এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায় #পর্বসংখ্যা_১০

0
391

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_১০

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে বেরিয়েছে নিখিল। হেমন্তের মিঠে রোদে একা একা বাগানে বেড়াতে ভালোই লাগছে। বাগানের ভেতরের দিকে গাছপালা বেশ ঘন। কিছুআম, কাঁঠালের গাছ আছে ওদিকটায়। সম্ভবত বড় গাছগুলোর জন্যই এদিকে অতো যত্ন নেয় না মালি। অযত্নে বড় হওয়া ঘাসের ডগায় স্বচ্ছ শিশির বিন্দু। পাতলা চটিকে তোয়াক্কা না করে সেই শিশিরেরা ভিজিয়ে দিচ্ছে ওর পায়ের পাতাকে। প্যাঁচ-প্যাঁচে চটি পরেও বিরক্ত হচ্ছে না সে। বরং অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে। চারিদিকে শীতল আবহাওয়া, হিম হিম বাতাসে শ্বাস নিতে অন্যরকম একটা অনুভূতি জাগছে। সতেজ লাগছে শরীরটা, নির্মল – স্বচ্ছ – সুন্দর।

হাঁটা শেষ করে ফেরার পথেই দেখা হয়ে গেল সৌভিকের মেজো ফুপুর সঙ্গে। মেজো ফুপুর পরিবার তৈরি হয়ে বেরিয়েছে। যেন কোথাও যাচ্ছেন। সঙ্গে লাগেজ দেখেই বুঝলো চলে যাবার আয়োজন। ফুপুকে এগিয়ে দিতে বাড়ির প্রায় সব মানুষই এসেছেন যেন। তিন জা’কেই দেখা যাচ্ছে সামনে। ননদের সঙ্গে বিদায়ী আলাপ করতে ব্যস্ত তারা। মেজো ফুপুর চোখে জল। তিনি জল মাখা চোখেই সকলের সঙ্গে মত বিনিময় করছেন। দূরে দাড়িয়ে থেকেই সবটা দেখলো নিখিল। পরিবারের আবেগঘন মুহূর্তে তার মত বহিরাগতের থাকা উচিৎ হবে কি-না ভেবে দ্বিধায় পড়লো। শুনেছে, সৌভিকের এই ফুপু নাকি প্রবাসী। বছরে, দু’ বছরে দেশে আসেন। ভাতিজির বিয়ে উপলক্ষ্যে দু’ বছর পর এবার এসেছিলেন। তার চলে যাওয়ার সময়টা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তাই দূর থেকেই সবার চেহারার অভিব্যক্তি দেখতে লাগলো সে।
ভীড় এগিয়ে এলো বাড়ির মূল ফটকের দিকে। দলের অর্ধেক বিদায় পর্ব সেরে ওখানেই দাড়িয়ে রইলেন। আর একদল এগিয়ে এলো বাড়ির চৌহদ্দি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে। আনমনে দেখতে দেখতেই, ভীড়ের মাঝখানে চারুকে আবিষ্কার করলো নিখিল। মেজো ফুপুকে একহাতে জড়িয়ে আছে মেয়েটা। তার চোখভরা জল। কোমল মুখখানিতে ঈষৎ লালচে আভাস, সম্ভবত কান্নার দরুণই। লোকে বলে সুন্দরীদের কাঁদলে নাকি কুশ্রী লাগে। অথচ চারুর এই কান্নাভেজা পেলব-কমনীয় চেহারা দেখে পুনর্বার প্রেমে পড়লো নিখিল। প্রথম দেখার অনুভূতি অন্তরে তরঙ্গ তুললো তার। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়লো শিহরণ। ঠোঁট নাড়িয়ে অস্ফুট স্বরে আবৃত্তি করলো রবিঠাকুরের সেই চিরচেনা কবিতার চরণ,

— “কমলফুল বিমল শেজখানি,
নিলীন তাহে কোমল তনুলতা।
মুখের পানে চাহিনু অনিমেষে,
বাজিল বুকে সুখের মত ব্যথা।”

হ্যাঁ। ওই মায়াভরা মুখের দিকে চেয়ে নিখিলের বুকে সুখের ব্যথাই বাজলো। কানে বাজলো গতরাতে চারু সম্বন্ধে সৌভিকের বলা সেই কথাগুলো। চারু ডিভোর্সী মেয়ে। তার বিয়ে হয়েছিল, সংসার হয় নি তার অক্ষম নারীস্বত্ত্বার কারণে। কথাগুলো মনে পড়তেই বুকের ভেতর বাজা সুখের আবেশটুকু অসহ্য যন্ত্রণায় পরিণত হলো ওর। মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো, একটি প্রশ্নের সমাধানে!
‘কি করবো আমি? কি করা উচিৎ?’

*****

বিয়ে – বৌভাতের আয়োজনের পসরা শেষ। আমন্ত্রিত অতিথিদের অধিকাংশই বিদায় নিয়েছেন। আপাদত বাড়িতে নিজের মানুষ ছাড়া আর কেউ নেই। যদিও নতুন সংসারে এসে একমাত্র স্বামীটিকে ছাড়া আর কাউকেই ওর আপন মনে হচ্ছে না; তথাপি অনু মানিয়ে নেবার চেষ্টা করলো।
নিজের বাড়িতে থাকাকালীন সে রাজকুমারীর হালেই থাকতো। চাল-চলন ছিল নবাবী ঢংয়ের। জীবনে কখনো ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠতে পারে নি; রান্নাঘরে মায়েদের সাহায্য করা তো দূর কি বাত্! সেই অভ্যাসগুলোর জন্যই আজও সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। নতুন বৌ, নতুন সংসার — তেমন করে কেউ কিছু বলে নি। কিন্তু রান্নাঘরে কাজ করতে গিয়ে বড় জা ঠিকই ঠেস দিলো,
— “কপাল তোমারই, ভাই। প্রেম করে বিয়ে করেছ। জামাইবাড়ির সবাই চেনা-পরিচিত। দেরি করে উঠলেও কিছু বলার নেই। সুখ, সুখ!”
অনু অপ্রস্তুত হাসলো,
— “না, আসলে— হয়েছে কি—”
ওকে কিছু বলতে না দিয়েই মাহিয়া বললো,
— “থাক, থাক। আর বলতে হবে না। ব্যাপার বুঝি তো। দিন এখন তোমাদের। আর আমাদের সময়! আহ্, কাউকেই চিনি না। কিছুই জানি না। দেরি করে উঠলে মানুষ কি বলবে, শরমেই রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছিল। তুমি তো সেই হিসেবে বহুৎ আরামেই আছো!”
অনু কোনো প্রত্যুত্তর না করে চুপ করে রইলো। এই কথাগুলো যদি তার বাড়িতে দাড়িয়ে কেউ তার উদ্দেশ্যে বলতো এতক্ষণে কি কুরুক্ষেত্র বেঁধে যেত আল্লাহ্ মালুম! ত্যাড়া করে উত্তর তো দিতোই সঙ্গে, খোঁচা দেয়া মানুষটির সাথে চুলোচুলি করতেও পিছপা হতো না সে। কিন্তু এখন কিছু বললো না। কারণ এটা তার নিজের বাড়ি নয়। শ্বশুরবাড়ি। আর এই হেসে হেসে খোঁচা দেয়া মানুষটি সম্পর্কে তার বড় জা, মাহিয়া। মাহতাব ভাইয়ের দ্বিতীয় স্ত্রী। অনুকে ডিভোর্স দেবার পর যাকে বিয়ে করে বউ করে সে।

নাশতা বানানোর ঝক্কিটা তেমন পোহাতে হলো না। ভাজি-ভুজি যা করবার কাজের মেয়ের সহায়তায় মাহিয়াই করলো। গতকালের বেঁচে যাওয়া গোশত গরম করলো। কিন্তু ঝামেলা শুরু হলো অনুর রুটি বেলতে গিয়ে!
অনুর ধারণা ছিল রুটি বেলা কোনো কঠিন কাজ না। ছোট থেকে দেখে এসেছে, মা – চাচীরা কতো সহজে ময়দার ডো’র উপর বেলনা ঘুরাতো, আর ফটাফট গোল গোল রুটি তৈরি হয়ে যেত। এতো সহজ কাজ-কারবার আবার হাতে-কলমে করবার কি আছে? চারুপা, ঋতু শুধু শুধু রান্নাঘরে সময় নষ্ট করে এগুলো শেখে। এখানে শিখবার মত আছে কি?
কিন্তু আজ এই এতদিন পর নিজের শ্বশুরবাড়ি এসে রুটি বানাতে গিয়ে অনুর মনে হলো, না, সে যতটা ভেবেছিল কাজটা মোটেও ততটা সহজ নয়। রুটির ডোর উপর বেলন চালালেই আপনাআপনি গোল হয়ে যায় না! বরং বিচিত্র পৃথিবীর বিচিত্র সব দেশের মানচিত্র বেরিয়ে আসে!
আধঘন্টা ধরে একটাই রুটি বেলে যাচ্ছে, তবুও সেটা গোল হবার নামই নিচ্ছে না। কখনো ত্যাড়া-ব্যাকা হচ্ছে, তো কখনো বেশি বলে গিয়ে মাঝখান থেকে ছিঁড়ে যাচ্ছে। অথচ একটু আগেই সে দর্প ভরে উচ্চারণ করেছে,
— “রুটি বেলা কোনো কাজ হলো? দাও, করে দিচ্ছি।”
কিন্তু এখন? মাহিয়া ভাবী আর কাজের মেয়েটা পাশে দাড়িয়ে মিটমিট করে হেসে যাচ্ছে। একেকবার ফোড়ন কাটতেও ভুলছে না!
— “ভাবী দেখি, বিরাট কারিগর! ও আল্লাহ্, আপনে তো রুটি না, আস্ত বাংলাদেশখানই বানায় ফেলছেন! চমৎকার!”
কাজের মেয়েটার কথা শুনে রাগে গা জ্বলে গেল অনুর। চাপা ক্ষোভে ফুঁসে উঠলো,
— “তুই তোর কাজ করতে পারছিস না? এখানে নাক গলাতে বলছে কে?”
— “আমারে বকেন ক্যা? আপনি কাম পারেন না, সেইটা স্বীকার করলেই তো হয়!”
ভেংচি কাটলো মেয়েটা। তারপর মাহিয়ার উদ্দেশ্যে বললো,
— “এতদিন ধইরা এই বাড়িত আছি, কেউ কিছু কইলো না। বড় ভাবী তো কতো ভালা। ধমক টুকুও দেয় না। আর আপনে? আইসাই হম্বি-তম্বি? শুনেন, আমি ফুলি। কাউরে ডরাই না। আপনার মেজাজ আপনে রাখেন!”
অনু তেড়ে এসে কিছু বলবে তার আগেই বড় জা মধ্যস্থতা করলো,
— “আহ্ হা, ফুলি। থাম তো। তুই তোর কাজ কর। গিয়ে সবাইকে ডাইন ইনে বসতে বল। নাশতা খাবে।”
সঙ্গে সঙ্গেই ফুলির প্রতিবাদ,
— “এখনো রুটিই গোল করতে পারে নাই, সে আবার খাবার দিবো কি? দেখবেন, আইজ বেলা গড়াইলেও খাবার জুটব না কপালে। শুধু শুধু মানুষগুলান রে ডাইকা কষ্ট দেয়া!”
— “ফুলি?”
মাহিয়া চোখ পাকিয়ে ধমক দিলো বটে, কিন্তু প্রশ্রয় দিয়ে মিটমিট করে হাসলোও। অনুকেও আরেকটু খোঁচালো,
— “কি? রুটি গোল হচ্ছে না? একটা বাটি এনে দেব? সেই সাইজে গোল করে কেটে ফেলো? তাহলে আর কষ্ট করতে হবে না!”
— “দরকার নেই। অনু একাই একশো, সব পারে!”
মাহিয়া যেন ভারী মজা পেল তাতে। মাথা নাড়িয়ে ঘর ছেড়ে বেরোল। তারপরই ওর কানে এলো, ওদের বিশ্রী খ্যাঁক খ্যাঁক করা হাসি! বারুদ জ্বলে উঠলো অনুর মাথায়।
নিজের নাজেহাল দশা দেখে নিজেকে একশোটা একটা গালি দিলো। রাগে চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে ওর। অদূরে দাড়ানো দুই নারীকে, মনে হচ্ছে ডাlকিনী! অসহ্য, এরা এভাবে হাসছে কেন? লোককে দেখাতে হবে তাদের দাঁত কেমন সুন্দর? ‘ইসস, সুন্দর না, বান্দর! কানের নিচে দুইটা লাগালেই দাঁত ক্যালানি বেরোবে!’ — মনে মনে ভেংচি কাটলো। আর ঘুষি মেরে ওদের দাঁত ভাঙবার প্রবল ক্রোধ দমিয়ে চালিয়ে গেল রুটি গোল করবার ব্যর্থ প্রয়াস!

*****

স্কুল থেকে ফিরেই হৈচৈ শুরু করে দিলো রিংকু – টিংকু। ‘স্কুল তাদের ভাল্লাগে না, তাও রোজ মা তাদের ধরে-বেঁধে স্কুলে পাঠায়। পাঠিয়ে লাভটা কি হয়? মিসেরা বকা দেন, স্যারেরা মারেন।’ — এই নিয়ে ওদের অভিযোগ। এসে কাঁধ থেকে ব্যাগটাও নামায় নি, সারা বাড়ীতে চিৎকার-চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে। নিখিলকে নিয়ে সৌভিক একটু বাইরে গিয়েছিল। ফিরে ফ্রেশ হবার জন্য উপরে গেছে নিখিল। সৌভিক সোফায় বসে ভাইদের কাহিনী দেখছে নির্লিপ্ত চোখে!
কিয়ৎক্ষণ পর নিখিল যখন হাতমুখ ধুয়ে, কাপড় বদলে নিচে নেমেছে তখনও হট্টগোল চলমান। টিংকু সমানে বকবক করে যাচ্ছে,
— “আমি মিসকে বললাম, আমার আপার বিয়ে ছিল। স্কুলে আসি নি। এইচ. ডব্লিউ. কি ছিল জানি না। তাও আমাকে মারলো, জানো? বেত দিয়ে হাতের তালুতে ঠাস-ঠাস করে লাগিয়ে দিলো!”
এই পরিস্থিতিতে কার কি বলা উচিৎ? নিখিল ঠিক জানে না। তার এমন বিচ্ছু মার্কা ছোট ভাই নেই। সৌভিকও কিছু না বলে উপরে চলে গেল ফ্রেশ হতে। তাই অগত্যা চুপ করে সোফায় বসে সব দেখতে লাগলো। বাড়ির কেউ কিছু বলছে না। যে যার মতো কাজে ব্যস্ত, ছোট দুই বিচ্ছুর কথা শুনেও যেন শুনছে না। কানের কাছে ভাঙা রেকর্ডে বেজে চলেছে একটানা। স্কুলের টিচারদের দুlর্নাম-বদনাম করছে , ওরা এই করেছে, সেই করেছে — ইত্যাদি।
সৌভিককে আসতে দেখা গেল। ওকে দেখেই রিংকু বললো,
— “ভাইয়া, শুনেছ তুমি! কি করেছেন সুস্মিতা মিস? শুধু শুধু মেরে আমাদের হাতের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে!”
সৌভিক একটু ব্যঙ্গ করেই বললো,
— “কই দেখি? মেlরে ফাটিয়ে দিয়েছে নাকি তালু? না হাড্ডি-গুড্ডি গুঁড়ো করে ফেলেছে?”
টিংকু মুখ লটকে বললো,
— “ভাইয়া! মজা করবে না। মিস সত্যিই খুব জোড়ে মেরেছে! দেখনা, হাত লাল? কীভাবে অত্যাচার করেছে?”
— “ওহ্ হো লে। বাবুটা লে। তা তোমরা কি করেছিলে যে তোমাদের মারলো?”
বিদ্রুপের হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো। রিংকু-টিংকুর সরল জবাব,
— “কিছুই না। ক্লাসে একটা শব্দও করি নি। মিস হুট করে চিৎকার করলো, আমরা নাকি ক্লাসে ডিস্টার্ব করছি। আমরা অস্বীকার করতেই বললো হোম ওয়ার্ক কই? বললাম, আপার বিয়ে..”

— “এই হয়েছে! হয়েছে! লম্বা কাহিনী বলা বন্ধ কর। আমরা ভালো করেই জানি তোরা কি! মিস নিশ্চয়ই এমনি এমনি মারে নি? তোরা তো এতটাও ভালো নস!”

ওরা আর কিছু বলবে তার আগেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসলো ছোট চাচী। হাতের ট্রে তে শরবত আর হালকা কিছু খাবার। নিখিল – সৌভিকের জন্য। বাইরে থেকে এলো, কিছু নাশতা করতে হবে না? ছোট চাচী নাশতাগুলো ট্রে থেকে নামাচ্ছেন, টিংকু লাফ দিয়ে এসে একটা আপেলের পিস তুলে নিলো। হেলে-দুলে নিখিলের সোফার হাতলে চড়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের উদ্দেশ্যে বললো,
— “কি যে বলো না, মা? আমরা কি কখনো খারাপ কিছু করেছি? নিখিল ভাই, তুমিই বলো তো? আমরা খারাপ কিছু করি কখনো?”
— “ও বলবে কি? ও কি তোদের ভালো করে চেনে? না তোদের বিচ্ছুগিরি সম্পর্কে জানে? হুঁ?”
শরবতের গ্লাস নিতে নিতে ভ্রু নাচায় সৌভিক। চানাচুরের পিরিচে খাবলা দিয়ে রিংকুর চটপট জবাব,
— “বিচক্ষণদের মানুষ চিনতে সময় লাগে না বেশি। এরা লোক দেখা মাত্রই বলে দেয় কে কেমন। আমাদের নিখিল ভাইও তো বিচক্ষণ, সে কি তোমার মত গোবর গণেশ? যে লাউ-কুমড়োর ফারাক করতে পারে না, সে মানুষ চিনবে কি করে?”
খোঁচা খেয়ে চুপসে গেল সৌভিক। এ কথা বড়োই সত্য যে, সে দুনিয়ার তাবৎ কাজ করতে পারলেও, একটা কাজ পারে না। সেটা হলো বাজার করা। শস্য-শ্যামলা বাংলার বুকে চাষকৃত হরেক রকমের সবজির মধ্যে সে বুঝি ঠিকঠাক লাউ-কুমড়োর পার্থক্যটাই পারে না। আর সেটা নিয়েই তাকে খোঁচা দিয়ে যায় তাদের বাড়ির দুষ্টুমির চুড়ামণি দু’ ভাই!

টিংকু ছটফটে ছেলে। প্রসঙ্গ পাল্টাতে ত্বরিতে প্রশ্ন করে বসে,
— “নিখিল ভাই, তোমরা গিয়েছিলে কোথায়? বেড়াতে? ভাই কি দেখালো তোমাকে?”
একটা শ্বাস ফেলে নিখিলের প্রত্যুত্তর,
— “আর কোথায়? এই আশপাশেই ঘুরে এলাম। তোমাদের এখানে নাকি বেরোনোর মতো জায়গা নেই!”
সঙ্গে সঙ্গেই হৈহৈ করে উঠলো দুই দেওয়ানী,
— “কে বলেছে জায়গা নেই? ভাইয়া কি কিছু চেনে নাকি? আরে কি সুন্দর নদীর ঘাট আছে। ভাইয়া দেখাতে নিয়ে যেতে পারলো না?”
ওদের উটকো আলাপচারিতায় বিরক্ত হলো সৌভিক,
— “নদীর ঘাটে দেখবার মত আছে কি রে? যে অতো লাফাচ্ছিস? সেই তো ক’টা বোল্ডার এনে লাগিয়েছে, কূল বাঁধাই করা তিস্তার ওখানে দেখবিটা কি?”
— “দেখবো নাই বা কি? ব্রিজ আছে। আমাদের নির্মিত সড়ক সেতু আছে, ব্রিটিশদের তৈরী রেল সেতু আছে। নদীর ওপারে পার্ক আছে। সেসব দেখবার মতো নয়?”
— “পার্ক কি আমাদের জন্য? আমরা তোদের মত ছোট বাচ্চা?”
— “কে বলেছে পার্ক বাচ্চাদের জন্য? ওখানে কতো কি আছে জানো?…”
শুরু হয়ে যায় তিন ভাইয়ের বাক-বিতন্ডা। ছোট দুই দেওয়ানী কিছুতেই হার মানতে রাজি নয়। তাদের ভাষ্যমতে, নিখিল এদিকটায় প্রথম বারের মত এসেছে। তো ওকে এখানকার সবকিছু ঘুরে দেখাতে হবে না? হতে পারে, এখানে তেমন ঐতিহ্যপূর্ণ কিছু নেই। প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক কিংবা ঐতিহাসিক কোনো তেমন সুন্দর অবকাঠামো নেই। কিন্তু যাই বা আছে, তাই কম কীসে? নিজের এলাকার যেটুকু আছে সেটুকু এই বহিরাগতকে অতিথিকে দেখাতে ক্ষতি কি? নিজের এলাকা নিয়ে গর্ব তো থাকা উচিত! হতে পারে, এই আপাত দৃষ্টিতে দেখা ছোটখাটো বিষয়গুলোই কোনোভাবে তার কাছে হয়ে উঠলো গুরুত্বপূর্ণ। হয়ে উঠলো শিক্ষণীয়, দর্শনীয় কিছু!

অবশেষে তাদের বিবাদ থামলো নিখিলের মধ্যস্থতায়,
— “আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমরা থামো। আমি কথা দিচ্ছি, তোমাদের ইচ্ছে অনুযায়ীই আমি ঘুরতে যাবো। তোমরা নিয়ে যাবে আমাকে। বলো, কখন যাবে?”
— “বিকেলে ফ্রি আছো? চলো বিকেলে যাই?”
টিংকু যেন এখনো তৈরী ঘুরতে যাওয়ার জন্য। রান্নাঘর থেকে বড় ফুপুর গলা,
— “কীসের রে ঘুরতে যাওয়া? রিংকু – টিংকু? তোদের না সামনে সপ্তাহে পরীক্ষা?”
রিংকুর নির্বিকার উত্তর,
— “দিল্লি বহুদূর, ফুপু! সামনে সপ্তাহ আসতে আরও চারদিন বাকি!”

****

বহুদিন হলো ভাইবোনদের একসঙ্গে হওয়া হয় না। অনুর বিয়ে উপলক্ষে অনেকদিন পর ওরা সবাই একত্রিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। মেজো ফুপু সকালে চলে গেছেন, ছোট ফুপু তো আসেনই নি। তাই এ দু’ জনের সন্তান ছাড়া বাকি সবকটা ভাইবোন এখন একসঙ্গে অরুণা ম্যানশনে উপস্থিত। তো, বিকেলে তিস্তা পাড়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা উঠতেই, বাকিরা বলে উঠলো, সবাই একসঙ্গে গেলেই তো হয়! নিখিলের ঘোরাও হবে আর ওদের বাকি ভাইবোনদের সঙ্গে সময়ও কাটবে ভালো। প্রস্তাব মনে ধরলো সৌভিকের, সুতরাং নাকোচ করবার প্রশ্নই ওঠে না। মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রিংকু – টিংকু ছুটলো তাদের আপাদের কাছে।

নিজের ঘরে ঘুমোচ্ছিল চারু। গতকাল আর আজ সারাদিনে অনেক ব্যস্ততা গেছে, কাজের মাঝে ঘুমোবার ফুরসৎ পায় নি। রাতেও ঘুম হয় নি ইনসমনিয়ার দরুণ। একটু বেলা পড়তেই মাথা ব্যথা উঠেছিল। প্রবল কষ্টটাকে চাপতে পেইন কিলার খেয়ে ডুবে গিয়েছিল গভীর নিদ্রায়।
হঠাৎ কারো ফিসফিসানো আওয়াজ শুনে ওর ঘুম পাতলা হয়ে আসলো। তারপর পরই কেউ কানের ফুটোয় কিছু একটা দিয়ে সুড়সুড়ি দিলো যেন!
আকস্মিক এহেন কাণ্ডে নিদ্রামগ্ন চারু চটকা ভেঙে হুড়মুড় করে উঠে বসলো বিছানায়। সঙ্গে সঙ্গেই কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো কারো অট্টহাসির আওয়াজ। চোখ কচলে তাকাতেই দেখতে পেল দুই বিচ্ছুর বত্রিশ পাটি দাঁত!
— “বড়’পা ভীতুর ডিম। ভয় পেয়েছে!”

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here