#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৩৯)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(৯৭)
অনেকসময় ধরে গাড়িতে বসে থাকায় হুমায়রা বিরক্তির স্বরে বললো…
—“এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন পুুরুষ আমি আর ২য় কাওকে দেখি নি। কি এমন রাজ কার্য উদ্ধার করতে ব্যস্ত হয়ে আছেন উনি যে একটাবার বাড়ির বাহিরে এসে আমার খোঁজ নেওয়ার সময় টুকু পাচ্ছেন না।”
হুমায়রা ওর কথা বলার মাঝেই কারোর ফোন বেজে উঠার শব্দ শুনতে পায়। পরক্ষণে গাড়ির ড্রাইভিং সিটের পাশে থাকা বক্সের উপর রাখা তাহিরের ফোনের দিকে চোখ পড়তেই দেখে ফোনস্ক্রিণের উপর তাহিরের মা রেবেকা তালুকদারের হাস্যোজ্জ্বল ছবি ভেসে উঠেছে। হুমায়রা তাহিরের ফোনটি হাতে নিয়ে কলটি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রেবেকা তালুকদারের চিন্তিত কন্ঠস্বর ভেসে আসে…..
—“তাহির…বাবা…কোথায় তুই? হঠাৎ করে কাওকে কিছু না বলে কোথায় চলে গেলি তুই? আর হ্যা…যেখানেই যাস না কেনো ভুলেও যেনো ঐ সিকদারদের বাসায় যাওয়া হয় না তোর। ঐ সিকদার পরিবার তোকে মি*থ্যে খু*নে*র দায়ে ফাঁ*সি*য়ে পাঁচ পাঁচটি বছর ধরে জেল খা*টি*য়েছে। তাই ওদের কারোর ছায়াও এবার তোর উপর পড়তে দিস না বাবা। ওদের থেকে দূরে থাক তুই। এটা তোর জন্মদাত্রী মায়ের অনুরোধ।”
রেবেকার মুখে এরূপ কথাগুলো শুনে হুমায়রার মাথার উপর যেনো বিনামেঘের ব*জ্র*পাত হয়। তাহির গত ৫ বছর যাবৎ মি*থ্যে খু*নে*র দায়ে জে*লে ছিলো এই কথা হুমায়রা আজ জানতে পারলো। এতোগুলো বছর ধরে সে তার খালা-খালু এমনকি নিজের বাবা-মায়ের থেকে এটাই জেনে এসেছিলো যে তাহির উচ্চতর ডিগ্রী লাভের জন্য আমেরিকাতে ছিলো। হুমায়রা গাড়ির কাঁচ নামিয়ে বাসার গেইটের পাশে থাকা বোর্ডের উপর বড় বড় অক্ষরে সিকদার ভিলা লেখা দেখে সাময়িক সময়ের জন্য থমকে যায়। ফোনের ওপাশ থেকে রেবেকা তাহিরের কোনো রেসপন্স না পেয়ে আবারও বললেন….
—“কি রে বাবা…কথা বলছিস না যে? তবে কি তুই সিকদারদের বাসায় চলে গিয়েছিস? তাহির….!”
রেবেকার কথা শোনামাত্র হুমায়রার হুস ফিরে। নিজেকে কোনোভাবে সামলে নিয়ে হুমায়রা বলে উঠে….
—“খালা…আমি হুমায়রা! তাহির আমার সাথেই আছে। আমরা একটা চায়ের স্টলের সামনে বসে আছি। তাহির আমার জন্য চা আনতে চায়ের স্টলের ভিতরে গিয়েছে। আর চিন্তা করবেন না আমি তাহিরকে সিকদার ভিলার ধারের কাছেও যেতে দিবো না।”
তাহিরের ফোনে এই মূহূর্তে হুমায়রার কন্ঠস্বর শোনার মতো এসপেক্টেশন রেবেকা তালুকদার রাখেন নি। এতোগুলো বছর ধরে চেপে রাখা তি*ক্ত সত্যটি আজ হুমায়রার সামনে খোলাশা হলোই। হুমায়রা রেবেকার নিস্তব্ধতা দেখে তার অবস্থা বুঝতে পেরে বললো…..
—“এই বিষয় নিয়ে কোনো প্রকার এক্সপ্লেইন এখন আপনাকে করতে হবে না খালা। বাসায় ফেরার পর এই বিষয় নিয়ে কথা হবে আপনাদের সাথে। এখন রাখছি।”
এই বলে হুমায়রা কল কেটে দেয়। রেবেকা কান থেকে ফোনটা নামিয়ে বিছানার উপর রেখে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ দিয়ে ‘চ’ শব্দ উচ্চারণ করলেন। হুমায়রা তড়িৎগতিতে গাড়ি থেকে নেমে গাড়িটি ভালোভাবে লক করে সিকদার ভিলার মেইন গেইট পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। এই মুহূর্তে হুমায়রার হৃদস্পন্দের গতি স্বাভাবিক এর তুলনায় অনেক দ্রুততার সাথে বিট করছে। কিছুটা পথ অতিক্রম করার পর সিকদার ভিলার মূল দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই হুমায়রা দেখতে পায় ওর থেকে কয়েকহাত দূরে একজন মধ্যবয়সের মহিলা স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছেন আর তার সামনে হাঁটু ভাজ করে মাথা নিচু অবস্থাতে তাহির বসে আছে। মূল দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সিকদার ভিলার কাজের মেয়ে মিতু হুমায়রাকে দেখা মাত্র কিছু বলতে নিলে হুমায়রা ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলে। মিতুও আর কিছু বলে না। পরক্ষণেই তাহির ওভাবে থেকেই চিৎকার করে কেঁদে উঠে বললো…..
—“হে আল্লাহ…..কি দো*ষ ছিলো আমার যার জন্য আমায় এতো বড় শা*স্তি দিলেন আপনি! নিঃস্বার্থ ভাবে কাওকে ভালোবাসার ফল বুঝি এতো ক*রু*ণ ভাবে পোহাতে হয়! আমাকে আজ এতো বেশি অসহায় কেনো বানিয়ে দিলেন আপনি! যাকে আমি আমার সবটুকু উজার করে ভালোবেসে ছিলাম। যাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য পৃথিবীর সবরকম বাঁধার সাথে ল*ড়া*ই করেছিলাম আজ সে কিনা অন্যকারোর জীবনসঙ্গিনী রূপে নিজের জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড সাচ্ছন্দ্যের সাথে পার করছে! বিনাদো*ষে বিগত পাঁচ পাঁচটি বছর ধরে জে*ল খাটতে হয়েছে আমায়। তবুও প্রতিটি দিনের শেষে আমার মনের ভিতর একটা আশার আলোই জ্বল জ্বল করতো যে, আমার ভালোবাসার মানুষটি আমার জন্য অপেক্ষা করছে। এই ন*র*ক য*ন্ত্র*ণা থেকে মুক্তি পাওয়া মাত্র আমি আমার ভালোবাসার মানুষটিকে পুরোপুরি ভাবে নিজের করে নিয়ে বাকিটা জীবন সুখে-শান্তিতে কাটিয়ে দিবো।”
হুমায়রার দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় নোনাজল ঝরে পড়ছে। তাহিরের বলা প্রতিটি শব্দ যেনো হুমায়রার বুকের ভিতর বি*ষা*ক্ত তীর হয়ে বিঁ*ধ*ছে আর অসহ্য য*ন্ত্র*ণায় ওর ভিতরটা ছাঁ*ড়*খার করে দিচ্ছে। নিজের ভালোবাসার মানুষটির মুখে তার ভালোবাসা হারিয়ে ফেলার কারণে আফসোসের বুলি শোনা ও অসহায়ের মতো তাঁকে কান্না করতে দেখার পর মনের ভিতর কাজ করা জ*ঘ*ন্য রকম য*ন্ত্র*ণা দায়ক অনুভূতি হয়তো পৃথিবীতে আর ২য় কিছুর জন্য হয় না। একটা মানুষ কাওকে কতোটা ভালোবাসলে তাকে হারানোর বেদনায় এমন অসহায়ের মতো কান্না করতে পারে তা হুমায়রা তাহিরকে দেখে বুঝতে পারছে।
তাহিরের এমন কান্নায় তমালিকা সিকদারের মনের ভিতর জমে থাকা সব রা*গ যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কিন্তু একজন মা হওয়ায় নিজের সন্তানের ভালোর কথা চিন্তা করার মতো ক্ষমতা তার ভিতর থেকে লোপ পায় না। তমালিকা সিকদার এহেনু পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে স্বা*র্থ*পর মায়ের মতো তাহিরকে উদ্দেশ্য করে বললেন….
—“সৃষ্টিকর্তা সকল পুরুষ ও নারীর জন্য একজন সঠিক জীবনসঙ্গী বা জীবনসঙ্গিনীকে সৃষ্টি করে রেখেছেন অনেক পূর্বেই। কিন্তু এখন যে বড্ড দেড়ি হয়ে গিয়েছে তাহির। বাস্তবতা ও সত্যটা যতো তি*ক্ত বা কঠিনই হোক না কেনো আমাদের তা মেনে নেওয়া উচিত। তরুনিমা এখন অন্য কারোর জীবনসঙ্গিনী। তাই ওকে আবার নিজের করে পাওয়া তোমার জন্য অসম্ভব। এই বাস্তব সত্যটাকে মেনে নিয়ে আমার মেয়েটাকে তুমি ভুলে যাও বাবা। ওর নতুন জীবনে তোমার ছায়া আর পড়তে দিও না। প্রকৃত ভালোবাসা যেমন মানুষকে স্বার্থপর হতে শিখায় তেমন পরিস্থিতির বিপাকে পড়লে প্রকৃত ভালোবাসা মানুষকে ত্য*গ করতেও শিখায়। আমার মেয়ে তরুনিমার প্রতি তোমার ভালোবাসা যদি সত্যিই প্রকৃত ও নিঃস্বার্থ হয়ে থাকে তাহলে তুমি আমার মেয়ের সুখময় জীবনটাকে ন*ষ্ট করে দিও না। এটা তোমার নিকট একজন মায়ের আকুল অনুরোধ রইলো।”
তমালিকার বলা প্রতিটি কথা তাহিরের বুকের ভিতরে তৈরি হওয়া ক্ষ*ত স্থানের উপর শান্তনার পাতলা প্রলেপ এর মতো ছড়িয়ে যায়। তাহির দু’হাতে নিজের চোখের পানি মুছে মাথা তুলে তমালিকা সিকদারের দিকে অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আকুল কন্ঠে বললো….
—“শেষ বারের মতো একটাবার তরুনিমাকে দেখার সুযোগ আমায় দিবেন প্লিজ! আমি কথা দিচ্ছি ওর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করবো না কিংবা আমার তরফ থেকে ওর কোনোরূপ ক্ষ*তিও আমি হতে দিবো না। আমার জন্য ওর বর্তমান জীবনে কোনোরূপ সমস্যারও সৃষ্টি হবে না। শুধু দূর থেকে ওকে একপলক দেখবো। নিজের নতুন জীবনে ও কতোটা সুখে আছে এতোটুকু দেখবো। তারপর ওর সামনেই ওর সুখের জন্য আমি আমার ভালোবাসার অনুভূতিগুলোর কু*র*বা*নি দিয়ে সারাজীবনের জন্য ওর থেকে অনেকদূরে চলে যাবো। যেখানে চলে গেলে আর কখনও ওর জীবনে আমার ছায়া পড়বে না সেখানে চলে যাবো।”
তাহিরের আকুল কন্ঠে করা আবেদনটি ফেলার মতো স্বা*র্থ*পর মানসিকতা তমালিকা সিকদার নিজের মধ্যে করে উঠতে পারলেন না। তাই চৌধুরী মেনশনের ঠিকানা তিনি তাহিরকে দিয়ে দিলেন। তাহির বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পিছন ঘুরতেই দরজার সামনে হুমায়রাকে স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখতে পায়। হুমায়রা কিছু না বলে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। তাহিরও সিকদার ভিলার মূল দরজা পেরিয়ে বাহিরে চলে যায়।
সিকদার ভিলার সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা তাহিরের গাড়ির কাছে এসে পিছনের দরজাটি খুলে সেখানে বসে পরে হুমায়রা। পরক্ষণেই তাহির গাড়ির কাছে এসে ড্রাইভিং সিটের দরজাটি খুলে পিছনের সিটে হুমায়রাকে মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখেও মুখে কিছু না বলে নিজ সিটে বসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে। পুরো রাস্তা গাড়ির ভিতর পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে। তাহির বা হুমায়রা কেও কারোর সাথে একটা টু শব্দ ও করে না।
#চলবে ইনশাআল্লাহ…….
{বি-দ্রঃ আজ রাত ৮টায় (বোনাস পর্ব-২) দিবো ভাবছিলাম🫰🖤। পড়বেন কি আপনারা? নাকি আগামীকাল দিবো পরবর্তী পর্ব?}