অনুভূতিরা_শব্দহীন লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী পঞ্চদশ পর্ব

0
468

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

পঞ্চদশ পর্ব

দুপুরের খাওয়াদাওয়া হয়েছে বহু আগে। সারাহ্ সামিহাকে সাথে নিয়ে খাবারের এলাহি আয়োজনের এঁ°টো বাসন পরিষ্কার করলো। এক জামাই আর এক মেয়ের জন্য এতো আয়োজন করেছে যেন আজকে আবারো মেয়ের বিয়ে৷

নার্গিস পারভিন এসে ওদেরকে তাড়া দিয়ে বললেন,
“একটু জলদি কর মায়েরা।”

সারাহ্ একটু বি°র°ক্তি নিয়েই বলে,
“আম্মু, এতো আয়োজন করা ঠিক হয়নি।”
“কেন ঠিক হয়নি?”
“অবশিষ্ট খাবারগুলো কি করবে? শুধু শুধু ওয়েস্ট হবে।”

সামিহা পাশ থেকে বলল,
“প্লেটে জমা খাবারগুলো কুকুরকে খাওয়াবো আর বাকিগুলো ফ্রিজে রেখে আমি মাঝরাতে খাবো।”

সারাহ্ চোখ কুঁচকে বলে,
“ওগুলো কুকুরকে না দিয়ে তুই খেয়ে ফেল। মাঝরাতে কেউ এসব খায়? পাগল কোথাকার?”
“তুমি মস্ত বড় ছাগল।”

নার্গিস পারভিন মেয়েদের ঝগড়ায় বি°র°ক্ত হয়ে নিজকক্ষে চলে গেলেন।

সারাহ্ মুচকি হাসলো। প্লেটগুলো গুছিয়ে রেখে দ্রুত প্রস্থান করলো। সামিহা ভ্রূ উঁচিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে অদ্ভুত একটা চেহারা করে বলে,
“কি এমন বললাম যে হাসতে হবে? ছাগল বললে কেউ হাসে?”

সারাহ্ রুমে গিয়ে আহনাফকে তৈরি হতে দেখে বলে,
“কোথাও যাবেন নাকি?”
“হুম।”
“কোথায়?”
“নিউমার্কেট। (একটু থেমে) তোমার কিছু লাগবে?”

সারাহ্ এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
“সবাই আমাকে ছাগল বলে কেন?”

আহনাফ দাঁত বের করে হেসে বলে,
“নি°র্ঘা°ত কোথাও ঘাস খাচ্ছিলে আর অনেকে দেখেছে।”

সারাহ্-র কপাল কুঁচকে গেল। আহনাফ একটু হেসে মুখটাকে আবার গম্ভীর করে বলে,
“ঐশী, তাহসিনার কথা শোনার পর এটা নিয়ে আর কিছুই তো বললে না। বরং অদ্ভুত একটা আচরণ শুরু করেছো।”

সারাহ্ একটু চমকায়। আহনাফ তার আচরণ খেয়াল করছে। সে শুনতে চাচ্ছে তাহসিনাকে নিয়ে সারাহ্ কি ভাবে।

“আর তো কিছু বলার নেই। যা জানার ছিল, জেনে গেছি। ব্যস।”
কথাটা বলে সারাহ্ বিছানায় গিয়ে বসে।

আহনাফ ঠিকঠাক মতো তৈরি হয়ে গলার কাছটায় পারফিউম দিয়ে সারাহ্-র কাছে এসে ওর গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বেরিয়ে গেল। হঠাৎ এমনটা কথায় একটু চমকে উঠে সারাহ্। গালে হাত দিয়ে মাথানিচু করে সে। গতকাল থেকে আহনাফ এমনভাবে আচরণ করছে যেন ওরা শুরু থেকেই একে অপরকে ভালোবাসে।

সামিহা ডাইনিং এ কাজ করছে। আহনাফকে বেরিয়ে যেতে দেখে বলে,
“ভাইয়া কোথাও যাচ্ছেন?”
“হ্যাঁ, একটু কাজ আছে। সন্ধ্যার আগে চলে আসবো।”
“আচ্ছা।”

আহনাফ বেরিয়ে গেল। সামিহা রুমে এসে তানজিমকে কল করে।

“হ্যালো, তানজিম। আমি খুব রেগে আছি।”

তানজিম অবাক হয়।
“কেন রে?”
“তুই আমাকে ভুলে গেছিস। তোর ওই বড় আপু, কি যেন নাম, (একটু ভেবে) ওই মিউকো আসার পর তুই আমাকে ভুলে গেছিস।”

তানজিম শব্দ করে হেসে বলল,
“এখন তোকে মনে করার জন্য আমার কি করতে হবে তাই বল।”
“আজকে আমাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে হবে।”

তানজিম পাশে বসা মৃত্তিকার দিকে একবার তাকায়। তারপর বলে,
“আমি এখন মিউকোপুর সাথে একটু বাইরে যাচ্ছি। কাল তোকে নিয়ে..”

তানজিমের কথার মাঝেই সামিহা ধ°ম°ক দিয়ে উঠে,
“দেখেছিস তুই আমাকে ভুলে গেছিস। এখন তো আমি কেউ না, মিউকোপু সব। থাক তুই।”
“তুই হিং°সা করি না সামি।”

সামিহা ভেঙচি কে°টে ফোন রেখে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। কান্না পাচ্ছে তার, কিন্তু ও কাঁদছে দেখলে সারাহ্ একশো চারটা প্রশ্ন করবে।

তানজিম ফোন হাতে নিয়ে মৃত্তিকাকে বলে,
“আপু, তোমার আজকে বাইরে যাওয়াটা কি খুব ইম্পোর্টেন্ট?”

মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে বলে,
“কেন? যেতে পারবে না?”
“আসলে সামিহা ঘুরতে যেতে চাইছে।”

মৃত্তিকা মুচকি হেসে বলে,
“যাও তবে। আমি একা একা চলে যাবো। একটু শপিং করতাম আরকি, এইতো ফরচুনে যাবো।”
“কি কিনবে?”
“ট্রলি কিনতাম আর টুকটাক কিছু৷ কাল তো মামার বাসায় চলে যাবো, বড় ট্রলিটা নিতে চাচ্ছি না।”

তানজিম মাথানেড়ে বলে,
“বসুন্ধরায় যাবা?”

মৃত্তিকা একটু ভেবে বলল,
“ওকে, যাওয়া যায়।”
“তবে সামিহাকে ওখানে আসতে বলি। ঘুরাঘুরি আর শপিং সব হবে।”

তানজিম মৃত্তিকার অনুমতির অপেক্ষা না করে কল দিতে নিলে মৃত্তিকা বলল,
“বাজেট কম আমার, দেখিও সামিহা আবার এটাওটা চাইলে কিন্তু কিনা যাবে না।”

তানজিম হেসে বলল,
“ও এমন না, সমস্যা নেই।”
______________________________________

বিকাল সাড়ে চারটা, সামিহা আর সারাহ্ বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সে চলে এসেছে। তানজিম এসে সারাহ্-কে দেখে সামিহাকে বলে,
“এটা কে?”
“আপু।”

সারাহ্ চোখ সরু করে ওদের দিকে তাকায়। তানজিম দাঁত কেলিয়ে বলে,
“আসসালামু আলাইকুম আপু, কেমন আছেন? আপনার হাসবেন্ড কেমন আছে?”

তানজিমের আচরণ আর তাড়াহুড়ায় সারাহ্-র মনে হলো সে একটা মানসিক রোগী। তবুও ভদ্রতা দেখিয়ে বলল,
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ভালো আছি।”
“সামিহা চল।”

বলেই তানজিম হাঁটতে শুরু করে। সারাহ্ পিছুপিছু যায়। একটু দূরে গিয়ে মৃত্তিকার সাথে একত্র হলো ওরা। মৃত্তিকা কুশল বিনিময় করে। অল্প সময়ের মধ্যেই মৃত্তিকা আর সারাহ্-র গল্প জমে উঠে।

মৃত্তিকা ট্রলি ব্যাগ দেখছে। সারাহ্ আশেপাশে তাকিয়ে সামিহা কিংবা তানজিমকে না দেখে বলে,
“দুজন কোথায়?”

মৃত্তিকা মৃদু হেসে বলে,
“দুজনে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করছে।”
“কি?”

সারাহ্ চোখ কুঁচকালে, মৃত্তিকা হেসে অন্যদিকে যায়। সারাহ্ শপ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে থাকে। একটা দোকানে সামিহাকে দেখে ওর দিয়ে এগিয়ে যায়।

মৃত্তিকার পাশে এসে দাঁড়ায় ইমতিয়াজ।
“সকালে কি বলেছিলেন?”

মৃত্তিকা চমকে উঠে পাশে তাকায়। বলে,
“কি?”
“কি বলছিলেন? কাকে পছন্দ?”

মৃত্তিকা মাথানিচু করে সরে যায়। ব্যাগ দেখতে থাকে নিরবে। ইমতিয়াজ একটা ব্যাগ হাতে দিয়ে বলে,
“এটা কিনুন।”

মৃত্তিকা আড়চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“ফলো করছেন আমাকে?”
“আমি না অন্যকেউ।”
“কে?”

বাবা ছাড়া আর কেউ মৃত্তিকাকে ফলো করে বলে ওর জানা নেই। আশেপাশে তাকাতে নিলে বাধা দেয় ইমতিয়াজ।

“বারবার তাকালে সন্দেহ করবে।”
“কে আছে?”

ইমতিয়াজ ফোন বের করে কিছুক্ষণ আগে ওর তোলা ছবিটা দেখায়। মৃত্তিকার পাশ থেকে যখন সারাহ্ সরে গেল, তখন ওর বাবা ওর কাছে আসতে নিয়েছিল।

মৃত্তিকা ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল,
“পাবলিক প্লেসে উনি কখনোই আমার সাথে কথা বলেন না।”
“তাই তো পাশে আছি।”

মৃত্তিকা সামনের আয়নার দিকে তাকায়। ইমতিয়াজের প্রতিচ্ছবিটি দেখে বলে,
“এভাবেই সারাজীবন থেকে যান না কেন?”

এতোটাই মৃদুস্বরে কথাটা বলেছে যে ইমতিয়াজ শুনেনি। সারাহ্, তানজিম আর সামিহাকে এদিকে আসতে দেখে ইমতিয়াজ নিরবে সরে যায়। মৃত্তিকা ওর চলন দেখে। ইমতিয়াজ ওকে চায়, হয়তো ওর চেয়েও বেশি করে চায়। কিন্তু তা প্রকাশিত নয়।
______________________________________

এক মাস পর,

আজ মৃত্তিকাকে পাত্রপক্ষ থেকে দেখতে আসবে। উত্তরা মামার বাসায় চলে এসেছে প্রায় ২৫ দিন আগে। মামার অফিসের কোনো এক ব্যক্তির ছেলেই পাত্র। মৃত্তিকা ছেলের ছবি দেখেছে, নাম কলরব।

সন্ধ্যা সাতটায় এসেছে ওরা। মৃত্তিকাকে মোটামুটি একটা সাজ দিয়েছে ওর মামাতো বোন সুরভি। মৃত্তিকা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে নিলো।

“আপু।”
আলতো কন্ঠে সুরভিকে ডাকলো মৃত্তিকা।

“জি, বলো।”

মৃত্তিকা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“বাবা মায়ের বিষয়ে কি বলেছে?”
“দুজনকেই মৃ°ত বলেছে।”

মৃত্তিকার ভিতরটা মো°চ°ড় দিয়ে উঠলো। সুরভি সোজা কথার মানুষ। যা বলছে ঠা°স ঠা°স করে বলবে। অর্ধেক কথা পেটে আর বাকিটা মুখে রাখবে না। পুরোটাই এক চো°টে বলে দেয়।

মৃত্তিকা আর কিছু বলল না। ওর বাবা জেনে ঠিক কি কি করবে তা ও বুঝতে পারছে না।

পাত্রের সামনে নেয়া হলো। কলরব বেশ সুদর্শন যুবক, প্রথম দেখায় যে কারো পছন্দ হতে বাধ্য৷ বয়সটা প্রায় মৃত্তিকার সমানই হবে। কলরবের সাথে ওর মা, বাবা, ছোট বোন এসেছে

মৃত্তিকাকে দেখে মুচকি হাসলো ওরা। বড়দের কথাবার্তা চলল অনেকক্ষণ।
______________________________________

কয়েকদিন ধরেই আহনাফ কলেজের কোনো একটা বিষয় নিয়ে কাজ করছে, বিজ্ঞান মেলার কোনো এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় অনলাইনে ছাত্রছাত্রীদের সাথে একটা সেশন করে। আজও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না।

স্মার্ট বোর্ডে ক্লাস নিচ্ছে সে। পেইজ পরিবর্তন করে নতুন পেইজ যেতেই দেখে কালো পেইজে লাল, সাদা, নীলে একটা ইংরেজি বাক্য লেখা,
“My handsome Physics sir, Ahnaf Foyez, I’m waiting for your call.”

আহনাফ বাক্যটি দেখে দ্রুত বোর্ড পরিষ্কার করে। এ যে সারাহ্-র কাজ তা সে ভালোই বুঝেছে। দিনদিন মেয়েটার সাহস বাড়ছে। আহনাফকে ভয় পায় না। লজ্জায় নু°ই°য়ে গেলেও ভ°য় তাকে কাবু করে না।

আহনাফ ক্যামেরা থেকে দূরে সরে যায়। সারাহ্ এখানে নেই, হয়তো ড্রইংরুমে টিভি দেখছে। ছাত্রছাত্রীরা সবাই মোটামুটি স্যারকে ডাকাডাকি শুরু করেছে। অনেকে হয়তো স্ক্রিনশট নিয়ে নিয়েছে আর কাল সেটা নিয়ে কলেজে আলোচনা চলবে।

আহনাফ ড্রইংরুমে গিয়ে সারাহ্-কে বলে,
“ক্লাস শেষে তোমার হচ্ছে সারাহ্। ফাজলামো বেশি শুরু করেছো।”
“আমি আবার কি করলাম?”
সারাহ্ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে।

“বোর্ডে ওসব কে লিখেছে?”
ভ্রূ উঁচিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে আহনাফ।

সারাহ্ মুচকি হেসে বলে,
“পরশু লিখেছিলাম, কারণ আপনি আমাকে নিজে থেকে কল করেন না। (একটু থেমে) মাত্র আজকে এটা দেখেছেন?”

আহনাফ দাঁত কি°ড়°মি°ড়িয়ে বলে,
“বাড়াবাড়ি করেছো।”
______________________________________

কলরবের পরিবার মৃত্তিকাকে পছন্দ করেছে। না করার কোনো কারণ নেই। মেয়ে ভালো, শিক্ষিত, সুশীল। ছেলে লন্ডনে পড়াশুনা করেছে, মেয়ে ইতালিতে। ভালো মানাবে ওদের৷ আংটি পড়িয়ে গেল ওরা। প্রায় ১৫ দিন পর বিয়ের তারিখ নির্ধারিত হয়ে গেছে।

মৃত্তিকা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। রাতের আকাশের কয়েকগুচ্ছ তারার পানে তাকিয়ে আছে সে। চাঁদ যে নেই, মেঘের আড়ালে লুকিয়ে গিয়ে ওর সাথে লুকোচুরি খেলছে৷ ইমতিয়াজের সাথে দেখা হয়নি গত একমাস, ফোনেও কথা হয়নি।

একটা বে°সু°রো বী°ণা বাজতে লাগলো ওর মনে। দীর্ঘশ্বাসগুলো হতে লাগলো সেই সুর। নয়নের অশ্রুধারা বে°ই°মা°নি করলো, গড়িয়ে পড়লো না আজ। হৃদয়ে বাজতে থাকা লাবডাবের মাঝে একটা নাম উচ্চারিত হলো,
“ইমতিয়াজ।”

চলবে….

(পর্ব ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত, পুরোদিন অনেক ব্যস্ততায় কে°টেছে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here