শরতের_শিশির #সূচনা_পর্ব #মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)

0
464

কলেজের অন্যতম সুদর্শন ছেলে অত্র। শুধু সৌন্দর্যের দিক থেকে নয় বরং অর্থ প্রতিপত্তির দিক থেকেও বাকিদের চেয়ে বেশ এগিয়ে। পড়াশোনায় খুব একটা মনোযোগী না হলেও পুরো কলেজ জুড়ে তার বেশ নামডাক। তবে তার বিচরণ শুধু খেলার মাঠ আর ক্যান্টিনেই সীমাবদ্ধ। ক্লাসে খুব কমই তাকে দেখা যায়। কিন্তু আচমকাই আজকে অত্রের লাইব্রেরীতে পদধূলি পড়াতে সবার চোখ কপালে। আশেপাশের সবাই কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকেই দেখছে। যার পড়াশোনার বালাই নেই সে আজ হঠাৎ লাইব্রেরীতে? নিরব লাইব্রেরী মুহূর্তে সরব হয়ে উঠল। সবার মাঝে চাপা গুঞ্জন শুরু হল অত্রের আকস্মিক আগমনে।

এত কিছুর ভীড়ে লাইব্রেরীর এককোণে কেউ একজন ছিল বেশ নির্লিপ্ত। চৈতন্যহীন রমণী নির্বিঘ্নে তার কলম চালিয়ে যাচ্ছে। এ দৃশ্য অত্রের দৃষ্টিগোচর হল। বেশ আত্মসম্মানে লাগল। তার মত ছেলেকে এড়িয়ে যাওয়া। ঠান্ডা মস্তিষ্ক মূহুর্তে আক্রোশে ফেটে পড়ল। তড়িৎ চৈতন্যহীন সেই রমণীর পাশে গিয়ে বসল।

ক্লাশ শুরু হতে এখনো ঢের সময় বাকী। তাই চাঁদনী লাইব্রেরীতে বসে নিজের অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করতে ব্যস্ত। আচম্বিত অত্রকে দেখে তার চক্ষু ছানাবড়া। এই ছেলে এখানে কি করছে? এক ঝলক দেখে নিজের কাজে পুনরায় মনোযোগ দিল। সামনে বসতে দেখে অস্বস্তিতে হাসফাস করছিল। তবু নিজের কলম বন্ধ করল না। অত্র প্রথমে গলা খাঁকারি দিল চাঁদনীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। কিন্তু তার আদলের কিঞ্চিৎ পরিবর্তনও হল না। ওপাশের এহেন নিরবতা অত্রকে ভাবান্তর করল। জবাব না পেয়ে অপমানিতবোধ করল। তবু নিজ থেকে বলে উঠল,

“হ্যাই, আমাকে চেনো। না চিনলেও সমস্যা নেই। আমার নাম অত্র আরবান খান। আমিও অর্থনীতি বিভাগের ৩য় বর্ষের ছাত্র। তোমার সাথেই পড়ি। তবে আমি কিন্তু তোমার নাম জানি। তুমি চাঁদনী তাই না! আসলে, আমি একটা বিপদে পড়ে তোমার সাহায্যে চাইতে এসেছি। আমাকে একটু সাহায্যে করবে মুনলাইট?”

চাঁদনীর নত মস্তক তড়িৎ অত্রের দিকে মাথা তুলে চাইল। তার হৃদকোণে কিঞ্চিৎ কৌতুহল সঞ্চারিত হল। ভীষণ ডানপিটে স্বভাবের অত্র। চঞ্চল আর দুরন্তপনার জন্য পুরো কলেজ জুড়ে তার নাম জঁপে সবাই। ভালো-মন্দ দুই গুণেই আছে এই ছেলের মধ্যে। হয়ত এজন্য এত নামডাক তার। কিন্তু তার কাছে কি চাই জানা দরকার। বিস্মিত হয়ে বলল,

“প্রথমত আমার নাম চাঁদনী, মুনলাইট নয়। বলুন, কি সাহায্যে করতে পারি আপনাকে?”

কথাগুলো বলে আবার নিজের খাতায় কলম বসাল সে। অত্র দু’ঠোঁট ফাঁক করে ছোট্ট করে বলল, ওহ। তারপর কিছুসময় চুপ করে থাকল। ভাবুক হয়ে বসে আছে। উঁকিঝুঁকি মারছে চাঁদনী খাতায় কি লিখছে দেখার জন্য। লেখা দৃশ্যমান হতেই অবাক হয়ে বলল,

“লিওনটিফ প্যারাডক্স, এটা আবার কি! কোন বিষয়ের?”

চাঁদনীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। পরক্ষণেই মনে পড়ল, পড়াশোনা করলেই তো জানবে। বইয়ের সাথে আদৌ সম্পর্ক আছে কি’না আল্লাইহ জানে। মুখে জবাব দিতে ইচ্ছে করল না। বিরক্তিতে মুখ কুঁচকালো সে। অত্র আবারও খাতার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। ফের বলে উঠল,
“হেকসার অলিন তত্ত্ব! এসব কি লিখছো? কোন বিষয়ের এগুলো?”

চাঁদনীর এবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। মুখ ফসকে বলল,
“ক্লাস করেন না ভালো কথা। বিষয়ের নামও জানেন না। ৩য় বর্ষের কিন্তু ছ’মাস পার হয়েছে। সামনে নির্বাচনী পরিক্ষা। আর এখন আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করছেন এগুলো কি? কোন বিষয়? ভারী অদ্ভুত তো!”

“এজন্যই তো তোমার কাছে আসলাম।”

“মানে!”

অত্র চারদিকে একবার নজর বুলাল। অনেকেই আঁড়চোখে তাকে দেখছে। আবার কেউ মুখ টিপে হাসছে। এসব কিছুর তোয়াক্কা সে করল না। দু’ঠোঁট ফাঁক করে চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে আলতো করে হাসল। নরম আর ক্ষীণ সুরে বলল,

“এতদিন ধরে ক্লাস ঠিক করে করা হয়নি। কারণ, আমি একজন খেলোয়াড়। আমাদের ক্রিকেট টিম আছে। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে খেলতে হয় আমাকে। তাই এখনো বই ধরা হয়নি। তাই তোমার কাছে সাহায্যের জন্য এসেছি। আমাকে মানা কর না, প্লিজ।”

চাঁদনী অবাক হল না। পড়াশোনা যে করে না, তা ভালোই জানে। তাই সাহায্যে কি চাইতে পারে তা কিছুটা হলেও অনুধাবন করল। নিজের দৃষ্টি তখনও খাতার দিকে নিবদ্ধ। শীতল কন্ঠে বলল,

“আমি কিভাবে সাহায্যে করতে পারি।”

“আমার অ্যাসাইনমেন্টগুলো করে দিবে।”

চাঁদনী তিরিক্ষি মেজাজে তাকাল। গলার স্বর দৃঢ় করে বলল, কিন্তু আমি কেন?

“আসলে তোমার থেকে উত্তম কাউকে পায়নি। প্লিজ, করে দাওনা মুনলাইট।”

“আমি আবারও বলছি, ডোন্ট কল মি মুনলাইট জাষ্ট চাঁদনী। রিমেম্বার। যান আপনার খাতা নিয়ে আসুন। অ্যাসাইনমেন্ট করে দিব।”

অত্র তড়িৎ উঠে দাঁড়াল। নিজের পা’ দ্রুত কদমে বাড়াল সামনের দিকে। কিন্তু কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে আসল। চাঁদনীর মুখোমুখি দাঁড়াল। নিজের মাথা সামনের দিকে বাড়িয়ে ধীরগলায় বলল,
“ধন্যবাদ মুনলাইট।”
দু’শব্দের কথা বলেই আর দাঁড়াল না। তড়িঘড়ি বের হয়ে গেল লাইব্রেরী থেকে।

চাঁদনী পুরো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। মেজাজ আবারও তিরিক্ষি হল। এমনিতেই সে বেশি কথা বলা পছন্দ করে না। সবসময় নির্জনে নিজের কাজ করে। কিন্তু হুট করে এই উল্কাপিণ্ড কোত্থেকে উদয় হল। তার মুডটাই নষ্ট হয়ে গেল। নিজের হাতঘড়িতে সময় দেখল ক্লাস শুরু হতে আর দশমিনিট। নিজের বই খাতা গোছাল। ক্লাসের উদ্দেশ্য পা’ বাড়ানোর আগে সবার দিকে দৃষ্টি বুলালো। অনেকেই কেমন উৎসুক দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। কারো মুখে আবার বিদ্রুপের হাসি। নত মস্তকে বেরিয়ে পড়ল সে।
_

ক্লাসে এসে দ্বিতীয় সারির চার নাম্বার বেঞ্চিতে বসল চাঁদনী। লাইব্রেরী থেকে ফিরতে দেরি হয়েছে। তাই সামনের বেঞ্চিতে বসার সুযোগ হল না তার। বসার দু’মিনিট পরে কেউ একজন তার পাশের বেঞ্চিতে বসল। আকস্মিক বসা ব্যক্তিকে দেখে ভীমড়ি খেল। অত্র তার পাশের বেঞ্চিতে বসেছে। হতবিহ্বল হল। শেষ এক ‘বছরে খুব একটা ক্লাস করতে দেখা যায়নি অত্রকে। আর ক্লাস করলেও একদম সামনের বেঞ্চিতে বসত। পড়াশোনায় অমনোযোগী হলেও স্যারদের ভীষণ প্রিয় ছাত্র। তার প্রধান কারণ অত্রের মিষ্টি আলাপন। খুব সহজেই স্যারদের সাথে মিশে যেত। খেলাধুলায় ভালো হওয়ায় স্যারদের বিশেষ নজরেও থাকত। তার উপর গানের গলা ভীষণ সুন্দর। খেলাধুলা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অত্র একাই অনেকগুলো পুরস্কার নিজের করে নেয়। হয়তো এজন্য স্যারদের প্রিয়র খাতায় তার নাম সবার উপরে। কিন্তু এর মত ছেলের তার সাহায্যের দরকার কেন হল! বোধগম্য হল না তার।

পাশের বেঞ্চি থেকে আচমকাই অত্রের হিসহিস করার শব্দ এল। চকিতে মুখ ঘুরাল চাঁদনী। তীক্ষ্ণদৃষ্টি পড়ল তার দিকে। ইশারায় বলল,
“কি ব্যাপার!”

অত্রের মুখে প্রাণবন্ত এক মিষ্টি হাসি। হাসলে ডানপাশে ঢোল পড়ে। ছেলে হয়েও তার হাসি অসম্ভব সুন্দর। কয়েক মূহুর্তের জন্য থমকাল চাঁদনী। মনের কোণে কিঞ্চিৎ ঈর্ষার জন্ম নিল। এজন্য বুঝি তার দিকে সবার সুনজর থাকে। দ্রুতই নিজের দৃষ্টি সংযত করল। অপাশ থেকে অত্র ফিসফিস করল, আমার খাতা।

চাঁদনীর মুখশ্রী বিরক্তিতে ছেয়ে গেল। তবু নেহাৎ ভদ্রতার খাতিরে বলল, হুমম দিন। অত্র নিজের খাতা এগিয়ে দিল। কেউ দেখার আগে তড়িঘড়ি নিজের ব্যাগে ঢুকাল। পাশে বসা রেবেকার অবাক দৃষ্টি পড়ল তার দিকে। ইশারায় জিজ্ঞেস করল,

“অত্রের সাথে কি নিয়ে কথা বলছিলে? আর সে তোমাকে কিসের খাতা দিল?”

চাঁদনী নিশব্দে নিশ্বাস ছাড়ল। কিঞ্চিৎ হতাশার সুর টেনে বলল, অ্যাসাইনমেন্ট করানোর জন্য।

“কিন্তু, সে তোমার কাছে কেন? তার বন্ধু-বান্ধবের অভাব আছে না’কি?”

“সে’তো আমিও ভাবছি? এত মানুষ থাকতে আমি কেন? উত্তরে কি বলল জানো, আমার থেকে ব্যাটার কাউকে পাইনি। তাই!”

“কে জানে? তবে সাবধানে থেকো?”
_

বাড়ির সদর দরজায় পা রাখতেই কারো ছোট্ট দু’হাত পিছন থেকে চাঁদনীকে জড়িয়ে ধরল। না তাকিয়ে বুঝল কে হতে পারে। সেও দু’হাত বাড়িয়ে কোলে নিল। তার কোলে এসে খিলখিল করে হেসে উঠল পাঁচ বছরের টিয়াশা। ব্যাগ হাতড়ে একটা মিনি চকলেট সে হাতে ধরিয়ে দিল। হঠাৎ ঘর থেকে তার বড় বোনের গলার স্বর ভেসে এল। টিয়াশা কোথায়’রে। বোনের জবাবে উত্তর দিল, আপু’ টিয়াশা আমার কোলেই আছে। চিন্তা করিস না। চৈতালি আশ্বস্ত হতেই তার উদ্দেশ্য বলে উঠল, তুই কখন এলি? চাঁদনী টিয়াশার সাথেই মজা মাস্তিতে ব্যস্ত। কিন্তু বোনের উত্তরে বলল, মাত্র এলাম। জলদি খাবার দে’তো। চৈতালি বোনের কথা শুনে বিজলীর মত জ্বলে উঠল। জবাবে কিছু কঠিন কথা শুনাল,
“জলদি বাথরুমে যা। হাত-মুখ সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে আয়। তারপর খাবার দিচ্ছি।”

চাঁদনী মুখ কুঁচকালো। এটা বোন নাকি পুলিশ! সারাক্ষণ আদেশ আর নিষেধ। এটা করা যাবে না, সেটা করা যাবে না। উফফ! টিয়াশাকে রেখে সে ওয়াশরুমে গেল। ফ্রেশ হয়ে আসতেই তার বোন খাবার টেবিলে রাখল। নিজের খাবার খেয়ে রুমে ফিরে আসল আবার। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তবে অত্রের অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে বসবে। মনের মাঝে সুপ্ত রাগ ভেসে উঠল। তখন না বলা উচিৎ ছিল তার। শুধু শুধু বাড়তি ঝামেলা। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করল। কিন্তু মুঠোফোন বের করতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। অপরিচিত এক নাম্বার থেকে আটাশ মিসডকল। সাইলেন্ট করা ছিল বলে ফোনকলের কোন শব্দ হয়নি। কিন্তু কলকারী কে হতে পারে? মস্তিষ্কের কোথাও এর উত্তর খুঁজে পেল না। তবে ভাবনার দুয়ার ভেঙে একই নাম্বার থেকে পুনরায় কল আসল। রিসিভ করতেই চমকে উঠল সে। গলার স্বর তার অজানা। ধীর গলায় বলল,

“কে আপনি?”

চলবে,,,,

#শরতের_শিশির
#সূচনা_পর্ব
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)

নতুন গল্প নিয়ে আসলাম। জানি না কেমন হয়ছে। ভালো লাগলে অবশ্যই রেসপন্স করবেন। ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here