#শরতের_শিশির ( ২ )
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)
বিমূঢ়তায় আচ্ছন্ন চাঁদনী। ফের জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কে? সত্যি করে বলুন। নয়ত দ্বিতীয়বার কথা বলার সুযোগ পাবেন না কিন্তু।’
ওপাশ থেকে ক্ষীণ হাসির শব্দ হল। আবারও বলল, ‘তুমি এখনও আমাকে চিনতে পারনি মুনলাইট।’
চাঁদনীর ধ্যান ভাঙল। তড়িৎ বুঝে নিল এই মহান ব্যক্তি কে হতে পারে। তাই রুক্ষভাষায় জবাব দিল, ‘নাম্বার কোথায় পেলেন। আমি তো আপনাকে নাম্বার দেয়নি।’
অত্র অবাক হল না। জানত এমন কথায় শুনতে হবে। তাই প্রস্তুত ছিল আগে থেকেই। নিজের হাসি চেপে রগড় গলায় বলল,
“ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। আর এটা তো জাষ্ট একটা নাম্বার মাত্র। তাই খুব সহজেই পেয়ে গেলাম। তবে আমি তোমার উপর ভীষণ রুষ্ট। আমরা একই ইয়ারে পড়ি। কিন্তু তুমি আমাকে সিনিয়রের মত আপনি আপনি কেন ডাকো। একদম পছন্দ নয় তোমার মুখে আপনি ডাক। এবার থেকে তুমি করে ডাকবে।”
চাঁদনীর মেজাজ চটে গেল। তিরিক্ষি গলায় বলল, ‘কথা বলা শেষ। আর কিছু বলার আছে। অপ্রয়োজনীয় কথা বলার একদম সময় নেই আমার হাতে।’
অত্র কিয়ৎক্ষন ভাবল। জবাব দিতে প্রস্তুত হল মাত্র। আচমকাই চাঁদনী কল কেটে দিল। তারপর নাম্বারটাই সাইলেন্ট লিষ্টে ফেলল। যাতে কল আসলেও কোনো শব্দ না হয়। ফোনটা বালিশের নিচে চাপা দিয়ে রাখল আপাতত। নিজের মেজাজ’টা শান্ত করতে হবে। অ্যাসাইনমেন্ট করার থাকলেও করল না। নিজের হুঁশে ফিরল। সে কেন অন্যের অ্যাসাইনমেন্ট করবে? তার কিসের ঠেকা পড়ছে। সে এত বোকা হল কিভাবে? তড়িৎ বালিশের নিচ থেকে মুঠোফোন বের করল। স্ক্রিনে তাকাতে তার চক্ষু চড়কগাছ। ছেলেটার কল স্ক্রিনে উঠানামা করছে। দ্রুতই কল রিসিভ করে নিল। ঝাঁঝালো স্বরে বলে উঠল,
“তোমার অ্যাসাইনমেন্ট করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কাল কলেজ আসলে তোমার খাতা নিয়ে যাবে। আর হ্যাঁ, নেক্সটাইম আমাকে কল দিয়ে ডিষ্টার্ব করবে না।”
কথাগুলো বলেই কলটা কেটে দিল। আচমকাই মেজাজটা চটে গেল। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই এখন। অত্রের দেয়া খাতাগুলো নিজের ব্যাগে আবার ঢুকানোর প্রস্তুতি নিল। কিন্তু হঠাৎ করে খাতার মাঝ থেকে একটা রঙিন কাগজ বেরিয়ে এল। কাগজটা উঠাতে গিয়ে কিছু একটা দেখে থমকাল। কাগজের এককোণে তার নাম লিখা। চমকাল বেশ। তার নাম কাগজের এককোণে। কিন্তু কেনো! তড়িৎ কাগজ’টা মেলে ধরল। যা দেখল, তাতেই চক্ষু কোটর থেকে বের হবার উপক্রম। বিশ্বাসই হচ্ছিল না তার। পড়তেই গিয়ে কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল তার। তবু পড়তে লাগল। বক্ষস্থলে টিপ টিপ শব্দ ক্রমাগত বাড়ছে। শুকনো ঢোক গিলল বারবার। চেপে রাখা রাগ সরে গিয়ে লজ্জ্বা’রা হানা দিল।
প্রিয় থেকেও প্রিয়,
আমার হৃদ গগনের ‘চন্দ্র’। জানো তোমার ঐ হাসিতে ঘায়েল হয়েছি বহুবার। মুগ্ধ হয়েছি তোমার স্নিগ্ধতায়। ডুবেছি তোমার কাজল কালো চোখের মায়ায়। আজকাল কেমন পাগল পাগল লাগে। নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি তোমার অতল গহ্বরে। এক পলক দেখার জন্য কতবার কলেজ ছুটে যায়। হয়ত ভাবছো, পাগলের প্রলাপ বকছি। তুমি কি ইন্দ্রজাল জানো? তবে কেন এত উতলা হই বারে বার। কেন এত মিষ্টি করে হাসো? তোমার ঐ সরু পাতলা ওষ্ঠদ্বয়ের মিষ্টি হাসি অন্যের জন্য নিষিদ্ধ। আমার নামে লিখিত হবে শুধু। আর কারো সামনে হাসবে না শুধু আমার জন্য হোক ‘প্রিয়’। অ্যাসাইনমেন্ট সে’তো শুধু একটা বাহানা মাত্র। আসল কাজ তো তোমার সাথে কথা বলা। চোখের ফ্রেমে তোমাকে বন্ধি করা। মনের ক্যামেরায় তোমার অজস্র ছবি তোলা। তোমার ঐ মনের সিন্ধু অববাহিকা আমার নামে বয়ে যাক। তোমার ভোর হোক আমার নামে, রজনীর আঁধারও নামুক আমার নামে। মাঝে মাঝে খুব করে চাই। বুকের বা’ পাশের শূন্য জায়গায় তোমার নিশ্বাসের ধ্বনি হোক। প্রিয়, ভালোবাসি বড্ড বেশি তোমায়। আমাকে যদি ফিরিয়ে দাও তবে বার বার ফিরে আসব কিন্তু। তবু তোমাকে ছাড়ছি না। একটা বার বলবে আমাকে ‘ভালোবাসি? আর যদি জবাব না দাও, তোমার মিষ্টি হাসিটাই উপহার দিও অনন্ত। তাতেই আমি নিজের উষ্ণতা খুঁজে নিব। নিজের চন্দ্রের উপহার স্বরূপ রেখে দিব বক্ষপিঞ্জরে।
ইতি
হৃদয় হারানো তোমার
পথভ্রষ্ট পুরুষ।
তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে চাঁদনী। বক্ষস্থল জুড়ে ঢিপঢিপ শব্দ তুলছে ভীষণ। সমস্ত কায়া বিন্দু বিন্দু ঘামে অর্ধ ভেজা প্রায়। এরকম অপ্রত্যাশিত কিছু পাবে কস্মিনকালেও ভাবেনি। তার কেমন হাসফাস লাগছে। ফোৎ ফোৎ করে ঘন ঘন নিশ্বাস ছাড়ল। এখনো অবিশ্বাস্য নজরে চিরকুটের দিকে তাকানো। যার পড়াশোনার বালাই নেই, অমনোযোগী, দিনের পর দিন ক্লাসে অনুপস্থিত। সে কিভাবে মনের মাধুরী মিশিয়ে চিরকুট লিখতে পারে। তার তো ভাবতেই গা’ শিউরে উঠছে। ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে পড়ল বিছানায়। হাতের মাঝে চিরকুট’টা এখনো মেলে ধরা। আকস্মিক চৈতালীর গলার স্বর ভেসে এল।
“চাঁদনী, এইদিকে আয় তো। মা’ ফোন দিয়েছে তোর সাথে কথা বলবে।”
বোনের গলার স্বরে নিজের ভাবনার দুয়ার বন্ধ করল। তড়িঘড়ি চিরকুটখানা ব্যাগের ভিতরে গুঁজে নিল। দ্রুতই নিজের রুম ছেড়ে বের হল। চৈতালী বোনকে দেখে হাতের মুঠোফোন এগিয়ে দিল। সে কানের কাছে ধরতেই ওপাশ থেকে একটা গম্ভীর নরম স্বর ভেসে এল।
“চাঁদনী, তুই বাড়ি আসবি কবে? তোর নানুর অসুখ আবার বাড়ছে। আমি তোর নানুরে দেখতে যাইতাম। তুই আসলে চিশতিয়াকে আমার সাথে নিয়ে যামু।”
“কিন্তু, মা’ আমি এখন বাড়ি কেমনে যাব। দু’দিন পর কলেজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বাড়ি গেলে আসতে যাইতে তো দেরি হয়ে যাবে। একদিনের জন্য হলে যেতে পারি। তবে বেশিদিন হলে যেতে পারব না।”
চাঁদনীর মায়ের মুখে চিন্তার ছাপ। বেশ ভেবেচিন্তে বললেন, ঠিক আছে আমি কালকে যামু। তুই পরশু বাড়ি আয়। অগত্যা মায়ের কথায় সায় জানাল সে। গ্রামের বাড়ি থেকে তার কলেজ বেশিদূর। তার উপর বাড়তি ভাড়া। তাই বড় বোনের বাসায় থাকে। এখান থেকেই ক্লাস করে। তবে প্রতি মাসে বাড়ি যেতে হয়। মায়ের না’কি ঘুম আসে না তার মুখ না দেখলে। তার ছোট বোন চিশতিয়াও তার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকে। কখন বাড়ি ফিরবে সে?
_
ক্লাসে আসতেই অত্রের দিকে খাতাগুলো একপ্রকার ছুঁড়েই মারল। চাঁদনীর এহেন আচরণ অত্রের বেশ আত্মসম্মানে লাগল। কিছু কটুবাক্য শুনাতে দু’ঠোঁট ফাঁক করল। কিন্তু তার আগে চাঁদনী দৃঢ়কণ্ঠে বলে উঠল,
‘নিজের কাজ নিজেই কর। আমি পারব না করতে। আর হ্যাঁ’ নেক্সটাইম এসব ভুজুংভাজুং আমার সাথে করতে আসবে না। কি ভাব নিজেকে? নায়ক সালমান খান। দ্বিতীয়বার আমাকে ডিষ্টার্ব করতে আসবে না। এর ফলাফল কিন্তু ভালো হবে না কিন্তু।’
কথাগুলো বলেই নিজের বেঞ্চের দিকে দ্রুতই ছুটল সে।
পুরাই হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে আছে অত্র। অক্ষিযুগল যেন অবাকের শিখরে। সে এমন’টা আশা করেনি চাঁদনীর থেকে। ভেবেছিল হয়ত কিঞ্চিৎ তার প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করবে বা একটু রাগ দেখাবে। কিন্তু এভাবে অপমান করবে এটা তার ভাবনার অতীত। ভারাক্রান্ত মনে চাঁদনীর পাশাপাশি একটা বেঞ্চিতে বসল। যদিও চাঁদনীর দূরত্ব তার থেকে বেশিই। চাঁদনী চার নাম্বার সারির তিন নাম্বার টেবিলের অপর প্রান্তে বসেছে। তার ব্যাকসাইড’টাই শুধু দেখছে সে। তবুও কিছুটা তার মনে প্রশান্তি। আজকে শুধু চাঁদনীর মুখে হ্যাঁ’ শুনতেই এসেছিল। কিন্তু হল তার উল্টো। মেয়েটা তার উপর ক্ষেপে আছে। এখন কিভাবে তাকে শান্ত করা যায়। সে উপায় ভাবছে। নিজমনে অজস্র সমাধান খুঁজল। কিন্তু উপায় পেল না।
ক্লাস চলাকালীন স্যারদের অফিসরুমে ডাক পড়ল, যারা ছাব্বিশে মার্চের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে শুধুমাত্র তাদেরকে। তার মধ্যে চাঁদনী আর অত্র দু’জনেরই নাম রয়েছে। অত্র এই সুযোগ কাজে লাগাল। সবার সাথে সেও বের হল। তবে চাঁদনীর পাশাপাশি হাঁটছে। কিছু একটা বলতে চাইছে। কিন্তু কথাগুলো বলতে গিয়েও তার মুখ থেকে বের হল না। নিশব্দে আফসোসের সুর তুলল।
_
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য অটোরিয়াম জুড়ে কৃত্রিম আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হল। স্যারদের একপাশে বসার ব্যবস্থা করা হল। অন্যপাশে ছাত্র-ছাত্রীদের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে খালি রাখা হল। অত্র লোক সংগীত, নজরুল সংগীত, রবীন্দ্র সংগীত, দেশের গান সবগুলোতে অংশ গ্রহণ করল। তার মধ্যে তিনটাতেই প্রথম আর একটাতে দ্বিতীয় হল। সংগীত পরিবেশন শেষ হলে শুরু হল অন্য প্রতিযোগিতা। চাঁদনী অংশগ্রহণ করল উপস্থিত বক্তৃতা, কবিতা আবৃত্তি, একক অভিনয়, যেখানে সে একজন টিচার হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। গানের গলা তার অত ভাল নয়। নয়ত গানেও তার নাম থাকত। অনুষ্ঠানের শেষে কবিতা আবৃত্তিতে প্রথম, উপস্থিত বক্তৃতায় দ্বিতীয় আর একক অভিনয়ে দ্বিতীয়।
অনুষ্ঠান শেষ হতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। চাঁদনী হাতঘড়িতে সময় দেখল বিকেল তিনটা দশ। দ্রুতই অটোরিয়াম থেকে বের হল। তাকে বাড়ি যেতে হবে। তৃতীয় তলার অটোরিয়াম রুম ছেড়ে যখন সে দ্বিতীয় তলার সিঁড়িতে পা রাখল। আচমকাই পিছন থেকে একটা মিষ্টি বাক্যে ভেসে এল। চকিতে মুখ ঘুরে তাকাতে দেখল তার সহপাঠী আনিশা দাঁড়িয়ে আছে। তড়িৎ জিজ্ঞেস করল, কেন ডাকলে। আনিশা কিঞ্চিৎ হেসে তার সামনে এসে দাঁড়াল। জবাবে বলল, এত তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছো। অনুষ্ঠান তো এখনো শেষ হয়নি।
চাঁদনী আফসোসের সুর তুলল। নিশব্দে নিশ্বাস ছাড়ল। প্রতিত্তোরে বলল, গ্রামের বাড়ি যাব। তাই তড়িঘড়ি করছি। বাড়ি যেতেও এক ঘন্টা সময় লাগবে। তাই এখনই রওনা দিতে হবে। কিন্তু তুমি বের হয়ে এলে কেন?
আশা নিজেও হতাশার সুর তুলে বলল, আর বল না শরীর ভালো না। গায়ে জ্বর তাই বেরিয়ে যাচ্ছি। চাঁদনী ছোট্ট করে বলল, অহহ।
বাড়ি পৌঁছাতেই প্রায় ঘন্টা দেড়েক লাগল। চাঁদনী বাড়ি ফিরেই দেখল সবকিছু কেমন এলোমেলো। তার মা’ বোন নেই। পুরো বাড়ি খালি। তার বাবা দোকানে। ফিরতে রাত হবে। সে ঘরের কাজ ধরার আগে নিজের মুঠোফোন’টা বের করল। কিন্তু স্ক্রিনে কলের পাহাড় দেখে ভিমড়ি খেল। ১২৮ কল আর ১০ টা ক্ষুদে বার্তা। তার মাথা ঘুরাল। বাপরে! এই ছেলের এত ধৈর্য্য কেমনে সম্ভব। আর কিছু ভাবল না। দ্রুতই নাম্বার’টা ব্লক করল। এবার শান্তিতে ঘুমাবে।
_
রাত প্রায় আট’টা। অচেনা এক নাম্বার থেকে কল আসায় তার মুঠোফোন বিকট শব্দ তুলল। সে তখন তার বাবার সাথে মাত্রই খাবার খেতে বসল। তার বাবা বলে উঠল, চাঁদনী কে কল দিল। তোর আম্মা কি’না দেখত। সে এত কিছু না ভেবেই কল রিসিভ করল। কিন্তু আবারও তব্দা খেয়ে গেল।
চলবে,,,