এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায় #পর্বসংখ্যা_১৪

0
306

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_১৪

পড়ন্ত বিকেল। একটু পড়েই টুপ করে ডুবে যাবে সূয্যিমামা। লালিমার রঙে রাঙিয়ে দিয়ে যাবে আকাশ, আর কালোরা ঝাঁপিয়ে পড়বে দুনিয়ায়। আঁধারিতে ভরে উঠবে পরিবেশ। কিন্তু সে অনেক দেরি!
তার আগেই সবাই মিলে বসে পড়লো একসঙ্গে। সবুজ ঘাসের আচ্ছাদনে বাগানের মাঝখানটায় গোল হয়ে বসলো। এখন আড্ডা হবে, গান হবে। দৌড়ে বাড়ি থেকে কাব্যের গিটার আনলো রিংকু-টিংকু। কাব্য দারুণ গাইতে জানে। একসঙ্গে আড্ডায় বসলে প্রায় এক-আধটা গান গাইতেই হয় ওকে। সবাই অনুরোধ করে। আর আজ এরকম একটা আয়োজন। গান না হলে জমে? কাব্য গান গাইলো, ঋতু কৌতুক বললো। কবির ভালো আবৃত্তি করে। ওর মুখে নজরুলের কোনো কবিতা শুনে এতো প্রাণবন্ত লাগে যে সেটাকে তখন আর স্রেফ একটা কবিতা বলে মনে হয় না। মনে হয় কোনো দৈববাণী, যার প্রতিটি শব্দ উচ্চারণে গায়ের শিরা-উপশিরায় রlক্ত ছলকে ওঠে। তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে প্রাণ দীপ্তিমান হয়! ইরা আবার মূকাভিনয় জানে। ও সেটাই করে দেখালো। চার্লি চ্যাপলিনের একটা পার্ট। ওর অভিনয় দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেল বাকি সবাই। যে যার মতো আনন্দের সঞ্চার করে যাচ্ছে আসরে। মেতে উঠেছে সোল্লাসে। কে যেন হঠাৎ প্রশ্ন তুললো,
— “নিখিল ভাই, আপনি কি করবেন? আপনার কোনো হিডেন ট্যালেন্ট নেই?”
সঙ্গে সঙ্গে নয় জোড়া চোখ একসঙ্গে ঘুরে তাক করলো নিখিলকে। আচম্বিতে এ প্রশ্নে চমকিত হলো নিখিল। অপ্রস্তুত চোখে চেয়ে হাসলো। ওর বিব্রতবোধ টের পেয়েই চট করে টিংকু বলে উঠলো,
— “গান হলো, কৌতুক হলো, অভিনয় হলো। আপনি কি করবেন? নাচবেন না-কি? একটু নাচুন না!”
ঝোপ বুঝে কোপটা মেরেই হাসলো ঠোঁট টিপে। তাল দিলো সহোদর রিংকুও,
— “হ্যাঁ , হ্যাঁ। নিখিল ভাই, একটু ড্যান্স হলে মন্দ হয় না!”
বলেই নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করলো দুই বিচ্ছু। বলা বাহুল্য, প্রথমোক্ত প্রশ্নবাণ রিংকুরই ছোঁড়া! চারু ওদের পাশেই বসেছিল। বাঁদর দু’টোর মতলব ধরতে অসুবিধা হলো না। সবার অলক্ষ্যে বাঁ হাতে সাঁই করে একটা চাটা মারলো দুটোর মাথায়। ফিসফিস করে বললো,
— “ভদ্রতা শিখিস নি? এগুলো কি কথা?”
বড় বোনের দিকে ফিরে দাঁতালো হাসি দিলো দু’জন,
— “কুল, বড়’পা! দেখই না কি হয়!”
— “বদমাইশ!”
কড়া সুরে শাসালো সে। ওদের কি আর তাতে কান দেবার সময় আছে! তখনও কুটিল হাসিতে মত্ত দু’জন!

রিংকু – টিংকু দুষ্টুমি করে নিখিলের নাচের প্রসঙ্গ উঠালেও এতক্ষণে সবার খেয়াল হলো ওর দিকে। সত্যিই তো, এই আসরে উপস্থিত সবচে’ অল্প পরিচিত মানুষটি সে। যার ভেতরে কোনো ‘হিডেন ট্যালেন্ট’ তথা ‘লুক্কায়িত গুণ’ আছে কি-না ওরা অবগত নয়। তাছাড়া বাদ-বাকি সবার গুণ – বেগুণ সব ব্যাপারেই তথ্য আছে ভুঁড়ি ভুঁড়ি!
ইমা বলে,
— “ও দুটোর কথায় কিছু মনে করবেন না, ভাইয়া। আপনি বরং বলুন আপনি কি জানেন? আবৃত্তি জানেন? করবেন?”
— “কি বলেন! আমি আর আবৃত্তি— তবেই হয়েছ!”
মুখ লটকে তাকায় ইমা। রিংকু – টিংকু ফের চেঁচায়,
— “নাচ, নাচ। একটু কোমড় দুলাতে হবে!”
এবার ওদের দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে ধমক দেয় কবির, উপস্থিত সকলের শ্রদ্ধেয় বড় ভাই,
— “চুপ, ফাজিলের দল!”
ব্যস। ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায় দু’টোর হাসি হাসি মুখ। তথাপি বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে নালিশের উদ্দেশ্যে বড় ভাবীর দিকে করুণ চাহনিতে চায়। জাবিন অবশ্যি পাত্তা দেয় না!
গিটারে টুং করে একটা আওয়াজ তুলে কাব্য শুধালো,
— “গান জানো না-কি, নিখিল? গাইবে?”
তাচ্ছিল্য নয়, আন্তরিক আহ্বান। অস্বস্তির পুরু আস্তরণে পড়ে নিখিল হাসলো কোনোমতে,
— “আরে না, না। আমি…”
— “মিথ্যে কথা। উনি ভালো গান জানেন!”
ওর কথা শেষ না করতে দিয়েই হঠাৎ প্রতিবাদ করলো চারু। এক লহমায় সবার দৃষ্টি ঘুরে গেল ওর পানে। ভারী অবাক করা বিষয় তো! চারু আবার নিখিল সম্বন্ধে জানে কি করে? ওই অন্তর্মুখী মেয়েটা তো সারাদিন একা একাই থাকে। নিজের ঘরের চার দেয়ালের সঙ্গে তার যে সখ্যতা! বেরোতেই চায় না! ভাইবোনদের আসরে বসলেও মুখ খোলে কদাচিৎই। সেই কি-না আজ নিখিলকে নিয়ে বলছে? আশ্চর্য তো বটেই!
সবার মতো সৌভিকও আশ্চর্য হলো, নিখিল তার ভালো বন্ধু। অনেক পুরনো ইয়ারি তাদের। সেই সুবাদেই নিখিলের ভালো গায়কী সম্পর্কে সে অবগত। চাইলে আসরে সেই এই প্রসঙ্গ তুলতে পারতো!
কিন্তু আসরে তারচেয়ে তার বন্ধুর মূল্য বেড়ে যাক — তা ও চায় নি। বিশেষত চারুর সম্মুখে গান গেয়ে নিখিল বাহবা নিক, ওর পছন্দ হয় নি বিষয়টা। তাই চুপ ছিল। চারুর স্বীকারোক্তিতে সে আশায় গুড়ে বালি পড়লো। মনে মনে গাল দিলো বন্ধুকে,
‘শালা, এরমধ্যে গান শুনিয়েও ফেলেছিস!’

চারুর মুখে নিখিলের প্রসংশা শুনে সবাই চেপে ধরলো নিখিলকে। এবার গাইতেই হবে ওকে। অগত্যা বলি বা বাকরা হলো নিখিল। গান গাইতে তার আপত্তি নেই। কিন্তু এতোগুলো অপরিচিত কিংবা অর্ধপরিচিত মুখের সামনে গিটারে সুর তুলতে ওর ভারী লজ্জা লাগছিল। কিন্তু পুরুষের অল্পে-সল্পে লজ্জা পেলে চলে না। অতএব, গিটারে সুর উঠলো কাব্যের; গলা সাধলো নিখিল,
— “যদি বারেবারে একই সুরে
প্রেম তোমায় কাঁদায়,
তবে প্রেমিকা কোথায়
আর প্রেমই বা কোথায়?
যদি দিশেহারা ইশারাতে
প্রেমই ডেকে যায়,
তবে ইশারা কোথায়
আর আশারা কোথায়?
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা,
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা,
তবে বুঝে নিও চাঁদের আলো কত নিরুপায়!

লাললালা

যদি প্রতিদিন সেই রঙিন
হাসি ব্যথা দেয়,
যদি সত্যগুলো স্বপ্ন হয়ে
শুধু কথা দেয়,
তবে শুনে দেখো প্রেমিকের
গানও অসহায়।

লাললালালা

যদি অভিযোগ কেড়ে
নেয় সব অধিকার,
তবে অভিনয় হয়
সবগুলো অভিসার।
যদি ঝিলমিল নীল আলো কে
ঢেকে দেয় আঁধার,
তবে কি থাকে তোমার
বলো কি থাকে আমার?
যদি ভালোবাসা সরে গেলে
মরে যেতে হয়,
ক্যানো সেই প্রেম ফিরে এলে
হেরে যেতে ভয়?
শেষে কবিতারা দায়সারা
গান হয়ে যায়।

লাললালালা

যদি বারেবারে একই সুরে
প্রেম তোমায় কাঁদায়,
তবে প্রেমিকা কোথায়
আর প্রেমই বা কোথায়?
যদি দিশেহারা ইশারাতে
প্রেমই ডেকে যায়,
তবে ইশারা কোথায়
আর আশারা কোথায়?
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা,
যদি চায়ের কাপেতে জমে নীরবতা,
তবে বুঝে নিও চাঁদের আলো কত নিরুপায়!

লাললালা

ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসে নিখিলের মোহনীয় কণ্ঠস্বর। হ্রাস পায় সুরের গতি। মধুর আবেশ তৈরি করে, সকলকে মূর্ছনায় হারিয়ে ফেলে একসময় থেমে যায় গিটার। সর্বশেষ বেসুরো টুং করে একটা আওয়াজ তুলে ওদের চটকা ভাঙলো কাব্য,
— “নাইস, ইয়ার! দারুণ গাইলে তো তুমি!”
কল্পনায় ছেদ ঘটলো। একমুহূর্তের জন্য সবাই নিশ্চুপ থেকে হঠাৎ চেঁচিয়ে অভিবাদন জানাতে উদগ্রীব হলো,
— “ফাটিয়ে দিয়েছ ভাই! সুপার! সুপার!”
— “ওয়ান্স মোর! প্লিজ!”
করতালিতে মুখরিত হলো স্বর্ণালী সন্ধ্যা। সকলে এতো এতো প্রসংশায় ভরিয়ে তুললো ওকে। মন ভালো করে দেয়া একেকটি শব্দ, বাক্য! একরাশ শুভকামনা আর শুভেচ্ছাবাণী যোগ হলো ঝুলিতে। বিনিময়ে লজ্জিত হয়ে শুধুই হাসলো নিখিল। হৈ-হৈ কলরবের মাঝে নির্নিমেষ চেয়ে রইলো একটি হাসিমুখের দিকে। কোমল পানপাতা মুখটিতে কোনো স্বর নেই, একেবারে নির্বাক শ্রোতা সে। অথচ তার দুটি চোখের দিকে চেয়েই যেন নিজের জন্যে হাজারও অনুপ্রেরণা খুঁজে পেল নিখিল!
সেই মুহূর্তে অনিমেষ চেয়ে রইলো দু’জনেই; নিখিল এবং চারু!

******
রাতের খাবার খেয়ে ব্যালকনিতে দাড়িয়েছে সৌভিক। মনটা বড্ডো উদাস উদাস লাগছে। কিছুতেই কিছু ভালো লাগছে না। চড়ুইভাতি করতে গিয়ে সারাদিন অনেক ব্যস্ততায় কেটেছে। প্রথমে রান্না – বান্না, গোছ-গাছ তারপর বিকেলের আড্ডা! সবকিছু গুছাতে গুছাতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেল।

সন্ধ্যায় গান গাওয়ার পর এ-বাড়িতে নিখিলের কদর বেড়ে গেছে। না, আগেও ওকে সম্মান করা হতো। কিন্তু সেটা সৌভিকের বন্ধু হিসেবে, একজন অভ্যাগত অতিথি হিসেবে। এখন সবাই কদর করছে ভালো গাইয়ে হিসেবে। তাই তো রাতের খাবার টেবিলেও ওকে নিয়েই ছিল ভাইবোনদের সমস্ত আলাপন। কথা-বার্তা। খাবার শেষ হলেও কথা শেষ হয় নি। ফলস্বরূপ নিখিলকে টেনে নিয়ে ড্রইংরুমে বসে গেছে সবাই। টিভি দেখতে দেখতে এবার গল্প জমবে!

সৌভিকের তাতে কোনো সমস্যা ছিল না। তার বন্ধুকে সবাই ভালো বলুক, সে চায় না এমন নয়। সেও চায় হয় তো। নাহলে নিখিলকে কেন সে নিজেদের বাড়িতে বেড়াতে এনেছে? সে হিংসুটে হলে তো আনতো না!
কিন্তু ঘাপলা সেখানে নেই। রয়েছে অন্য জায়গায়। বাড়ির সকলে মিলে নিখিলের প্রসংশা করে, মুখে ফেনা তুলতে তুলতে মlরে যাক — ওর কিছু যায় আসে না। কিন্তু প্রসঙ্গ যখন চারুকে ঘিরে, তখন সৌভিক তো হিংসুটে হবেই! ওর বুকেও তো জ্বলন হবেই! সন্ধ্যায় কেউ না দেখুক, হাততালির কান ফাটানো শব্দ, সবার হুল্লোড় করা জমজমাট আসরের মাঝেও নিখিল কেমন বেহায়ার মতো চারুর দিকে চেয়ে ছিল সে ও দেখেছে। সঙ্গে চারুর মুগ্ধ দৃষ্টিও ওর চোখ এড়ায় নি। তাই তো ওর ভয় হয়! বুক জুড়ে হতাশা তড়পাতে থাকে। আহা রে, চারু কেন তার হলো না? কেন কেউ মানলো না তাকে? দিলো না চারুকে তার করে! একান্ত তার করে?

চলবে___

#মৌরিন_আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here