মেঘের_শহর #পর্ব_২২ Saji Afroz

0
84

#মেঘের_শহর
#পর্ব_২২

Saji Afroz

.

হুরায়রা যে বাড়িতে ভাড়া থাকে, সে বাড়িতে একটি চিলেকোঠা আছে। যেটি বর্তমানে খালি। বাড়িওয়ালা সেটি ভাড়া দেয় না। পরিপাটি করে সাজিয়ে রেখেছে নিজের জন্যই। বউ এর সাথে ঝগড়া হলেই ওখানে গিয়ে থাকেন।
বাড়িওয়ালা লোকটি ভীষণ ভালো। হুরায়রাকেও ভালো জানেন তিনি।
আজ হুট করে তার সাথে একটা ছেলে দেখে তিনি একটু অবাকই হলেন। তিনি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই হুরায়রা বলল-
ও বিষণ্ণ শহর থেকে এসেছে। আমার বন্ধু। কিছুদিন এখানে থাকবে।
.
হুরায়রার কথা শুনে তিনি চোখ বড় করলেন। হুরায়রা বলল-
আপনার চিলেকোঠায় কি কিছুদিন থাকা যাবে? ভাড়া দিব আপনাকে।
.
হুরায়রার কথা শুনে তার বেশ ভালো লাগলো। চোখের চশমা টা ঠিক করতে করতে বললেন-
তুমি তো জানোই আমি ওটা ভাড়া দিই না। তবে যেহেতু তুমি একা একটা মেয়ে, এই ছেলে তো তোমার সাথে থাকতে পারেনা। সে তোমার যত ভালো বন্ধুই হোক। তাই আমি তাকে চিলেকোঠায় থাকার অনুমতি দিলাম। তবে…
-কি?
-ভাড়া দেয়ার প্রয়োজন নেই। আমার বউ ঝগড়া করলে আমি কিন্তু থাকতে আসব।
.
হুরায়রা হেসে বলল-
আচ্ছা।
.
শহর কে নিয়ে চিলেকোঠায় এল হুরায়রা। দরজায় তালা লাগানো নেই। এমনিতেই বন্ধ। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দুজনেই চমকালো। বেশ পরিপাটি ভাবে সাজানো চিলেকোঠা টি। একটা ছোট খাট আছে। খাটের সাথে লাগানো একটা টেবিল। টেবিলের সামনে বেতের চেয়ার রাখা। তবে টেবিলের উপরে একটি ল্যাম্প, কয়েকটি খাতা ও কলম ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না।
একপাশে বড় একটি শোকেস আছে। যাতে রয়েছে হরেক রকমের বই।
দুজনেই একসাথে বলে উঠলো-
সুন্দর!
.
হুরায়রা ও শহর একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো। শহর জিজ্ঞাসা করলো-
আপনি আগে আসেন নি এখানে?
-নাহ। তবে এখন থেকে আসা হবে।
-কেনো?
-আপনার জন্য।
.
শহর কে বিশ্রাম নিতে বলে হুরায়রা নিজের বাসায় ফিরে এল। পুনম কে একটা চিঠি পাঠানো প্রয়োজন। শহরের কথা শুনে ওভাবে না জানিয়ে হুট করে চলে আসা ঠিক হয়নি। বেচারি হয়তো তাকে খুঁজছে!
খাতা কলম নিয়ে বিছানার উপরে বসলো হুরায়রা। খাতায় লিখলো সে-
প্রিয় পুনম! তুই আমার প্রিয় একজন ছিলি। তোর শহরে যাওয়ার পর আমাদের ঘনিষ্ঠতা আরো বেড়ে যায়। তুমি থেকে তুই করে বলা শুরু করি আমরা! এই কয়েকদিনে তুই আমার আরো আপন হয়ে উঠেছিস।
আমি দুঃখিত, তোকে না জানিয়ে আমার শহরে ফিরে এসেছি। কিন্তু কথা দিলাম, আবার আসব জলদি। আর হ্যাঁ, শহর আনন্দ নগরেই আছে৷ থাকবে কিছুদিনের জন্য। পারলে তুইও চলে আয়। ভালোবাসা নিস।
.
.
.

মেঘের জন্য নিজের লেখা চিঠি টা ছিড়ে ফেলেছে সাইয়ারা। মেঘ এই মুহুর্তে ভীষণ কষ্টে আছে। তাকে এই চিঠি দিয়ে আরো কষ্ট সে দিতে পারে না। তার উচিত মেঘের পাশে থাকা। হুরায়রা কে খুঁজতে মেঘ কে সাহায্য করা। এবং এটাই সে করবে। কালই ভার্সিটি তে গিয়ে সে হুরায়রার বাড়ির নাম্বার জোগাড় করার চেষ্টা করবে। না পেলেও সমস্যা নেই। হুরায়রার জন্যই নিয়মিত ক্লাসে যাবে সে। যাতে করে তাকে দেখলেই মেঘ কে জানাতে পারে।
তার ভালোবাসা পূর্ণতা পায়নি কিন্তু মেঘের ভালোবাসা অপূর্ণ সে রাখতে পারে না। কিছুতেই না।
.
.
.
ডাক্তার পরশের কথা মিথ্যে নয়। জিকো আসলেই অনেক অন্যায় করেছে। কিন্তু কোন অন্যায় এর শাস্তি সে পাচ্ছে জানে না।
জিকোর সমস্যার কারণ ডাক্তার পরশ ধারণা করতে পারলেও এর কোনো সমাধান সে করতে পারেনি। বরং জিকো কেই বের করতে বলেছে, সেই রাতে কি হয়েছিল! যার কারণে এক রাতের ব্যবধানেই সে ছেলে থেকে মেয়ে হয়ে গেল!
হুট করে ফোনের রিং বেজে উঠলে ঘোর কাটলো তার। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো, বোনের ফোন এসেছে। ফোনের লাইন কেটে সে মেসেজ করলো-
কেনো ফোন দিচ্ছিস?
.
ওপাশ থেকে জবাব এল-
বাবার শরীর টা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেছে। স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলাম গেলাম।
সেলাইন দিয়ে রাখা হয়েছে বাবা কে। এই মুহুর্তে আমাদের হাতে কোনো টাকা নেই। যত দ্রুত সম্ভব পাঁচ হাজারের মতো টাকা পাঠাও।
.
জিকোর কাছে বলতে গেলে টাকা নেই তেমন। মাস শেষ হয়নি যে বেতন পাবে সে। এখন সে কি করবে!
মোখলেসের কাছে ধার নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু যা হয়ে গেছে সে কি ধার দিতে চাইবে?
বেশি না ভেবে মোখলেসের ফোন নাম্বারে ডায়াল করলো সে। ফোন বন্ধ পেয়ে বেরিয়ে পড়লো জিকো। রিকশায় চড়ে তার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
.
.

হুরায়রা আজ ক্লাসে এসেছে! এ যেন এক আনন্দের খবর! ক্লাসের প্রত্যেকেই তার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করছে, কেনো সে এতদিন আসেনি। কিন্তু সাইয়ারা মোবাইল হাতে নিয়ে সোজা মেঘের নাম্বারে ডায়াল করলো। হুরায়রা ফিরে এসেছে! এটা জানতে পারলে নিশ্চয় অনেক খুশি হবে মেঘ।
.
সাইয়ারার কাছে কথাটি শুনে আনন্দে লাফিয়ে উঠলো মেঘ। একবার ভেবেছিল হুরায়রা কে বুঝি আর কখনো সে দেখতে পারবে না! সে ইচ্ছে করেই মেঘের কাছ থেকে আড়াল হয়েছে। কিন্তু আজ যখন সাইয়ারার কাছে এই খবর টি পেয়েছে মেঘ এক মুহুর্তও দেরী করলো না। কোনোমতে শার্ট টা পরে ছুটলো সে তার হুরায়রার কাছে।
.
.
.
মোখলেসের বাসায় এসে তাকে পেল না জিকো। হতাশ হয়ে সে বেরিয়ে যেতে চাইলে মোখলেসের মা তাকে আটকালেন। মাথার উপরে ভনভনিয়ে ফ্যান চললেও অনবরত ঘামছে জিকো। ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিলো সে। মোখলেসের বোন পানি নিয়ে এলে, পুরো এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে আরো এক গ্লাস চাইলো সে। মোখলেসের মা
জানতে চাইলেন কেনো তাকে এত চিন্তিত মনে হচ্ছে?
সে তাকে বাবার শরীর খারাপের কথা খুলে বলল। এটাও বলল তার টাকার প্রয়োজন। মোখলেসের কাছে ধার চাইতে এসেছে। বেতন পেলেই ফেরত দিয়ে দিবে। তা শুনে মোখলেসের মা বললেন-
তোমার ভাই এর কাছে নেই?
-আসলে…
-বুঝেছি। সে তো শুধু মদ, গাজা, সিগারেট এসবেই টাকা উড়ায়! কি করে থাকবে তার কাছে! তা তোমার কত টাকা প্রয়োজন?
-পাঁচ হাজার।
.
মোখলেসের বোন আরেক গ্লাস পানি নিয়ে হাজির হলে তিনি বললেন-
তুই জেসিকা আপুর পাশে বস। আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।
.
একটু পরে ট্রে হাতে ফিরে এলেন তিনি। ট্রে টেবিলের উপরে রেখে পাঁচ হাজার টাকা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন-
এই নাও টাকা। আর এ টাকা ফেরত দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
-না আন্টি। তা কি করে হয়!
-হয় হয়। রাখো বলছি।
.
জোর করে জিকোর হাতের মুঠোয় টাকা ঢুকিয়ে দিলেন তিনি। এরপর খুব সংকোচের সাথেই বললেন-
শুনেছি মোখলেস তোমাকে ওর মনের কথা জানিয়েছিল। কিন্তু তুমি রাজি হচ্ছ না। একটাবার ভেবে দেখো মা। ও কিন্তু ভীষণ ভালো ছেলে। তোমাকে অনেক সুখে রাখবে।
.
তার মুখে কথাগুলো শুনে বেশ অবাক হলো জিকো। তার মানে মোখলেস তাদের সব বলেছে। এমন কি সে জিকোর বোন সেটাও? সবটা জানার পরেও পুরো পরিবার মোখলেসের ইচ্ছে কে প্রাধান্য দিয়েছে। কত ভালো পরিবার তার। আর সে কি না তাদের অন্ধকারে রেখেছে! এটা কি ঠিক হচ্ছে?
.
.
.
মেঘের মুখোমুখি হলো হুরায়রা। আচমকা মেঘ কে দেখে চমকে উঠলো সে। এই কয়েকদিনেই ছেলেটার চেহারা বদলে গেছে। দাড়িও কাটেনি। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। বিষণ্ণ মেঘ কে দেখে হুরায়রার বুকটা কেঁপে উঠলো। অজান্তেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল-
আপনার এই অবস্থা কেনো?
.
মেঘ বলল-
তোমার জন্য।
.
নিজেকে সামলিয়ে হুরায়রা বলল-
বুঝলাম না আপনার কথা।
-বুঝেও না বোঝার ভান করছ।
-মানে?
-সেদিন তুমি ইচ্ছে করে অন্য এক বাড়িতে প্রবেশ করেছিলে। যাতে করে আমি তোমার বাড়ি চিনতে না পারি। তোমার এই কাজের জন্য একটা মেয়ে কে কষ্ট দিয়েছি আমি। নিজেও কষ্ট পেয়েছি। কেনো আমার কাছ থেকে দূরে থাকছ তুমি?
-আপনার কাছে কখনো আমি ছিলাম না।
-কিন্তু…
.
কথা শেষ হবার আগেই মেঘের পেছনে তাকিয়ে হুরায়রা হাসি মুখে বলল-
আপনি এসেছেন!
.
দ্রুত হুরায়রা সেখান থেকে শহরের পাশে এল। হাসতে হাসতেই বলল-
ভার্সিটি দেখা হয়েছে?
-হ্যাঁ। তুমি ক্লাস করতে করতে আমি নিজেই ঘুরে দেখে ফেলেছি।
-চলুন এবার বাসায় যাওয়া যাক। আজ আপনাকে ইলিশ রান্না করে খাওয়াব।
-ঠিক আছে চলো।
.
দূর থেকে তাদের এভাবে কথা বলতে দেখে মেঘ পাশে এল। গম্ভীরমুখে জানতে চাইলো-
ছেলেটি কে?
-শহর। শহর আহমেদ। বিষণ্ণ শহরে তার সাথে পরিচয় আমার।
.
আর অপেক্ষা করলো না হুরায়রা। শহর কে হাঁটতে বলে নিজেও হাঁটতে শুরু করলো।

এভাবে তো কখনো মেঘের সাথে হাসিমুখে কথা বলেনি হুরায়রা!
শহর নামের ছেলেটার সাথে এত সখ্যতা গড়ে উঠেছে কিভাবে তার!
হুরায়রা কি তাকে ভালোবাসে? আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না মেঘ। ক্লান্তি ও অবসাদে ভেঙে আসতে চাইছে দেহ টা৷ বুকের মাঝে একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে সে। সারা শরীর কাঁপছে। মনে হচ্ছে এখুনি কোথাও ছুটে যেতে পারলে কিছুটা হলেও শান্তি সে পেত!
.
-বাসায় চলুন।
.
সাইয়ারার ডাকে ঘোর কাটলো মেঘের। কখন যে চোখ পানি চলে এসেছে খেয়ালই করেনি। আঙুল দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল-
আমি দেরী করে ফেলেছি সাইয়ারা।
-কাল আমি নিজে হুরায়রার সাথে কথা বলব।
-তার কোনো প্রয়োজন নেই। ও শহর কে নিয়েই ভালো থাক। আমার শহরের নাগরিক হবার কোনো ইচ্ছে তার নেই।
.
সাইয়ার দুচোখও টলমলে। মেঘের কষ্ট সে দেখতে পারছে না। আজ যদি হুরায়রা মেঘের কাছে আসতো, তার চেয়ে খুশি বেশি কেউ হত না। কেউই না!
.
.
.
রিকশায় বসে আছে শহর ও হুরায়রা। দুজনেই চুপচাপ। শহর হালকা কেশে বলল-
ম্যাডাম এতক্ষণ তো অনেক বকবক করছিলেন। এখন চুপ কেনো?
.
ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে সে বলল-
এমনিতে।
-ছেলেটি কে?
-মেঘ।
-পরিচিত?
-হুম।
-আপনজন?
-এখানে আমার আপনজন বলতে কেউ নেই।
-এখন আপনার বিষয়ে জানার আগ্রহ জমেছে আমার।
.
হারায়রা মুচকি হাসলো। শহর আর কথা বললো না। তবে হ্যাঁ, হুরায়রা কেনো মেঘ কে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে তা সে নিশ্চয় জানবে। খুব জলদি রহস্যময়ীর রহস্য জানতে চলেছে সে।

.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here