চুপিসারে (৯) কলমে #রেহানা_পুতুল

0
220

#চুপিসারে (৯)
কলমে #রেহানা_পুতুল
নদীর হাত টেনে নিয়ে তৃষ্ণাত চোখে বলল রজত।
নদী দৃষ্টি লুকিয়ে ফেলল রজত থেকে।লাজুক মুখে মৌন হয়ে চেয়ে রইলো নিচের দিকে।

কিরে চুপ করে আছিস কেন? এই নদী? বল কিছু একটা? তোর থেকে ক্লিয়ার হয়েই আমি মাকে জানাবো। এজন্যই আমি আজ এসেছি। মাতো ঘুরেফিরেই আমার মত জানতে চাচ্ছে।

আমি মানা করে দিলে কি আরুকে বিয়ে করবেন?
দৃষ্টি অন্যদিকে ফেলে জানতে চাইলো নদী।

একদম নাহ। তুই আমার না হলেও আমি আরুকে বিয়ে করব না।

নদীর মুখ জ্বলজ্বল করে উঠলো চাঁদের কিরণের মতো। মুখাকৃতি লুকাতে চেয়েও পারল না।

রজত ফের বলল,
তুই কি সময় নিতে চাচ্ছিস?

হুম বলে নদী সম্মতি পোষণ করলো।

কবে আনসার পাবো? মাকে জানাতে হবে যে?

আম্মার সাথে কথা বলছেন?

নাহ। তোর মত না পেয়ে কিভাবে কি বলি?

নাহ! আপনি আম্মার সঙ্গে এখনই সব বলেন। কারণ আম্মার মত না থাকলে আমি চাইলেও হবে না।

কেন হবে না নদী?
নিবেদিত স্বরে বলল রজত।

অদ্ভুত! হবেই বা কেন?

ঠোঁট উল্টিয়ে বলল নদী।

নদী উঠে তার বড় মামার ঘরে চলে গেলো রজত থেকে বিদায় নিয়ে।

তার পিছন দিয়ে রজত নদীর মায়ের কাছে গিয়ে বসলো। শুরু থেকে শেষ অবধি আদ্যোপান্ত সব বলল মামী রুবিনাকে।

রুবিনা তাজ্জব বনে গেলো শুনে। তবুও গোপনে উল্লসিত অনুভব করলো একমাত্র আদরের মেয়েকে নিজেদের লোকই পছন্দ করে ফেললো বলে। বিস্ময় প্রকাশ করে বলল,

কিন্তু ভাগিনা শোন, যেখানে আপা পছন্দ করলো আরুকে। সেখানে নদী গেলে কতটুকু ভালো হবে এটা উপলব্ধি করতে পারছ?

আমি মাকে ম্যানেজ করে ফেলব মামী। আপনি এ নিয়ে চিন্তিত হবেন না।

আচ্ছা তা না হয় মানলায়।তবুও হুট করে এত বড় সিদ্বান্ত এখন দিতে পারব না। তুমি এখন চলে যাও। আমি জানাব।

রজত এক বুক আশা নিয়ে চলে যায় নিজের বাড়ি। নদীর নানাদের বাড়িতে যাওয়ার বিষয়টা তার মা এবং সবার কাছ হতে গোপন রাখলো।

রুবিনা ভাবনায় ডুবে গেলো। রাতে নদীসহ আলাপ করতে লাগলো রজতকে নিয়ে। নদী মায়ের মুখে রজতের সঙ্গে নিজের বিয়ের কথা শুনে লজ্জা পেলো। কিন্তু নিরুপায় সে। ডিসকাস করতেই হচ্ছে নিজের বিয়ের বিষয়ে নিজেকে। যেহেতু তার বিয়ের অভিভাবক তার মা ও সে নিজেই।

নদীর বাবা নেই। রজত সম্পর্কে ভাগিনা। এখন জামাই হলে রুবিনার ও তদারকি করবে ভালো করে। পাশাপাশি নদীর বিয়ে অন্যঘরে হলে সময়ে অসময়ে খরচ করতে হবে। নদীকে চাইলে রুবিনা কাছে পাবে না। পরের হুকুমেই চলতে হবে নদীর। কিন্তু রজতের দিক হতে এসবের কোন চাপ সৃষ্টি হবে না নদীর উপরে। সে নিজের মানুষ। নদীকেও যত্নে রাখবে রজত।

এমন আরো বহু সুবিধার দিক বিচার বিবেচনা করে রুবিনা মনস্থির করলো, নদীর বিয়ে রজতের সঙ্গেই হোক। কার মত আছে না আছে তা মূখ্য নয় গৌণ। নদীও মায়ের সঙ্গে সুর মিলালো। আর ব্যক্তি হিসেবে এমনিতেই তার রজতকে বরাবরই ভালোলাগে।

এদিকে শ্রাবণের বিয়ের কথাবার্তা চলছে তার মতামত নিয়েই। তার নিদিষ্ট কোন মেয়েকে পছন্দ নয়। পরিবারের পছন্দকেই সে গুরুত্ব দেয়। তাই মা বাবাকে জানিয়ে দিয়েছে তাদের ইচ্ছেতেই সে বিয়ে করবে।

আচমকা এক অবেলায় কর্কশ স্বরে রুবিনার সেলফোন বেজে উঠলো। রিসিভ করতেই শুনতে পেলো শ্রাবণের ভরাট কণ্ঠস্বর। রুবিনা হকচকিয়ে গেলো। কারণ শ্রাবণ ব্যস্ততা দেখিয়ে কালে ভদ্রে ফোন দেয় তাকে।

সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করলো। এবং জিজ্ঞেস করলো,
চাচী নদীকে কি গান শিখিয়েছেন নাকি?

রুবিনা পালটা জানতে চাইলো,

তুমি কিভাবে জানলে? নদী শুনালো নাকি?

আপনার যেই মেয়ে,সে আবার গান শুনাবে আমাকে? সে পারেতো আমার থেকে পালিয়ে বাঁচে। স্কুলে গাইতে দেখলাম তাকে বিদায়ী প্রোগ্রামে।

আলতো হেসে বলল শ্রাবণ।

ওহ আচ্ছা। আর বাবা তুমি ভুল বুঝ না। নদী আসলে তোমাকে কাছ হতে সেভাবে পায়নি। আবার যতটুকু পেয়েছে তোমাকে শক্তরূপে দেখেছে। রজতকে তো ও ভয় পায় না। বরং খুব সহজেই মিশে যায় ওর সঙ্গে। এই বলে রুবিনা নদীকে নিয়ে তার ইচ্ছের কথা বলল শ্রাবণকে।

শুনে শ্রাবণ বলল,

চাচী নদীর গলা ভালো। ঠিকঠাকভাবে সুর, তাল,লয় রপ্ত করতে পারলে সে হয়তো ফিউচারে ভালো করতে পারবে। এখন আমি কি বলি শুনেন,

এখন তার একাডেমিক পড়াশোনার কোন চাপ নেই। আর আপনাদের ওদিকে ভর্তি করিয়েও কোন লাভ নেই। কারণ কলেজ ভালো আমাদের এদিকে। নদীর তিনমাস পরে হলেও নিজের বাড়ি চলে আসতে হবে পড়াশোনার জন্য। তাই বলছি কি নদীকে দুচারদিন পর বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। আমি ওর জন্য এদিকে গানের স্কুলে গিয়ে কথা বলে আসব। ও আসলে ভর্তি করিয়ে দিব। খরচ সম্পূর্ণ আমিই বহন করবো। এসব ক্লাস হয় সপ্তাহে একদিন বা দুইদিন। সুতরাং পড়াশোনার হ্যাম্পার হবে না।

রুবিনার চোখ ছলছল করে উঠলো শুনে।আদ্র স্বরে বলল,

বাবা বাড়িতে রেওয়াজ করতে হয় রোজ। জানোতো?

চাচী খুব জানি। আমি হারমোনিয়াম কিনে দিব তাকে।

বাবা ভালো করে ভেবে দেখো। আরুর মা ভাবি এসব মেনে নিবে? এক তেঁতুল খাওয়া নিয়ে কি তুলকালাম কাণ্ড করলো। নদীর গায়ে হাত তুলতেও সে দ্বিতীয়বার ভাবল না।

শ্রাবণ থামিয়ে দিলো রুবিনাকে। অধিকারসুলভ ভঙ্গিতে বলল,

চাচী নদী দিনদিন বড় হচ্ছে। সমস্যা হবে না আর। ওর গান শেখার বিষয়টা আমার রেস্পন্সিবলিটি।

শ্রাবণ ফোন রেখে দিলো। রুবিনা স্রষ্টার করুণার উপর হাজারো কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলো। নদীকে বাড়ি চলে যাওয়ার তাড়া দিলো সব বলে। নদী বেঁকে বসল অবুঝের মতো। বলল,

ওই নেতাখেতার দান দাক্ষিণ্য নিব না আমি। গান ও শিখব না। যে কিনা কারণে অকারণে শাসায়। খবরদারিত্ব দেখায়। কর্তৃত্ব ফলায়। চোখ রাঙানি দেয়।এক গান শিখিয়ে চিরদিন তার খোঁটা দিতে থাকবে। রজত ভাই হলে শিখতাম। আমি যাব না।

রুবিনা রেগে গেল মেয়ের উপরে। বলল,

রজতের এত টাকা আছে অতিরিক্ত খরচ বহন করার মতো? শ্রাবণের টাকাও আছে৷ পাওয়ার ও আছে। তার এইকথা না শুনলে এরপর ভালোমন্দ কিছু হলে পাশে পাবো? সে কি তারজন্য বলছে এইকথা? সবসময় গোঁয়ার্তুমি করলে হয় না বাপ মরা মেয়ের।

নদী চকিতে চাইলো মায়ের মুখপানে। বাপ মরা মেয়ে বাক্যটি তার অন্তরে কাঁটার মতো বিঁধলো। একটা সূক্ষ্ণ দুঃখবোধ তাকে পেঁচিয়ে ধরলো অক্টোপাসের মতো। অসহায় মনে নদী ভাবল, মাতো ভুল বলেনি। মিথ্যা বলেনি। এবার কিছুটা নিমরাজি হলো নদী। ঠিকাছে যাব বলে মাকে আস্বস্ত করলো। রুবিনা মেয়েকে লেপ্টে নিলো বুকের মাঝে।

তার সপ্তাহ পরে রুবিনা রজতকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলো তাদের মা মেয়ের কোন আপত্তি নেই বিয়েতে। শুনে রজতের খুশীর সীমা রইল না। এক অসীম আনন্দে ভেসে গেলো সে এক লহমায়। কল্পনার সুখ সমুদ্রে তলিয়ে গেলো নদীকে নিয়ে।

পরক্ষণেই রজত নদীকে ফোন দিয়ে বলল,
একটা গান শুনতে চাই হবু গিন্নি।
রজতের কন্ঠে আকুলতা।

ফোনে না সরাসরি? নরম কন্ঠে জানতে চাইলো নদী।

মুখোমুখি হলে বেশী ভালো হয়।

সেটা কিভাবে?

সেই ব্যবস্থা করবো।

থাক তার আর প্রয়োজন নেই। আমি বাড়ি আসবো। তখন শুনাব। বলে গানের বিষয়টা শেয়ার করলো রজতের সঙ্গে। শুনে রজতও খুশী হলো। তার মনে শ্রাবণকে নিয়ে কোন খচখচানি শুরু হলো না। কারণ নদীর বিয়ে তার সঙ্গেই হতে যাচ্ছে এই ভেবে। বরং সে বলল,

যাক এই প্রথম আমাদের চেয়ারম্যান সাহেব তোর কোন বড় উপকার করতে যাচ্ছে। তাই বলে আমার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপকারগুলোকে ক্ষুদ্র করে দেখিস না যেন।

দুষ্টমির ছলে বলল রজত।

নদী কোমল হাসলো। মোলায়েম স্বরে বলল,
আপনার সকল ক্ষুদ্রঋণ আমার কাছে কতটা বৃহৎ, তা মাত্র আমিই জানি।

আজ নদী নিজের বাড়ি চলে গেলো। আরু নদীর গলা পেঁচিয়ে বলল,

আপা তুই নেই বলে বড় চাচ্চুর বাড়িতে যেতে পারছি না। চল না ঘুরে আসি ও বাড়ি থেকে। আড্ডা দিয়ে আসি একটু সারথির সাথে। এত্ত ভালো লাগে আমার বড় চাচ্চুর বাড়িটা।

আরুর জোরাজোরিতে নদী রাজি হলো যেতে। শ্রাবণ ঘুম থেকে উঠে উঠানে যেতেই নদীকে দেখতে পেলো। সবাইর সঙ্গে গল্প করছে নদী। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে নদী ও আরু চলে যেতে উদ্যত হলো।

এই আরু, চাইলে তুই যেতে পারিস। নয়তো থাকতে পারিস। তবে নদী রাতে আমাদের বাড়ি থাকবে। বলল শ্রাবণ।

আমি থাকব না বড় ভাইয়া। কি দরকার
বলেন? নিস্তেজ স্বরে বলল নদী।

শ্রাবণ লালচোখে নদীর চোখে তাকালো। কঠিন স্বরে বলল,

এই তোকে আমার কৈফিয়ত দিতে হবে? রাতে এখানে তুই থাকবি। এটা আমার আদেশ। আরু থাকলে আমি বাড়িতে ফোন দিয়ে বলে দিব। বলেই শ্রাবণ পুকুর ঘাটের দিকে চলে গেলো পা বাড়িয়ে।

চলবে

#চুপিসারে
সকল পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=122113601558106938&id=61553208165829&mibextid=2JQ9oc

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here