মেঘের_শহর #পর্ব_২৪ Saji Afroz .

0
198

#মেঘের_শহর
#পর্ব_২৪
Saji Afroz
.
সকালে ঘুম ভাঙতেই হুরায়রার দেখা পেল মেঘ। হুরায়রা তার পাশে বসে আছে। যা দেখে মেঘ হাসলো। হুরায়রার ভাবনায় এতটায় সে মগ্ন থাকে যে, দিন রাত শুধু তাকেই কল্পনা করে। মেঘ বলল-
কল্পনায় না এসে বাস্তবে আসলেও তো পারো?
.
মিষ্টি করে হেসে হুরায়রা বলল-
বাস্তবেই এসেছি।
.
মেঘ চোখ বন্ধ করে খুললো। হুরায়রা কে এখনো বসে থাকতে দেখে চমকালো সে। এক লাফে বসা থেকে উঠে পড়লো। হুরায়রার হাতের উপরে নিজের হাত টা রাখলো।
এটা কল্পনা নয়! সত্যিই হুরায়রা তার পাশে বসে আছে! মেঘ হাত সরিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
হুরায়রা বলল-
আমি আসাতে আপনি খুশি হলেন না? তবে আমি যাই।
.
হুরায়রা কে আটকালো মেঘ। এরপর দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল, সকাল ছয়টা।
তার নিজের রুমের দরজাও বন্ধ। হুরায়রা এখানে কিভাবে এসেছে সে বুঝতে পারছে না। হুরায়রা মেঘের অবস্থা বুঝতে পারে। সে বলল-
এত ভাবনার কিছু নেই। চলুন এখন।
-কোথায়?
-বারেহ! আমাকে বাড়ির সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবেন না?
.
মেঘ কিছু বলার আগেই হুরায়রা দরজা খুললো। দরজা খুলতেই অন্তরা আহম্মেদের দেখা পেল। তিনি সকালে ঘুম ভাঙলেই সারা বাড়ি হাঁটাহাঁটি করেন। তবে আজ হুট করে ছেলের রুমে একটা মেয়ে দেখে তিনি বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে চলে গেলেন। শক্ত হয়ে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি।

আর ভাবলেন, হুরায়রার শোকে তার ছেলেটা খারাপ হয়ে গেল না তো! যার কারণে বাসায় মেয়ে এনে রাত কাটিয়েছে!
হুরায়রা অন্তরা আহম্মেদ কে সালাম জানালো। কিন্তু তিনি তার জায়গায় দাঁড়িয়ে অগ্নি দৃষ্টি তে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছেন। মেঘ মায়ের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল-
মা আমি জানি না ও কখন এসেছে। আমি এখুনি ঘুম থেকে উঠে দেখলাম। ও তোমাকেই ডাকতে যাচ্ছিল এখন।
.
নিজের ছেলের প্রতি অগাধ বিশ্বাস অন্তরা আহম্মেদের। তাই কথাটি শুনে তিনি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। হুরায়রার দিকে তাকিয়ে গম্ভীরমুখে বললেন-
এই মেয়ে কে তুমি? আমার ছেলের রুমে কি করছ? আর বাসায়ই এসেছ কিভাবে? আমি এখনো দরজা খুললাম না।
.
কোনো প্রশ্নের উত্তর হুরায়রা দিলো না। শুধু বলল-
আমি হুরায়রা।
.
যা শুনে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে লাগলেন অন্তরা আহম্মেদ।

হালকা বেগুনী রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছে সে। কোমর সমান লম্বা চুলগুলো খোলা। কোনো সাজগোছ নেই। তবুও কি সুন্দর টায় না লাগছে তাকে!
অন্তরা আহম্মেদ মনে মনে ছেলের পছন্দের প্রশংসা করলেন। তবে মেয়েটির এখানে হুট করে আসা তার পছন্দ হয়নি। তাছাড়া প্রথমবার এসেই সোজা মেঘের রুমে চলে এসেছে! অদ্ভুত!
এই বিষয়ে কথা বাড়ালেন না তিনি। হুরায়রা কে নিয়ে ড্রয়িংরুমের এলেন। সোফায় বসতে বসতে বললেন-
এতদিন কোথায় ছিলে তুমি?
-বেড়াতে গিয়েছিলাম।
.
মিন্নী কে দেখতে চাইলে তার নাম ধরে জোরে জোরে ডাকলেন অন্তরা আহম্মেদ। চোখ জোড়া কচলাতে কচলাতে সে আসলো। হুরায়রা কে দেখে নিজের জামাকাপড় ও চুল ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। এত সুন্দরী একটা মেয়ের সামনে নিজেকে তুচ্ছ মনে হচ্ছে তার। কিন্তু কে এই মেয়েটি?
মেঘ দুজনের পরিচয় করিয়ে দিলো। মিন্নী বলল-
এটা হুরায়রা আপু! আপু তো অনেক সুন্দরী! আমার কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি।
.
হুরায়রার কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো মিন্নী। এরপর সে ফ্রেশ হয়ে আসবে বলে ভেতরে চলে যায়। অন্তরা আহম্মেদও নাস্তা বানাতে রান্নাঘরে এগিয়ে যান। মেঘ হুরায়রার সামনে এসে বলল-
হঠাৎ এমন সারপ্রাইজ?
-আসতে পারি না আমি?
-তা কেনো নয়!
.
শহরের কথা মনে পড়লো মেঘের। সে আমতাআমতা করে বলল-
আপনার বন্ধু টি কোথায়?
-শহর? বাসায়ই আছে।
-ও কি শুধুই আপনার বন্ধু?
-হুম। শহরই আপনার কাছে পাঠিয়েছে আমাকে।
.
এটা শুনে মেঘের মুখে হাসি ফুটলো। মিন্নী এসে বলল-
যাও ভাইয়া তুমিও ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি আপুর সাথে কথা বলি।
.
মেঘ উঠতে না চাইলে মিন্নী বলল-
তোমার মুখ থেকে গন্ধ আসছে। বিশ্বাস না হলে আপুকেই জিজ্ঞাসা করো।
.
হুরায়রা মুখ টিপে হেসে বলল-
হ্যাঁ ঠিক।
.
মেঘের একেবারেই ইচ্ছে করছে না উঠতে। তবুও সে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। একটু পরেই আবার ফিরে আসে। এদিকে অন্তরা আহম্মেদেরও নাস্তা বানানো হয়ে এসেছে। তিনি সকল কে ডাইনিং টেবিলে বসতে বললে মেঘ মিন্নীর উদ্দেশ্যে বলল-
সাইয়ারা কে ডেকে আন। হুরায়রা এসেছে জানলে ও অনেক খুশি হবে।
.
.
.
বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে জিকো। মোখলেস কে আসতে বলেছে সে। আজ তার সাথেই অনাথ আশ্রমে যাবে ঠিক করেছে। আজ জিকো প্রথম বারের মতো শাড়ি পরেছে। শাড়ি টি ধার নিয়েছে নবীনার কাছ থেকে। এবং সেই তাকে পরিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়। জিকো কে সে সাজিয়েও দিয়েছে। চুলে খোপা করে তাতে দিয়েছে গোলাপ ফুল। নিজেকে নিজেই আয়নায় দেখে অবাক হয়েছে জিকো। তাকে দেখে কেউ বলবে না, সে আগে ছেলে ছিল!
মোখলেস আসতেই শাড়ি পরিহিতা জিকো কে দেখে বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো। জিকো কে শাড়ি তে দেখবে আশা সে করেনি।
মোখলেস নীরবে তাকে দেখতে লাগলো। প্রথমবারের মতো শাড়ি পরাতে অস্বস্তি লাগছে জিকোর। তার উপরে মোখলেসের এমন চাহনি! জিকো কিছুটা বিব্রতবোধ করে বলল-
চলুন যাওয়া যাক?
.
দুজনে রিকশায় বসে। মোখলেস একটা কথাও বলেনি। জিকো রিকশা চালক কে কোথায় যাবে জানায়। মোখলেস বুঝতে পারলো না, এত সেজেগুজে জিকো তাকে নিয়ে অনাথ আশ্রমে যাচ্ছে কেনো!
.
.
.
মিন্নীর সাথে সাইয়ারা এল। হুরায়রা কে দেখে চমকালো না সে। বরং খুশি হয়ে তার পাশে এসে বসলো। হুরায়রা তাকে চিনতে পারলো। মেঘ নিজের বান্ধবী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলো সাইয়ারা কে।
মেঘ বলল-
আমি জানতাম না তোমরা দুজনেই একই ক্লাসে পড়।
.
অন্তরা আহম্মেদ নাস্তা নিয়ে আসলেন। সকলে খেতে খেতে গল্প করছে। এদিকে হুরায়রা সাইয়ারার হাত ধরে ধীর কণ্ঠে বলল-
ধন্যবাদ।
.
সাইয়ারা তার হাতের উপর হাত রেখে মৃদু হাসলো।
.
.
.
মোখলেস কে নিয়ে ক্লাসে এল জিকো। বাচ্চারা সবাই তাদের দেখে সালাম জানালো। জিকো মুচকি হেসে সবার খবরাখবর জানতে চাইলো। এরপর সে সবার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞাসা করলো-
তোমাদের মোখলেস ভাইয়ার সাথে আমাকে কেমন দেখায়?
.
সকলে উচ্চশব্দে বলে উঠল-
ভালো।
-আমি ওর বউ হলে কেমন লাগবে?
.
আরো জোরে করে সবাই বলল-
ভালো।
.
অবাক হয়ে মোখলেস তার দিকে তাকায়। জিকো বলল-
আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।
.
কথাটি বলতেই বাচ্চারা সবাই তাদের দিকে এগিয়ে আসলো। সকলে মোখলেস কে বলল-
বিয়ে খাব, বিয়ে খাব।
.
মোখলেস খুশিতে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। এ যেন স্বপ্ন দেখছে সে!
.
.
.

হুরায়রা মেঘ কে নিয়ে বের হয়েছে। এদিকে সাইয়ারা ছাদে এসেছে। হাতে ডায়েরি ও কলম।
ডায়েরি খুলে লিখছে-
প্রিয় মানুষটা আজ তার প্রিয় মানুষ টাকে কাছে পেল। তার খুশিতে আমিও খুশি। কিন্তু বুকের মাঝে একটা কষ্ট অনুভব করছি। এটা কেনো?
আমার কি তবে এখান থেকে চলে যাওয়াই শ্রেয়?
.
চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে সাইয়ারার। সে ডায়েরি থেকে তার লেখা পাতা টি আলাদা করে নিলো। বাতাসে পাতা টি উড়ে নিচে চলে যায়। সাইয়ারা তাড়াহুড়ো করে ছাদ থেকে নামতে থাকে।
এদিকে পাতা টি পরশের পায়ের কাছে এসে থামলো। সে হাতে নিয়ে সম্পূর্ণ টা পড়ে মুচকি হাসলো। সাইয়ারা এসে পরশের হাতে পাতা টি দেখে তার দিকে ছুটে আসলো। হাপিয়ে উঠেছে সে। লম্বা একটা দম ফেলে বলল-
ওটা আমার।
.
নিজের শহরে ফিরে যাচ্ছিলো পরশ। পথিমধ্যে তার মতোই কারো সাথে দেখা হবে ভাবেনি। পরশ তার দিকে কাগজ টি এগিয়ে দিয়ে হেসে বলল-
আপনার মাঝে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পারছি আমি।
-মানে?
-আমিও আমার ভালোবাসার মানুষ টার সুখে খুশি হতে চেয়েছিলাম।
-তারপর?
-তারপর আর কি! সে সুখী হলো না। চলে গেল ওপারে।
-কিন্তু কেনো?
-যাকে সে মনে প্রাণে ভালোবেসেছিল, সে তাকে ধোঁকা দিয়েছে। যা মেনে নিতে পারেনি সে।
.
সবটা শুনে সাইয়ারার বুক টা ধুক করে উঠলো। সে আবারো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এখানে থাকবে না। ফিরে যাবে নিজের গ্রামে। কিন্তু এখন পরশের কথা শুনে তার মনে ভয় জমেছে।
পরশ বলল-
নিজের ভালোবাসার মানুষ টা কে অন্যের ভরসায় এভাবে একা রেখে যাবেন না। অপেক্ষা করুন শেষ পর্যন্ত।
.
কথাটি বলে পরশ তার ট্রলি ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। সাইয়ারা ভাবছে, হুরায়রা কি সুখে রাখবে না মেঘ কে? অবশ্যই রাখবে। সে ওমন মেয়েই নয়। কিন্তু এই ছেলেটি যা বলেছে তা কি মাথায় রাখা উচিত নয়?
.
.
.
আজ আর ক্লাস করালো না জিকো। মোখলেস কে নিয়ে ঘুরতে বের হলো সে। দুজনে পাশাপাশি রিকশায় বসে আছে। জিকো বলল-
আপনি তো জানেনই জিকো ভাইয়ার সম্পর্কে। বাবা ভীষণ অসুস্থ। বাট সে এখানের কাজকর্ম ফেলে ওখানে বসে আছে। হাতে টাকাও নেই। এখন বাবার চিকিৎসা আটকে আছে।
.
জিকোর হাতের উপরে হাত রেখে মোখলেস জানায়-
আমি আছি তো। জিকো কে বলো চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে।
.
জিকো হ্যাঁ সূচক ভাবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। তবে তার ইচ্ছে করছে এক ঝাটকায় মোখলেসের হাত টা সরিয়ে দিতে। কই? নবীনা যখন আজ তাকে স্পর্শ করেছে, তখন তো এমন খারাপ লাগেনি তার। সে মেয়ে হয়েছে। তবে কেনো তার মোখলেসের প্রতি দূর্বলতা কাজ করছে না। কেনো!
সে মোখলেস কে ঠকাচ্ছে। তবে এছাড়া এখন আর উপায় নেই। তার ভালো থাকতে হবে। নিজের পরিবার কেও ভালো রাখতে হবে।
.
.
.
-এ কি তুমি চলে এলে এত তাড়াতাড়ি ?
.
দরজার পাশে হুরায়রা কে দেখে প্রশ্ন টি করলো শহর।
হুরায়রা ভেতরে এসে বসলো। নরমস্বরে বলল-
আমি মেঘ কে কিছু জানাতে পারিনি।
-কেনো?
-আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি। সবটা জেনে যদি ও আমার কাছ থেকে দূরে থাকতে চায়? আমার মাথা কাজ করছে না।
.
শহর হাসলো। হুরায়রা তার দিকে তাকালে সে বলল-
ভুল করলে মেঘা। নিজের সত্যি টা আড়াল করে ভুল করলে। মিথ্যে বলেও কি তুমি তার সাথে থাকতে পারবে? পারবে না। তবে কেনোই বা আড়াল করলে?
.
হুরায়রার চোখ থেকে পানি পড়ছে। সে ভেজা গলায় বলল-
আমি মেঘ কে বলতে পারিনি, আমি হুরায়রা নয়। আমি মেঘা!
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here