মেঘের_শহর #পর্ব_২৯ #শেষ_পর্ব Saji Afroz

0
395

#মেঘের_শহর
#পর্ব_২৯
#শেষ_পর্ব
Saji Afroz

.

আজ বিকাল থেকেই অন্তরা আহম্মেদের শরীর টা খারাপ। নিজের রুমেই শুয়ে বসে দিন কাটিয়েছেন তিনি। বিকাল থেকে মাথায় ব্যথা বললেও রাতে তার জ্বর আসে। মিন্নী মায়ের সেবা করলেও মেঘ তাকে একবার দেখেই নিজের রুমেই বসে আছে।
হুরায়রার সাথে সময় কাটালে পৃথিবীর সমস্ত কিছু ভুলে যায় সে। মনেহয় তার চেয়ে সুখী কেউ নেই। সে যদি মেঘের রাজ্যে চলে যায়, তবে হুরায়রা আজীবন তার হয়ে থাকবে। এটা ভাবতেই মনের মাঝে অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে। সকাল থেকে ভেবেচিন্তে মেঘ সিদ্ধান্ত নেয়, সে হুরায়রা কে ছাড়া থাকতে পারবে না। চলে যাবে তার সাথে মেঘের রাজ্যে। তার পরিবার আগেও তাকে ছাড়া চলেছে। এখনো নিশ্চয় পারবে। মেঘের রাজ্যে সে পৃথিবীর সমস্ত কিছু ভুলে যাবে কিন্তু এখানে হুরায়রা কে না পাওয়ার বেদনা নিয়ে সে থাকবে কি করে!
মিন্নী রাতের খাবার খেতে ডাকলে মেঘ ডাইনিং রুমে আসলো। মিন্নীর সাথে খাবার খেয়ে নিলো। একটা বারো মায়ের কথা জানতে চাইলো না। খাবার শেষে মিন্নী বলল-
ভাইয়া তোমাকে মা ডেকেছে। গিয়ে দেখো কি বলে।
.
মেঘ চায়নি মায়া বাড়াতে। কিন্তু
মায়ের ডাকে সাড়া না দিয়েও থাকতে পারলো না মেঘ। সে মায়ের রুমে এসে তার মাথার কাছে বসলো। অন্তরা আহম্মেদ জানতে চাইলেন, সে খেয়েছে কি না। মেঘ খেয়েছে জানায়।
তা শুনে তিনি হেসে বললেন-
ভালো হয়েছে।
.
মেঘ কে নিশ্চুপ দেখে তিনি বললেন-
কেনো যেন ভয় হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে বিরাট এক ঝড় আসতে চলেছে আমার জীবনে। আপন কাউকে হারানোর ভয় পাচ্ছি। এমন টা কেনো হচ্ছে বলতে পারিস?
.
মায়ের কথা শুনে মেঘের বুকটা ধুক করে উঠলো। তিনি কিভাবে বুঝে গেলেন, এমন কিছু ঘটতে চলেছে!
অন্তরা আহম্মেদ আরো বললেন-
তুই আর মিন্নী ছাড়া আমার আর কে আছে বল? তোরাই আমার আপনজন। তোরা তো আমাকে রেখে কোথাও যাবি না। তবুও আমার মনে এসব উল্টাপাল্টা চিন্তা কেনো আসছে বলতে পারিস?
.
ভেজা গলায় কথাগুলো বললেন অন্তরা আহম্মেদ। তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। মেঘ তার চোখ মুছে বলল-
একটু ঘুমাও মা। তোমার শরীর টা দূর্বল।
.
মিন্নীও এসে উপস্থিত হলে তিনি বললেন-
আজ নিজেকে বাচ্চা বাচ্চা মনে হচ্ছে। মা বাবা কেউ তো নেই আমার। তোরাই আমার সব। একটা কথা রাখবি?
.
মিন্নী মায়ের পাশে এসে বলল-
বলো মা?
-আজ তোরা দুজনে আমার দুপাশে ঘুমোবি? কতদিন একসাথে থাকি না! খুব ইচ্ছে করছে তোদের মাঝখানে ঘুমোতে।
.
মেঘের দুচোখ ছলছল করে উঠলো মায়ের কথা শুনে। সে কিছু না বলে হ্যাঁ সূচক ভাবে মাথাটা নাড়লো।
মিন্নী মায়ের পাশে শুয়ে বলল-
কেনো থাকব না! তুমি বললে প্রতিদিনই থাকব তোমার পাশে।
.
মেঘও চুপচাপ শুয়ে পড়লো মায়ের পাশে। অন্তরা আহম্মেদ দুই ছেলে মেয়ের হাত শক্ত করে চেপে ধরে চোখ জোড়া বন্ধ করলেন। এখন যেন শান্তিতে ঘুমোতে পারবেন তিনি।
.
.
.
সাইয়ারার কাছে সবটা শুনে রাফিন হেসেছে। সে শুধু বলেছে-
তুমি বাচ্চাই থেকে গেলে।
.
রাফিন সাইয়ারা কে সময় নিতে বললেও তার পরিবার অস্থির হয়ে আছেন। রাফিনের মতো ছেলে তারা হাতছাড়া করতে চায় না। খালাও তাকে বেশ জোরাজোরি করছে। আজ রাতের খাবারের সময়ও একই কথা তুলেছেন। সাইয়ারা ভালোভাবে না খেয়েই ডাইনিং টেবিল ছেড়ে উঠে যায়। এরইমাঝে রাফিনের ফোন আসে। সে জানায়, তার আবারো দেশের বাইরে চলে যেতে হবে। সে চেয়েছিল যাওয়ার আগে সাইয়ারা কে বিয়ে করবে। মেঘ তো তার হুরায়রা কেই বিয়ে করবে সামনে। তবে সাইয়ারা কিসের আশায় বসে থাকবে? তারও জীবনে সুখে থাকার অধিকার আছে। আর সেই সুখটা রাফিনই তাকে দিতে পারে। রাফিনের মতো ভালো তাকে কেউ বাসতে পারবে না।
.
রাফিন আরো বলে-
আজকে সারারাত তুমি ভাবো। কাল আমি তোমাকে ফোন দিব। যদি তুমি আমাকে বিয়ে করতে রাজি থাকো তবেই ফোন রিসিভ করবে নাহলে কেটে দিবে। এতেই আমি তোমার উত্তর পেয়ে যাব। তোমার মুখে না শুনলে কষ্ট টা আরো বাড়বে। তাই কাটার কথা বললাম। তবে আমার বিশ্বাস, তুমি ফোন রিসিভই করবে।
.
রাফিনের সাথে কথা বলে শুয়ে পড়লো সাইয়ারা। মাথাটা ভীষণ ব্যথা করছে তার। কাল সে কি করবে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো।
.
.
.

সকালে ঘুম ভাঙতেই নাস্তা হাতে চিলেকোঠায় এল হুরায়রা। দরজা খোলা থাকায় সে সহজেই প্রবেশ করলো। কিন্তু ভেতরে ফাঁকা দেখে শহর কে খুঁজতে লাগলো সে। শহর তাকে না বলে কোথাও যায়নি। আজ সকাল সকাল কোথায় গেল!
টেবিলের উপরে একটা খামে চোখ পড়লো তার। হাতে নিয়ে দেখলো এটি পুনমের পাঠানো চিঠি। নিশ্চয় কালকের চিঠি টি।
অন্যজনের চিঠি বিনা অনুমতি তে পড়া উচিত নয়। তবুও শহর কে না পেয়ে সে চিঠি টি পড়তে শুরু করলো। মনে হচ্ছে চিঠি টি পড়লেই শহর কোথায় জানা যাবে।
পুনম শহরকে বিষণ্ণ শহরে ফিরে যেতে বলেছে। যেখানে পুনমসহ পুরো শহরবাসী তার তার অপেক্ষা করছে।
.
চিঠি টি পড়ে মৃদু হাসলো হুরায়রা। তবে নিশ্চয় শহর নিজের শহরেই ফিরে গেছে।
হুরায়রা রুমটা গোছাতে শুরু করলো। বাড়িওয়ালা কে জানাতে হবে, চিলেকোঠা এখন ফাঁকা। আর আজ মেঘ তার সাথে নিজের রাজ্যে যাবে। হুরায়রা কখনো ভাবেনি, পড়াশোনার জন্য যে মেয়ে নিজের রাজ্য ফেলে সাধারণ মানুষ দের সাথে বসবাস করছে আজ সেই মেয়ে ভালোবাসার জন্য সব বাদ দিবে। ভালোবাসা কত অদ্ভুত!
.
.
.

বউ সাজে জিকো কে দেখে কেমন লাগবে তা দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছে মোখলেস। তার বোন ও মা নিজের হাতে সাজিয়ে দিচ্ছে তাকে। তাদের বাসায় বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে ঘরোয়া ভাবে। আত্মীয়স্বজন কাউকে বলা হয়নি। কেবল শাপলা ও তার বাবা কে ছাড়া। অবশ্য শাপলার বাবা নিজেই আসার ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন।
শাপলা না আসতে চাইলেও বাবার জোরাজোরি তে আসতে বাধ্য হয়। মোখলেসের মাও তাকে খুব করে আসতে বলেছেন। কারণ শাপলার রান্না দারুণ। প্রিয়তমের বিয়ের রান্না নিজ হাতে করতে হয়েছে শাপলা কে।
.
রান্নাঘরে রান্নার কাজে ব্যস্ত শাপলা। এমন সময় মোখলেস এসে জানতে চায়, তার কিছুর প্রয়োজন আছে কি না।
-আমার প্রিয়জন কে প্রয়োজন।
-মানে?
.
কথা ঘুরিয়ে শাপলা বলল-
আপনার কিছু লাগবে?
-নাহ। তোমার কোনো সহয়তা লাগলে বলতে পারো।
-তার দরকার নেই। তাছাড়া আপনি ছেলেমানুষ।
-তবুও আমি রান্না পারি।
-বাহ! জেসিকা ভাবীর তো কপাল ভালো বলতে হয়। আমার হবু বরটা কেমন জানা নেই।
-তোমাকে বলেছিলাম দেখা করতে।
-যেমনি হোক , আমি মানিয়ে নিব।
-শুনলাম সামনেই বিয়ের তারিখ ঠিক হবে?
-হ্যাঁ।
.
শাপলার বাবা এসে তাড়া দিয়ে বললেন-
রান্না কতদূর মা?
-হয়ে আসছে।
-কাজি সাহেব বারোটার দিকেই আসবেন। তুমি নাস্তার ব্যবস্থা করেছ?
-আমি ভেবেছি দুপুরে আসবেন।
.
মোখলেস বলল-
সমস্যা নেই। মা সামলে নিবেন। তুমি যা করছিলে করো।
.
.
.

অন্তরা আহম্মেদের জ্বর টা বেড়ে গেছে। মিন্নীর আজ ক্লাসের পরীক্ষা আছে বলে তাকে কলেজে যেতে হয়েছে। যদিও সে চায়নি। কিন্তু অন্তরা আহম্মেদের জোরাজোরি তে যেতে বাধ্য হয়েছে।
মিন্নী যাওয়ার পর মা একা হয়ে যাওয়ার কারণে মেঘ বের হতে পারছে না। ওদিকে হুরায়রা নদীর পাড়ে তার জন্য অপেক্ষা করবে বলেছে।
মায়ের অবস্থা খারাপ দেখে ডাক্তার এনেছে মেঘ। অন্তরা আহম্মেদ জ্বরের ঘোরে আবোলতাবোল বলছেন। ডাক্তার তাকে দেখে বললেন-
চিন্তার কিছু নেই। রোগী হয়তো কোনো কারণে টেনশনে ছিলেন। তাই জ্বরের ঘোরে ওসব বলছেন তিনি। নিয়মিত মেডিসিন খাওয়ান, আর তার সাথেই থাকুন। ইনশাআল্লাহ সুস্থ হয়ে যাবেন দ্রুত।
.
ডাক্তার চলে গেলে মেঘ মায়ের পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। প্রচন্ড গরম হয়ে আছে তার শরীর টা।
অন্তরা আহম্মেদ বিড়বিড়িয়ে বললেন-
আমার মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা করছে। একটু টিপে দিবি বাবা?
-আমি দিচ্ছি আন্টি।
.
সাইয়ারা এসে অন্তরা আহম্মেদের মাথায় হাত রেখে বলল-
মিন্নীর কাছে শুনলাম আপনি অসুস্থ। আমাকে কাল কেউ বলেনি। নাহলে কালই আসতাম।
-অহেতুক তোমায় বিরক্ত করতে চায়নি কেউ।
-অহেতুক! আপনি আমার আন্টি না? আপনার শরীর খারাপ এটা আমাকে জানানোর প্রয়োজন ছিল। যাক এখন আমি মাথা টিপে দিচ্ছি, ব্যথা সেরে যাবে।
.
অন্তরা আহম্মেদ মেঘের দিকে তাকিয়ে বললেন-
হুরায়রা কে একবার ডাকবি? তোর দায়িত্ব ওকে দিয়ে যাব।
-কোথায় যাবে?
-মনে হচ্ছে চলে যাওয়ার সময় হয়েছে আমার।
-এসব কি বলছ বলো তো? জ্বরের ঘোরে অনেক বেশি উল্টাপাল্টা কথা বলছো তুমি।
.
অন্তরা আহম্মেদ হেসে বললেন-
আচ্ছা আর বলব না। আমার পাশে বসে থাক।
.
এভাবে মায়ের পাশে বসে থাকতে থাকতে সকাল এগারোটা হয়ে যায়।
মিন্নীও এসে উপস্থিত হয়। সে সাইয়ারা কে ধন্যবাদ জানায়। মেঘ ঘড়িতে সময় দেখে বলল-
মিন্নী তো এসেছে, এখন আমি একটু আসি মা?
-কোথায় যাবি?
-এই তো চলে আসব এখুনি।
-আচ্ছা।
.
মেঘ বসা থেকে উঠলে তার হাত টা ধরে ফেললেন অন্তরা আহম্মেদ। ভিজে গলায় বললেন-
তাড়াতাড়ি আসিস।
.
মেঘ চোখের পানি লুকিয়ে নিজের রুমে যায়। অন্তরা আহম্মেদ সাইয়ারার হাত ধরে বললেন-
হুরায়রা তো তোমারও পরিচিত তাইনা? তুমি একবার ডাকতে পারবে তাকে?
-জি পারব।
-আমি নিজেও প্রেমে পড়েছিলাম। করেছিলামও। কতটা ভালোবেসেছিলাম মানুষ টাকে। বিনিময়ে পেয়েছি ধোঁকা। সেই থেকে প্রেম বিরোধী আমি।
কিন্তু মেঘের ভালোবাসা কে সম্মান করেছি আমি। তবে আমার কি মনেহয় জানো? মেঘ হুরায়রা কে নিয়ে সুখে নেই। কোনো ঝামেলায় আছে সে। তাই আমার ছেলেটা ওমন পাগলের মতো আচরণ করেছে, ঘর থেকে মন উঠে গেছে তার। জানি না কি হলো। আমার হুরায়রার সাথে কথা বলার প্রয়োজন।
-জি। আমি এখুনি হুরায়রার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি।
.
সাইয়ারা রুম থেকে বেরুতেই দেখলো, মেঘ চোখ মুছতে মুছতে ঘরের বাইরে গেছে।
মেঘ তার মা কে এই অবস্থায় রেখে কোথায় যেতে পারে? নিশ্চয় হুরায়রার কাছে। তবে কি তাদের মাঝে সবটাই স্বাভাবিক আছে?
.
.
.

সমস্তা রান্নাবান্না সেরে শাপলা তার বাবার উদ্দেশ্যে বলল-
আমার এক বান্ধবীর শরীর টা ভীষণ খারাপ বাবা। তার বাসায় কেউ নেই। এখনই আমাকে যেতে হবে।
.
তা শুনে মোখলেস বলল-
তুমি আমার বিয়ে তে থাকবে না?
-হয়তো আপনার বিয়েতে থাকা আমার নসিবে নেই।
.
শাপলার বাবা তাকে আর আটকালেন না। সে বেরিয়ে পড়লো এই বাড়ি ছেড়ে।
সে মিথ্যে বলেছে। কারণ চোখের সামনে অন্য একজনের সাথে নিজের প্রিয় মানুষটির বিয়ে সে কি করে দেখবে!
.
এদিকে জিকো বউ সাজে পুরোপুরি তৈরী। কিন্তু তার বুকের মাঝে ধুকপুক করছে। বাসর রাতের কথা ভেবে নয়, নানারকম চিন্তায়! সে কি করবে বুঝতে পারছে না। শহরের কথাটি বারবার তার কানে বাজছে। হ্যাঁ, সে মোখলেস কে ঠকাচ্ছে। যা মোটেও উচিত হচ্ছে না। তাকে সবটা জানানো দরকার।
মোখলেস তার বোনের সাথে ভেতরে এল। তাদের একা কিছু সময় কাটাতে বলে তার বোন বেরিয়ে যায়। মুগ্ধ দৃষ্টি তে জিকোর দিকে তাকিয়ে মোখলেস বলল-
অপরূপা!
.
জিকো ধন্যবাদ দেয়ার বদলে চোখ বন্ধ করে এক নাগাড়ে বলল-
আমি জেসিকা নয়, জিকো। আমি ছেলে থেকে মেয়ে হয়ে যাই হুট করেই। তুই আমাকে দেখে মেয়ে ভেবেছিস। তাই আমিও আর কিছু বলিনি। বিশ্বাস কর তোকে ফাঁসানোর কোনো ইচ্ছেই আমার ছিল না। তুই নিজেই ফেঁসেছিস। পরবর্তীতে এতকিছু না চাইতেও ঘটে গেল। আমিও লোভে পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু নিজের ভুল এখন বুঝতে পারছি। আমাকে ক্ষমা করে দে বন্ধু। আমি খুবই লজ্জিত। এখান থেকে চলে যাচ্ছি আমি। ভালো একটা মানুষ হবার চেষ্টা করব।
.
জিকোর কথা শুনে প্রথমে নীরব থাকলেও পরে উচ্চশব্দে হেসে উঠলো মোখলেস। হাসতে হাসতেই বলল-
মজা করার আর সময় পাওনা? একটু পরেই আমাদের বিয়ে।
-আমি কোনো মজা করছি না। সত্যি বলছি।
.
এরইমাঝে মোখলেসের মা এসে বলল-
কাজি সাহেব চলে এসেছেন। আসো তোমরা।
.
জিকো বিড়বিড় করে বলল-
মোখলেস কে কিভাবে বিশ্বাস করাব, আমি আসলেই জিকো!
.
.
.

নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসলো হুরায়রা। জিকোর এই অবস্থা সেই করেছে। সে চেয়েছে জিকো মেয়ে হয়ে মেয়েদের কষ্ট উপলব্ধি করুক। এতে করে সে হয়তো বা একজন ভালো মানুষে পরিণত হবে সে। আজ জিকো তার ভুল বুঝতে পেরেছে। সে ভালো মানুষ হতে চায়। তাহলে তাকে আরেকটা সুযোগ দেওয়াই যায়। কিন্তু মেঘ টা কোথায় গেল! সেই সকাল থেকেই তার অপেক্ষা করছে হুরায়রা। তবে কি মেঘ আসবে না!
-আমি এসেছি হুরায়রা।
.
পেছনে ফিরে মেঘ কে দেখে হুরায়রা ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল-
আমি জানতাম তুমি আসবে।
.
হুরায়রা কে ছেড়ে মেঘ বলল-
আসতে তো আমাকে হতই।
-এত দেরী হলো যে?
-মায়ের শরীর টা খারাপ।
-কি হয়েছে?
-জ্বর।
-তবে কি কয়েকদিন পর যাবে তুমি আমার রাজ্যে?

-কেনো?
-মায়ের পাশে থাকো এখন।
-আর পরে যদি আবার মা অসুস্থ হয়?
-মিন্নী তো থাকবে।
-সে এখনো আছে।
-ওহ! তবে তুমি এখুনি যেতে চাও তো? তবে চলো।

.
হুরায়রা মেঘের হাত ধরলে সে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো মেঘ। হুরায়রা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়।
মেঘ বলল-
তুমি কাকে ছেড়ে যেতে বলছ জানো? আমার মা কে। কাকে ভুলে যেতে বলছ জানো?
আমার মা কে।
সেই মা কে, যার হৃদয় স্পন্দন থেকে আমি আমার হূদয়স্পন্দন পেয়েছি। ছোটবেলায় আমার জান গড়ে উঠেছে যার কোলে। তার মুখ থেকেই আমি ভাষা পেয়েছি, শিখেছি কথা বলতে। তিনি আমার জীবনের পরম আশ্রয়। তার লালনেই তো বিকশিত হয়েছে আমার জীবন। সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে সবকিছুতে তিনিই আমার পাশে ছায়ার মতো থাকেন। আমার মা-ই আমার সবচেয়ে প্রিয়জন। আর সেই মা কে তুমি ছেড়ে যেতে বলছ?
যে মানুষ টাকে আমার কিছু বলতে হয় না, মুখ দেখলেই সবটা বুঝে যায়। সেই মানুষ টাকে ভুলে যেতে বলছ?
.
মেঘের কথা শুনে হুরায়রা নিজের জায়গায় নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো। সে বুঝছে না তার কি করা বা বলা উচিত এখন।
.
.
.
কাজির সামনে বসেও হুট করে দাঁড়িয়ে পড়লো জিকো। সে বলল-
বিশ্বাস কর মোখলেস আমি জিকো।
.
কথাটি শুনে উপস্থিত সকলে দাঁড়িয়ে পড়লো। মোখলেস হেসে সবাই কে বসতে বলে বলল-
ও মজা করছে এসব।
.
কিন্তু জিকো বারবার একই কথা বলেই যাচ্ছে।
মোখলেস জিকোর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল-
মা কিন্তু রেগে যাবেন। এত বেশি মজা করতে হয়না সোনা।
.
জিকোও ফিসফিসিয়ে বলল-
আরে সোনা জাদু এসব কোনো মেয়েরে ডাকিস। আমি তোর বন্ধু জিকো। বোঝার চেষ্টা কর মোখলাইস্সা।
.
এই নামে তাকে জিকো ডাকতো। জেসিকা কিভাবে জানলো!
মোখলেস দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে বলল-
পাজি মেয়েটা জিকোর কাছ থেকে এসব শুনেছে নিশ্চয়। এসব ছাড়ো, তাড়াতাড়ি বিয়েটা সেরে ফেলি। তারপর বাসর রাত না, বাসর দিনই করে ফেলব আমরা।
.
জিকো একপ্রকার চেঁচিয়ে বলল-
নিজের বন্ধুর সাথে এসব করবি তুই?
.
যা শুনে মোখলেসের মাও চেঁচিয়ে বললেন-
এই মেয়ে মজা করার একটা সীমা আছে। বসো বলছি। তুমি জিকো হও বা হিজরা, বিয়ে তো তোমাকে করতেই হবে।
.
তিনি একপ্রকার জোর করেই মোখলেসের পাশে জিকো কে বসালেন। বাধ্য হয়ে জিকো বসে পড়লো। তার কথা কেউ বিশ্বাস করলো না যখন কিছু করার নেই আর। বিয়েটা বোধহয় হয়েই যাবে।
কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। সে কবুল বলার আগেই তার বোন চিৎকার করে উঠলো। সকলে তার দিকে তাকালে সে বলল-
আমার দিকে নও, সবাই ভাইয়ার পাশে দেখো।
.
মোখলেসের পাশে শাড়ি পরে বসে আছে জিকো! দৃশ্যটি দেখে সকলে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। একটা মেয়ে কে হুট করেই ছেলে রূপে দেখে কাজি সাহেব ভুত ভুত বলে দৌঁড়ে পালালেন। মোখলেস জিকো বলে জোরে চিৎকার করে জ্ঞান হারায়।
সকলে মোখলেস কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে জিকো বেসিনের সামনে এসে আয়নায় নিজের চেহারা টা দেখলো।
সে তার আগের রূপ ফিরে পেয়েছে!
সে মনে মনে শহর কে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল-
আমি এখন থেকে ভালো একজন মানুষ হবার চেষ্টা করব। নিজের পায়ে দাঁড়াব। আর তার পরেই নবীনা কে ভালোবাসার কথা জানাব। ওকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। আর মোখলেস? সে তো এমনিতেই ভালো মানুষ। নিশ্চয় ভালো কাউকেই পাবে।
.
মোখলেসের জ্ঞান ফিরলে সে জেসিকা বলতে বলতে সারারুমে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। বাড়ির অন্যান্য রা কিছু বুঝতে না পেরে হা করে জিকোর দিকেই তাকিয়ে আছে।
জিকো মোখলেসের উদ্দেশ্যে বলল-
করবি না বাসর দিন?
.
মোখলেস জিকোর দিকে তাকিয়ে আবারো জ্ঞান হারালো। তার বাড়ির লোকেরা অগ্নি দৃষ্টিতে জিকোর দিকে তাকালে সে এক দৌঁড়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেল। ছুটতে ছুটতে বলল সে-
আমি ছেলে হয়ে গেছি, ছেলে হয়ে গেছি!
.
.
.

এদিকে হুরায়রা কে নিশ্চুপ দেখে মেঘ বলল-
না পারবে তুমি তোমার পরিবার ছাড়া এখানে থাকতে, না পারব আমি। আমি জানি তোমার রাজ্যে গেলে আমি হয়তো বা সব ভুলে যাব। কিন্তু আমি চাই না আমার পরিবার কে ভুলতে। আমার মা কে ভুলতে। সরি হুরায়রা।

.
হুরায়রা মৃদু হেসে বলল-
ইচ্ছে করলেই তোমাকে জাদুর শক্তি তে আমি নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু এমন টা আমি করব না। কেনো জানো? মায়ের প্রতি তোমার ভালোবাসা দেখে। মেঘের রাজ্যে তুমি আমাকে পেতে, কোনো রোজগার ছাড়াই সারাজীবন চলতে পারতে। এতসব কিছু জেনেও তুমি তোমার পরিবার ছাড়তে পারোনি। তুমি আসলেই একজন ভালো ছেলে।
-ভালো প্রেমিক হতে পারলাম না।
-এটা আমি বলব না। কারণ আমিও ভালো প্রেমিকা হতে পারলাম না। দুজনেই নিজেদের পরিবার কে বেছে নিয়েছি।
-হুম।
– নিয়তি আমাদের সহায় হয়নি। যাক ওসব, এবার আমায় বিদায় দাও।
-বিদায়?
-কোনো শহরের মানুষ যদি আমাদের আসল পরিচয় টা জানতে পারে, তবে সেই শহরে আমরা থাকতে পারি না।
-কিন্তু…
-আমায় আঁটকাবে না মেঘ। তোমার শহরে আর থাকা হবে না আমার।
.
মেঘের চোখে পানি চলে এল। হুরায়রা কে আটকানোর ক্ষমতা তার নেই। কিছুই করার নেই তার।
হুরায়রা বলল-
একটা অনুরোধ রাখবে?
-বলো?
.
কান্নাজড়িত কণ্ঠে হুরায়রা বলল-
একটাবার জড়িয়ে ধরবে আমায়?
.
সময় নিলো না মেঘ। হুরায়রা কে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠলো।
সাথে সাথে বৃষ্টি নামতে শুরু করলো। আজ আকাশও যেন তাদের জন্য কাঁদছে!
.
.
.
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেল। মোখলেস নিজেকে রুম বন্দী করে রেখেছে। জিকোর প্রতি তার কোনো রাগ নেই। রাগ নিজের উপরেই। সে কেনো বুঝতেই পারলো না, জেসিকা তার বন্ধু জিকোই!
মোখলেস রুমের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে চেঁচিয়ে বলল-
বললাম তো দরজা খুলব না এখন আমি। মন ভালো নেই আমার।
.
তবুও দরজায় কড়া নেড়েই যাচ্ছে বাইরে থেকে। মোখলেস বিরক্ত হয়ে দরজা খুলেই শাপলার দেখা পায়। সে অবাক হয়ে বলল-
তুমি?
-হ্যাঁ, আমি।
-তোমার বান্ধবীর না শরীর খারাপ?
-সে তো আমি মিথ্যে বলেছিলাম।
-কেনো?
-বুঝেন না কেনো? চোখের সামনে আপনার বিয়ে দেখতে পারব না বলে।
-মানে?
-মানে? খুব তো জেসিকা করে করে ছুটেছেন এতদিন। আর আমার কথার মানেই বুঝছেন না?
.
মোখলেস কিছুক্ষণ নীরব থেকে হেসে ফেলল। শাপলাও তার সাথে হাসতে হাসতে বলল-
ভালোই হলো জেসিকা টা জিকোই!
.
.
.
উঠোনে অন্তরা আহম্মেদের চেঁচামেচির শব্দ শুনে বারান্দায় এল সাইয়ারা।
মেঘ এতক্ষণ বাসায় ছিল না। বাইরে এতক্ষণ বৃষ্টি ছিল। সে বৃষ্টি তে ভিজেছে এতক্ষণ তা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
তাই অন্তরা আহম্মেদ চেঁচিয়ে বলছেন-
এতক্ষণ বাসায় ছিলি না। না খেয়ে দেয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে বাইরে ছিলি তুই?
.
সাইয়ারা চেঁচিয়ে বলল-
আন্টি আপনার না শরীর খারাপ?
-এখন ভালো লাগছে আমার। তাছাড়া শরীর খারাপ হয়েছে বলে কি নিজের ছেলে কে বকব না! শরীর খারাপ হলেও ছেলে মেয়েদের খবর আমি ঠিকই রাখি।
.
আচমকা মা কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো মেঘ। অন্তরা আহম্মেদ বললেন-
কি রে বোকা ছেলে তুই কাঁদছিস কেনো? বকা দিয়েছি বলে? তুই কি বাচ্চা না কি!
.
সে কথার উত্তর না দিয়ে মেঘ মা কে ছেড়ে চোখের পানি মুছে বলল-
আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি মা।
.
কথাটি শুনে অন্তরা আহম্মেদের চোখের কোণে পানি চলে এল। মিন্নী এসে বলল-
ভালোবাসলে হবে? তুমি বাসায় ছিলে না বলে অসুস্থ শরীর নিয়েও মা কিছু খায়নি।
-কি বলিস!
-হু।
-আমি এখুনি মা কে তার প্রিয় খাবার রান্না করে খাওয়াব।
.
অন্তরা আহম্মেদ বললেন-
সত্যি?
-হ্যাঁ। তবে আগে শাড়ি টা বদলে নাও। ভুলে জড়িয়ে ধরলাম ভেজা শরীর নিয়ে।
.
কথাটি বলে মেঘ ভেতরে চলে যায়। নিজের রুমে এসে লম্বা একটা নিশ্বাস ফেললো সে। মা কে সে ছাড়তে পারেনি ঠিকই। কিন্তু হুরায়রা কে যতটা সে ভালোবেসেছে তেমন অন্য কোনো মেয়ে কে সে বাসতে পারবে না। যদি কখনো কোনো মীরাক্কেল ঘটে হুরায়রা তার কাছে ফিরে আসে, সেই অপেক্ষায় দিন পার করবে সে।
হুরায়রা আবার ফিরে আসবে তার মেঘের কাছে, এই দিনটার অপেক্ষা করবে মেঘ।
.
অন্তরা আহম্মেদ সাইয়ারা কেও মেঘের রান্না খেতে আসতে বলে ভেতরে চলে গেলেন।
আজ সাইয়ারা মেঘের পিছু নিয়েছিল। সে সবটা দেখেছে। হুরায়রার আসল পরিচয়ও জেনেছে। দেখেছে হুরায়রা এই শহর ছেড়ে চলে গেছে। সে এটাও জানে মেঘ হুরায়রার জায়গা কাউকে দিতে পারবে না। তবুও সে মেঘকেই ভালোবেসে যাবে। এরইমাঝে তার ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো, রাফিনের ফোন এসেছে। সাইয়ারা মৃদু হেসে রাফিনের ফোন কেটে দিলো।
তার পক্ষে সম্ভব নয় অন্য কাউকে ভালোবাসা। মেঘ তার প্রথম ভালোবাসা। এবং সেই শেষ থাকবে। কিন্তু মেঘ কি তাকে কখনো ভালোবাসবে?
নাই বা বাসুক। তার বন্ধু হয়েই না হয় সারাজীবন পাশে থাকবে সাইয়ারা। আর এই মুহুর্তে মেঘের একজন ভালো বন্ধুর খুব প্রয়োজন। সেটি সাইয়ারা হলে তো মন্দ হয় না। এই ভেবে মুচকি হেসে সাইয়ারা মেঘের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো, তার রান্না খাবে বলে।
.
সমাপ্ত
.
বি:দ্র: এই গল্পের সেরা কমেন্ট কারী কে আমার পরবর্তী বই (বিষাক্ত প্রজাপতি) উপহার দিব বলেছিলাম। সব ঠিক থাকলে ইনশাআল্লাহ খুব দ্রুতই বইটি প্রকাশিত হবে। প্রি-অর্ডারের আগেই বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here