#চুপিসারে ( ১০)
#রেহানা_পুতুল
শ্রাবণ লালচোখে নদীর দিকে তাকালো। কঠিন স্বরে বলল,
এই তোকে আমার কৈফিয়ত দিতে হবে? রাতে এখানে তুই থাকবি। এটা আমার আদেশ। আরু থাকলে আমি বাড়িতে ফোন দিয়ে বলে দিব। বলেই শ্রাবণ পুকুর ঘাটের দিকে চলে গেলো পা বাড়িয়ে।
আরু রিনরিনিয়ে হেসে নদীকে বলল,
ধরা পড়েছো কুকুরের হাতে।খানা খেতে হবে আভি একসাথে।
নদী দৃষ্টিতে কাঠিন্যতা এনে আরুর দিকে চাইলো। বলল,
এমন করে ভেটকানো হাসি দিবিনা বলছি। চামড়া জ্বলে যাচ্ছে আমার। আমাকে নিয়ে যাওয়ার ফন্দী কর। হারিআপ।
ওকেহ করতাছি। উমমম…ইউরেকা। জাস্ট ওয়েট।
শ্রাবণ হাতমুখ ধুয়ে উঠানের একপাশে গেলো। নাইলনের মোটা রশি থেকে ঝুলানো তাওয়েলটা হাতে নিলো। ভেজা মুখমুন্ডল মুছতে মুছতে বলল,
কিরে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ঘরের ভিতর যা।
বড় ভাইয়া আমার কাল ক্লাস আছে। সকালে কোচিং আছে। রাতে পড়া কমপ্লিট করতে হবে। নরম সুরে বলল আরু।
আচ্ছা তাহলে তুই যা। নদী থাকুক।
না ভাইয়া নদী আপারও যেতে হবে। আমার একটা অংক বুঝিয়ে নিতে হবে।
পাটিগণিত না বীজগণিত?
বীজগণিত ভাইয়া।
খাতা ও বই নিয়ে আয় বাড়ি গিয়ে। আমি করিয়ে দিব। ভালো করে বুঝিয়ে দিব।
ভাইয়া আম্মা যে বদরাগী জানেন তো। গেলে আর আসতে দিবে না। আর অত কাছে নাকি দুই বাড়ির তফাত?
তা অবশ্য রাইট বলছিস তুই। তাহলে এক কাজ করিই, দাঁড়া আমি টিশার্টটা পরে আসি। বাজারে চা খেতে যাব। এমনি তোকে অংকটাও বুঝিয়ে দিব। তাহলে তোর আম্মা রাগের বদলে হ্যাপিই হবে। নাকি বলিস?
তা ঠিক ভাইয়া। তবুও নদী আপাকে নিয়ে যাই। কতদিন পর কাছে পেলাম। নদী আপাতো থাকতে চাচ্ছেনা আপনাদের বাড়ি।
আচ্ছা তাহলে চলে যা দুজনে। নদীকে দিয়ে অংক করিয়ে নিস।
আরু নদীকে ফিসফিসিয়ে বলল,
জামিন হ্যাঁ মঞ্জুর হয়েছে৷ আমার ভিজিট দিস আপা৷
আরু ও নদী বাড়ির গেইটে পা রাখতে গেলে পিছন দিয়ে সারথি এসে নদীকে জড়িয়ে ধরলো পিছন হতে। যেতে মানা করলো ওদের। ওরা সারথিকে বুঝিয়ে চলে গেলো।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরে শ্রাবণ নিজেদের পুরোনো বাড়িতে গেলো। গিয়েই দেখে ঘরের পরিবেশ বিষন্ন। দাদী হাফসা বিবি মরামুখে পান চিবোচ্ছে। তার পাশে বসে নদী নিরবে অশ্রুপাত করছে। শ্রাবণ তাদের কিছু জিজ্ঞেস করলো না। রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আস্তে করে আরুর রুমে উঁকি মারলো। আরু পড়ার টেবিলে বইয়ের ভাঁজে চোখ বুলাচ্ছে। শ্রাবণকে দেখতে পায়নি। সে এবার চাচী নাহারের রুমে ঢুঁ মারলো। তিনি নীরুকে পড়াচ্ছেন। নীরু চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। শ্রাবণ চাচীকে সালাম দিলো। নাহার বেগম সালামের জবাব নিলো।
চাচী কোন ঝামেলা হয়েছে নাকি?দাদী,নদীর মন খারাপ দেখলাম?
ওহ! তাদের মন খারাপ নজরে পড়লো? চাচীরও যে মন খারাপ সেটা নজরে পড়লো না তোমার?
গজগজ করে বলল নাহার বেগম।
শ্রাবণ ইতস্ততবোধ করলো। বলল,
চাচী আমি আপনার মুখের দিকে সেভাবে লক্ষ্য করিনি তাই বুঝতে পারিনি। বলেন কি হয়েছে?
আগে তুমি আসছ ক্যান সেইটা কও?
আমি আসছি নদীকে বলার জন্য, যেন সকালে রেড়ি হয়ে থাকে। তাকে গানের স্কুলে ভর্তি করাবো।
বুঝলাম না? চমকানো চোখে বলল নাহার বেগম।
শ্রাবণ নদীর গানের বিষয়টা খুলে বলল চাচীকে।এবং হারমোনিয়াম কিনে দিবে সে সেটাও শেয়ার করলো চাচীর সাথে।
শুনেই নাহার বেগম চনচনিয়ে উঠলো। বলল,
বাবারে মাফও চাই। দোয়াও চাই। ওইসব ঢং আমার সহ্য হইবো না। এরমইধ্যে আবার ফ্যাঁ ফুঁ শুরু হইবো আমার কানের কাছে। গান যহন তুমি দায়িত্ব নিয়া শিখাইবা। তখন তারে তোমগো বাড়িতেই নিয়া যাও। ভাত খাইতে ভাত পায় না আবার কোর্মা পোলাওয়ের শখ কত মাইয়ার।
আচ্ছা চাচী তাই হবে। আপনি টেনশন ফ্রি থাকেন। এবার ঘরে কি হয়েছে সেটা বলেন?
কি আর হইবো। যত ঝামেলা ওই মাইয়ারে নিয়াই। আমি, তোমার চাচা, তোমার আব্বা,আম্মা,তোমার ফুফু,ফুফা,আমরা সবাই চাই আরুর বিয়া হোক রজতের সঙ্গে। ভাবছিলাম আমরা দুই পরিবার মুখে মুখে কথা পাকা কইরা রাখুম। ওমাগো! হায় খোদা! রজত নদীরে বিয়ে করতে চায়। নদীরেই নাকি তার বেশি ভালোলাগে। আরুকে বিয়া করা নাকি তার পক্ষে অসম্ভব!
এটা কে জানাল এখন?
কে আর? রাফিয়া আপা। রজত তারে কইছে। সে আমারে জানাইলো।
চাচী ধৈর্য ধরুন। নদী যদি রজতকে বিয়ে করতে চায় কিনা এটাতো জানতে হবে আমাদের।
আমারতো মনে হয় নদীর ও তলে তলে ভাব রজতের সঙ্গে। আরেহ মাইয়া,তুই বুঝলি না, রজতের মায় তোরে মাইনা না নিলে তুই শান্তি পাইবি? ভালা রইবি ওই ঘরে?
এটা ঠিক বলছেন চাচী।
তাইতো বাবা৷ এইটা বিকালে শোনার পর হইতেই আমার দেমাগ খারাপ হইয়া আছে । যদি পারো রজতকে আরুর জন্য রাজী করাও। তার লগেতো তোমার সুসম্পর্ক রয়েছে।
এখন নদীকে বকছেন মনে হয়?
আমি কাউরেই বকিনাই। নিজেরে নিজে ঝাড়ছি। তুমি চেয়ারম্যান মানুষ। ঘরে তোমার অবস্থান মজবুত। ভাই ভাবিরে বুঝায়া নদীরে পার্মানেন্ট নিয়া যাও। আমরা যখন যা পারি তার খরচপাতি দিমু। আমার এই মাইয়ার মুখ দেখলে শরীর জ্বলতে থাহে একশো চুল্লীর মতন।
আচ্ছা চাচী দেখি কি করা যায়। আপনি শান্ত হোন বলে শ্রাবণ ফের দাদীর রুমে গেলো।
নদীকে বলল,
একটু বকা শুনেই এমন কাঁদতে হয় না। সব শুনেছি। সকালে রেডি হয়ে নয়টা বাজে আমাদের বাড়িতে চলে আসবি। গানের স্কুলে যেতে হবে।
আমি ভর্তি হব না ভাইয়া। এখানে রেওয়াজ করার সেই পরিবেশ নেই।
যেখানে রেওয়াজ করার পরিবেশ। তুই সেখানেই থাকবি। কথা বললে কথা শুনবি বাধ্যের মতো। দিনে দিনে ঘাড়ত্যাড়া হয়ে যাচ্ছিস কেন? আমি তোর অমঙ্গল চাই? আমি তোর পর?
পাশ থেকে হাফসা বিবি বলল নাতিকে,
খালি বকছে আরুর মায় ? রজতরে নিয়া কর্দয ভাষায় কতগুলান কথা হুনাইলো। কইলো নদী তার ঠেলা যৌবন দিয়া পরিক্ষার একমাস এক রিকশায় গা ঘেইঁষা বইসা রজতরে বেহুঁশ কইরা ফালাইছে।
আচম্বিতে দাদীর মুখে এমন খোলাখুলি বাক্য শুনে শ্রাবণ লজ্জিত অনুভব করলো। নদীরও দাদীর উপর প্রচন্ড জেদ উঠলো।
শ্রাবণ নদীকে সকালে যাওয়ার তাড়া দিয়ে বের হয়ে গেলো।
বাড়িতে গিয়েই শ্রাবণ নদীর বিষয়ে বিস্তারিত মা বাবার সাথে শেয়ার করলো এবং সমাধান চাইলো। তার পিতা রফিক দেওয়ান কিছুক্ষন চুপ হয়ে রইলেন ভাবুকের ন্যায়। অতঃপর বললেন,
নদী আমার ছোট ভাইয়ের মেয়ে। অর্থাৎ সে আমাদের পরিবারের একজন। তার দায়িত্ব সবারই নেওয়া উচিত। আমরা তাকে অবহেলা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলে, তার হক নষ্ট করলে পরকালে এর পইপই করে জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ আমাদের অনেক দিয়েছে৷ শফিকের তেমন নাই। চাকরিজীবি সে। একটু বুঝেশুনে চলতে হয় তার স্ত্রীর। সে কারণেও হয়তো অনেক সময় মনমেজাজ ভালো থাকে না।
নদী কাল থেকে সবসময় আমাদের বাড়িতেই থাকবে। কে কি দিলো না দিলো, কে তার খবর নিলো না নিলো সেটা ভাবার আমাদের প্রয়োজন নেই। আজ নদী যদি আমার মেয়ে হতো তাহলে তার ভালোমন্দ,জ্বালা যন্ত্রণা আমরা মেনে নিতাম না। অবশ্যই মেনে নিতাম।
পিতার মহানুভবতায় শ্রাবণ সন্তুষ্ট হয়ে গেলো। পাশ থেকে তার মা মোরশেদা বলে উঠলো,
নদীর সমানতো আমাদের এক কন্যা ছিলোই। দুই বছরের সময় পুকুরের পানিতে পড়ে মরে গেলো আমার মেয়েটা। কত সুন্দর নাম রাখলাম।সায়ন্তী।
শ্রাবণ বলল,তাহলে নদী কাল থেকেই আমাদের বাড়িতে চলে আসুক। দাদীকেও আমাদের কাছে রাখতে চাই। নাহ উনি স্বামীর ভিটা ছেড়ে অন্য বাড়িতে থাকবে না।
দেখবি এখন থাকবে। নদীকে দেখার জন্য চলে আসবে তুরতুর করে। থেকেও যেতে পারে।
নদী আসবে শুনে শ্রাবণের অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া ছোটবোন সারথি ব্যাপক উৎফুল্ল হয়ে গেলো। শ্রাবণ বোনের গাল টিপে দিয়ে চলে গেলো নিজের রুমে।
আজ শুক্রবার। নদী বড় চাচার বাড়িতে গেলো যথাসময়ে। শ্রাবণ আগেই রেডি হয়েছিলো। উঠানে গিয়ে মোটরবাইকে বসে স্ট্রাট দিলো। নদীকে বলল,
আমার পিছনে ভালো করে সাপোর্ট নিয়ে বস।
নদীর অভ্যাস নেই বলে বসতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছে।
কিরে কি হলো?
ভাইয়া সুবিধা পাচ্ছি না বসতে।
উমম।আমাকে জড়িয়ে ধরে বস। তাহলে আর পড়বি না।
নদী কাঁচুমাচু করতে লাগল। শ্রাবণ বলল,
আমার পেটে হাত দিয়ে শক্ত করে বস বলছি।
নদী শ্রাবণের পেট পেঁচিয়ে দাঁতমুখ খিঁচে বসে রইলো। শ্রাবণ নদীকে নিয়ে বাইক চালিয়ে চলে গেলো। কাছাকাছি গিয়ে রাস্তায় স্পীড বেকার জোরে পার হতেই,নদী ঝুঁকে শ্রাবণের পিঠের সাথে ধাক্কা খেলো।
নদী ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। শ্রাবণ বলল,
ব্যথা পেয়েছিস?
নাতো।
শ্রাবণ নদীকে ভর্তি করিয়ে বাইকে করে দ্রুত বাড়িতে চলে এলো।
সে এসে দেখে সবাই রেডি হয়ে গিয়েছে। নদীকে মোরশেদা বলল,
মা তুই একা থাকতে পারবি আমাদের বাড়িতে? নয়তো বাড়ি চলে যেতে পারিস। আমরা তোর শ্রাবণ ভাইয়ার জন্য পাত্রী দেখতে যাচ্ছি।
বড় ভাইয়া যাবে না বড়াম্মু?
নাহ। সে আগেই পাত্রীকে দেখে পছন্দ করে রেখেছে কিছুটা। আজ আমাদের পছন্দ হলেই এনগেজমেন্ট হবে।
চলবে