এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায় #পর্বসংখ্যা_১৭

0
369

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_১৭

কলিং বেল বাজতেই দরজা খুলে দিলেন নিলুফার নাজিয়া। আর ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই তাকে জাপটে ধরলো কেউ। উচ্ছাসে চেঁচিয়ে উঠলো প্রায়,
— “আসসালামু আলাইকুম, আম্মি।”
ছেলেকে দেখে ভীষণ রকমের খুশি হলেন নাজিয়া। একটু অবাকও। কারণ ছেলে যে ফিরবে সে কথা আগে জানায় নি তাকে। ওর তো আসবার কথা ছিল আগামীকাল। আজ হঠাৎ?
মাকে ছেড়ে চমৎকার হাসলো নিখিল,
— “আম্মি তুমি কিন্তু এ-কয়দিনে আরও বেশি সুন্দর হয়ে গেছ! সুইট লাগছে খুব!”
— “আর তুমি? তুমি কিন্তু শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছ, নিখিল। তোমার বন্ধুর বাড়িতে বোধ হয় তোমায় খেতেই দেয় নি!”
নাজিয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর। নিখিল হেসে বললো,
— “চোখে ভুলভাল দেখছ। আমার শরীর ঠিকই আছে। বরং বলো, আমি মোটা হয়েছি। সৌভিকের বোনের বিয়ে ছিল না? কব্জি ডুবিয়ে খেয়েছি। ওজন বেড়ে গেছে আমার!”
জুতো খুলে ব্যাগ-পত্র নিয়ে ভেতরে ঢুকলো নিখিল। তারপর টুকটাক কথা হলো। নাজিয়া ছেলের খাবার দিতে চাইলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
— “যা হাতমুখ ধুয়ে নে। তারপর ডাইন ইনে আয়। কি খাবি বলে যা। ভাত রাঁধি নি। রুটি করেছিলাম আমার জন্য। তুই আসবি জানতাম না তো…”
— “কোনো সমস্যা নেই, আম্মি। আমি এখন কিছু খাবো না। বাস থেকে নেমেই হোটেলে খেয়েছিলাম। এখন ঘুমাবো।”
বলেই নিজের ঘরের দিকে এগোয়। নাজিয়া ছেলের পিছু পিছু ছোটেন,
— “সে কি রে? হোটেলে খেলেই হলো নাকি? কিসব বাসি তেল-তুল দিয়ে রাঁধে ওরা…”
— “একদিন না খেলে কিচ্ছু হয় না। আমার ঘুম পাচ্ছে। গেলাম!”
ব্যস! আর কোনো কিছু না বলেই ঘরে চলে গেল। নাজিয়া বেশি জোর করলেন না। ছেলেকে কখনো কোনকিছুতে তিনি জোর করেন না। তাতে একটু স্বাধীনচেতা ধাঁচের হয়েছে বটে, কিন্তু সেচ্ছাচারি নয়। বোধশক্তি যথেষ্ট আছে!
ফ্রেশ হয়ে এসেই নিখিলের সর্বপ্রথম যে নামটি মনে এলো তা হলো, ‘চারুলতা’। চট করে পকেট থেকে ফোনটা বের করলো কল করবার জন্য। কিন্তু কন্ট্যাক্টসে গিয়ে নাম খুঁজতে গিয়েই মনে হলো, সে তো চারুর নাম্বারটা নিতেই ভুলে গিয়েছে! চারু তার হাতে লিখে দিয়েছিল নাম্বার। সে চেয়েছিলে, ঘরে ফিরে ফোনে সেভ করতে। কিন্তু করে নি! কোনো কারণে ভুলে গিয়েছে!
সেই মুহূর্তেই ছটফটানি শুরু হয়ে গেল বেচারার। মন উচাটন করতে লাগলো। এটা কেমন হলো? কি করবে ও এখন? চারুর সঙ্গে যোগাযোগ করবে কি করে? কইবে কি করে মনের কথা? ওর নাম্বারটাই যে নেই!
___

বিয়ের আগে সে নিজের বাড়ি নিয়ে যথেষ্ট বিরক্ত ছিল অনুলেখা। বাড়ির মানুষগুলো তাকে ঠিক পছন্দ করত না সে জানতো। আর করবেই বা কেন? তাদের ভালোবাসার ‘চারুলতা জাফরিন’ আছে না? তাকে ছেড়ে ওকে নিয়ে ভাবার সময় কারো আছে? তাই ওকে যখন কেউ ভালোবাসে নি, ওও কাউকে ভালোবাসে নি। ভাবতেই মনটা খারাপ হলো। অসহ্য হিংসেই বুক জ্বলতে থাকলো!
চারু! চারু তার সব কেড়ে নিয়েছে। সবার অ্যাটেনশন, অ্যাপ্রিশিয়েশন — সব! লেখাপড়া থেকে শুরু করে প্রতিটি বিষয়ে ওর চেয়ে এগিয়ে ছিল। কোনোকিছুতে চারুর চেয়ে ভালো করে কারো নজর কাড়তে পারে নি অনু। কোত্থাও না। না পড়ালেখায়, না নাচে – গানে! এমনকি জীবনে প্রথম কোনো পুরুষের প্রতি ভালোলাগাতেও চারুকে টেক্কা দিতে পারে নি সে!
ক্লাস নাইনে পাড়ার এক বড় ভাইকে দারুণ মনে ধরেছিল অনুলেখার। পড়ালেখায় ভালো, পাড়ার অনুষ্ঠানে দারুণ গান গাইয়ে, লোকজনের অ্যাটেনশন পাওয়া স্মার্ট, হ্যান্ডসাম, সুপুরুষ ছেলে। কিশোরী বয়সের প্রথম আবেগ ওর! মনে মনে তাকে নিয়ে ভাবতে গেলেও শরীর শিহরিত হয়। ইসস, কি লজ্জাময় সুখের অনুভুতি! কিন্তু মুখে কি করে বলবে তাকে? তবুও বলতে চেয়েছিল। ম্যাট্রিক পাশ করে প্রেমের প্রস্তাব দিবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঠিক তখনই তাকেও কেড়ে নিলো চারু!
ফট করে একদিন রাস্তায় দাড়িয়ে দেখলো, কলেজপড়ুয়া চারুকে প্রপোজ করছে সেই ছেলে! রাগে – দুঃখে – অপমানে গা জ্বলে যাচ্ছিল ওর। মন ভাঙার অনুভূতির সঙ্গে বড় বোনের প্রতি অদম্য হিংসেয় জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হচ্ছিল হৃদয়!
এভাবেই ছোট থেকে সবকিছুতে চারু হয়েছিল তার থেকে শ্রেষ্ঠ। পেয়েছিল যা যা ওর পাবার কথা! ওর আকাঙ্ক্ষিত!
বংশের বড় মেয়ে; তার উপর আচার – আচরণে মার্জিত, বিনম্র এবং দারুণ মেধাবী — তাকে তো সবাই ভালোবাসবেই! কিন্তু এসব ভাবার সময় কিংবা ইচ্ছে ছিল না অনুর। সে শুধু তাই জানত, বুঝত যা চোখের সম্মুখে দেখতে পেত। দেখতে পেত, বাড়িতে তার দাম নেই। তার কথার মূল্য নেই, প্রশংসা নেই। অতএব, ক্রমশই বাড়ির প্রতি অনাগ্রহ বাড়ছিল। বাড়ির মানুষগুলোর প্রতি বিতৃষ্ণা বাড়ছিল। বিশেষ করে ওর রোষানলে পুড়ছিল চারু। এতটাই রোষ ওর প্রতি যে কখনো কখনো অতিরিক্ত ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে প্রকাশ করেই ফেলতো। বিনিময়ে বাড়ির লোকেদের বকা জুটত কপালে, আরও ক্ষেপে গিয়ে বেশি করে হিংসা করত চারুকে!
স্বভাবে উগ্র, রগচটা মেয়েটা ধীরে ধীরে হয়ে গেল ভীষণ রকমের স্বেচ্ছাচারী, উড়নচন্ডী। কারো কথা শুনবে না, পরোয়া করবে না কোনো বাঁধা!

শ্বশুরবাড়িতে এসেও এই অভ্যাস অব্যাহত রইলো ওর। এতদিনের বহুল প্রতীক্ষিত মুক্তি পেয়ে আরও বেশি বিগড়ে গেল অনু। ভাবলো, এখানে চারু নেই। ওর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। সে এখানে যা খুশি তাই করতে পারে, যা খুশি তাই বলতে পারে! আনন্দে আত্মহারা হলো। নিজের এই নতুন সংসারকে নিয়ে তার গর্ব, অহংকারের সীমা রইল না!
কিন্তু অচিরেই ওর ভুল ভাঙলো ওর। বালুর প্রাসাদের মতো চুরচুর করে ওর চোখের সামনেই একে একে ভেঙে পড়তে লাগলো ওর সকল চিন্তা – চেতনা। সাতদিনেই অতিষ্ট হয়ে উঠলো অনু। সংসার জীবনে তিক্ততা ঢুকে গেল শুধুমাত্র, একটি মানুষের কারণে!
সে মাহিয়া!
বাড়ির বড় বধূ সে। ওর চেয়ে আগে এসেছে এই সংসারে। তাই বয়স, সম্পর্ক আর অভিজ্ঞতা — তিন ক্ষেত্রেই ওর চেয়ে বড়। সুতরাং, অনুর উপরে খবরদারী তো চলবেই!
কিন্তু এটাই ঠিক অসহ্য হয়ে উঠলো ওর কাছে। এক গ্যাড়াকল থেকে বেরোতে না বেরোতেই অন্য জায়গায় এসে ফাঁসলো? বাড়িতে চারুর সবকিছুতে দখলদারি, এখানে আবার এই মেয়ের? এতসব মানবে কেন অনু?
আর অত্যাচারেরও যেন শেষ নেই। সে রান্না-বান্না অতটা পারে না। সেসব জেনেও রোজ রোজ রান্না নিয়ে খোঁটা। অন্য কাজে দখলদারি দেখানো, অনু-মাহাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে পর্যন্ত মাঝে মাঝে কথা বলে! সাহস কত!
কিন্তু মাহিয়াকে চেয়েও কিছু বলতে পারে না ও। চারুর মতো অতটা শান্ত তো নয় এই মেয়ে, আর নাই ওর মায়ের পেটের বোন। যে ছাড় দিবে। অনু কিছু বলতে এলে পাল্টা যুক্তি নিয়ে তেড়ে আসতে দেরি হবে না!

ঘরে বসে এমন কথা ভাবছিল অনু। তখনই কাজের মেয়েটা দরজা নক করলো। ভেতরে আসবার অনুমতি দিলেই এসে বলে গেল,
— “বড় ভাবী, আপনারে বিকেলের নাশতা বানাইতে বলছে। তার শরীলডা ভালা না। শুইয়া থাকবো। কইছে, আপনি য্যান চা – নাশতা কইরা আম্মা আর তার ঘরে পাঠায় দ্যান।”
বলেই দাড়ালো না ফুলির মা। চটপট পায়ে চলে গেল। অনু নিশ্চিত জানে, ও এখন গিয়ে কি করবে। টিভি ছেড়ে সিরিয়াল দেখতে বসবে। অন্যান্য দিন ওর পরাণের বড় ভাবীর সাথে মিলেমিশে সিরিয়াল দেখে, আজ তিনি নেই। অতএব, রাজত্ব তার একার দখলে!
সুখ তো এ-বাড়িতে এই দুজনের। একজন গর্ভ ধারণ করেছেন এই সুখে বাঁচছেন না। দুদিন পর পর ঢং করছেন, রান্না কিংবা কাজের সময় হলেই ‘শরীর ভালো না’র বাহানা! অন্যজন তার খেদমতদারিতে ব্যস্ত বলে কেটে পড়ার ধান্দা। কিছু বলেও লাভ নেই। ফট করে ‘কাজ ছাইড়া দিমু!’ বলে উড়াল দিতে উনি উতলা। আর এদিকে অনু? জ্বালার শেষ নেই তার!
অগত্যা বিছানা থেকে নামতে নামতে মনে মনে ভেংচি কাটলো অনু,
— “দেখাচ্ছি, তোমায়। খুব ঢং না? ঢং যদি বের না করেছি— ক’টা দিন যেতে দাও। সংসারটা গুছিয়ে নেই একটু! তোমারও হচ্ছে! ডাlইlনী কোথাকার!”

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
সকল পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=122111588804106938&id=61553208165829&mibextid=2JQ9oc

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here