চুপিসারে (১৩) #রেহানা_পুতুল

0
457

#চুপিসারে (১৩)
#রেহানা_পুতুল

শ্রাবণ বিশ্বাস করলো নদী ইচ্ছে করেই মরে যাওয়ার জন্য এই কাজটি করলো। নয়তো সে সাঁতার জানে না। তবুও কেন পুকুরের পানিতে দূরে গেল?

শ্রাবণ ভয়ানক ক্ষেপে গেলো নদীর উপরে। নদীকে নিয়ে একটা নতুন ফন্দী এঁটে ফেলল #চুপিসারে।
হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক নির্দেশ দিলো নদীর শরীরের ভেজা পোশাক বদলে দেওয়ার জন্য। সুরমা দুজন মহিলা নার্সের সহযোগিতায় তাই করলো। নদীর জ্ঞান ফিরে এলো।
শ্রাবণের দৌড়ঝাঁপে ডাক্তারদের সুচিকিৎসায় নদী সুস্থ হয়ে গেলো ঘন্টা দুয়েকের মাঝেই। সিএনজি করে নদীকে নিয়ে শ্রাবণ ও সুরমা বাড়ি চলে এলো।
শ্রাবণ নদীর সঙ্গে পুরো পথ কোন কথা বলল না। বাড়িতে এসেও কথা বলেনি। এমনকি কোন জেদও প্রকাশ করেনি তার উপরে। সে সিএনজি থেকে বের হয়ে তাদের পুরোনো বাড়িতে চলে গেলো।

উঠানে সিএনজি থামলে রফিক, মোরশেদা, সারথি ছুটে গেলো। তারা নদীকে ধরে ঘরের ভিতর নিয়ে গেলো। জেলা সদরে রফিকের বড় কাপড়ের দোকান রয়েছে। স্টাফ ও ম্যানেজার রয়েছে। রফিক ভালো লাগলে দোকানে গিয়ে কিছুক্ষন বসে। টালি খাতাটা চেক করে। বিক্রির খোঁজ খবর নেয়। না ভালো লাগলে যায় না। সেই সুবাদে আজ ওয়ার্কিং ডে হলেও রফিক দেওয়ান বাড়িতে। তিনি নদীকে সন্তানতুল্য স্নেহ করেন। সেই অধিকারে নদীকে শাসন করলেন আদরের সুরে।
মা তুই নাকি সাঁতার জানিস না? শুনলাম আজ? তাহলে ঘাটের সিঁড়ি থেকে দূরে গেলি কেন?
হুম চাচ্চু। সারথির সাথে দুষ্টমি করতে করতে চলে গিয়েছি একটু দূরে। ভালো লাগছিলো। আর গরমও লাগছিলো বেশ।
মুখ করে গোঁজ বলল নদী।
পুকুরের কিনারার সুরমাকে রেখে সাঁতার শিখে নিবি এই কয়দিনে। তারপরে ইচ্ছেমতো সাঁটার কাটিস।
নদী ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালো।
রফিক দেওয়ান তৎক্ষনাৎ সুরমাকে পাঠিয়ে আমিন গাছিকে ডেকে আনলো। যুতসই দেখে একটা কলাগাছ কেটে পুকুরে ঘাটের কাছে পানিতে ফেলে রাখার আদেশ দিলো। আমিন মাঝি তাই করলো। এবং তার মুজুরি নিয়ে চলে গেলো। সুরমা ভাত এনে দিলে নদী ভাত খেয়ে নিলো।

দাদী কই?
কে দাদু ভাই? আয়। ভালা আছত?
হাফসা বিবি নামের উচ্চারণ পারে না বলে শ্রাবণের সামনে তার নাম ধরার চেষ্টাটুকুও করে না। পাশে যদি শ্রাবণ মনে কষ্ট পেয়ে যায় তাই। যদিও শ্রাবণ এটা বেশ বুঝতে পারে। সে সময় সুযোগ পেলেই দাদীকে দেখতে যায় তাদের পুরোনো বাড়িতে।
ভালো? তোমার নদী ভালো থাকতে দেয়? যত অকাজ কুকাজ সেই করবে।
কি হইছে ভাই?
শোন, বলে দুপুরের ঘটনা ব্যাখ্যা করলো শ্রাবণ দাদীর কাছে। এবং বলল,
তুমি এখন আমার সঙ্গে যাবে আমাদের বাড়ি। থাকবে। নদীকে ভালো করে বুঝিয়ে বলবে, এমন যেন আর মরার চেষ্টা না করে। তুমি বললে বুঝবে। তবে আমি যে শিখিয়ে দিলাম। তা একদম বলবে না। নয়তো আমার প্রতি ওর ভয় কমে যাবে।
আচ্ছা ল যামুনি। খাড়া বাথরুম থেইকা আইসা নি।

সন্ধ্যার আলো আঁধারি নেমে এলো ধরণীর কোলজুড়ে। বাহারি রঙের রক্তিম আকাশ ক্রমে ধূসর হয়ে এলো। শ্যামল প্রকৃতি নির্জনতার গান গাইবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সমস্ত দিনের লেনদেন চুকিয়ে ব্যস্ত পাখিরা নীড়ে ফিরে গেলো। মাগরিবের আযান শুরু হয়ে গেলো। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সুর বলা হয় এই আযানের ধ্বনিকে। মোর‍শেদা অজু করে নামাজ আদায় করলো। সবাইকেও তাড়া দিলো নামাজ পড়ার জন্য। তিনি নামাজ শেষে মোনাজাতে নদীর জন্য, নিজের সন্তানদের জন্য,পৃথিবীর সকল মানুষের কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করলেন স্রস্টার নিকট।
সন্ধ্যা মিলিয়ে গেলে শ্রাবণ ঘরে ঢুকলো। সঙ্গে নিয়ে এলো দাদী হাফসা বিবিকে। তিনি সোফায় বসলেন আরাম করে।মোরশেদা হেসে বলে উঠলো,
আম্মা চেয়ারম্যান নাতির সঙ্গে বড় ছেলের বাড়ি এলো। অথচ আমি বলে আম্মাকে কখনো আনতে পারিনাই। তার মানে হলো,আম্মার কাছে পদের মূল্য আছে। ঘরের বউর মূল্য নাই।
কি ব্যপার বড় বউ? তোমার কথার আদল আরুর মায়ের মতন হইলো কবে থেইকা? তোমার কথার সাইজতো এমন ছিলো না?
আধভাঙ্গা গালে হেসে পাল্টা প্রশ্ন করলো হাফসা বিবি।
মোরশেদা বলল,
আমার শাশুড়ী দেখি আজকাল রসিকতা বুঝে না। আগে খুউব বুঝতো।
এর মাঝেই সারথি ছুটে এসে দাদীকে পেঁচিয়ে ধরলো। হাফসা বিবির ঝুলে পড়া বাহুর চামড়া চিমটি করে টেনে ধরলো। গালভরা হাসি দিয়ে বলল,
দাদী ও দাদী? তুমি নাকি গাধী? আসো দুজন মিলে পা * দী।
এই বেয়াদ্দপ মেয়ে? কি কস এগুলো দাদীর সাথে? চোখ রাঙিয়ে বলল মোরশেদা।
আরেহ বউ থামো। আমারে কাছে পায় সাথী মশকরা করতে?
এই বুড়ি? আমি কারো সঙ্গী সাথি না। কেমন দাদী তুমি? নাতি নাতনির নাম সঠিকভাবে কইতে পার না? একবার শাবুন,সাবান,এখন সাথি। কয়দিন পর বলা শুরু করবা ছাতি,আর করি যাঁতাযাতি। হুহ। আমার নাম সারথি। মনে রাখবা। এই নামের অর্থ জানো? সফল বা বিজয়ী। আবার রথ চালকও বলে।
সারথি তুই প্রয়োজন না হলে সুরমার গা ঘেঁষে ঘেঁষে চলবি না আর। খবরদার বলে দিচ্ছি। নয়তো তোর ভাইয়ার কাছে নালিশ দিবো আমি।
মায়ের শাসানি পেয়ে সারথি পড়ার রুমে চলে গেলো।
আম্মা জানেন না। আজকাল ও ফাজিল হয়ে যাচ্ছে। দিনে দিনে সুপারিগাছের মতো লম্বা হচ্ছে। কিন্তু কোন আক্কেল জ্ঞান হয়নি। সুরমার সাথে থেকে থেকে ও এসব অসভ্য মার্কা ডায়লগ ও ভাষা শিখেছে।
হইছে আর কইবো না। আমি বইলা দিমু।
শুনলেই হয় আপনের পেয়ারের নাতনি।
শুনবো। দেইখো। নদী কই? আইজ নাকি পানিতে ডুইবা গ্যাছিলো?
আর বলবেন না আম্মা। আল্লাহ রক্ষা করছে। রুমেই আছে যান।
যামুনি। আগে পান দাও এক খিলি। শাবন আমার পানের বাটা নিতে দিল না। কইলো আমি যেমনে খাই তেমনে খাওনের পঞ্চ মসলা নাকি আছে তোমার কাছে?
হ্যাঁ আছে আম্মা। বাড়িতে নানা বয়সের লোকজন আসে এখন। তাই সবকিছুর ব্যবস্থা রাখতে হয়।

রফিক দেওয়ান এসে মায়ের পাশে বসলো। নানান কথায় গল্প জুড়ে দিলো। নিজেদের জায়গা ভাগ নিয়ে ভাই শফিকের প্রসঙ্গ তুলে কিছু কথা বলল।

শ্রাবণ সারথির রুমের দরজায় গিয়ে থামলো নদীকে দেখার জন্য। উঁকি মারলো খাটের উপরে। নদী উপুড় হয়ে শুয়ে আছে বিছানার মাঝ বরাবর। বাড়াবাড়ি রকমের মন খারাপ তার। রজতের কথা খুব মনে পড়ছে। একটু কথা বলতে ইচ্ছে করছে। রজত ভাই কি বাড়ি ফিরে এসেছে। এত অভিমান করে কেন? কি লাভ এত অভিমান করে। খালি নিজেকে পোড়ানো। এটার কোন মানে হয়? যেই সম্পর্কের ভবিষ্যতে সংঘাতময়। সেই সম্পর্ক তৈরি না করাইতো ভালো দুজনের জন্য। নদীকে ডেকে তার কল্পনার সুর বেসুরো করতে চায় না শ্রাবণ। নদী তাকে দেখার আগেই সে পা ঘুরিয়ে চলে গেলো নিজের রুমে। পিসি অন করে কিছু ফাইল নিয়ে সেখানে মনোযোগ স্থাপন করলো।
পান চিবোতে চিবোতে হাফসা বিবি নদীর কাছে গেলো। নিজের শীতল হাতটি নদীর পিঠের উপর রাখলো। নদী টের পেলো এটা দাদীর হাত। তাই বিশেষ হেলদোল দেখালো না।
একথা ওকথায় হাফসা বিবি নদীকে জিজ্ঞেস করলো,
পুষ্কুনীতে ডুইবা মরতে গ্যালি ক্যান বইন?
নদী তব্দা খেয়ে গেলো। থতমত কন্ঠে বলল,
কে বলল এটা তোমারে?
কে আবার? তোর চেয়ারম্যান সাহেব?
এইজন্য তুমি আসছ? আমাকে দেখতে?
হ। শাবন আমারে দেখতে গ্যালো। আমি তোর কথা জিগাইলাম।তখন কইলো তুই নাকি মরতে গ্যাছিলি?
নদীর অনেক রা*গ হলো শ্রাবণের উপরে। মন চাচ্ছে ঘুষি মেরে নাকমুখ ফাটিয়ে তক্তা বানিয়ে দিতে। কিন্তু এটা ইম্পসিবল তার জন্য। জুনিয়র সিনিয়রের ব্যবধান বিস্তর।
এমুন আর করিস না বইন আল্লার দোহাই লাগে বলে হাফসা বিবি মায়া মায়া কন্ঠে নদীকে আচ্ছা করে বুঝিয়ে দিলো। নদী দাদীর তুলতুলে পেট ধরে বলল,
দাদী আমি মরতে যাইনি। মরতে যাবো কোন দুঃখে।এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা অপবাদ দিলো উনি। ভাইয়া আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছে। সারথিকে জিজ্ঞেস করো। আমি পুকুরের ঘাটের পিলার ধরেই ছিলাম। সারথি আমাকে টান দিলো। অমনি আমার হাত ছুটে গেলো পিলার থেকে। আমি ডুবে গেলাম। এটা তোমার কাছে গিয়ে বলা লাগে উনার? মেয়েদের মতো পেটে কথা হজম হয়না তার?
যা হইছে, হইছে। সতর্ক হইয়া চলিস বইন।
রজত ভাইয়ের কি খবর দাদী? জানো কিছু?
হ এখন আছে ভালাই। রাফিয়া ফোম দিছিলো। বাড়িতে চইলা আইলো। কারণ তার বাপে বেশী অসুস্থ হইয়া পড়ছিলো। কি করবি রজতের লগে তোর জোড়া বান্ধা নাই যে।

রাতে সবাই একসঙ্গে হাসি ঠাট্টায় নৈশভোজ সেরে নিলো। তারপর মোরশেদা শ্রাবণের রুমে গেলো। বলল,
বাবা এখন তোর দাদীও আছে। কাল সকালে সবাই মিলে এনগেজমেন্টের তারিখটা করে ফেলো।
ঠিকাছে মা। তাই হবে।
পরেরদিন সকাল দশটার দিকে রফিক দেওয়ানের সেলফোন বেজে উঠলো। তিনি হ্যালো বলার পর ওপাশ থেকে যা শুনতে পেলেন, তারজন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here