চুপিসারে (১৫) #রেহানা_পুতুল

0
208

#চুপিসারে (১৫)
#রেহানা_পুতুল

শ্রাবণ তার রুম থেকে পুরো দৃশ্যটা দেখলো। এবং মনে মনে বলল,

মিস নদী, পইপই করে সব হিসেব গুণে নিবো তোর থেকে। এক কানাকড়িও বাকি রাখবে না চেয়ারম্যান ইশতিয়াক দেওয়ান শ্রাবণ।

সারথি নাক কুঁচকে আহ্লাদী ঢংয়ে বলল,

কি ব্যাপার আপু? তুমি দেখি আস্ত একটা শয়তান। যে নিজের টাকায় মিষ্টি কিনে আনলো,তুমি তার হাতে মিষ্টি খেলে না। অথচ রজত ভাইয়ার হাতে খেলে? মিষ্টি খাইয়েও দিলে উনাকে?

রজত একটা মিষ্টি নিয়ে জোর করে সারথির মুখে পুরে দিলো। স্মিত হেসে বলল,

নদী আমাকে খাইয়ে দিলো। আমি তোকে খাইয়ে দিচ্ছি। শোধবোধ।

সারথি মিষ্টি ফেলে দিলো উঠানে গিয়ে।বিরক্তিকর চোখে চাইলো রজতের দিকে। রজত, শ্রাবণ, মামা, মামির থেকে বিদায় নিলো।

তার মামা বলল,
থাক রজত। সকালে চলে যাইস।

না মামা,আসলাম ত নদীর রেজাল্টটা দেখেই ওকে মিষ্টিমুখ করাতে। নানির সাথে দেখা করেই বাড়িতে চলে যাবো।

তার মামী মোরশেদা বলল,
খুব ভালো করছিস। নদীর পড়াশোনার পিছনে এই পর্যন্ত অবদান বেশি তোরই। এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই কারো। শ্রাবণও এটা প্রায়ই বলতো। নারে শ্রাবণ?

হ্যাঁ রজত। মা ঠিক বলছে। তবে নদীর জন্য তোর আর খাটতে হবে না। ও যেহেতু আমাদের বাড়িতেই থাকবে সবসময়। সুতরাং ওর বাকি দায়িত্বগুলোও আমরা করবো। কারণ নদীকে বিয়ে করা পরের কথা,তুই নদীর জন্য সময় দিচ্ছিস। কিছু করছিস। তোর মানিব্যাগ থেকে মানি যাচ্ছে,এসবও ফুফু একদম নিতে পারে না। আর আমাদের বাড়িতে এমন কিছুই নেই।

ইতিবাচক সুরে বলল শ্রাবণ। রজত ও সব ইতিবাচকভাবেই নিলো। বিষন্ন হেসে বলল,

তা ঠিক বলছিস তুই।

মোরশেদা বলল,
তোর মা যে কি এক মানুষ। আরুকেই বউ বানাবে। নদীকে নয়। থাক বাবা মন খারাপ করিস না। জন্ম মৃত্যু বিয়ে আল্লাহর হাতে।

ঠিক তাই মামী। মেনে নিতে বাধ্য হলাম। তবে জেনে রাখুন আপনার ননদের এই ইচ্ছে কখনোই সফল হবে না। প্রয়োজনে আমি বিয়ে করবো না। চিরকুমার থাকবো।

অভিমানী স্বরে বলল রজত।

কি বলে পাগল ছেলে। বিয়ে করবে না নাকি। চিরকুমার থাকবে। আপার রাগ পানি হয়ে যাবে সময় গড়ালে আস্তে আস্তে। দেখিস।

রজত নদীকে ডেকে বলল,

এই নদী পাশ করলি যে, নানী,মামীর সঙ্গে দেখা করতে যাবি না?

যাবো রজত ভাই। দাঁড়ান একটু। গলা বাড়িয়ে বলল নদী।

আমিও যাবো নদীপুর সঙ্গে। বলল সারথি।

নদী ও সারথি শ্রাবণের সঙ্গে চলে গেলো তাদের পুরনো বাড়িতে।

যেতে যেতে রজত নদীকে কলেজের ভর্তির বিষয়ে জিজ্ঞেস করলো। নদী বলল,
বড় ভাইয়া,চাচ্চু যা ভালো মনে করে তাই হবে। এবং বলল আমার হারমোনিয়াম আছে এখন বাড়িতে।

রজত হেসে বলল,
তাইনাকি। খুব ভালো। একদিন গান শুনাইসতো।

একদিন কেন, শতদিন শতবার শুনাবো।

আচ্ছা নদী, তোর কি আমার কথা মনে পড়ে? বা খারাপ লাগে?

আপনি আমার নিজের মানুষ। মনে না পড়ার কি আছে। আর খারাপ লাগা তেমন হয় না। কারণ আমাদের দুজনের মাঝে কোন প্রেম ছিল না। কোন বন্ধুত্বতা ছিলো না। ছিল না বাড়তি ঘনিষ্ঠতা। তবে মধুর সখ্যতা ছিলো। বিয়ের কথা উঠলে আপনি ভেবে দেখলেন, আমি হলে ভালো হয়। প্রপোজাল দিলেন আম্মার কাছে। আম্মা ও আমি ভেবে দেখলাম আমার জন্যও আপনি পারফেক্ট পারসন। এখন যেভাবেই হোক এটা হবে না। এখানে উছিলা ছিলো একজন। আপনার আম্মা। আমার ফুফু। তবে এই সত্য আমাদেরকে মানতেই হবে। আপনি আমার আগের সেই রজত ভাই। সারাজীবনও তাই থাকবেন সেই ভালোবাসার জায়গায়। আপনার হৃদয়েও আমিও প্রিয় নদী হয়েই থাকতে চাই।

রজত নদীর মুখের দিকে তাকালো। বলল,
বাহ খুব গুছিয়ে, বুঝিয়ে,সাজিয়ে, কথা বলতে শিখে গেছিস দেখি। ভালোলাগলো।

বাড়িতে গিয়ে নদী নাহার বেগম,ও হাফসা বিবিকে সালাম দিলো। নাহার বেগম সৌহার্দপূর্ণ হাসি দিলো। নদীর সঙ্গে মার্জিত আচরণ করলো। তবে তার পাশে রজতকে দেখে অসন্তুষ্ট হলো। নদী মনে মনে বলল,

এই পৃথিবীতে কে নয় স্বার্থবাদী। এগিয়ে যাওয়া মানুষকে সবাই গুরুত্ব দেয়। আমাকে আরো গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে হবে। মন দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। ভালো রেজাল্ট করতে হবে। নানার বাড়িতে,নিজের বাড়িতে কম অবহেলা,উপেক্ষা,অনাদরের শিকার হইনি। তবে আর নয়।

রজত মিষ্টির প্যাকেট নানীর হাতে দিলো। এই মিষ্টি রজত আসতেই নিয়ে এসেছে এখানের জন্য। কারণ সে জানতো বড় মামার ঘরে তারাই মিষ্টি কিনে আনবে।
এখানে আনার কেউ নেই। নদী, একে একে সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে দিলো।

হাফসা বিবি নদীকে বলল,

শাবনরে খাওয়াছিস? এখনতো সেই তোর জন্য সব করতেছে।

না দাদী।

ওমা! এ কেমন কথা। গিয়ে খাওয়াইস কইলাম।

আচ্ছা দাদী।

সারথি বলল,

দাদী আমি সাক্ষী থাকব তোমার হয়ে। নইলে তোমার কাছে নালিশ দিবো।

রজত বলল,

এই বুড়িটা দেখি পুরাই সুবিধাবাদী। যখন যেই দল ক্ষমতায়। সেইদলের স্লোগান গায়।

হ হাঁচাই ত। আমার সময় শ্যাষ। যেইদিকে সুবিধা দেখুম সেই দিকেই টানুম। কিন্তু তোরগুলাও ভুইলা যামুনারে ভাই।

শেষ সন্ধ্যায় রজত চলে গেলো। সারথি ও নদীও চলে গেলো। আযানের পর রফিক দেওয়ান বাজারের দিকে চলে গেলো। মোরশেদা পাশের বাড়ির এক অসুস্থ পরিচিতজনকে দেখতে গেলো। সারথিও তার সঙ্গে চলে গেলো না নিতে চাইলেও। নদী একা কি করবে। তাই ড্রয়িংরুমের ডিভানে গিয়ে বসলো।
টিভি ছেড়ে দিলো।

গান বাংলা চ্যানেলের গানগুলো তার ভীষণ প্রিয়।

” শীতল বাতাসে দেখেছি তোমায়,
মেঘও মিলনে চেয়ে রাগ করোনা।
মন চায় তোমায় আজি রাতে..”

শ্রাবণ ঘুমিয়েছিলো। গানের জোরালো আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। উঠে গিয়ে মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে এলো। নদীর পিছনে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে চুপটি করে। নদী গুনগুনিয়ে গানটার তালে তালে গাইছে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে।

বাহ ভালোই তো গাইছিস স্রোতস্বিনী নদী। গম্ভীর স্বরে বলল শ্রাবণ।

আচম্বিতে শ্রাবণের গলা শুনে নদী হকচকিয়ে গেলো। ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। বলল,

ভা..ভা..ভাইয়া আপনি ঘরে?

কেন? অন্য কোথাও থাকার কথা নাকি আমার ?

নাতো।

তো এমন ভড়কাচ্ছিস কেন তাহলে?

নাহ আমি ভাবছি আপনিও বাইরে।

তাহলেতো একা ঘরে তোর ভয় পাওয়ার কথা।

নাহ। মানে..হ্যাঁ… ইয়েহ..

শ্রাবণ নদীর পাশে গিয়ে বসলো। বলল,

এমন করছিস কেন? আমি বাঘ? তোকে কড়মড়িয়ে কচকচ করে খেয়ে ফেলব?

নদী উঠে অন্য সোফায় বসতে গেলো। শ্রাবণ নদীর হাত ধরে পাশে বসিয়ে রাখলো। সামনে সেন্টার টেবিলে মিষ্টির প্যাকেট ও কাঁচাচামচ ছিলো। শ্রাবণ একটা মিষ্টি কাঁটাচামচে না গেঁথে হাত দিয়ে নিলো। নদীকে বলল,

হা কর।

নদী ঠোঁট ভিড়িয়ে ঝিম মেরে বসে আছে। রাগে নাকের ডগা লালবর্ণ ধারণ করেছে। মনে পড়ল দাদীর কথা।

কি ঠোঁট ফাঁক করছিস না কেন? বিষ খাওয়াচ্ছি নাকি তোকে?

নদী অল্প করে দুই ঠোঁট ফাঁক করলো।

শ্রাবণ মিষ্টি পুরে দিলো নদীর মুখে। নদী কামড়ে ধরে আছে মিষ্টি। শ্রাবণ নিজের দুই ঠোঁট নদীর ঠোঁটের উপর বসিয়ে বাকি অর্ধেক মিষ্টি নিজের মুখের ভিতর নিয়ে নিলো।

শ্রাবণ মিষ্টি খেতে খেতে নদীর দিকে শিহরিত চোখে চেয়ে আছে। নদী অনিচ্ছাসত্ত্বেও মিষ্টি খেয়ে ফেলল।

ভেরি গুড় নদী। খারাপ ভাবার কোন কারণ নেই। তুই অর্ধেক কামড়ে ধরে রেখেছিস। আমি না খেলে তা পড়ে যেতো। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়েছে। দুজনের দুজনকে মিষ্টি খাইয়ে দেওয়া হয়েছে।

শ্রাবণের এহেন কান্ডে নদী হতবাক। বাক্যহারা। শংকিত। বিরক্ত। দপদপ পায়ে উঠে গেলো শ্রাবণের সামনে থেকে। নিজের রুমে গিয়ে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছিলো। শ্রাবণ ও তার পিছন দিয়ে গিয়ে রুমে ঢুকলো।

তেজী গলায় বলল,
দরজা বন্ধ করছিস কেন?

মরার শখ হইছে তাই। আপনাদের বাড়িতে থাকি বলে যা ইচ্ছা তা করবেন আমার সঙ্গে? আমি কি আপনার কেনা দাসী? জোর করে আদায় করবেন কিছু?

ফুঁসতে ফুঁসতে বলল নদী।

শ্রাবণ নিমিষেই নদীর গালে কষে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। চিৎকার করে বলল,

তোর সমস্যা কি নদী? মিষ্টি কিনে আনলাম আমি। অথচ কি করলি তাতো দেখলাম। সেদিন আমি সরে গেলে গান শুনালি রজতকে। রজতের অধিকার আছে তোর উপরে, আমার নেই? সে তোর ফুফাতো ভাই। আমি কি? আমি তোর চাচাতো ভাই নই?

নদী কেঁদেই যাচ্ছে। শ্রাবণ ফ্রিজ থেকে বরফের টুকরো নিয়ে এলো। নদীর গালে বরফ ঘষতে গেলে,নদী ভয়ানক ক্ষেপে গেলো। বলল,

ভাইয়া আপনি আমার সামনে থেকে চলে যান বলছি। নইলে আমি সকালেই আম্মার কাছে চলে যাবো একবারেই।

তোর গাল লাল হয়ে আছে নদী।

তো আপনার কি? যান বলছি।

শ্রাবণ চলে গেলো নিজের রুমে। মন খারাপ নিয়ে বসে আছে। একটু পরে বাকিরা ঘরে চলে এলো।

রফিক দেওয়ান ঘরে ঢুকেই সবাইকে শুনিয়ে বলল,

শ্রাবণের বিয়ে ঠিক করে এলাম। এই মাসের আটাশ তারিখ শুক্রবার মেয়ে দেখতে গিয়ে একবারেই কাবিন করে ফেলব।

আলহামদুলিল্লাহ বলে এগিয়ে এলো মোরশেদা। শ্রাবণের মত জানতে চাইলো। শ্রাবণ বলল,

মা তোমরা যা ভালো মনে করো। আমার কোন আপত্তি নেই। সমস্যাও নেই।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here