরেকটু খেতে গিয়েছিলাম।এখন আমার এটা কি হলো?পেটে আমার বাচ্চা।লোভে পরে পাপ করে ফেলছি।ওরে মা,পেট আমার পেটের জায়গায় থাকতে চায় না কেন?কেন বাপ কেন?আমার পেট ফেটে গেলো রে।ওরে তোরা কেউ আমারে ধররেএ।

মিলন কাজে সাজু বসে শব্দ করে হাসছে।পুতুল চোখ বড় বড় করে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।কি সবর্নাশা কথা ব’লছে?এসব কি কথা ছিঁড়ি?পুতুল ভাইকে বলল,বাড়ি বারান্দায় হাঁটতে।হাটাহাটি আস্তে আস্তে করলে ঠিক হয়ে যাবে।পুতুল কথায় মিলন পেটটা ধরে বাড়ির বারান্দায় আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগে।সাজু,মিলন মতো করে পেটে হাত দিয়ে হেঁটে হেঁটে বলল,

আসছে গোপাল,যাচ্ছে গোপাল।

মিলন গাল ফুলিয়ে বলল,আপু,সাজুকে কিছু বলো।ওহ আমায় ক্ষ্যাপায় কেন?আমি কিন্তু ওকে খুব মারবো।পঁচা ছেলে ভাগ।

-;তুই ভাগ।গোপাল ভাড় একটা।আগে আগে পেট চলছে।পেটুক একটা।আর বেশি খাবি।

পুতুল,সাজুর কান টেনে ধরে হাতের ইশারা বলল।মারব কিন্তু।

-;আপু লাগছে আমার।ছাড়।আচ্ছা আর বলবো না।ছাড় আপু।পুতুল কান ছেড়ে দিতেই সাজু দৌড়ে ঘরে চলে যায়।পুতুল হাঁটু গেড়ে ভাইয়ের ফুলো পেটে হালকা করে চিমটি কাটে।মিলন চিতকার করে বলল,

ওরে মা,পেট আমার ফেটে গেলো।
তুমিও খুব পচাঁ আপু।রাগ করে মিলন বারান্দায় ছেড়ে ঘরে চলে যায়।পুতুল মিটমিটে হাসে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here