#মেঘের_শহর
#পর্ব_২৩
Saji Afroz
.
আজ মেঘ কি বললো? তার জন্য অন্য এক মেয়ে কে কষ্ট পেতে হয়েছে। কিন্তু কেনো! সে ইচ্ছে করে অন্য এক বাড়িতে প্রবেশ করেছিল ঠিকই। তার এই কাজের জন্য অন্য কোনো মেয়ে কষ্ট পাবে কেনো?
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে ঘোর কাটলো তার। দরজা খুলে শহর কে দেখতে পেল সে। ভেতরে আসতে বললে শহর আসলো। সে বাইরে যাবে জানালো। হুরায়রা যেতে চাইলে শহর জানায়, সে একাই যেতে চায়। একা একা ঘোরার মাঝেও আলাদা একটা আনন্দ আছে। হুরায়রা মুচকি হেসে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলল। আর তাকে না জানিয়ে নিজের শহরে যেন ফিরে না যায়, এটাও বলল।
শহর আর দাঁড়ালো না। দ্রুত সে হাঁটতে শুরু করলো।
.
.
.
জিকো টাকা পাঠিয়ে সবেমাত্র বাসায় এল। বোনের মেসেজও এসেছে-
ভাইয়া টাকা পেয়েছি।
.
যা দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো সে। ফ্রেশ হবার জন্য উঠতেই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মোখলেস কে দেখলো সে। বাইরে থেকে এসে দরজা বন্ধ করা হয়নি তার। তাই মোখলেস কখন এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি জিকো।
মোখলেস কে দেখে বলল-
আপনি?
-মায়ের কাছে শুনলাম তুমি আজ বাসায় এসেছিলে।
-আসলে…
-আমি সবটা জানি। দুঃখিত আমার ফোনে সমস্যা ছিল।
-ওহ!
.
একটু থেমে মোখলেস বলল-
এভাবে আর কতদিন চলবে? তোমার পুরো পরিবারের দায়িত্ব আমি নিতে চাই। জিকো আমার বন্ধু। তোমার সাথে বিয়েটা হলে আমাদের সম্পর্ক আরো মজবুত হবে। তুমি সেটা চাওনা?
.
জিকো কে নীরব দেখে মোখলেস বলল-
আমার মা সব জেনেও আমার খুশির জন্য রাজি হয়েছে। কিন্তু তিনি আমায় বিয়ের জন্য তাড়া দিচ্ছেন। আমার হাতে বেশি সময় নেই জেসিকা। মা আমাকে অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে বলার আগেই তোমার কাছে জবাব চাই আমি। আমি মায়ের অবাধ্য হতে পারিনা। বিয়ে তো করতেই হবে। কিন্তু আমি চাই মেয়েটি তুমি হও। তুমি ঠান্ডা মাথায় ভেবে তোমার সিদ্ধান্ত আমায় জানিয়ে দিও।
.
.
.
চটপটি খাওয়ার জন্য বের হয়েছে সাইয়ারা। পথিমধ্যে তার সাথে দেখা হলো শহরের। শহর কে দেখে চিনতে ভুল হলো না তার। একপ্রকার ছুটেই তার পাশে এসে বলল-
আপনি হুরায়রার বয়ফ্রেন্ড না?
.
সাইয়ারার প্রশ্ন শুনে না হেসে পারলো না শহর। তাকে হাসতে দেখে সাইয়ারা ভ্রু কুচকে বলল-
হাসার মতো প্রশ্ন করলাম?
-অবশ্যই। কারণ আমি ওর বয়ফ্রেন্ড না জাস্ট ফ্রেন্ড।
-ওহ! যাক আপনাকে পেয়েছি ভালোই হলো। যেহেতু আপনি হারায়রার বন্ধু আপনিই ওকে বোঝাতে পারেন।
-কি?
-মেঘ তাকে অনেক ভালোবাসে।
-তাই?
.
সাইয়ারা শুরু থেকে সবটা খুলে বলল শহর কে। শহর সব শুনে বলল-
হুরায়রা রাজি না হলে আপনার সবচেয়ে বেশি খুশি হবার কথা।
-আমার। কেনো?
– মনে হলো।
.
সাইয়ারা চুল ঠিক করতে করতে এদিক ওদিক তাকালো। শহর কিছু বুঝেছে কি না ভাবলো। শহর বলল-
কতটা ভালোবাসলে প্রিয় মানুষটির সুখের কথা ভেবে নিজের খুশি বিসর্জন দেওয়া যায়, আপনাকে না দেখলে বুঝতামই না।
.
এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলো না সাইয়ারা। চোখ জোড়া ছলছল করে উঠল তার। ভিজে গলায় বলল-
এতদিন মেঘ যেটা বুঝতে পারেনি আপনি প্রথম দেখাতেই বুঝে ফেললেন। আমার আপনার প্রেমে পড়ার দরকার ছিল।
.
শহর হেসে বলল-
তাহলে আরো কষ্ট পেতেন। শহর কারো প্রেমে পড়ে না। তবে হুরায়রা…
-কি?
-তাকে আমি সবটা বলব মেঘের ব্যাপারে। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।
.
.
.
মোখলেস বাড়িতে প্রবেশ করতেই শাপলা তার জন্য তড়িঘড়ি করে চা বানিয়ে আনলো। শাপলা বেরুতে চাইলে তাকে আটকালো মোখলেস। সে চা খেতে খেতে বলল-
জেসিকা কে দেখেছ আজ?
-হ্যাঁ।
-কেমন লাগলো?
-ভালোই?
-শুধুই ভালো? মা কিছু বলেনি তোমাকে?
-বলেছে। আপনি তাকে পছন্দ করেন।
-তাহলে ওর সম্পর্কে আমার সামনে তোমার একটু প্রশংসা করা দরকার নয় কি?
.
হাসলো শাপলা। মোখলেস বলল-
শুনেছি তুমি ওর সাথে দেখা করোনি। আড়াল থেকেই দেখেছ। কারণ টা জানতে পারি?
-এই খবরও পেয়ে গেলেন!
-এমন টা করার কারণ?
-বাইরের মানুষের সামনে যাওয়ার অভ্যেস আমার নেই।
-ওহ!
.
মোখলেস আর কথা বাড়ালো না। শাপলার এমন কান্ডে সে একটু অবাকই হলো। তার পছন্দের মেয়েটির সামনে এসে দুটো কথা কি সে বলতে পারতো না! নাস্তা বানিয়ে ছোট বোনের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়েছে। এতবার বলার পরেও সামনে যায়নি সে। রান্নাঘরে পিড়ির উপরে বসে ছিল। এতে করে বাড়ির সবাই অবাক হয়।
শাপলার এমন ব্যবহারের কারণ কি হতে পারে?
মুহুর্তের মাঝেই এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো মোখলেস। আপাতত তার জেসিকা কে নিয়ে ভাবা উচিত। শেষ পর্যন্ত জেসিকা কি রাজি হবে তার প্রস্তাবে?
.
.
.
চিলেকোঠায় ফিরে এল শহর। বিছানার উপরে হুরায়রা বসে বসে বই পড়ছে। জানালা টা খোলা। তাই বাতাস এসে হুরায়রার চুল স্পর্শ করার কারণে তার চুলগুলো উড়ছে। বই এর মাঝে সে এতটায় ডুবে ছিল যে, শহর এসে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করেনি।
শহর তার নাম ধরে ডাকতেই উঠে দাঁড়ালো সে। বলল-
আপনি এসেছেন কি না দেখতে এলাম। আপনাকে না পেয়ে বই পড়তে শুরু করলাম।
-ও আচ্ছা। বসুন না।
.
হুরায়রা বসলো। তার ঠিক সামনে চেয়ার টেনে বসতে বসতে শহর বলল-
আপনি মেঘ কে ভালোবাসেন না?
.
হুট করে শহরের মুখে এমন একটা প্রশ্ন শুনবে ভাবতে পারেনি সে। মেঘের নাম শুনতেই তার মুখ থেকে হাসি গায়েব হয়ে গেল। আমতাআমতা করে বলল-
হঠাৎ এই প্রশ্ন?
-জবাবের বদলে প্রশ্ন?
.
নিশ্চুপ হুরায়রা কে দেখে শহর আবারো বলল-
.
-আজ আমার একজনের সাথে দেখা হয়েছে, যার কাছে অনেক কিছু জানতে পারলাম।
-কে? আর কিইবা জানলেন?
.
শহর তাকে সবটা বলল। যা শুনে হুরায়রার চোখে পানি চলে এল। তার একটা ভুলের জন্য এতকিছু হয়ে গেল! সে ভেবেছিল মেঘের কাছ থেকে কিছুদিন দূরে থাকলে সে হয়তোবা তাকে ভুলে যাবে, মোহ টা কেটে যাবে। কিন্তু এ কি হয়ে গেল!
অন্য কোনো মেয়েকে হুরায়রা ভেবে কত স্বপ্নই না দেখেছিল সে। কিন্তু শেষ মুহুর্তে এসে তার স্বপ্ন ভেঙে যায়। শুধু মেঘ নয়, ওই মেয়েটিও কষ্ট পায়।
.
হুরায়রার চোখে পানি দেখে শহর বলল-
আমি জানি আপনি এটা ইচ্ছে করে করেন নি। পুরোটায় একটা কাকতালীয় ঘটনা। কিন্তু আপনি মেঘের কাছ থেকে কেনো নিজেকে আড়াল করছেন? সে তো আপনাকে অনেক বেশিই ভালোবাসে। আর আপনার চোখ বলছে, আপনিও তাকে ভালোবাসেন। তবে কেনো এই দুরত্ব?
.
এবার হুরায়রা নিজেকে আর সামলাতে পারলো না। তার চোখ বেয়ে অনবরত পানি পড়তে থাকলো। শহর পানির গ্লাস টা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল-
শান্ত হোন।
.
ঢকঢক করে পুরো এক গ্লাস পানি খেয়ে হুরায়রা এক লম্বা দম ফেললো। এরপর ওড়না দিয়ে চোখের পানি মুছে নিয়ে বলল-
আমার পক্ষে কাউকে ভালোবাসা সম্ভব নয়।
-আপনি আমার মতো ছন্নছাড়া তো নন। তবে?
.
মুখে এক রহস্যের হাসি ফুটিয়ে হুরায়রা বলল-
আমি কোনো মানুষ কে ভালোবাসতে পারব না।
.
তার কথা শুনে শহর অবাক হলো না। বরং সে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল-
ভালো তো আপনি বেসেই ফেলেছেন।
.
.
.
অস্থিরতার সাথে দিন কাটছে জিকোর। বোনের মেসেজ এসেছে। তার বাবার কিছু টেস্ট করাতে হবে। যেসবের জন্য আরো টাকার প্রয়োজন হতে পারে। যদি জিকো টাকা দিতে পারে তবেই টেস্ট করানোর ব্যবস্থা করা হবে। নতুবা বাসায় ফিরে যাবে তারা।
জিকোর স্পষ্ট মনে আছে। ছোটবেলায় সে একটু কাশলেও মা বাবা কতটা অস্থির হয়ে পড়তো! বাবা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেত আর মা সারারাত মাথার কাছে বসে থাকতো। তাদের সেই ছেলে কি না শহরে এসে বদলে গেল! টাকা পাঠাতো ঠিকই কিন্তু যোগাযোগ করতো না। সময় ছিল কোথায়? কাজের পরেই মাতাল হয়ে পড়ে থাকতো। কিন্তু আজ যখন বাবার শরীর খারাপ শুনেছে, ইচ্ছে করছে ছুটে চলে যেতে সেখানে। ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে তাকে। আফসোস হচ্ছে, কেনো সে এভাবে টাকা উড়িয়েছে! এখন কি মদ খাওয়া ছাড়া দিন সে পার করছে না? টাকা নষ্ট না করলে আজ বাবার চিকিৎসা টা অন্তত করতে পারতো।
মেঝেতে বসে পড়লো জিকো। কান্নায় ভেঙে পড়লো সে। তার সার্টিফিকেটও অকেজো এখন। যার কারণে ভালো চাকরি সে কোনোকালেই পাবে না। এই মুহুর্তে তার কি করা উচিত? মোখলেস কে বিয়েটা করে নেওয়া উচিত? যাতে করে নিজের ভরণপোষণ এর দায়িত্ব মোখলেসের ঘাড়ে চাপিয়ে সে তার ছোট চাকরিটার মাধ্যমে বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারে?
এটা করলে কি খুব বেশি অন্যায় হয়ে যাবে?
জিকো একবার ভাবলো মোখলেস কে সে সব জানাবে। কিন্তু পরমুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদলালো সে। সব জেনে মোখলেস কিছুতেই রাজি হবে না। আর যদি রেগে গিয়ে এই চাকরিটা থেকেও…
না, না আর ভাবতে পারছে না জিকো। চোখ মুছে সিদ্ধান্ত নিলো সে, বিয়েটা করবে। তার জন্য জিকো কে মরতে হবে। জিকোর পরিবার সত্যিটা জানলেও মোখলেস জানবে না। মোখলেস জানবে জিকোর মৃত্যু হয়েছে। যার কারণে জেসিকার পরিবার এখন অসহায়। আর এই অসহায় পরিবারের পাশে থাকবে মোখলেস!
.
.
.
নিজের সবটা শহর কে খুলে বলল হুরায়রা। শহর সব শুনে বলল-
আমার মনেহয় মেঘ কেও আপনার সত্যি টা জানানো দরকার। সব জেনে সে যদি রাজি হয় তো…
-আমি ওর জীবনের অভিশাপ হতে চাই না।
-কিন্তু কষ্ট তো দিচ্ছেন। নিজেও পাচ্ছেন। তার চেয়ে সত্যি টা জানানোই উত্তম নয় কি?
.
হারায়রা কিছুক্ষণ ভেবে বলল-
আমি মেঘের কাছে যাব সত্যি টা জানাতে। এবং তা কালই।
.
চলবে