যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয় #আফসানা_মিমি |পর্ব: ষোলো|

0
182

#যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয়
#আফসানা_মিমি
|পর্ব: ষোলো|

অন্তিকের চোখের সামনে অন্ধকার। লজ্জায়, হীনতায় মাথা নুইয়ে আছে তার। একজন পুরুষের অক্ষমতার কারণ ভীষণ লজ্জাজনক। এতো বছর সে তার জীবনের সত্যটা মনের কুঠায় লুকিয়ে রেখছিল। সে জানতো একদিন না একদিন সত্য প্রকাশ পাবে তাই বলে এভাবে? মিষ্টিও নির্বিকার, অন্তিকের চোখে কী সে অপরাধী হয়ে গেছে? কিন্তু সে তো নির্দোষ। তার পেটের সন্তান অন্তিকেরই। মিষ্টি ভীত পায়ে অন্তিকের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে। আঁজলা ভরে দু হাতে ধরে ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে ওঠে,” আমি কোন পাপ করিনি, অন্তু! এই বাচ্চা আমাদের।”

অন্তিক মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। মিষ্টি সেখানে বসেই কাঁদতে থাকে। লায়লা বেগমের মুখের রেখা বৃদ্ধি পায়। আজ সে মনের ঝাল মেটাবে। মিষ্টিকে চার মাসের প্রতিটা দিনের হিসাব দিবে। মিষ্টির হাত ধরে দাঁড় করায় লায়লা। বেশ দাম্ভিকতার সহিত বলতে শুরু করে, ” তা কই গেল তোমার তেজ? এতো অহংকার কোথায় ঠেকলো! মাথা কা’টা গেলো তো! অবশ্য পাপিষ্ঠা নারীর লজ্জা বালাই কমই থাকে। বেশ্যাবাড়ি গমন বেশি থাকলে কী চক্ষুলজ্জা থাকবে? তা কার পাপ নিয়ে ঘুরছিস নষ্টা মেয়ে, তোর প্রাণপ্রিয় স্বামীর তো টিউব নষ্ট। ঐ টিউব শুধু চলতেই পারব বাচ্চা পয়দা করতে পারব না।”

মিষ্টি হাত ঝাড়া দিয়ে লায়লা বেগমের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। মানুষের মুখের ভাষা এতোটা বিশ্রী হতে পারে তা লায়লা বেগমকে দেখেই উপলব্ধি করা যায়। ঘৃণায় মিষ্টির শরীর রি রি করছে।
” আপনাদের মতো কিছু মহিলাদের জন্য আজ মা জাতি খারাপ। আর রইলো বাচ্চার কথা, আমি এবং আমার প্রভুই জানে সত্য কী? আপনাদের ছেলেও যদি এই ভুল ধারণায় বসবাস করে তবে আমি তার চোখ খুলে দিব।”

লায়লা বেগম গগনবিদারী অট্টহাসি দিয়ে কলির হাত থেকে কাগজপত্র মিষ্টির মুখে ছুড়ে মেরে প্রত্ত্যুত্তরে বলে, ” শহরের বড়ো বড়ো হাসপাতালের ডাক্তারের রিপোর্ট এখানে, যাতে স্পষ্টত লেখা আছে, অন্তিকের বাবা হওয়ার ক্ষমতা নাইন্টি পার্সেন্ট সম্ভাবনা কম।”

মিষ্টি কাঁপা হাতে রিপোর্টগুলো উঠায়। রিপোর্টে অন্তিকের ছোট বেলা থেকে শুরু করে যুকব বয়সেরও রিপোর্ট বিদ্যমান। অর্থাৎ ছোট বেলা থেকেই তাকে ডাক্তার দেখানো হচ্ছে। মিষ্টির চোখের সামনে থেকে সকল রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। সে জমিনে বসে পেটে হাত রেখে বিড়বিড় করে বলে, ” এসব মিথ্যা, আমাদের পবিত্র ভালোবাসায় এই বাচ্চা এসেছে। শোন বাবু, তুই একদম কষ্ট পাবি না। মা আছে তো! আমি সব ঠিক করে দিব।”

লায়লা বেগমের অকথ্য ভাষা তখনও থামেনি। মিষ্টির উপর তার সমস্ত রাগ ঝাড়ছে।
” এমন পাপী মেয়ের মোল্লা বাড়িতে জায়গা নাই। বের হয়ে যা ন’ষ্টা মেয়ে। মোল্লা বাড়ির মতো বংশের মান খারাপ করে দিয়ে এখনো পড়ে আছে। তুই বের হবি নাকি ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিব!”

লায়লা বেগম মিষ্টির হাত ধরে ঘর থেকে বের করতে নিলে সেখানে মিষ্টির দাদী এসে উপস্থিত হয়। মিষ্টির পিছনে আফিয়ার কাপাকাপি অবস্থা। এমন পরিস্থিতির সামনে প্রথম দাঁড়িয়ে সে। বয়োঃবৃদ্ধা নাজমার চাহনি তীরের মতো লায়লা বেগমের মনে গেঁথে। সে মিষ্টির হাত ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। মিষ্টির দাদী রাগে থরথর করে কাঁপছে। লায়লা বেগমের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দেয় সে। মিষ্টিকে বুকে টেনে বলে, ” জেনে শুনে নাতনিকে নরকে পাঠিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, পাপ পূন্যের মিলনে যদি পদ্মের জন্ম হয়, তাহলে দোষ কীসের? সবারই তো সুখে বেঁচে থাকার হক রয়েছে। কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম পাপী পাপীই হয়। পূন্য পাপের কাছে পাপিষ্ঠ মনে হয়, সে যে মূল পাপী তা ভুলেই বসে। আজ বাড়ির মাথা গত হয়েছে। আজকেই নাতনিকে বাড়ি ছাড়া করা হচ্ছে! শুনো বড়ো বউ, মেয়ে জাত হয়ে জন্ম নিছো তুমিও যে ছাড় পাইয়া যাবা ভাববে না। মরন একদিন সবাইকেই গ্রহণ করতে হবে। ক্ষমতার দাপটে এখন যাদের দূর দূর করছো, শেষ বয়সে পাশে কাউকে পাও কী না দেখে নিও।”

লায়লা বেগম যেন কথা শুনেও শুনেনি। সে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করে। নাজমা বেগমকেও হেয় করে বলে, ” আমাকে আঘাত করছেন, করেন। শাক দিয়ে মাছ ঢেকে কী করবেন, চাচী আম্মা। অতিথি হয়ে আসছেন তবুও বলতে হচ্ছে, যেই বংশের মেয়ের চরিত্রের দোষ আছে সেই বংশের বড়োরা কেমন জানা হয়ে গেছে।”

নাজমা বেগমের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। তিনি মিষ্টির হাত ধরে বলেন, ” আমার নাতনি যদি খারাপ হয় তাহলে তুমি জঘন্যতম খারাপ। যেই বাড়িতে আমার নাতনির সুখ নেই সেখানে থাকারও দরকার নেই। আমার নাতনিকে নিয়ে চলে যাচ্ছি।”

” আমাকেও নিয়ে যাবেন, খালা! এই বাড়িতে দম বন্ধ হয়ে আসছে।”

কায়েসের কথা শুনে সকলেই দরজার দিকে তাকায়। মিষ্টি দৌড়ে শ্বশুরের কাছে গিয়ে বলে, ” আমাকে বিশ্বাস করুন, বাবা। আমি কোনো খারাপ কাজ করিনি। আমি আপনাকে, অন্তুকে একা ফেলে কোথাও যাব না।”

কায়েস মিষ্টির মাথায় হাত রেখে বলে, ” তুমি পূন্য, পবিত্র। কোন অপবিত্র তোমাকে ছুঁতে পারেনি। আমি বিশ্বাস করি তোমাকে। তবে আমার সাহসী মা যে আজ দুর্বল হয়ে গেছে তার জন্য আমি কষ্ট পেয়েছি, মা!”

মিষ্টি ছলছল চোখে শ্বশুরের দিকে তাকান। নাজমার সাথে আসা আগন্তুক মহিলা মাটি থেকে রিপোর্টের কাগজগুলো তুলে নেন। লায়লা বেগম তখনও কটুক্তি করেই যাচ্ছে, ” আপদকে সহ নিয়ে যান। পারলে কবর থেকে ঐ বুড়াটাকেও তুলে নিয়ে যান। বলে দেই, সম্পত্তির অধিকার পেতে দুয়ারে আসলে লাথি দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিব।”

মিষ্টি দুর্বল পায়ে দাদীকে নিয়ে বের হয়ে যায়। আফিয়া সবকিছুর প্রত্যক্ষদর্শী। শাশুড়ির কাছে এসে বলতে শুরু করে, ” এবার বুঝেছি, কেন আপনার সন্তান আপনার চেহারাও দেখতে চায় না। আজ থেকে আমিও দেখতে চাইব না। আমার পান্না কখনো জিজ্ঞেস করলে বলব, তার দাদা দাদী কেউ নেই।”

আফিয়া চলে যেতেই লায়লা বেগম উচ্চ আওয়াজে হাসে। কলি এতক্ষণ মায়ের পিছু লুকিয়ে ছিল। সকলে চলে যেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলে, ” আপদ বিদায় হয়েছে। এবার অন্তিক ভাই শুধুই আমার।”

লায়লা বেগম কথাটা শোনার সাথে সাথেই কলির গালে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। কলির চুলের মুঠোয় ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,” আরেকবার ঐ সর্বনাশার নাম শুনলে ভুলে যাবো তুই আমার পেটের সন্তান। দা দিয়ে বাইশ টু’ক’রা কটে নদীতে ভাসিয়ে দিব।”

কলি মায়ের কথায় দমে গেলেও মনে মনে ঠিকই অন্য পরিকল্পনা করে নেয়।
———————–

বাসের জন্য অপেক্ষা করছে মিষ্টি। সে আপাতত বোরখায় আবৃত নারীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। চোখের পানি ফেলে বলতে শুরু করে, ” এমন হওয়ার কথা ছিল না তো, মনি! আমি তো চেয়েছিলাম আমার একটা সংসার হোক। একটি অসম্পূর্ণ সংসার সম্পূর্ণ হোক। একজন মা হারা সন্তানের জীবন রঙিন হোক। দাদা চলে গিয়ে সব শেষ হয়ে গেল।আমি হেরে গেলাম মনি।”

বাস চলে এসেছে। মিষ্টি অন্তিককে খুঁজছে। অন্তিকের খোঁজ কেউ জানে না। মিষ্টি ভেবে নিয়েছে অন্তিকও তাকে ভুল বুঝঋে লায়লা বেগমের মতো। মিষ্টি এই ভেবে ভীষন কষ্ট পাচ্ছে, অন্তিক কী মিষ্টিকে ভালোবাসেনি? মিষ্টি কী তার মনের গহীনে জায়গা করতে পারেনি! পরক্ষণেই মিষ্টি নিজের মনকে বলে, হয়তো মিষ্টিকে সে চিনতেই পারেনি। বুঝতেও পারেনি সে অন্তুর জন্য কতোটা পাগল সেই ছোট বেলা থেকেই।
কায়েস জিনিসপত্র গুছিয়ে মিষ্টির কাছে এসে বলে, ” অন্তিকও চলে আসবে। এই অবস্থায় বেশি চিন্তা করা ঠিক না।বাচ্চার ক্ষতি হবে।”

মিষ্টি বাসে উঠার জন্য পা বাড়াতে নিলেই পরে যেতে নেয়। তখনই একজোড়া হাত এসে মিষ্টিকে ধরে ফেলে।মিষ্টি তাকিয়ে দেখে অন্তিক মাথা নীচু করে মিষ্টিকে ধরে রেখেছে।খুবই সতর্কতার সাথে মিষ্টিকে নিয়ে বাসে উঠে সে। মিষ্টিকে বসিয়ে দিয়ে নিজেও পাশে বসে। পরিবারের সকলে ঠিকঠাক মতো বসতে পেরেছে কী না একবার পরোখ করতে নেয়। মিষ্টি অন্তিকের হাত শক্ত করে ধরে কাঁদছে।যেন হাত ছেড়ে দিলেই অন্তিক কোথাও চলে যাবে। অন্তিক হাতের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় মিষ্টির হাতের নখ অনেকটাই দেবে গেছে অন্তিকের হাতে সে মিষ্টির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,” এটা আমার হাত, তোমার ঘরের চাদর নয় যে আদর করার সময়ে খামচে ধরবে। অবশ্য যা হলো, দশমাস কাছে আসতে দিবে কী না কে জানে?”

অশ্রুসিক্ত নয়নে মিষ্টি তাকিয়ে আছে। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না সে এই মুহূর্তে তার অন্তুর পাশে বসে আছে। তার পুরোনো অন্তু। একদম স্বাভাবিক সে। মিষ্টিকে লজ্জায় ফেলতে দুষ্ট কথা বলছে। মিষ্টির কী হলো জানে না, অন্তিককে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ” আমি আর পারছি না, অন্তু! সংসারের কঠিন চাবিকাঠি নাড়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। আমি শান্তি চাই, বাঁচতে চাই।”

অন্তিক চোখ বন্ধ করে নেয়। মিষ্টির প্রতি তার ভরসা আছে। মিরাক্কেল বলেও কিছু আছে, এমনও হতে পারে বাচ্চাটা তারই! এক বুক আশা নিয়েই সে মোল্লা বাড়িতে প্রবেশ করতে নেয়। আফিয়া তখন বাড়ি থেকে বের হচ্ছিল। মিষ্টির সাথে ঘটা অন্যায়ের কথা তার থেকেই শুনে অন্তিক।কাল বিলম্ব না করে স্টেশনের দিকে রওনা দেয়। মিষ্টিকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে বলে, ” আমি সাথে আছি, চন্দ্রিমা! এক সমুদ্র ভালোবাসা নিয়ে তোমার কাছে আছি। সমুদ্রের পানি যেমন ফুরায় না তেমন আমার বিশ্বাস ভালোবাসা কখনোই ফুরাবে না।”

মিষ্টি নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করে নেয়। আগামীকাল কী হবে কেউ জানে না কিন্তু আজ মিষ্টি ঘুমাতে চায়, অন্তিকের বুকে মাথা রেখে আজ নিশ্চিত থাকতে চায়!

চলবে……………………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here