এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায় #পর্বসংখ্যা_১৬

0
202

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_১৬

চারু হতচকিত হয়ে তাকায়। ফ্যাল ফ্যাল নয়নে চেয়ে রয় অনিমেষ। নিখিল সময় নেয় না। মনের কথা সব ব্যক্ত করতে হড়বড় করে বলে,

— “আমি জানি, আপনি কি অজুহাত দেখাবেন। আপনার আগে বিয়ে হয়েছিল; ডিভোর্স হয়েছে। আপনার কখনো বাচ্চা হবে না। এজন্যে আমি আপনা কে মানবো কি-না; আমার পরিবার—ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু বিশ্বাস করুন। এগুলোতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমার কাছে আপনার অতীত গুরুত্বপূর্ণ নয়, আর নয়ই বাচ্চা হওয়া না হওয়ার ব্যাপার। আমার নিজের ক্ষেত্রেও বাচ্চা না হওয়ার বিষয়টা ঘটতে পারতো। নিজের ক্ষেত্রে হলে যেটা আমাকে মানতে বাধ্য, সেখানে ভালোবাসার মানুষের ক্ষেত্রে হলে কেন মানব না? আপনি ইচ্ছে করে নিশ্চয়, নিজের অক্ষমতা সৃষ্টি করেন নি?”

বলেই নিশ্বাস ছেড়ে চারুর দিকে তাকালো। মেয়েটার জল টলমলে আঁখি ওর বুকে চিনচিনে ব্যথার অনুভূতি দিলো। একটু দম নিয়ে বললো,

— “আর রইলো পরিবার। আমার বাবা নেই। মাকে নিয়েই ছোট্ট সংসার। সেখানে আমরা দু’জনেই দু’জনের ভালো বন্ধু। দুজন দুজনকে প্রাধান্য দেই। তাই আমার মনে হয় না, আমার ভালোবাসাকে অযোগ্য ভাবার কোনো কারণই মা’র আছে! তিনি তা করবেনও না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”

চারু মলিন গলায় শুধায়,

— “আর সমাজ? আত্মীয়-স্বজন? তারা বাঁধা দিবে না?”
নিখিল যেন আশার আলো পেল ওকে মুখ খুলতে দেখে। খানিক হেসে বললো,

— “আমাদের সমাজের খারাপ দিক কি জানেন? এখানে নিন্দুকের সংখ্যা বেশি। আর এই নিন্দুকেরা কখনো কারো ভালো দেখতে পারে না। ভালোকে নিরুৎসাহিত করাই এদের অভ্যাস। ওদের আমি পাত্তা দেই না। আর আত্মীয়-স্বজনের কথা বলছেন? ওরা হয় তো, সুযোগ পেলে একটু – আধটু বলবার চেষ্টা করবে। কিন্তু ভাববেন না, ও আপনার শাশুড়িই সামলে নেবে। তার বৌমাকে কিছু বলে পার পাবে নাকি?”

হাসলো নিখিল। সেই সঙ্গে ঠোঁটের কোণটা একটু প্রসারিত হলো চারুরও। নিঃশব্দ হাসির তালে দু’ ফোঁটা জল কখন যে গড়ালো কপোল বেয়ে সে টের পেল না। কিন্তু নজর এড়ালো না নিখিলের। এই প্রথম সাহস করে ওর অশ্রু মুছে দিতে হাত বাড়ালো নিখিল। ডান হাত দিয়ে ওর চোখের কোলের সবটুকু জল কণা শুষে নিয়ে বললো,

— “আপনাকে আগে একটা কথা মনে রাখতে বলছিলাম, রেখেছেন? চাঁদের মুখে কান্না মানায় না। তাকে উজ্জ্বল হাসিতেই শোভা পায়। আপনি চাঁদ চারুলতা; আমি আপনাকে আমি পাই বা না পাই, কিন্তু আপনার চোখে অশ্রু দেখার দুর্ভাগ্য আমি চাই না। কখনো কাঁদবেন না!”

চারু না চাইতেও ফুঁপিয়ে উঠলো,

— “কেউ কি শখ করে কাঁদতে চায়?”

— “চায় না, জানি। জীবনে হাসি – কান্না সবই থাকে। কিন্তু আমি চেষ্টা করবো, আপনার জীবনে সেই দুঃসময় গুলো না আসুক। অনেক তো সয়েছেন! আর না—”

বলেই হাতটা বাড়িয়ে দিলো ওর দিকে; ছোট্ট করে বললো,

— “বাকিজীবনটা আমার হাত ধরে থাকবেন, চারুলতা? প্লিজ?”

ওর সেই নরম গলার ছোট্ট আবদারটা এতো বেশি আদুরে ঠেকলো চারুর কাছে! একটু-একটু করে কোমল হাতটা এগিয়ে এলো নিখিলের পোক্ত হাতের তালুতে। মুঠো করে সেই কোমল হাতের পিঠে চুমু এঁকে দিলো সে! অস্পষ্ট স্বরে আওড়ালো,

— “ভালোবাসি, চারু। অনেক বেশিই ভালোবাসি!”

পুরুষালি সৌষ্ঠবপূর্ণ অধরের উষ্ণ ছোঁয়ায় আবেশে চোখ বুঁজলো চারু। অনুভূতির জোয়ারে ভেসে গেল সিক্তমন। হৃদ পিঞ্জিরায় ডানা ঝাপটালো বিহঙ্গের দল। কানে কানে ফিসফিসিয়ে গেল প্রজাপতিরা,

— “অবশেষে তোমার জীবনেও ভালোবাসা এলো, চারুলতা!”

*****

সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় নামতেই হাসিতে ফেটে পড়লো দুই ভাই। মুখ হাত চাপা দিয়ে ‘হা হা’ করে পেট থেকে উৎলে আসা হাসিটা আটকানোর ভঙ্গি করলেও হলো না। প্রাণ খুলে হাসতে লাগলো ওরা। এতদিন দুষ্টুমি করে, অন্যকে জব্দ করে তো প্রচুর হেসেছে; কিন্তু আজ— তাদের প্রিয় বোন বড়’পার জন্যে খুশিতে তৃপ্তি নিয়ে হাসলো। উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলো টিংকু,

— “আমি বলেছিলাম! বলেছিলাম তোকে! দেখলিই?”

— “হুঁ।”

মাথা নাড়ে রিংকু। ও আবার চেঁচায়,

— “আমি জানতাম। আগেই টের পেয়েছিলাম। নিখিল ভাইয়ের পেটে খিচুড়ি পাকছে! ও যেভাবে বড়’পার দিকে তাকাতো না—”

— “একটু-একটু সন্দেহ তো আমারও জাগত। কখনো সেভাবে খতিয়ে দেখি নি।”

সঙ্গে সঙ্গেই হৈহৈ করে উঠলো টিংকু,

— “ওও? এখন সন্দেহ তোমারও হতো, না? মিথ্যেবাদী! আমি শুরু থেকেই তোকে বলতাম, তুইই বিরুদ্ধে যেতি। বলতি, ‘না-আ-আ! নিখিল ভাইয়া সরল মানুষ। এসবের ধান্দা নেই।’ ইসস, যেন কতো সাধু?”

শেষের অংশে ভেংচিয়ে বললো। রিংকু জবাব না দিয়ে হাসলো। নীরবে মাথা পেতে নিলো দোষ। তাই দেখে প্রসন্ন হলো সহোদর,

— “শোন, বড় বড় সাধুদেরও ধ্যান ভাঙে সুন্দরী নারীর সাহচর্যে এসে। ঋষিত্ব ছেড়ে সংসারী হয় কেবল নারীর প্রেমের টানে। আর সেখানে বড়’পার মতো এতো প্রীটি একটা মেয়েকে দেখে নিখিল ভাই পিছলাবে না? এও হয়! আমাদের আপা কত্তো সুইট!”

বোনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলো দুষ্টু দুই জমজও। হবু দুলাভাইকে নিয়েও মন্তব্য করলো,

— “নিখিল ভাইও কিন্তু হ্যান্ডসাম। বলিউড হিরোর মতো ড্যাশিং লুক ওনার, না?”

টিংকু দাম্ভিক হাসলো। কলার ঝাঁকিয়ে বললো,

— “দেখতে হবে না, দুলাভাইটা কার?”

ভাইয়ের অহেতুক দর্পে রাগ করলো না রিংকু। একটু ভেবে বললো,

— “তবে যাই বলিস, মাহতাব ভাইয়ের থেকে নিখিল ভাই অনেক ম্যাচিউর। অনেক ভালো। আপাকে ভালো রাখবে উনি, তাই না?”

মাহতাবের নাম শুনতেই মুখ কুঁচকে ফেললো ও। ঠোঁট উল্টে তীব্র অবজ্ঞাভরে উচ্চারণ করলো,

— “ওই ক্ষ্যাতের নাম নিস না তো। অশিক্ষিত একটা! নাম শুনলেও আপার সুখে নজর লাগবে। ফালতু লোক!”

— “ঠিকই বলছিস। ওর নাম নিলেও কু-নজর লাগবে আপার। কতো খুশির দিন ওর!”

— “তারচে’ চল, পার্টি করি। হোল নাইট মাস্তি!”

বলেই কাঁধ চাপড়ে দিল ভাইয়ের। রিংকু একঝলক হাবার মতো চেয়ে,
‘কিন্তু পড়া —’ প্রসঙ্গ তুলতে চাইলেও, জমজের যুক্তির উপর যুক্তিতে ধোপে টিকলো না কিছু। আনন্দে আত্মহারা হয়ে দু’ ভাই জড়িয়ে ধরলো দুজনকে! তারপর হাঁটা দিলো নিজেদের ঘরের দিকে।

****
অন্ধকার কক্ষে একলা বসে সৌভিক। সন্ধ্যা নেমেছে সেই কখন! এখনো আলো জ্বালে নি। জানালাও খুলে রাখা আলগোছে। অক্টোবরের হিম ধরানো মাতাল হাওয়ায় পর্দা উড়ছে সবেগে, হাতছানি দিয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে ওকে। তবুও তার কোনো হেলদোল নেই!

বাগানের আলোয় দেখা আবছা ঘরে চেয়ে দেখলে বোঝা যায়, ছেলেটা স্তব্ধ মূর্তির ন্যায় নিশ্চুপ বসে। যার চোখের কার্নিশে চিকচিক করছে নোনা জলবিন্দু!

কিয়ৎক্ষণ পর দরজা খুলবার আওয়াজ হলো। বাতি জ্বালিয়ে নিখিল বললো,

— “কি রে, ঘুটঘুটে অন্ধকারে কি করছিস? জানালাও বন্ধ করিস নি? মশা এসে তো ভরে গেল—–”

বলেই ওর দিকে তাকালো। বিমূঢ় সৌভিক হঠাৎ যান্ত্রিক ভঙ্গিতে মুখ ফিরালো। ওর প্রশ্নকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কেমন অদ্ভুত গলায় বললো,

— “চারু এতো সহজেই রাজি হয়ে গেল, তাই না? কি জাদু করলি ওকে?”

তাচ্ছিল্য নয়, উপহাসও নয়। বরং নিদারুণ অসহায়ত্ব মিশে। বন্ধুর এমন বিধ্বস্ত দশা দেখে নিখিল হতবাক!

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here