এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায় #লেখিকা:মৌরিন-আহামেদ #পর্বসংখ্যা_০৩,৪

0
299

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#লেখিকা:মৌরিন-আহামেদ
#পর্বসংখ্যা_০৩,৪

নাচ শেষ করে সৌভিকদের কাছেই আসতে দেখা গেল কবির – জাবিনকে। ওদের দেখেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো সৌভিক। উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,
— “আরে, ভাইয়া! তোমরা তো ফাটিয়ে দিয়েছ একেবারে!”
— “তাই, না?”
হাসলো ওরা দু’জনেই। নিখিলের সঙ্গে তখন পরিচয় করিয়ে দিলো সৌভিক,
— “দোস্ত, এই যে আমার বড় ভাই-ভাবী। এদের কথাই তো বলছিলাম তোকে। আর ভাইয়া, এ হলো নিখিল। আমরা সহকর্মী হলেও সম্পর্কটা একদম বন্ধুত্বের।”
কবির হাত বাড়িয়ে দিলো নিখিলের দিকে। করমর্দন করতে করতে বললো,
— “পরিচয় হয়ে ভালো লাগলো।”
— “আমারও।”
এরপর একে একে প্রায় সকলের সঙ্গেই পরিচিত হয়ে নিলো নিখিল। সৌভিকের সব ভাইবোনের সঙ্গেই দেখা হলো, কথা হলো। শুধু কথা হলো না একজনের সঙ্গে। সন্ধ্যার সেই হৃদয় হরিণী নারী, ডাগর ডাগর আঁখিতে যে দৃষ্টি মেলে ধরে, পানপাতার ন্যায় ছোট্ট মুখখানিতে যার সর্বদা মিষ্টতা লেপ্টে, সেই চারুলতারই সাক্ষাৎ পেল না নিখিল। সারা বিয়েবাড়ি জুড়ে এতো এতো মানুষের মাঝেও নিখিলের দুটি চোখ শুধু তাকেই খুঁজে বেরালো। এতো এতো সুন্দরীর ভীড়কে উপেক্ষা করে তার মানসপটে ভেসে এলো সেই সরলার সুশ্রী চেহারা। তার বলা প্রতিটি শব্দের ঝংকার বাজতে লাগলো কানে। হৃদয় মাঝে জাগলো এক গোপন সুখের ব্যথা। নিজের অজান্তেই গুনগুন করে উঠলো সদ্য প্রেমে পিছলে পড়া দামাল সাতাশের যুবক,
“মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না~”
__

‘বিয়ে’ — শব্দটা দু’ অক্ষরের হলেও এটা আদৌ কোনো ছোট ব্যাপার নয়। এতে দুটি মানুষকে সারাজীবনের জন্য তো এক করে দেয়া হয়ই, সঙ্গে দুটি ভিন্ন পরিবারের মধ্যেও সৃষ্টি করে দেয় নতুন সম্পর্কের। যার সূচনা বিয়ের অনুষ্ঠান থেকেই। মুসলিম মত অনুসারে বিয়ের কালেমা পড়তে আর রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করতে কখনো মিনিট বিশেকের বেশি লাগে না। অথচ এই ছোট্ট কাজ সারবার জন্য কতো যে আয়োজন মানুষ করে, তার ইয়াত্তা নেই। গায়ে হলুদ, মেহেদী কতকিছু করে, বিয়ে! আবার সেই বিয়েতেও কি কম ঝক্কি?
অন্যান্য বিয়ের ক্ষেত্রে যা হয়, গাড়ি থেকে বর নামতেই সারা বাড়িতে সাড়া পড়ে যায়, “বর এসেছে, বর এসেছে!” তার সঙ্গে সঙ্গেই উঠতি বয়সী সব ছেলেপুলেরা ভীড় জমায় গেটের কাছে। বরের পথ আটকে তারস্বরে চেঁচায়,
— “টাকা দাও, নইলে ভেতরে যাওয়া হবে না!”
বরপক্ষ প্রথমে রাজী হলেও কনেপক্ষের আকাশছোঁয়া চাহিদা দেখে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়। দু’ পক্ষের চলে কাচা বাজারে সবজি কেনার মত দরকষাকষি। পরিবেশ সরগরম হয়ে উঠে মুহূর্তেই। চিৎকার – চেঁচামেচিতে মুখরিত হয় সবকিছু। কয়েক প্রস্থ কথা কাটাকাটি শেষে, মুরব্বী স্থানীয় কারো হস্তক্ষেপে বর ভেতরে ঢুকবার অনুমতি পায়। মিষ্টি মুখ করে, ফুলের তোড়া উপহার নিয়ে বর হেলেদুলে গিয়ে স্টেজে বসে। আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে সেখানে চলে হাসি – ঠাট্টার আসর। কোনো একফাঁকে বরের জুতো চুরি যায়। ওই পক্ষের সব বাঘা বাঘা লোকেরা এসে ছেঁকে ধরে কনে পক্ষকে। জুতো চুরি নিয়েই ঘণ্টা দেড়েকের বিরাট ঝগড়া হতে দেখা যায় অধিকাংশ বিয়েতে। তারপর বর-কনের খাওয়ার সময়ও চলে সমবয়সীদের নতুন মশকরা। নতুন জামাইকে কতো রকম উপায়েই যে ওরা উত্যক্ত করে! টক-ঝাল-মিষ্টির মিশেলে সময়টা দারুণ উপভোগ্য হয়ে ওঠে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বর্ণিত এই লোকরীতির দু’ একটার ব্যতিক্রম দেখা যায় বটে কিন্তু খুশির কমতি থাকে না কোথাও এক ছটাক অবধি! সবাই আনন্দ করে, উল্লাসে মেতে ওঠে। চারুর বিয়েতেও এসবই হতে দেখেছে এ-বাড়ির সবাই। বংশের প্রথম মেয়ের বিয়েতে সবাই ভীষণ আনন্দ করেছিল। গেট ধরা, জুতো চুরি থেকে শুরু করে সবটাই করেছিল ওরা সব ভাইবোনেরা মিলে। কিন্তু এবার অনুর বিয়েতে এসবের কিছুই যেন হলো না। বড়রা আয়োজনের কোনো ত্রুটি রাখেন নি। অ্যাপায়নেও কিছু কমতি নেই। তবুও সেরকম ভাবে জমলো না অনুষ্ঠান!

মূল স্টেজের থেকে বেশ দূরত্বে এসে আড্ডা সাজিয়েছে ওরা। ছোট ফুপু দেশে আসতে পারেন নি বলে, তার ছেলে অমিত ছাড়া এখানে প্রায় সব ভাইবোনই উপস্থিত। বরযাত্রী আসবার আগ পর্যন্ত ওরা নিজেদের মতো হুল্লোড় করেছে। কিন্তু আপাদত সবাই। যে যার নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। ফোন স্ক্রোল করতে করতে কখনো বা দুটো কথা বলছে। ঋতু একবার ছোট দুই বিচ্ছুকে খোঁচা দিলো,
— “কি রে, রিংকু-টিংকু দুলাভাইয়ের জুতো চুরি করবি না?”
রিংকু বিরস বদনে বোনের দিকে তাকালো। কিছু বললো না। বড় ফুপুর ছোট মেয়ে প্রমি, ঋতুর ব্যাচমেট। জিগরি দোস্ত ওরা একে-অপরের। বান্ধবীর কথায় সায় দিয়ে বললো,
— “তাই তো রে, বিয়ের এতো ইম্পর্ট্যান্ট একটা সেগমেন্ট তোরা বাদ দিয়ে দিবি? এক্কেবারে বাতিলুন?”
বলেই চাপড় দিলো টিংকুর কাঁধের উপর। টিংকু মহাবিরক্ত হয়ে ওর হাতটা সরিয়ে দিলো,
— “তোমার এতো শখ থাকলে তুমি যাও, না। চুরি করো গে! আমাদের সাধছ কেন?”
— “না, বাবা। দরকার নাই।”
— “তাহলে আমাদের গুঁতোগুঁতি করছো কেন?”
মুখভার করে বসে রইলো ঋতু। এ ঘটনায় আশেপাশের কারো ভাবান্তর হলো না। শুধু একপ্রান্তে বসে থাক নিখিলের এই বিষয়টা কেমন খটকা লাগলো। এটা বিয়েবাড়ি, এখানে বর-কনে দু’ পক্ষেই আছে, তাদের মধ্যে বেয়াই-বেয়াইন সম্পর্কের মিষ্টি ঝগড়া হবে, হৈচৈ করবে, আমোদে-আহ্লাদে আনন্দ করবে — অথচ সেরকম কোনো ব্যাপার যেন চোখে পড়ছে না। শুরুতে তাও যা গান-টান গাইছিল, নাচানাচি করছিল, এখন আর কারো তেমন আগ্রহ নেই। কেমন বিমর্ষ হয়ে বসে আছে সবগুলো!

নির্বিঘ্নে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলো। সে সময়ও এরা কেউ জায়গা ছেড়ে উঠলো না। বর – কনের ফটোশ্যুটের সময় ছোট চাচী এসে ডাকলেন ওদের। কারোর বিশেষ কোনো ভাবাবেগ হলো না। রিতা বিরক্ত হয়ে বললেন,
— “তোরা এরকম শুরু করেছিস কেন? ওখানে সবাই ছবি তুলছে, অনুটা ডাকছে তোদের। যেতে পারছিস না?”
কাব্য ভাই ফোন স্ক্রোল করছিলো। সেভাবে থেকেই বললো,
— “আমাকে এখন ডেকো না, চাচী। আমি একটা কাজ করছি।”
হতাশ হয়ে পাশে থাকা কাব্যের বৌ রাত্রির দিকে তাকালেন রিতা,
— “তুমিও কি কাজ করছ?”
— “না, চাচী। যাচ্ছি।”
দোনোমনা করতে করতেই উঠে দাড়ালো রাত্রি। একে-একে টিংকু, প্রমি আর বুশরাকেও সাথে নিলেন চাচী। সৌভিক গেল না, ভীড় পছন্দ করে না বলে। জাবিন ভাবী আর ঋতু খুব মনোযোগ দিয়ে কি যেন করছিল, চাচীকে পাত্তাও দিলো না। ইমা মাথা ব্যথার অজুহাতে পার পেল। আর রিংকু তো সোজাসাপ্টা বলেই ফেললো,
— “শোনো মা, অনু আপার ওই আলগা ঢং দেখার জন্য তুমি আমাকে ডাকবে না। ওই ঢংগীর সাথে ছবি তোলার কোনো শখ আমার নাই।”
ছেলের এই ধৃষ্টতা দেখে তেড়ে এসে কানমলে দিলেন রিতা,
— “বিরাট শখওয়ালা হয়েছ তুমি, না? বের করছি তোমার শখ, দাড়াও!”
— “উহ্, মা! ছাড়ো তো।”
জবরদস্তি করে নিজের কানটাকে রিতার কাছ থেকে উদ্ধার করে রিংকু। তারপর আসন ছেড়ে উঠে চলে আসে নিখিলের কাছে। ওর পিছে আশ্রয় নিয়ে বলে,
— “আমি নিখিল ভাইয়ার সাথে থাকবো। তুমি যাও তো!”
বিপন্ন হয়ে নিখিল ওকে বলে,
— “তোমার মা যখন ডাকছেন তখন গেলেই ভালো হতো না, রিংকু?”
— “না। আমি যাচ্ছি না।”
একগুঁয়ে উত্তর দেয় ছেলেটা। অগত্যা রিতাকে চলে যেতে হয়। বরযাত্রীদের খাইয়ে – দাইয়ে বিদায় দিতে দিতে রাত সাড়ে এগারোটা বাজলো। বিদায়বেলায় সাধারণত খুব কান্নাকাটি হয়। এখানেও ব্যতিক্রম হলো না। খুব কাঁদলো অনুলেখা। মা – চাচী – ফুপুদের গলা ধরে কাঁদলো। এতক্ষণ হাসি-খুশি হয়ে রঙিন ফানুসের মতো উড়তে থাকা মেয়েটাকে এমন হাউমাউ করে কাঁদতে দেখে একটু খারাপই লাগলো নিখিলের। মেয়েদেরকে চিরায়িত এই নিয়মটা মেনে নিয়ে চলতে হয়। নিজের বাড়ি ছেড়ে পরের বাড়ি গিয়ে থাকতে হয়, নিজের সারাজীবনের পরিচয়, বাবা নামক বটগাছের আশ্রয় ছেড়ে নিত্যান্ত অল্পপরিচিত বা স্বল্পপরিচিত একটি পুরুষ যাকে বলা হয় তার স্বামী; তার পরিচয়ে বাঁচতে হয় — এইতো নিয়ম। সব জেনেশুনেও মেয়েটার এই অঝোরে বৃষ্টির মতো কান্না, ওর শুষ্ক মনটাকে বাষ্পীভূত করে দিলো। অনু একটু ধাতস্থ হলে ওকে গাড়িতে তুলে দিতে এগোলো সবাই। তখনই কথাটা শুনলো নিখিল, কে যেন বলছে,
— “অনু তো যাইবো গা, চারু মাইয়াটা কই? বইনের বিদায়ে থাকবো না সে?”
ভীড়ের একপাশে দাড়িয়ে পান চিবোতে চিবোতে দু’টো মহিলা কথা বলছিলেন। চারুর প্রসঙ্গ উঠতেই প্রবল আগ্রহ নিয়ে কান খাড়া করলো নিখিল। ওদের সামন দিয়ে যাচ্ছিলেন একজন মহিলা। খুব সম্ভব মহিলাটি সৌভিকের বড় চাচী। পূর্বোক্ত মহিলাটি তার যেন হাত টেনে ধরে শুধালেন,
— “আপা, আপনার বড় মাইয়া কই? ছোট বইনের বিয়াত সে আইসে নাই?”
— “চারু? এসেছে তো। আসবে না কেন? আসলে, মেয়েটা একটু অসুস্থ। তাই—”
— “ওহ্ আইচ্ছা।”
বলেই পিচ করে শব্দ করে ওখানেই পানের পিক ফেললেন মহিলাটি। সৌভিকের বড় চাচী ব্যস্ততায় ছিলেন, মহিলা হাত ছাড়া মাত্রই দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন। তার মেয়ের বিদায় হচ্ছে, উনি যাবেন না?
তার প্রস্থানের পরপরই নিখিলের কানে ফের বাজলো দুটো কথা। মহিলা দুটি একে-অপরের সঙ্গে বলাবলি করছেন,
— “বুঝলা, রাজুর মা। চমক আপার এইসব হইলো ঢং। চারুয় অসুস্থ, না? এক্কেরে মিছা কথা। আসলে ছেরিটারে অনুষ্ঠানে এরাই আইতে দেয় নাই।”
তথাকথিত রাজুর মায়ের কণ্ঠ শোনা গেল। হাঁসের মতো ফ্যাঁস ফ্যাঁসে গলায় তিনি পরচর্চা করলেন,
— “ঠিকই কইছ তুমি। ওই ছেরি যে অলক্ষুণে— ভয় পায়, ছোটটার কপালও যদি পুড়ায়!”
বলেই ফ্যাক ফ্যাক করে হাসলেন দু’জন। নিখিলের বিরক্ত লাগছিল কথা শুনতে। সে আশা করেছিল এরা চারুলতার সম্বন্ধে ভালো কিছু বলবে। ক্ষণিক দেখায় সেই হৃদহরিণীকে নিয়ে এমন কিছু বলবে যা শুনে সে তার কর্ণকুহর ধন্য করবে, প্রাণ জুড়াবে। বাকিটা রাত ওই মনমোহিনীকে নিয়ে মিষ্টি মিষ্টি স্বপ্ন দেখে পার করবে। কিন্তু কথাবার্তার ধরনে বুঝলো, এদের চরিত্র বাংলা সিরিয়ালের অতি পরিচিত সেই কুটিল মহিলাদের মতোই। যাদের কাজই হলো, অন্যের পিঠ-পিছে বদনাম রটানো। ত্যক্ত হয়ে বেরোতে চাইলো এখান থেকে কিন্তু ভীড় কাটিয়ে বেরোনো গেল না। রাজুর মায়ের বিশ্রী হাসির সাথে শুনতে পেল; তাদের এতক্ষণের বোগাস আলাপকে পাত্তা না দিলেও এই কথাটা তার ভেতরে একটা খচখচানির সৃষ্টি করলো,
— “কথায় আছে না, অতি বড় ঘরনী না পায় ঘর,
অতি বড় সুন্দরী না পায় বর? ওদের চারুর সেই দশা! হা হা।”

চলবে___

#এই_সুন্দর_স্বর্ণালী_সন্ধ্যায়
#পর্বসংখ্যা_০৪

অরুণা ম্যানশনের সবারই মোটামুটি আশঙ্কা ছিল মাহতাবকে নিয়ে। শত হোক, তারই ছোট ভাইয়ের বিয়ে। সে না এসে পারে না। কিন্তু এসে গেলেও এখানে আছে চারুলতা। তার প্রাক্তন স্ত্রী। দু’ বছর আগে ওদের সম্পর্কটা শেষ হয়ে গেলেও, এমন নয় যে ওরা দু’জন দু’জনকে পুরোপুরি ভুলে গেছে! সেটা তো সম্ভবও নয়। অথচ এই উজ্জ্বল আলোকসজ্জায় সজ্জিত, রঙিন সাজের বাড়িটির চমৎকার পরিবেশে ওদের দেখা হয়ে গেলে কেমন বিব্রতকর ঘটনার সৃষ্টি হবে তা কি ভাবা যায়?
সবাই তাই দুশ্চিন্তায় ভুগছিল। কেউই চাচ্ছিল না, কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে। যাতে এই সুন্দর সময়টা নষ্ট হতে পারে। থমকে যেতে পারে, ওদের আনন্দ-উল্লাস! কিন্তু ওদের ভাগ্যটা ভালো। কোনো অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটলো না এ-যাত্রায়। বরের বড় ভাই, মাহতাব এলো না বরযাত্রীর সঙ্গে। কারণ হিসেবে জানানো হলো, ছোট ভাইয়ের বিয়ের এতো আয়োজন সামলে হিমশিম খাচ্ছে মাহতাব। তাদের গোছগাছ এখনো শেষ হয় নি, বিধায় সে বাড়িতেই রয়ে গেছে তার আরও কিছু আত্মীয়সহ। মাহতাবের বাবা মুনিম শেখ স্মিত হেসে এই কথা জানালেন আজমীর রাজাকে। বেয়াইয়ের মুখের কথা শুনে বাইরে একটু অসন্তোষ প্রকাশ করলেন বটে; “না, না, ভাই সাহেব কাজটা ঠিক হয় নাই। ছোট ভাইয়ের বিয়েতে আসলো না, এটা কেমন কথা?” — বলে রাগও দেখালেন খানিক। কিন্তু মনে মনে তিনি হাঁফও ছাড়লেন! মাহতাব ছেলেটা কাজটা ঠিকই করেছে না এসে। এতে, তারও মঙ্গল আর তার বড়মেয়ে চারুরও! আর এর ফলে নির্ঘাত অস্বস্তির হাত থেকে বেঁচে গেলেন তিনি এবং তার পরিবারও!

বাড়ির বড়কর্তী হিসেবে বাড়ির প্রতিটি ঘরের চাবি, প্রতিটি জিনিসের সঠিক তত্ত্বাবধান করেন চমক। তাই বাড়ির অন্য সদস্যের চেয়ে সবকিছুতেই তার কর্তব্য যেন একটু বেশিই। ছোট বৌয়েরা যতোই কাজ করুক, সাহায্য করুক, যিনি মূল তিনিই তো মূলই। এই বাড়ির প্রতিটি কাজের পরিকল্পনা, রক্ষণাবেক্ষণ সবই তার কাঁধের উপর। আর আজ তার মেয়ের বিয়ে সেখানে তার দায়-দায়িত্ব কি কম?
বিয়ের খাবারের আয়োজন, বাবুর্চির সঙ্গে বোঝাপড়া, বেচে যাওয়া খাবারের বিলি-বণ্টন, সব ঠিকঠাক করে গুছিয়ে চমক যখন শোবার ঘরে ঢুকেছেন রাত বারোটা পেরিয়েছে। আজমীর রাজা অনেক আগেই শুয়ে পড়েছেন, এতোক্ষণে বোধ হয় ঘুমিয়েও গেছে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় গা এলাতে এলাতে তিনি মৃদু স্বরে ডাকলেন স্বামীকে,
— “ঘুমিয়েছ?”
আশা করেন নি কোনো জবাবের। তিনি তো জানেনই লোকটা ঘুমিয়েছে। তবুও শুধু অভ্যাসবশত ডেকেছেন। পাশ ফিরে শুতেই আজমীর সাহেবের গলা শোনা গেল,
— “নাহ্। মেয়ে বিয়ে দিয়েছি। আজ কি আর ঘুম আসবে, বলো?”
ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে চমক বললেন,
— “এক মেয়েকে বিয়ে দিলাম, আরেক মেয়েকে কষ্ট দিয়ে। যে বাড়িতে বড় মেয়ের জায়গা হলো না, সে বাড়িতেই ঢাকঢোল পিটিয়ে ছোট মেয়েকে পাঠাচ্ছি। আমরা কেমন বাবা-মা?”
— “কাজটা ঠিক হয় নি, জানি চারুর মা। কিন্তু কি করতাম? তোমার ছোট মেয়ের যে জেদ!”
চুপ করলেন আজমীর রাজা। সন্তান স্নেহের কাছে তারা সবাই বাঁধা। এক সন্তানের জন্য তারা আরেকজনকে কষ্ট দিতে পারেন না। চারুর দুর্ঘটনাটা হওয়ার পর, তারা চেয়েছিলেন অনুর অন্য জায়গায় বিয়ে দিতে। কিন্তু মেয়ে রাজী হয় নি। জানিয়েছে, মাহাদকে সে ভালোবাসে। বড় বোনের জীবনের দুর্গতির জন্য, নিজের ভালোবাসাকে ত্যাগ করতে পারে না। তারপরও যদি তারা ওকে অন্যত্র বিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চালান, তবে মেয়ে ভালো-মন্দ কিছু একটা করে ফেলতে দ্বিধা করবে না!
এই নিয়ে বাড়িতে বহুৎ ঝগড়া-অশান্তি হয়ে গেলেও জেদী মেয়েটা নিজের সিদ্ধান্ত থেকে নড়ে নি। মার খেয়ে পর্যন্ত অটল থেকেছে নিজের কথায়। মেয়ের সঙ্গে রাগ করে দীর্ঘদিন কথা বলা বন্ধ করেছিলেন আজমীর রাজা। কিন্তু শত হোক, নিজের মেয়ে। সে যতোই খারাপ হোক, অবুঝ হোক, তারা তো তার খারাপ চান না। কোনোভাবে ক্ষতি করতেও পারেন না। তাই বড় মেয়েকে কষ্ট দিয়ে হলেও ছোট মেয়ের ইচ্ছে তারা রেখেছেন। বিয়ে দিয়েছেন পছন্দের মানুষের সঙ্গে!
ভাবনার সুতো ছিঁড়লো স্ত্রী চমকের কথায়,
— “থাক, যা হবার হয়েছে। মেয়েটা যদি খুশি থাকে তো সব ঠিক। স্বামী-সংসার নিয়ে সুখী হোক, দোয়া করি। বাবা-মা হয়ে সন্তানদের দুঃখ তো দেখতে পারি না। একে চারুর অবস্থা দেখলে আমার ভালোলাগে না। ওর কোমল মুখটা দেখলে বুকভার হয়ে আসে। শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারি না। তাতে অনুর যদি কিছু হয়— থাক, ও নিজের মতো। যেভাবেই থাক, সুখী যেন হয়!”
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বলে উঠলেন আজমীর রাজা,
— “চারুর বিয়েটা তো আমরা দেখে-শুনেই দিয়েছিলাম। ছেলে দেখতে ভালো, মাইনেও ভালো, পরিবার-বংশ — সব দেখেই তো—”
অনুশোচনায় দlগ্ধ মন। আত্মজার দুর্দশায় আদ্র হলো মাতৃ হৃদয়,
— “এতো ভালো মেয়ে আমাদের। এতো নম্র-ভদ্র! কখনো কারো মুখের উপর কথা বলে না। রাগ করে না। কি শান্ত-শিষ্ট থাকে সবসময়, সেই মেয়েটার কপালে এমন হবে কেন? ওর কপালে কি আল্লাহ্ আর ভালো কিছু দিতে পারলো না? এতো কষ্ট রাখতে হলো ওর ভাগ্যে? কোন দোষের শাস্তি পাচ্ছে মেয়েটা?”
বলতে বলতেই গলা ভারী হলো। আঁচলে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন তিনি। শুনশান নীরবতার নিঃস্তব্ধ গভীর রাতে স্ত্রীর এই মৃদু ফোঁপানির আওয়াজ যেন বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো না আজমীর রাজার কানে। একহাতে পৌঢ়া স্ত্রীকে আগলে সান্ত্বনাবাণী উচ্চারণ করলেন,
— “এটা আল্লাহর ইচ্ছা। তিনি হয় তো এই ছোট কষ্টটার বিনিময়ে আমাদের চারুকে অনেক বেশি সুখী করবেন। হয় তো ওর জন্য এমন কোনো উপহার তিনি তৈরি করে রেখেছেন, যাতে ওর ভবিষ্যৎ অনেক সুন্দর হবে!”
— “তাই যেন হয়, গো। তাই যেন হয়!”
কাঁদতে কাঁদতেই মেয়ের জন্য প্রার্থনা করলেন তিনি। সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে স্ত্রীর প্রার্থনায় সহযোগী হলেন আজমীর রাজা। গভীর রাতে তাদের এই হাহাকার মিশ্রিত মোনাজাত সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারো কি কর্ণগোচর হলো? কেউ কি জানলো, সন্তানের ভবিষ্যৎ আশঙ্কায় কি নিদারুণ যন্ত্রণা বুকে পুষে বেঁচে আছেন দু’টি মানুষ?
___

সন্ধ্যায় ঘুমোনোর কারণে রাতের খাবারটা আর খাওয়া হয় নি চারুলতার। ফলশ্রুতিতেগভীর রাতে ক্ষুদা পেয়ে গেল ওর। দেড়টার সময় ঘুম ভেঙে বেচারী উঠলো পেটের জ্বালায়!
এমন নয় যে কেউ তার খোঁজ-খবর রাখে না বিধায় তাকে অভুক্ত থাকতে হয়েছে। বরং সে নিজেই ঘুমোতে যাবার আগে বড় ফুপুকে বলেছে রাতে খাবে না। বড় ফুপু প্রথমে একটু বুঝানোর চেষ্টা করেছেন; ও যখন কিছুতেই বুঝলো না তখন খুব রাগ করেছেন, ধমকি-ধামকি করে বলেছেন তার মাকে বলে দেবে। চারু সেসবকে কাঁচকলা দেখিয়ে ঘরে গিয়ে বিছানাকে আঁকড়ে ধরেছিল। প্রচণ্ড মাথা ব্যথাকে ছুটি দিতে, একটা ব্যথানাশক ওষুধ গিলে পরে ছিল বালিশ নিয়ে। কিন্তু সেই সাধের ঘুমটা ভেঙে গেল তার এই ক্ষিদের যন্ত্রণায়!
নাহ্, আর পারা যাচ্ছে না। পেটে বালিশ চাপা দিয়ে বিছানায় মোচড়া-মুচড়ি করে দাবানলের মতো ক্ষুধাকে আটকানো যাচ্ছে না। অগত্যা রাত দেড়টায় চারুকে উঠতেই হলো, বেরোতেই হলো খাবারের সন্ধানে। সিঁড়ি ভেঙে নিচে এসে ড্রয়িং স্পেসে আসতেই চারুর চোখে পড়লো একগাদা ঘুমন্ত মানুষকে। সোফা আর টি-টেবিল সরিয়ে মাঝখানে বেশ বড়সড় ফাঁকা জায়গা পাওয়া গেছে। সেখানে বড় একটা তোষক বিছিয়ে শুয়ে পড়েছে ক’জন। সৌভিকসহ সবগুলো ব্যাচেলর কাজিনকে দেখা যাচ্ছে। কারোরই অবস্থা বিশেষ ভালো না। একেকজন একেক ভাবে শুয়েছে, বেঘোরে ঘুমের মাঝে কেউ কেউ তোষক ছাড়িয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি দিচ্ছে, কেউ বালিশবিহীন হয়ে হা করে ঘুমোচ্ছে, কেউ নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলার বংশধর হয়ে চার-হাত-পা ছড়িয়েছে, কেউ আবার পাশের জনের গায়ে উঠে পড়েছে, অন্যের পেট জড়িয়ে ধরেছে — একঝলক ওদের অবস্থা দেখে চোখ সরিয়ে নিলো চারু। ইসস, কি একটা অবস্থা! এভাবে কেউ ঘুমায়?
সাবধানে ওদের পাশ কাটিয়ে এগোলো রান্নাঘরের দিকে। মিটসেফ বা ফ্রিজে খুঁজতে হবে, যদি কিছু পাওয়া যায়। তার ক্ষুধা নিবারণের জন্য! কয়েক পা এগোতেই কথাগুলো কানে এলো ওর, চমক আর আজমীর রাজার কথোপকথন। তার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা, তার মন্দভাগ্য নিয়ে আহাজারি!
কারো দরজায় আড়ি পাতার অভ্যাস চারুলতার নেই। সে জানে কাজটা অত্যন্ত গর্হিত, অনুচিত। কিন্তু তবুও সে দাড়াতে বাধ্য হলো। সত্যি বলতে, তার পা দুটো আসলে অসাড় হয়ে আসছিল। বুকটা ফেটে যাচ্ছিল অবর্ণনীয় কষ্টে! নিজের হতভাগ্য নিয়ে চারু দারুণ লজ্জিত। তার কি উচিৎ ছিল না, বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর? তাদের একদণ্ড শান্তির ব্যবস্থা করবার? অথচ সে অপারগ হয়ে বসে! তালাকের তকমা নিয়ে ঘরে ফেরা নারী!
কথাগুলো শুনতে শুনতে কখন যে চোখের কোণে জল জমেছে টের পায় নি মেয়েটা। হুশ হলো যখন নোনা অশ্রুকণা কার্নিশ উপচে গড়িয়ে পড়লো, তখন! বিবশ হাতটা গালে ছুঁইয়ে খুব সংগোপনে জল মুছলো চারু। তারপর ত্রস্ত পায়ে প্রস্থান করলো সেখান থেকে। মুহূর্তেই ভুলে গেল, তার ব্যক্তিগত প্রয়োজন, ক্ষুন্নিবৃত্তির কথা!

এক দৌড়ে ছাদে এসে হাজির হলো চারুলতা। মাঝরাতে ছাদে আসা যে ওর মতো একটা মেয়ের উচিৎ নয়, এটা ও ভুলে গেছে এখন। সব ভুলে গিয়ে ছাদে এসেছে শুধু একটু স্বস্তির জন্য। একটু নিরিবিলি খোলা আকাশের নিচে দাড়িয়ে নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়ার জন্য।
আকাশে চাঁদ আছে, কিন্তু তা মেঘের আড়ালে লুকিয়ে। নিঝুম রাতের হিমশীতল সমীরণ বয়ে চলেছে ক্ষণে ক্ষণে। গাছের ডালে ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে চলেছে একটানা। এই সুন্দর, মোহনীয় রাতের ফিনিক ফোটা জোৎস্নায় একটি মেয়ে একা দাড়িয়ে ছাদে! হু হু করে কেঁদে যাচ্ছে অপরূপ রূপবতী সেই মেয়ে! নীরব প্রকৃতির কাছে যেন নিজের দুঃখটা উজাড় করে দিচ্ছে। ব্যাকুল হয়ে নিজের সমস্ত আক্ষেপ, আফসোস, যন্ত্রণা ব্যক্ত করছে। চোখের জলে ধুয়ে ফেলছে সব বেদনা আর না বলা আহাজারি!
আপনমনে কাঁদতে ব্যস্ত চারুলতা। হঠাৎ শুনলো কার যেন কণ্ঠস্বর,
— “কে? কে ওখানে?”
ঝিঁঝিঁ ডাকা নিশ্চল রাতে গমগমে মনুষ্যধ্বনি কর্ণগোচর হতেই চকিতে ফিরে তাকালো চারু। জলভরা ঝাপসা চোখে সিঁড়িঘরের উল্টোদিকে কে যেন দাড়িয়ে আছে। পুরুষ দেহাবয়ব। ওকে ঘুরে তাকাতে দেখেই সে এগিয়ে ফের প্রশ্ন করলো,
— “কে? চারুলতা?”
আকস্মিক চাপে মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। বিস্ময়ের রেশ কাটতেই লোকটার দিকে ভালো করে তাকালো। উচ্চতায় গড়পড়তা বাঙালির মতো, তবে বাঙালিদের ননীযুক্ত শরীর নয়। মেদহীন; সুঠাম। হঠাৎ করে চাইলে যেন পুরুষালি সৌষ্ঠব আলাদা করে নজরে পড়ে। এই অপরিচিত লোকটি ঠিক কে চারু চিনে উঠতে পারে না! ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই লোকটি একেবারে ওর সম্মুখে এসে দাড়ায়। বিহ্বল নয়নে বলে,
— “আপনি কাঁদছেন?”
প্রশ্নটা যেন চারুকে নয়, সে নিজের মনেই করলো। চারু জবাব না দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো। লোকটাকে সে চিনতে পেরেছে। সৌভিক ভাইয়ার বন্ধু; নিখিল নওশাদ। তার জন্য পুরোপুরিই অপরিচিত একজন মানুষ। এরকম কারো সামনে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের হতাশা, বেদনা প্রকাশ করে দেয়ার মত মেয়ে সে নয়। নিজের হতভাগ্যের বর্ণনা কাউকে বলে, সহানুভূতি কুড়ানোর মানসিকতাও ওর নেই। চোখ মুছে ওর দিকে না চেয়েই পাল্টা প্রশ্ন করলো,
— “আপনি? এতরাতে এখানে কি করছেন? ঘুমাতে যান নি কেন?”
সহসা কথা বলতে পারলো না নিখিল। নির্বাক দৃষ্টিতে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো জোৎস্না স্নাত চারুকে। চারিদিকের নিঃস্তব্ধ নিরালোকের মাঝে অতীন্দ্রিয় দেবীর মতো রূপবতী নারীর ক্রন্দনরত মুখশ্রী, অদ্ভুত রহস্যময়তার সৃষ্টি করেছে। সেই রহস্যময়ীর ভেজা চোখের দিকে অনিমেষ চেয়ে ঢিমে যাওয়া গলায় নিখিল শুধায়,
— “একই প্রশ্ন তো আমিও করতে পারি। এতরাতে না ঘুমিয়ে আপনি কি করছেন? এই একা ছাদে, খোলা আকাশের নিচে দাড়িয়ে— কীসের ব্যথায়, কার জন্য কাঁদছেন? কেন ব্যাকুল হয়ে বিসর্জন দিচ্ছেন নিজের মূল্যবান অশ্রুজল? বলুন, এই প্রশ্ন কি আমি আপনাকে করতে পারি না?”
কণ্ঠে আশ্চর্য মাদকতা মিশে। নিচু স্বর অথচ প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট করে উচ্চারণ করা। বলার ভঙ্গিতেও একটা দুঃখবোধ আছে। না, সে ওর জন্য নয়, নিজেরই জন্য বোধ হয়!
অতলস্পর্শী সেই কণ্ঠের ঝংকারে বিমুগ্ধ হয় চারু। মনে হয়, এতো সুন্দর মায়াময় সুরে যে তার দুঃখ জানতে চাইতে পারে, নির্দ্বিধায় যেন তাকে সবটা বলে দেয়া যায়! কিন্তু সে কি করে বলবে, তার অন্তরের গভীরতম স্থানে, একান্ত নিভৃতে যে ব্যথা আছে — সে কথা?
তুষের আগুনের মতো যে জ্বালা তার অন্তরে অচিন কোণে! সতেজে প্রত্যুত্তর করলো,
— “না, পারেন না। আপনি এ-বাড়ির মেহমান। সে হিসেবে মেহমান কেন না ঘুমিয়ে ছাদে পায়চারি করছে তা জানতে চাওয়া আমার কর্তব্য। কিন্তু আমার বিষয়ে আপনার প্রশ্নটা ঠিক যায় না। অধিকার থাকে না।”
নিখিল একটুও দমে না গিয়ে বলে,
— “অধিকার না থাক। নিতান্ত সৌজন্য রক্ষার্থে হলেও আমি কথাটা জিজ্ঞেস করতে পারি?”
অন্য দিকে ফিরে চারু। ওকে কিছু বলতে না দেখে নিখিল স্মিত হাসে,
— “প্রশ্নটা ব্যক্তিগত পর্যায়ের হয়ে গেছে, বুঝতে পারছি। আসলে মাঝরাতে একটা মেয়েকে নির্জনে একাকি কাঁদতে দেখে কৌতুহল জাগ্রত হওয়া স্বাভাবিক। তাই বলে ফেলেছি। আপনি কিছু মনে করবেন না।”
বলে একপল তাকায় নীরব চারুর পানে। ওর মৃদু ঘাড় নাড়াতেই ফের বলে,
— “অনধিকার চর্চা হচ্ছে জানি, তবুও না বলে পারছি না। কান্না কোনো কষ্টের শেষ করতে পারে না। যদি পারতো তবে পৃথিবীতে দুঃখ বলতে কিছু থাকতো না। ধৈর্য ধরে বিপদকে হাসিমুখে জয় করুন। সৃষ্টিকর্তা আপনার পাশে থাকবে। দেখবেন, দিনশেষে বিজয় সুনিশ্চিত। আমি কথাপাগল মানুষ, কথা বলতে ভালোবাসি। তাই বলে ফেললাম এসব। নিজগুণে ক্ষমা করবেন। আর একটা কথা মনে রাখবেন, চাঁদের মুখে কান্না মানায় না। তাকে উজ্জ্বল হাসিতেই শোভা পায়।”
চাঁদের সঙ্গে তুলনা দেয়ায় চমকে উঠে চারু। নিখিলের অন্তর্ভেদী দৃষ্টির সামনে আড়ষ্ট বোধ করে। নিখিল চমৎকার হেসে ফিরে যাবার জন্য পা বাড়িয়ে শেষ কথাটা বলে যায়,
— “কষ্ট থাকুক আর যাই থাকুক, এখন হাসিমুখে গিয়ে চোখ বুঁজুন। বোনের বিয়েতে কাজ অনেক। না ঘুমালে চলবে? আমার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গিয়েছিল বলে ছাদে এসেছিলাম, হাওয়া খেতে। এখন ঘুম পাচ্ছে। আসছি!”
নিখিল চলে যাবার পরও সেখানে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে থাকে চারু। একটা অপরিচিত লোক তাকে নিয়ে কতো কি বলে গেল, অথচ সে নির্বাক-নিশ্চল!

চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here