মেঘের_শহর #পর্ব_১২ Saji Afroz

0
73

#মেঘের_শহর
#পর্ব_১২

Saji Afroz

.
ফোনের লাইন টা কেটে বোনের নাম্বারে মেসেজ পাঠালো জিকো-
কি বলবি মেসেজ বল। আর বাসার সবাই ভালো আছে তো?
.
তার বোন জুঁই লিখেছে-
হ্যাঁ আছে। বিশেষ কিছু না।
ভাইয়া হঠাৎ তোমাকে ভীষণ মিস করছি।
.
বোনের মেসেজ টা দেখে জিকোর চোখের কোণায় পানি চলে এল। নিজেকে সামলে নিয়ে সে মিস ইউ টু লিখে সেন্ড করলো। তারপর ধীরপায়ে ব্যালকনিতে আসলো সে। আকাশের চাঁদ টা এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কত সুন্দর! তার জীবন টা কি চাঁদের মতো সুন্দর হতে পারতো না?
একটা সময় সে পরিবারের সবার কাছ থেকে দূরে থাকতো। টাকা পাঠানো মানেই যেন দায়িত্ব শেষ! কথা বলতে ইচ্ছে হত না একেবারেই। আর আজ! আজ ইচ্ছে করছে বাড়ির সবার সাথে কথা বলতে। মা কে বলতে-
তোমাকে বড্ড ভালোবাসি মা।
.
কিন্তু এখন এটা কিছুতেই সম্ভব নয়! নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে তার। পরিবারের একমাত্র ছেলের এই দশা শুনলে নিজেদের সামলাতে পারবে তো তারা?
ভাবতে ভাবতে জুঁই এর আরেকটি মেসেজ এল-
তুমি ভালো আছো তো ভাইয়া?
.
.
.
টান টান উত্তেজনার মাধ্যমে শেষ হলো লুডু খেলা। খেলায় জিতেছে সাইয়ারা ও মেঘ। খুশিতে তারা একে অপরের সাথে হ্যান্ডশেক করে ফেললো।
অন্তরা আহম্মেদ তাদের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলেন। সাইয়ারা খানিকটা লজ্জা পেয়ে বলল-
আন্টি আপনি আর মিন্নী অনেক ভালো খেলেন। আপনাদের হারাতে পেরে ভালো লাগছে! নিজে হারব ভেবেছিলাম তো।
-নাকি মেঘের সাথে জিততে পেরে ভালো লাগছে?
-তাতো অবশ্যই।
.
কথাটি বলেই জিভে কামড় বসালো সাইয়ারা। তাড়াহুড়ো করে উঠে সে পুডিং এর কি অবস্থা দেখতে গেল।
এদিকে মিন্নী কে দেখেও বেশ অবাক হলো মেঘ। সে হেরে গেছে এতে কোনো আফসোস নেই। বরং সাইয়ারার প্রশংসায় মেতে উঠেছে সে। মেঘ তার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল-
কি ব্যাপার? হঠাৎ সাইয়ারার সাথে তোর এত ভাবসাব?
.
মিন্নী বুঝতে পারলো মেঘের এমন প্রশ্নের কারণ। সে সাইয়ারা কে পছন্দ করে না, এটা সবারই জানা। হঠাৎ এত ঘনিষ্ঠতা দেখে মনে প্রশ্ন আসবে স্বাভাবিক! কিন্তু সত্যি টা জানানো যাবে না। তাতে করে তার প্রেমের কথা ফাঁস হয়ে যাবে। তাই সে কথা ঘুরিয়ে আমতাআমতা করে বলল-
মেয়েটা ভালো আগে বুঝতে পারিনি।
.
বলেই সেও উঠে চলে গেল।
মেঘ বলল-
কিছু তো একটা আছেই।
.
অন্তরা আহম্মেদ একটু রাগী স্বরে বললেন-
সব কিছুতে কিন্তু কেনো খুঁজিস তুই!
.
সাইয়ারা ও মিন্নী পুডিং নিয়ে হাজির হলো। প্লেটের উপরে হলুদ বর্ণের পুডিং টা দেখতেই বেশ ভালো লাগছে।
মেঘ ঠিক করেছিল সে খাবে না। কিন্তু পুডিং টা দেখেই খাওয়ার লোভ জেগেছে তার।
সাইয়ারা ও মিন্নী পুডিং কেটে আলাদা বাটি তে নিয়ে অন্তরা আহম্মেদ ও মেঘ কে দিলো।
অন্তরা আহম্মেদ মুখে দিয়ে কিছু বললেন না। গপাগপ খেতে থাকলেন তিনি। তার এমনিতেও কাঁঠাল প্রিয়। কাঁঠালের পুডিং ভালো লাগারই কথা।
মিন্নী একটু খেয়েই সাইয়ারার সুনাম করলো। তবে সাইয়ারার দৃষ্টি মেঘের দিকে। সে বাটি হাতে অপেক্ষা করছে মেঘের প্রশংসা শোনার জন্য। তবে মনে হয় না সে এমন কিছু করবে। ইচ্ছে করে হলেও তাকে পঁচাবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মেঘ বলল-
বেশ ভালোই!
.
নিজের কানে শুনেও বিশ্বাস হচ্ছে না সাইয়ারার। তার হাতে বানানো পুডিং মেঘের ভালো লেগেছে! এটা শুনেই তার খুশিতে লাফাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এত খুশি দেখানো টা ঠিক হবে না। তাই সে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
মেঘ খাওয়া শেষে নিজের রুমে চলে গেল। অন্তরা আহম্মেদ সাইয়ারা কে বসতে বললেন। সাইয়ারা তার পাশে এসে বসলে তিনি বললেন-
এত ভালো একটা পুডিং খাওয়ালে, এবার বলো তোমার কি চাই? একটা উপহার তো দিতেই হবে।
.
নরম স্বরে সাইয়ারা বলল-
নাহ আন্টি কিছু লাগবে না। আপনার ভালোবাসা পাচ্ছি, এটাই যথেষ্ট। তবে আন্টি একটা বিষয় ক্লিয়ার করার ছিল। এইজন্যই এসেছি আজ।
-কি বিষয়?
-আসলে সেদিন আপনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন আমাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক আছে কি না।
.
সাইয়ারা কথাটি বলতেই তার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন অন্তরা আহম্মেদ। এমন কিছুই শোনার অপেক্ষায় ছিলেন তিনি।
সাইয়ারা আবারো বলল-
আসলে আন্টি আপনি ভুল বুঝেছেন। আমাদের মাঝে কিছু নেই।
.
শুনে খুশিই হলেন তিনি। কারণ তার প্রেমের সম্পর্ক পছন্দ নয়। তবে তার সাইয়ারা কেও অপছন্দ নয়! তাই তিনি বললেন-
আচ্ছা! কিন্তু মেঘ কি তোমাকে ভালোবাসার কথা টথা বলেছে?
.
মাথা নিচু করে সাইয়ারা জবাব দিলো-
না।
.
এরপর সে দাঁড়িয়ে বলল-
রাত হয়ে যাচ্ছে আন্টি। আমি এলাম।
.
তাকে আর আঁটকালেন না অন্তরা আহম্মেদ। তাদের বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে গেল সে।
মিন্নী সোফায় পা তুলতে তুলতে বলল-
তুমি তাহলে ভাইয়া আর সাইয়ারা আপু কে সন্দেহ করেছিলে।
-হু।
-সাইয়ারা আপু কে কিন্তু আমারো বেশ লাগে। মানাবে তাইনা দুজন কে?
.
অন্তরা আহম্মেদ মৃদু হেসে হ্যাঁ সূচকভাবে মাথাটা নাড়লেন।
.
.
.
সকালে ঘুম ভাঙতেই আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো জিকো। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো, সকাল দশটা বাজতে চলেছে।
ইদানীং বাসায় শুয়ে বসেই দিন পার করতে হচ্ছে তার। এছাড়া আর কিইবা করবে! মোখলেস কে একটা কাজের জোগাড় করে দিতে বলেছিল। কিন্তু সে এখনো কিছু জানায়নি।
বিছানা ছেড়ে উঠতেই জিকোর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। বিছানায় রক্ত লেগে লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে আস্ত একটা মুরগী কেটে রক্ত ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে!
এত রক্ত কোথা থেকে এসেছে তার মাথায় আসলো না। তৎক্ষনাৎ তার পিরিয়ডের কথা মনে পড়লো। নিজের সালোয়ার খুলে দেখলো, তাতেও তাজা রক্ত!
কাল সেই যে প্যাড সে পরেছে আজ বদলানো হয়নি। যার কারণে এমন টা হয়েছে। প্রথমবার হওয়াতে জিকো বুঝতে পারেনি, প্যাড বদলানোর প্রয়োজন।
নিজের উপর রাগ হচ্ছে জিকোর। রাগ সামলে নিয়ে বিছানার চাদর টা তুলে নিলো সে। এখনি তার এসব পরিষ্কার করে গোসল সারতে হবে।
.
গোসল সেরে এসে ব্যালকনিতে এসব শুকোতে দিলো জিকো। রুমে ফিরে এসে খাটের উপরে নতুন চাদর দিলো। এরপর রান্নাঘরে এসে চা বানাতে বানাতে বিড়বিড় করতে লাগলো-
সব বদলে গেল এতটুকু তেই ঠিক ছিল না? এখন আবার পিরিয়ডও দিতে হলো আমাকে! এর চেয়ে হিজড়া হলেই ভালো হত।
.
সাথে সাথে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেল সে। ধীরপায়ে এগিয়ে এসে দরজা খুলে মোখলেসের দেখা পেল।
ভেজা চুলে জিকো কে দেখে নতুন ভাবে যেন তার প্রেমে পড়ল মোখলেস। পলকহীনভাবে সে তাকিয়ে রইল জিকোর দিকে।
জিকো মনে মনে আওড়াতে লাগলো-
তোর নজর এত খারাপ জানা ছিল না মোখলাইস্সা!
.
জিকো আঙ্গুলে তুড়ি বাজাতেই ঘোর কাটলো তার। কিন্তু তার চোখেমুখে এখনো মুগ্ধতা ছেয়ে আছে।
ভেতরে আসতে চাইলে তাকে আসতে বলল জিকো।
তাকে বসতে বলে সে চা বানাতে এগিয়ে গেল রান্নাঘরে।
মেজাজ টা এমনিতেই বিগড়ে আছে তার পিরিয়ডের জন্য। শুনেছিল মেয়েদের এই সময়ে মেজাজ খিটখিটে থাকে। তার ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। বরং আরো বেশি। একজন ছেলের জন্য এটা কতটা অস্বস্তিকর ব্যাপার, যার হবে না সে বুঝবে না। উফফ! আবারো ভুলে গেল সে এখন মেয়ে। যাই হোক, মেয়ের জন্যও কোনো স্বস্তির বিষয় নয় এটি।
এই মুহুর্তে তার মোখলেস কেও বিরক্ত লাগছে। ইচ্ছে করছে দুটো লাথি মেরে বলতে-
যাহ বদমাশ বের হয়ে যা। আমি কে জানলে তো ফিরেও তাকাবি না আর।
.
নিজের রাগ সংযত করে চা বিস্কুট নিয়ে ফিরে এল সে।
মোখলেস বলল-
যদিও একটা দরকারে এসেছি তবে তোমার হাতের চা খাওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না।
-কি দরকার?
-দরকার না ঠিক। সারপ্রাইজ বলতে পারো।
-সারপ্রাইজ?
-হ্যাঁ। তৈরী হয়ে নাও। এখুনি বেরুতে হবে আমাদের।
.
এই ক্লান্ত শরীর নিয়ে জিকোর মোটেও বের হতে ইচ্ছে করছে না। তার উপর তার শরীর খারাপ। ঠিকমতো সে কিছু জানে না। কোনোভাবে রক্ত যদি দেখা যায় তখন একটা লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়বে সে। তাই সে শরীর খারাপের বাহানা দিলো না বেরুবার জন্য। কিন্তু মোখলেসও ছাড়ার পাত্র নয়। সে জিকো কে জোর করতে থাকলে একসময় রাজি হয়ে যায় সে। তবে শর্ত দিলো বেশিক্ষণ বাইরে থাকতে পারবে না। মোখলেসও তার শর্তে রাজি হয়। জিকো আলমারি থেকে সালোয়ার কামিজ বের করে তৈরী হতে যায়। মোখলেস আপন মনে বলল-
আমি জানি আজ তুমি অনেক খুশি হবে।
.
.
.
আজ ক্লাস শেষে অনেকক্ষণ মাঠের মাঝখানেই দাঁড়িয়ে আছে হুরায়রা। এই কয়েক দিনে ক্লাসের পরে মেঘ কে দেখা যেন অভ্যেস এ পরিণত হতে যাচ্ছিল। ভালোই তো লাগতো তার। তবে আজ কেনো মেঘ আসলো না? অবশ্য সে যেমন আচরণ করে তার খারাপ লাগারই কথা।
রোদের আলোটা মুখে এসে লাগছে তার। আর বেশিক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না ভেবে হাঁটতে শুরু করলো সে।
সেই ছোট্ট থেকে তার জন্য ছেলেরা হুমড়ি খেয়ে পড়ত। কত শত প্রেমের প্রস্তাব সে পেয়েছে নিজেরই হিসাব নেই। তার এসবে কখনো আগ্রহ ছিল না। ভালোও লাগেনি কাউকে। কিন্তু এই কয়েকদিনে তার মাঝে বেশ পরিবর্তন এসেছে। ভালো লাগছে তার মেঘ কে। এখন নয়, সেই প্রথম দেখাতেই তাকে ভালো লেগেছে তার। যাকে বলে প্রথম দেখাতেই ভালোলাগা!
আর ভালোবাসা? সে এই বিষয়ে ভেবে দেখেনি। তার যে ভালোবাসতে মানা! একটাই লক্ষ্য তার জীবনে। পড়াশোনা করে অনেক বড় হওয়া ও নিজের পায়ে দাঁড়ানো। প্রেম ভালোবাসা তার জীবনে আসতে পারে না। এটাই তো পণ করে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিল সে। তবে মেঘের মাঝে এমন কি আছে যে হঠাৎ তার সব নিয়ম অনিময়ে পরিণত হতে যাচ্ছে? কেনো সে আজ মেঘ কে না দেখে শান্তি পাচ্ছে না!
ভালোলাগা কি কেবল ভালো লাগাই আছে? নাকি ভালোলাগা রূপ নিচ্ছে ভালোবাসায়?
ভাবতে ভাবতে দাঁড়িয়ে পড়ল হুরায়রা। তার মুখে মুচকি হাসি। সে বুঝতে পেরেছে মেঘ তার পিছু নিয়েছে। কেনো নিয়েছে এটাও সে বুঝেছে। মেঘ তার পিছু নিয়ে বাসার ঠিকানা জানতে চায়। কিন্তু এত সহজে এমন টা তো হতে দিতে পারে না সে। মেঘ তার বাসার ঠিকানা ততক্ষণ পর্যন্ত খুঁজে পাবে না, যতক্ষণ না হুরায়রা নিজে চাইবে।
এসব ভেবে আবারো হাঁটতে শুরু করলো হুরায়রা।
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here