চুপিসারে (১৪) #রেহানা_পুতুল

0
196

#চুপিসারে (১৪)
#রেহানা_পুতুল

পরেরদিন সকাল দশটার দিকে রফিক দেওয়ানের সেলফোন বেজে উঠলো। তিনি হ্যালো.. বলার পর ওপাশ থেকে যা শুনতে পেলেন, তারজন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না।
যেহেতু নাস্তার পরবর্তী সময়। তাই সবাই তার পাশেই উপস্থিত ছিলো। চায়ের কাপ হাতে সবার। কেউ মসলা চা কেউ মালাই চা খাচ্ছে। মালাই চা গরুর দুধ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। চায়ের উপরে দেয়া হয়েছে দুধের ঘন সর। হাফসা বিবি আসার উপলক্ষে স্পেশাল এই চা তৈরি। যা কিনা মাঝে মাঝেই তৈরি হয় শ্রাবণদের বাড়িতে। রোজ এককেজি করে দুধ রোজ নেয় তারা গ্রামের পাল বাড়ির গোয়ালা থেকে।
ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তির কথা শুনে রফিক দেওয়ানের মুখের অবস্থা থমথমে দেখা যাচ্ছে। তিনি ফোন রেখে দিলেন।
শ্রাবণসহ সবাই তার মুখের দিকে হা হয়ে চেয়ে আছে। এপাশে তার রিপ্লাইগুলো শুনে সবাই বুঝে গেলো কিছু।
হাফসা বিবির ভাঁজ পড়া কপাল আরো ভাঁজ হলো। তিনি পুত্রকে জিজ্ঞেস করলেন,
কিরে? কি হইলো হেগো মাইয়ার?
আম্মা,তাদের মেয়ের নাকি অন্যত্র রিলেশন আছে। যেটা তারা আগে জানতো না। মেয়েও ভয়ে তাদের বলতে পারেনি। এখন তাদের মাঝে এনগেজমেন্টের কথা চালাচালি হচ্ছে দেখে মেয়ে তার মাকে জানালো।
বিরস মুখে বলল রফিক দেওয়ান।
ওম! এইটা কোন কথা কথা হইলো? কোনভাবে হেগোরে রাজী করন যায় না রফিক? শাবন তো এই মাইয়ারেই পছন্দ করলো।
পাশ থেকে মোরশেদ বলে উঠলো শাশুড়ীর উদ্দেশ্যে,
আম্মার যা কথা। তাদের রাজী করায়া কি হবে? শ্রাবণ ভালো থাকবে এই মেয়ের সাথে? আল্লায় যা করে তার বান্দার ভালোর জন্যই করে। মেয়ের অভাব পড়বে নাকি? আমি অন্য মেয়ে খুঁজে বের করবো।

রফিক দেওয়ান ভারাক্রান্ত মনে বসে রইলেন কপালে হাত দিয়ে। বললেন,
আজকাল ভালো পাত্রী পাওয়াই হলো সোনার হরিণের মতো। আমি আমার পরিচিতজনের মধ্যে কিছু পাত্রীর খবর নিলাম। সেই একই অবস্থা। সবগুলো মেয়ের রিলেশনশিপ আছে। কোথায় যে মনমতো পাত্রী পাবো?
নদী ও সারথি হাত ধরাধরি করে উঠে চলে গেলো ঘরের বাইরে। মোরশেদাও চলে গেলো কাজের ব্যস্ততায়। শ্রাবণ নিরব হয়ে বসে আছে। তার বাবাও চলে গেলো ডাইনিং হতে। হাফসা বিবি উঠে গিয়ে শ্রাবণের কাঁধে হাত রাখলেন। বললেন,
জানি ভাই তোর এহন ম্যালা মন খারাপ। কাউরে দোষ দেওনের সুযোগ নাই তোর। এই মাইয়া তুই পছন্দ করছোত। তুইই নিজেই এই মাইয়ার লগে দেহা করলি। আইচ্ছা,তুই এই মাইয়ার চোখমুখ দেইখা ঠাহর করতে পারসনাই কিছু?

শ্রাবণ দাদীর দিকে তাকালো মেঘমুখে। বলল,
এইযে আমি তোমার বড় নাতি। এখন তোমার সামনে বসে আছি। এত বছর ধরে দেখে আসছ তুমি আমাকে। কোলে পিঠে করে বড়ও করেছো আমাকে। তাহলে এখন আমার মুখ দেখে তুমি বলতে পারবে আমার ভিতরের খবর? বা আমার মন কি চায়?
হাফসা বিবি বোকা বনে গেলেন। বেকুব চাহনি নিক্ষেপ করে জবাব দিলেন,
নাতো আমি ক্যামনে তোর দিলের খবর কমু? যার দিল সেইই জানে তার দিলের খবর।

ইয়েস। কারেক্ট আনসার। পাশ করেছো বিবি। বলেই শ্রাবণ টেবিলে চাপড় মেরে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এবং বলল,
তাহলে এবার তুমিই বল,আমি কিভাবে না জানা, ও ক্ষণিকের এক দেখায় একটা মেয়ের ভিতরের খবর জানবো? তার অভিব্যক্তি তো তখন স্বাভাবিক হাস্যোজ্জ্বল ছিলো। আচরণ নম্র ছিলো।

হাফসা বিবি আর ধোপে টিকলেন না রাজনীতি করা চেয়ারম্যান নাতির সঙ্গে। হাতের তসবিহ গুনতে গুনতে রান্নাঘরের উঠানে চলে গেলেন। শ্রাবণও উঠে গেলো তার রুমে। বিছানার শুয়ে ল্যাপটপে গান ছেড়ে দিলো।

মোরশেদার মোবাইলে নদীর মা রুবিনা ফোন দিলো। নদী মায়ের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলল। এখন সবসময় রুবি না ফোন দেয় মেয়ের খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য। আগে আরুর মায়ের মোবাইলে একবার ফোন দেওয়ার আগে দশবার ভাবতে হতো তার। এখন কোন দ্বিধা ছাড়া মন চাইলেই সে ফোন দিতে পারে। নদী মাকে শ্রাবণের বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার বিষয়টা জানালো। রুবিনা আফসোস করলো এবং মোরশেদার সঙ্গে কথা বলে শান্তনা দিলো যেন মন খারাপ না করে।
হাফসা বিবি দুইদিন থেকে চলে গেলেন। আরু এসে তাকে নিয়ে গেলো। শুক্র শনি গানের ক্লাসে নদী এখন একাই যায় একাই আসে। আজ আসার পর হতেই তার মন বেজায় খারাপ। রুমে গিয়ে চেয়ারে বসে আছে।
সুরমা ভাত দিলো তাকে। কিন্তু নদী খেল না বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও। অন্যদিন এসেই ঠান্ডা ভাত খাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে যায়। সুরমা এসে বিষয়টা মোরশেদাকে জানালো। মোরশেদা নদীকে জিজ্ঞেস করেও কথা বের করতে পারছে না। নদী সারথির কাছেও বলল না। রফিক দেওয়ান এসে নদীকে জিজ্ঞেস করলো মন খারাপের কারণ। নদীর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে বৃষ্টির ফোঁটার মতন। হাতের পিঠ দিয়ে ঢলে দুচোখের কোণ মুছে নিলো। অতঃপর বলল,
আমি আর গান শিখব না চাচ্চু। গানের ক্লাসে আজ আমাকে ইনসাল্ট করেছে অন্য মেয়েরা।
কি বলল শুনি? জিজ্ঞেস করলো মোরশেদা।
আমি গানের স্কেল ধরতে পারিনি। সুর,তাল,লয়,ছন্দ সব বাজে হয়েছে। তখন গানের ম্যাম আমাকে জিজ্ঞেস করলো প্র‍্যাক্টিস করা হয়না কেন? ফ্যামিলিতে কে কে আছে? বাবা মা কি করে? আমি সব বললাম। তখন পাশ থেকে অন্যমেয়েরা ফোঁড়ন কাটতে শুরু করলো। বলল,
ফকিরের শখ দেখো। বাক্ষ্মণ হয়ে চাঁদ ধরতে চায়। হারমোনিয়াম কিনতে পারে না। আবার গায়িকা হবে উনি।

সবাই নদীর সামনে থেকে চলে গিয়ে শ্রাবনের রুমে ঢুকলো। রফিক দেওয়ান ছেলেকে আদেশ দিলেন নদীর জন্য যেন হারমনিয়াম কিনে আনা হয়। মোরশেদা বলল,
কারো দায়িত্ব নিলে সবটুকু নিবি। আধাআধি নিলে তারও লস। তোরও লস।
বিচক্ষণ শ্রাবণের মায়ের কথা বুঝতে অসুবিধা হলো না। বলল,
আমি যেহেতু ওর গান শেখার দায়িত্ব নিয়েছি। তখন কি হারমোনিয়াম বা যাবতীর যা লাগে কিনে দিতাম না?
হ দিতি। দেওয়ার নমুনাতো রুমে গিয়ে দেখে আয়। কি রকম অপমানিতবোধ করলে সে আর গান শিখবেই না বলল।
আচ্ছা তোমরা যাও। আমি দেখছি তারে।
তারা স্বামী স্ত্রী চলে গেলো।
শ্রাবণ ও সারথি নদীর রুমে ঢুকলো। নদী মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে।
রেডি হ। হারমোনিয়াম কিনতে যাবো।
লাগবে না ভাইয়া। আমি গান শিখব না।
শ্রাবণ জানে নদী স্বভাবে একরোখা জেদী। যেটা বলে সেটা করেই ছাড়ে। যাবে না বলছে যাবেই না। তাই শ্রাবণ নদীকে আর ঘাটালো না। নদীর সামনে হতে চলে গেলো। ঝটপট রেডি হয়ে চলে গেলো হারমোনিয়াম কিনতে। কয়েকঘন্টা পর রিকশায় করে একটি সুন্দর কালো রঙের হারমোনিয়াম নিয়ে ঘরে ঢুকলো। ড্রয়িংরুমে রেখে ফের বের হয়ে গেলো বাইক চালিয়ে। পৌরসভার চেয়ারম্যানের অফিসে গেলো জরুরী মিটিংয়ে। সারথি নদীকে টেনে নিয়ে এলো হারমোনিয়ামের কাছে। রফিক ও মোরশেদা এলো। রফিক নদীর মাথায় হাত বুলিয়ে খানিক পরে চলে গেলো। মনোনিবেশ করলো জাতীয় দৈনিকে। নদী ফ্যালফ্যালিয়ে চেয়ে রইলো হারমোনিয়ামের দিকে। সবার খুশি খুশি মুখ। কাজ ফেলে সুরমাও এলো। নদীর দিকে চেয়ে বলল,
নদী আপা গান শিখলে আমিও তার কাছে শিখমু। মমতাজের গান শিখমু আমি।
” ফাইট্টা যায়,ওরে বুকটা ফাইট্টা যায়..বন্ধু যখন বউ লইয়া… ”
মোরশেদা কটমট চোখে তাকালো সুরমার দিকে। সুরমা বোবা বনে গেলো।

দুপুর হয়ে গেলে সারথি ও নদী পুকুরে গোসল করতে গেলো। এই কয়দিন নদী একটু একটু করে কলাগাছ ধরে সাঁতার শিখে নিচ্ছে। আজকেও সাঁতার কাটছে কলাগাছের উপর দুইহাত দিয়ে উপুড় হয়ে। শ্রাবণ এসেই পুকুর ঘাটের দিকে পা বাড়ালো হাতমুখ ধোয়ার জন্য। দেখতে পেলো নদীর গায়ে কামিজ নেই। ভেজা সেমিজটা লেপ্টে আছে শরীরের সাথে। নদী তাকে দেখার আগেই সে পা পিছিয়ে সরে গেল। মনে মনে বলল,
এত উদাম হয়ে খোলামেলাভাবে হিন্দি ফিল্মের নায়িকা হয়ে গোসল করতে হয়? বেক্কল কোথাকার। পারে শুধু গোঁড়ামি করতে।
নদী ও সারথি উঠে এলে শ্রাবণ গেলো পুকুর ঘাটে। নদী আড়চোখে শ্রাবনের দিকে চাইলো।
আজ নদীর এসএসসির রেজাল্ট দিয়েছে। নদী এ প্লাস পেয়েছে। সেটা তার আগেই শ্রাবণ জেনেছে। সে বাইরে ছিলো তখন। একবারে অনেক মিষ্টি নিয়ে বাড়িতে এসেছে। সবাই সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে দিলো। শ্রাবণ দেখলো নদী তাকে ছাড়া সবাইকেই মিষ্টি খাইয়ে দিলো নিজের হাতে। কিন্তু তাকে খাইয়ে দিল না।
সারথি বলল,
ভাইয়া নদীপু তোমাকে ভয় পায়। তাই তোমাকে মিষ্টিমুখ করাতে সাহস পাচ্ছে না। তুমি নদীপুকে খাইয়ে দাওনা।

দিবো? তুই বলছিস।
শ্রাবণ একটা মিষ্টি হাতে নিলো। নদীর মুখের সামনে ধরলো। পরে খাবো বলে নদীরে সরে গেলো দ্রুত। শ্রাবণ রে*গে গেলো। নদীর সামনে থেকে সরে গেলো।
নদী মাকে ফোন দিয়ে কেঁদে ফেলল। মাকে আসতে অনুরোধ করলো তারকাছে। তার মা বলল,
মারে আমি সেই পরিবারের কেউই নয়। আমার যাওয়া সাজে না। তুই চলে আয়। থেকে যা দুইদিন।
আচ্ছা আসবো আম্মা।

নদীর রোল নাম্বার রজতের কাছেও ছিলো। তাই সে রেজাল্ট দেখেই নদীকে দেখতে চলে এলো বিকেলে। রজতকে দেখে নদী আনন্দে আটখানা হয়ে গেলো। রজত তাকে মিষ্টি খাইয়ে দিলো। নদীও নিজ হাতে রজতকে মিষ্টি খাইয়ে দিলো।

শ্রাবণ তার রুম থেকে পুরো দৃশ্যটা দেখলো। এবং মনে মনে বলল,

মিস নদী, পইপই করে সব হিসেব গুণে নিবো তোর থেকে। এক কানাকড়িও বাকি রাখবে না চেয়ারম্যান ইশতিয়াক দেওয়ান শ্রাবণ।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here