মেঘের_শহর #পর্ব_৫ Saji Afroz

0
118

#মেঘের_শহর
#পর্ব_৫

Saji Afroz

.
মেঘ ও অন্তরা আহম্মেদের সামনে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে সাইয়ারা। তার চোখেমুখে অপরাধীর ছাপ বিদ্যমান। সেই কতক্ষণ আগেই মেঘ তাকে সত্যিটা স্বীকার করতে বলেছে। কিন্তু সে কিছু না বলে চুপচাপ মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।
হঠাৎ অন্তরা আহম্মেদ পেট ধরে বলে উঠলেন, তিনি পেটে ব্যথা অনুভব করছেন। মেঘ উত্তেজিত হয়ে বলল, দুপুরে না খাওয়ার ফল এটা। তিনি বেশিক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারেন না। আর জেদ না করে খেয়ে নিতে।
এবার সাইয়ার চোখ তুলে মুখ খুললো-
আন্টি আমি মজা করেছি। আপনি খেয়ে নিন প্লিজ!
.
সাইয়ারা সত্যি টা স্বীকার করতেই মিন্নী বলল-
ঠিক এইভাবেই সাইয়ারা আপু মায়ের কাছে নানাভাবে বকা শুনিয়েছে আমাকে। আজ মা ওকে কিছু কথা শুনিয়ে দাও। কেনো আমাদের বিরুদ্ধে সে কান ভারি করে তোমার!
.
মিন্নীকে থামিয়ে অন্তরা আহম্মেদ সাইয়ারা কে কাছে ডাকলেন। সাইয়ারা তার পাশে এসে বসলো। তিনি সাইয়ারার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বেশ অবাক হয় সাইয়ারা! ভেবেছিল অন্তরা আহম্মেদ তাকে কটু কথা শোনাবেন, বকাঝকা করবেন। কিন্তু এমন কিছুই তিনি করলেন না। বরং সাইয়ারাকে তিনি ভালোভাবে বোঝালেন, এসব ঠিক নয়। সে যেন এমন আর না করে।
সাইয়ারা নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত হলো। সবার কাছে ক্ষমা চাইল সে।
মিন্নীর মন গললো না৷ সে বকবক করতে করতে ভেতরে চলে গেল।
সাইয়ারার হাত ধরে অন্তরা আহম্মেদ বললেন-
মিন্নী একটু বদমেজাজি। তুমি কিছু মনে করোনা৷ তোমরা বসো, আমি খেয়ে আসি।
.
অন্তরা আহম্মেদের রান্নাঘরের দিকে গেলেন।
সাইয়ারা দাঁড়িয়ে মেঘের উদ্দেশ্যে বলল-
আমি আসি তবে।
-ধন্যবাদ।
-কেনো?
-সত্যিটা জানানোর জন্য।
.
সাইয়ারা দরজার দিকে পা বাড়ালো। কি যেন ভেবে থেমে গেল সে। পেছনে ফিরে দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে বলল-
সে তো আন্টি কিছু খাননি বলে বলেছি। আপনার জন্য না! দুষ্টুমি আমি ছাড়ছি না।
.
সাইয়ারা দৌড়ে বাড়ির বাইরে চলে গেল। মেঘ হেসে আনমনে বলল-
দুষ্টু মেয়ে!
.
.
সকাল সকাল ঘুম ভাঙতেই তৈরী হয়ে বাড়ির বাইরে বেরুলো হুরায়রা।
আজ তার বিশেষ একটি কাজ রয়েছে। এরপরে ভার্সিটি যাবে সে।
হাঁটতে হাঁটতে মেঘদের বাড়ির সামনে আসতেই থেমে গেল সে। সেদিন এখান থেকেই একজন মহিলা তার নাম ধরে ডেকে কিছু কথা বলেছিল। সবটায় শুনেছিল হুরায়রা। কিন্তু সে থামেনি। থামলে মহিলাটির সাথে কথা বলতে হত তার। অপরিচিত কারো সাথে অহেতুক কথা বলতে সে পারে না। তবে ওই মহিলাটি কি মেঘের মা হোন? তাই তো তিনি চেঁচিয়ে তার ছেলের ছাতার কথা বলছিলেন।
এমন হলে এটি নিশ্চয় মেঘের বাড়ি!
একতলার ছোটখাটো সুন্দর একটা বাড়ি। বাড়ির দরজাটা খোলা আছে। হয়তো খুব ভোরেই কেউ খুলেছে।
হুরায়রা গেইটটা ঠেলে উঁকি দিলো।
বাড়ির সামনে ছোট্ট একটি উঠান, তার পাশেই বাগান আছে। বেশ ভালোই লাগলো হুরায়রার।
বেশিক্ষণ দাঁড়ালো না সে। কিছু একটা ভেবে আবারো হাঁটতে শুরু করলো।
.
আজ খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল মেঘের। বাড়িতে আসলে এমনটা সচারাচর হয়না। এপাশ-ওপাশ করতে লাগলো সে। তবুও তার ঘুম এল না। তাই সে ছাদে আসলো সকালের প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে।
রেলিং এর পাশে এসে নিচে তাকাতেই হুরায়রা কে দেখতে পেল সে।
এত সকালে হুরায়রা! সে কি ভুল দেখছে?
চোখ জোড়া কচলিয়ে আবারো রাস্তার দিকে নজর দিলো মেঘ। হুরায়রা কে দেখে এক মুহুর্তও দেরী না করে দৌড়ে নিচে নেমে আসলো।
কেউ না দেখে মতো বাড়ির বাইরে এসে হুরায়রার পিছু নিলো সে।
এত সকালে মেয়েটি কোথায় যাচ্ছে তা জানার কোনো আগ্রহ মেঘের নেই। কিন্তু তাকে দেখার সুযোগ পেয়েও সহজে হাতছাড়া তো সে করতে পারেনা।
.
বেশকিছুক্ষণ পর থেমে গেল হুরায়রা। পেছনে ফিরে মেঘকে দেখতে পেল সে।
এলোমেলো চুল, কালো ট্রাউজার ও টিশার্ট পরিহিত মেঘকে দেখে সে বলল-
আমার পিছু নেওয়া হচ্ছে কেনো?
.
তাকে হুরায়রা দেখে ফেলেছে বলে কিছুটা লজ্জা পেল মেঘ। মাথাটা না সূচকভাবে নেড়ে সে বলল-
আসলে আমি…
-দেখছিলেন এত সকালে কোথায় যাচ্ছি?
-তা নয়। আপনাকে দেখেই নিচে নেমে এলাম। আমার বাড়ি পার হয়েই এসেছেন আপনি।
-জানি।
-চিনেন?
-হ্যাঁ।
.
হুরায়রা আবারো হাঁটা শুরু করলে মেঘ ছুটে তার পাশে এসে বলল-
এত তাড়াতাড়ি ক্লাস শুরু হয় আপনার?
-সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেই পারেন, আমি কোথায় যাচ্ছি?
.
হালকা হেসে মেঘ বলল-
কোথায় যাচ্ছেন?
-আপনি চাইলে আমার সাথে যেতে পারেন।
-চলুন তবে।
.
হাঁটতে হাঁটতে তারা বেশ কিছুদূর চলে আসলো। একটা বস্তির সামনে এসে থামলো হুরায়রা। ছোটাখোট একটা বস্তি। তবুও বোঝা যাচ্ছে অনেক মানুষের বাস এখানে।
মেঘের দিকে তাকিয়ে হুরায়রা বলল-
সমস্যা হবে ভেতরে যেতে?
.
হাসিমুখে মেঘ বলল-
নাহ!
.
হুরায়রা লম্বা একটা গলিতে ঢুকে পড়লো। মেঘও তার সাথে যেতে থাকলো। এর আগে মেঘ কখনো বস্তিতে প্রবেশ করেনি। বাইরে থেকে অনেকবারই দেখেছে। আর বই-পুস্তকের মাধ্যমে তাদের জীবন জীবিকা সম্পর্কে ধারণা পেয়েছে।
হুরায়রা কেনো এখানে এসেছে সে জানেনা। হয়তোবা একটু পরেই জানবে।
হঠাৎ মেঘ একটি ইটের সাথে ধাক্কা লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে থাকে। হুরায়রা তা খেয়াল করে ক্ষিপ্রতার সাথে তার একটা হাত ধরে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। ছেলেও হয়ে সে পড়ে যেত! ব্যাপারটায় বেশ লজ্জা পায় মেঘ। পাশেই কয়েকটি বাচ্চা ছিল। যারা ছাই দিয়ে দাঁত মাজছে। তারা মেঘের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। মেঘ অসহায় এর মতো দাঁড়িতে থাকলো। তাকে স্বাভাবিক করার জন্য হুরায়রা বলল-
ব্যাপারা না! হতেই পারে এমন।
.
তারপর তারা আরেকটু সামনে এগিয়ে এসে একটি ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। ছোট্ট একটি টিনশেডের ঘর। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, ভেতরে দুটো রুমের বেশি নেই।
মেঘ তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিকে তাকালো। তাকে কোনো উত্তর না দিয়ে ঘরটির দরজায় কড়া নাড়ে হুরায়রা।
মধ্যবয়সী একজন মহিলা বেরিয়ে এলেন। হুরায়রা কে দেখে তিনি খুব খুশি হলেন। তিনি জানতে চাইলেন, হুরায়রা তার বাড়ি কিভাবে চিনেছে। সে কথার জবাব না দিয়ে ব্যাগ থেকে হাজারখানেক টাকা বের করে তার হাতে দিলো হুরায়রা।
খুশিতে মহিলাটির চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি হুরায়রাদের স্বাগত জানিয়ে ভেতরে নিয়ে আসলো।
তোড়জোড় শুরু করে দিলেন তিনি মেহমানদারির জন্য। হুরায়রা তাকে ব্যস্ত হতে নিষেধ করলো।
মেঘ এসবের কিছুই বুঝতে পারলো না।
চুপচাপ এসব দেখে চলেছে সে।
মহিলাটি মেঘের পরিচয় জানতে চাইলে, হুরায়রা তাকে বন্ধু বলে পরিচয় করিয়ে দিলো।
মহিলাটি মেঘের উদ্দেশ্যে বলল, সে অনেক খুশি হয়েছে তারা এখানে এসেছে। হুরায়রা মেয়েটি অনেক ভালো। তাদের বন্ধুত্ব যেন অটুট থাকে।
.
কিছুক্ষণ সময় কাটানোর পর বস্তি ছেড়ে বেরিয়ে আসলো তারা।
হুরায়রা বলল-
আপনাকে এখানে কেনো এনেছি জানেন?
-কেনো?
-আসলে কিছুদিন আগে এই জমিলা খালার সাথে আমার রাস্তায় দেখা হয়। আমার কাছে তিনি সাহায্য চান, তার মেয়ের বিয়ের জন্য। কিন্তু আমার কাছে কোনো টাকা ছিল না তখন। কিভাবে দিতাম! তাই আজ এসেছি। তবে আপনাকে সাথে আনার একটা কারণ আছে।
-কি?
-এই মহিলাটির জন্য একটি কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন? তার স্বামী নেই। আপনার নিশ্চয় এখানকার সবকিছুই জানাশোনা আছে।
-আপনার নেই?
-থাকলেও সবার দ্বারা সব হয়না।
-মানে?
-এত ব্যাখা করতে পারব না। পারবেন কি না তা বলেন।
-চেষ্টা করব।
-ধন্যবাদ। আজ আসি তাহলে। ক্লাস আছে আমার।
.
হুরায়রা ভার্সিটির উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলো। মেঘ তাকিয়ে আছে তার পথের দিকে। আজ নতুনভাবে আবিষ্কার করলো সে হুরায়রা কে। মেয়েটি শুধু সুন্দরী তা নয়, মমতাময়ীও বটে!
.
.
মেঘ বাড়িতে আসতেই মায়ের চেঁচামেচির শব্দ শুনতে পেল।
তিনি মিন্নীর সাথে চেঁচামেচি করছেন। মেঘ মা কে থামাতে চাইলে তিনি আরো ক্ষেপে যান।
মিন্নী জানায়, সকালে উঠে মেঘ কে না দেখেই চেঁচামেচি শুরু করেছেন তিনি।
মেঘ বলল, এমনটা আর হবে না। না বলে কোথাও যাবে না সে।
কোনোমতে অন্তরা আহম্মেদ কে শান্ত করলো মেঘ। তিনি নাস্তা তৈরীর জন্য রান্নাঘরে গেলে মিন্নী বলল-
হুট করে সকাল সকাল কোথায় গেলে ভাইয়া?
.
আমতাআমতা করে মেঘ বলল-
হাঁটতে।
-গলার স্বর এমন লাগছে কেনো তোমার?
-কেমন?
-মনেহচ্ছে সাইয়ারা আপু যা বলেছে সত্যি!
.
বোনের দিকে তাকিয়ে মেঘ বলল-
আমি এসেছি পর্যন্ত কোনো খবর নাই তোর, এখন আমার সাথে মশকরা করা হচ্ছে?
-খবর আমার নাই! তোমাকেই তো খুঁজে পাই না আমি। এখানে সেখানে ঘুরতে থাকো। আমার জন্য সময় আছে তোমার?
.
আসলেই এই শহর ছেড়ে যখন ভিন্ন শহরে পড়াশোনার জন্য মেঘ পাড়ি জমায়, তখন থেকেই ভাইবোনের মাঝে দুরুত্ব টা সৃষ্টি হয়। বাড়িতে খুব কমই আসতো মেঘ। আসলেও মিন্নী কে সেভাবে সময় দেওয়া হয়নি। দূরে থাকতেও ফোনেও খুব একটা কথা বলতো না।
মিন্নী একটু চাপা স্বভাবের মেয়ে। সেও নিজ থেকে কখনো ফোন দিত না। এভাবেই তাদের মাঝে দুরুত্বের সৃষ্টি হয়।
বড় ভাই হিসেবে মেঘের দায়িত্ব বেশি এটা সে ভুলেই গিয়েছিল। আজ মিন্নীর কথা শুনে মনে হচ্ছে মাঝেমাঝে বোনটাকেও একটু সময় দিতে পারতোই সে।
বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মেঘ বলল-
এখন থেকে দিব সময়।
.
.
আজ চটপটি খেতে বাড়ির বাইরে যেতে হয়নি সাইয়ারার। তার খালা তার জন্য চটপটি বানিয়েছে বাসায়। সে বড় একবাটি চটপটি নিয়ে ছাদে আসলো। ঠিক ছাদের মাঝখানে বসে সে আপনমনে চটপটি খেতে থাকলো।
.
-বাটির উপরে কাক যদি বাথরুম সেরে দেয়?
.
পাশের ছাদ থেকে মেঘের বলা কথাটি শুনে চটজলদি উঠে পড়ল সে। ওড়না দিয়ে বাটি টা ঢেকে বলল-
ওহ আপনি!
-ইশ! বেচারি কাকের ভয়ে বাটি ঢাকলো।
-জি না! আপনার ভয়ে।
-আমার?
-হ্যাঁ। যদি নজর দেন!
.
হেসে ফেললো মেঘ। সাইয়ারা জানতে চাইলো, তার মা কেমন আছে। সে বলল-
ভালো।
-আচ্ছা একটা কথা বলুন তো। আন্টি প্রেমের কথা শুনলেই এত ক্ষেপে যান কেনো? এর আগে এই বিষয়ে মিন্নীর সাথেও তাকে আমি রাগ করতে দেখেছি।
-জানি না তো!
-আপনি তার ছেলে হয়েই জানেন না? জেনে নিবেন। নাহলে আপনারা কেউই প্রেম করতে পারবেন না। যদি করেন, আন্টি ভিলেনের ভূমিকা পালন করবে।
.
সাইয়ারার কথাটি মাথায় ঢুকলো মেঘের। আসলেই তো! ছোট থেকেই তার মা কে দেখে আসছে মেঘ। কখনো তিনি রোমান্টিক উপন্যাস পড়েন না, না দেখেন রোমান্টিক কোনো সিনেমা বা নাটক! কেউ প্রেম করেছে তা শুনলেও সহ্য করতে পারেন না তিনি। কিন্তু এর কারণ কি? কখনো জিজ্ঞাসা করা হয়নি তাকে। হয়তো বা প্রয়োজন মনে করেনি। এখন একবার কি জিজ্ঞাসা করেই দেখবে? তিনি প্রেমের বিরুদ্ধে কেনো!
.
.
জিকোর বাসায় কোনো খাবার নেই। ক্ষিদেয় তার পেট টা চো-চো করছে। তাই সে কিছু টাকা নিয়ে বাজার করার জন্য বাসার বাইরে আসলো। কয়েক কদম পা বাড়াতেই কোনো মেয়ের কণ্ঠস্বর শুনে থামলো সে। মেয়েটিকে সে চিনে। একই বাড়ির ভাড়াটিয়া সে। কিন্তু কখনো কথা হয়নি তার সাথে। তবে আজ কেনো ডাকছে!
মেয়েটি এসেই জিকো কে চোর বলে সম্বোধন করলো। জিকো কিছু বলার আগেই মেয়েটি বলল-
চোর কোথাকার!
তোমার কি বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধও নেই! আরেকজনের পোশাক চুরি করে আবার সেটা গায়ে দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছ!
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here